যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৬
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________
আহনাফের বুকের সাথে মিশে আছে অর্ষা। ভয়ে, ঠাণ্ডায় সে থরথর করে তখনও কাঁপছিল। আহনাফ তাকে এক হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। অন্য হাতে ধরে রেখেছে অর্ষার ভেজা হাত। হাসিব ড্রাইভ করছিল। সে একবার পেছনে তাকিয়ে আহনাফের উদ্দেশ্যে বলল,
“কোথায় যাব এখন?”
“মুনের বাসায়।”
হাসিব মুনের বাসার সামনে গিয়ে গাড়ি থামাল। আহনাফ এবং অর্ষাকে ভেজা অবস্থায় দেখে মুন বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চেয়েও বেশি আ’ত’ঙ্কিত হয় সে অর্ষার শাড়ির বেহাল অবস্থা দেখে। ভীতি স্বরে জিজ্ঞেস করে,
“এসব কী!”
“বলছি। আগে ওকে চেঞ্জ করাও।” বলল আহনাফ।
মুন অর্ষাকে নিয়ে বেডরুমে চলে গেল।
“তুই ওয়াশরুমে যা। আমি জামা বের করছি।”
অর্ষা ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার পর মুন ওর জন্য থ্রি-পিস আর আহনাফের জন্য শার্ট, প্যান্ট বের করল। আগে অর্ষাকে জামা-কাপড় দিয়ে সে ড্রয়িংরুমে যায়। আহনাফকে শার্ট-প্যান্ট দিয়ে বলল,
“দুলাভাই, আপনিও কাপড় চেঞ্জ করে নিন। আদিবের বডি ফিটনেস তো আপনার মতোই। ওর কাপড় আপনার গায়ে হয়ে যাবে। এগুলো একদম নতুন। আদিব একদিনও পরেনি।”
আহনাফ স্মিত হেসে কাপড়গুলো নিল। মুন বলল,
“ঐতো ওয়াশরুম। পালটে আসুন। আমি চা নিয়ে আসি।”
অর্ষা ফ্রেশ হয়ে দু’পা ভাঁজ করে মুনের বিছানায় বসে আছে। কিছুতেই সে ঘটনাটি ভুলতে পারছে না। মুন এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“কী ভাবছিস? বাইরে আয়।”
অর্ষা কথা বলল না। নিরব সম্মতিতে সে মুনের সাথে ড্রয়িংরুমে যায়। আহনাফ পথিমধ্যেই অর্ষার থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাটি শুনে নিয়েছে। এসব শুনে তার ভেতর যে কী বয়ে যাচ্ছে সেটা সে বাইরে প্রকাশ করল না। নিজেকে সে ভীষণ শান্ত এবং স্বাভাবিক দেখাল। অর্ষার গা ঘেঁষে বসে একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,
“কিচ্ছু হয়নি অর্ষা। একটা এ’ক্সি’ডে’ন্ট ধরে নাও। আর স্বাভাবিক হও প্লিজ!”
অর্ষা নিরুত্তর। মুন বলল,
“কিন্তু ভাইয়া কী হয়েছে?”
আহনাফ সংক্ষেপে ঘটনাটির বিবৃতি দিল। রাগে উত্তেজিত হয়ে ওঠে মুন। সামনে কে বসে আছে, কী ভাববে এসব না ভেবেই সে রাগের বশীভূত হয়ে বিশ্রী ভাষায় তোফায়েলকে গালাগাল দেওয়া শুরু করে। সর্বশেষ সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
“ঐ বে’য়া’দবটাকে হাতের কাছে পেলে সত্যি সত্যিই আমি খু-ন করে ফেলব। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার।”
তোফায়েলের উদ্দেশ্যে আরেকটা বিশ্রী গা-লি দিয়ে মুন স্থির হলো। হাসিব ভাবছে, মুনেরই এই অবস্থা তাহলে না জানি আহনাফের ভেতর কী চলছে! সত্যি বলতে, গাড়িতে বসে অর্ষা যখন কাঁদতে কাঁদতে পুরো ঘটনাটা বলেছিল তখন তার নিজেরই রাগে নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছিল। তার এটাও মনে হচ্ছিল, তোফায়েলকে পেলে হয়তো সে নিজেই শেষ করে দিত।
অর্ষা শূন্য দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। আহনাফ তার হাতে স্লাইড করতে করতে ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে,
“একটা কথা বলি, রাখবে? আজকে যা যা হয়েছে এসব কথা বাড়িতে জানিও না। তোমার বাবার শরীরের কথা তো জানোই। এই কথা জানতে পারলে তিনি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন। আর মা জানলে তো তার রাতের ঘুমেরই হারাম হয়ে যাবে। মায়ের মন কেমন হয় তা তো জানোই বলো? সকাল ছোটো মানুষ। এই কথা জানলে এর প্রভাব ওর মনের ওপর পড়বে। বাইরে বের হতে ভয় পাবে। আর বাকি রইল ভাইয়ার কথা। ভাইয়ার রাগ সম্পর্কে আমার থেকে তুমি দশগুণ ভালো জানো। সে এসব জানলে রাগে কী না কী করে ফেলবে তখন হিতে বিপরীত কিছু হয়ে যেতে পারে। সবার জন্য হলেও তোমায় এই ঘটনার কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ভালো থাকতে হবে। এবং স্বাভাবিক থাকতে হবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ তুমি?”
অর্ষা আহনাফের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। আহনাফ অর্ষার মাথা নিজের কাঁধের ওপর রাখল। চোখের পানি মুছে দিয়ে গাল স্পর্শ করে বলল,
“প্লিজ জান! তুমি যদি এইভাবে কাঁদতে থাকো তাহলে আমি কী করে থাকব বলো তো? আমার প্রজাপতি না ভীষণ স্ট্রং? সে কি এত সহজে ভেঙে পড়ে নাকি? অনুরোধ করছি, কেঁদো না। এরকম ঘটনা দ্বিতীয়বার কেন আর কখনও-ই ঘটতে দেবো না প্রমিস।”
মুনও অর্ষার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
“হ্যাঁ, দোস্ত। দুলাভাই কিন্তু ঠিকই বলেছে। বাড়িতে এসব কথা বলার প্রয়োজন নেই। আর তুইও এভাবে ভেঙে পড়িস না প্লিজ! আমরা তো এই অর্ষাকে দেখে অভ্যস্ত নই। আমরা হাসি-খুশি, রাগী, অভিমানি অর্ষাকে দেখতে চাই। সেই আগের অর্ষাকে।
.
সেদিনের পর অর্ষা পুরোদমে আগের আমিতে হাজার চেষ্টা করেও ফিরে যেতে পারেনি। সবসময় বিষণ্ণতায় ভুগত। ভীষণ স্ট্রং মাইন্ডের হলেও সে কিছুতেই কুৎসিত ঘটনা হাজার প্রচেষ্টায়ও ভুলতে পারেনি। এই ভীতি তাকে সবার থেকে কেমন যেন দূরে সরিয়ে রেখেছে। সেলিনা বেগম প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন,
“তোর কী হয়েছে রে, মা?”
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে বলত,
“কিছু না, মা।”
“তাহলে এত বিষণ্ন হয়ে থাকিস কেন?”
অর্ষা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জোরপূর্বক হেসে বলত,
“তোমাদের ছেড়ে চলে যাব তো তাই ভেবে কষ্ট হচ্ছে।”
“ধুর পাগলী মেয়ে! এজন্য মন খারাপ করতে হয় নাকি? একদম মন খারাপ করবি না।”
অর্ষা প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসত। আজ তার গায়ে হলুদ। গতকাল রাতেই রেশমি, লামিয়া, জুঁই আর মুন চলে এসেছে। আশিক আর দিদার আহনাফদের বাসায় গেছে। আহিলের জন্য ওদেরকে হতে হয়েছে বরপক্ষ। পার্লার থেকে চারজন মেয়ে এসেছে ওদেরকে সাজানোর জন্য। প্রথমদিকে ওদের পার্লারে যাওয়ার কথা থাকলেও আহনাফ এই সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। নিজে বেস্ট পার্লার খুঁজে চারজন মেয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছে। বান্ধবীদের আগমনে অর্ষা আগের থেকে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে পেরেছে।
_____
আহনাফ অন্ধকার বাগানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পরণে গায়ে হলুদের পাঞ্জাবি। কিছুক্ষণ বাদেই তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। সে হাত-ঘড়িতে সময় দেখে নিল একবার। সাথে রয়েছে আশিক, দিদার, আহিল, আদিব, হাসিবসহ আরও কয়েকজন ছেলেপেলে। আহনাফ বাদে বাকি সবার মুখ ঢাকা। আহিল রাগের সহিত চাপাস্বরে বলে,
“হা’রা’মির বাচ্চাটা কখন আসবে ভাইয়া?”
আহনাফ খুবই শান্তভঙ্গিতে বলল,
“লোক পাঠিয়েছি। চলে আসবে।”
“শিওর আসবে তো?” জিজ্ঞেস করল আশিক।
“আসতে বাধ্য! বিদেশি মা’ল খাওয়ার টোপ না গিলে যাবে কোথায়?”
আহনাফের ফোন বেজে উঠল তখন। সবাই সতর্ক হয়ে যায়। ঘন জঙ্গলের মাঝখানের রাস্তায় ট্রাক ব্যতীত তেমন কোনো গাড়ির চলাচল নেই। এজন্যই আহনাফ এই জায়গাটি বেছে নিয়েছে। প্রত্যেকের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তোফায়েল সেখানে এলো। তার হাতে সিগারেট। অন্ধকারে মুখ স্পষ্ট নয়। সে সিগারেট ফুঁকে বলল,
“মা’ল কই?”
রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে আহনাফের। সে কাল বিলম্ব না করে তোফায়েলের নাক বরাবর ঘু’ষি দিল। এমনকিছু হবে বা হতে পারে তোফায়েল সেটা আন্দাজও করেনি। তাই অপ্রস্তুতভাবেই সে নিচে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে কুৎসিত একটা গালি দেয় সে আহনাফকে। আহনাফ ঝুঁকে বসে একের পর কি’ল, ঘু’ষি, থা’প্প’ড় দিতেই থাকে। আহিলের হাত থেকে লাঠি নিয়ে এলোপাথাড়ি পে’টা’তে থাকে। অবস্থা এমন যে মা’রে’র ধরণ দেখে বাকিরা হতভম্ব। ওদের যেন সুযোগই নেই। আহনাফ উদভ্রান্তের মতো পি’টি’য়ে যাচ্ছে। কতটা রাগ যে সে ভেতরে পুষে রেখেছিল সবাই এখন হারে হারে টের যাচ্ছে! বাকিরা আর মারবে কি, ওরা এখন আহনাফকে থামানোর চেষ্টা করছে। আদিব পেছন থেকে আহনাফকে শক্ত করে ধরে বলে,
“ভাই আর মাইরেন না! ম’রে যাবে।”
সবাইকে উপেক্ষা করেও আহনাফ আরও কিছুক্ষণ লাঠি দিয়ে পে’টা’ল তোফায়েলকে। গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি সে প্রয়োগ করেছে। হাতের লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে হাঁটু মুড়ে বসে সে। তোফায়েলের শার্টের কলার ধরে বলে,
“আর কখনও অর্ষার দিকে চোখ তুলে তাকানোরও চেষ্টা করিস না। খুব তো করিস ভালোবাসার বড়াই। ভালোবাসা কাকে বলে সেটা জানিস তুই? ভেবেছিলি কী? তোর পাওয়ার আছে বলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবি? খবরদার! এমন ভাবনা আর ভুলেও মনে রাখিস না। আজ তো শুধু মা’র’ধো’র করেছি। এরপরের কিন্তু তাহলে জানে মে’রে ফেলব।”
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। পরীক্ষা শেষ হবে ২৩ তারিখ। এর আগে আর গল্প পাবেন না।]