মন কেমনের জন্মদিন
(ছোটগল্প)
স্বামী স্ত্রী দীর্ঘসময় একসাথে থাকলে একসময় নাকি ঘরের ব্যবহার্য জিনিসের মতো সম্পর্ক হয়ে যায়। ফেলে দিতে মায়া লাগে আবার পাশে রাখতেও কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগে টাইপ। চাল, ডাল, আলু, পটলের হিসেবে নাকি তখন কথা আটকে যায় বেশীর ভাগ দিনে। নীলাশ্রী আর রাহাতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অবশ্য ততটা সাধারণ হয়ে যায়নি কারণ চাকুরীর খাতিরে দুজন দীর্ঘ সময় দুই শহরে বাস করতে হয়েছে বলে। গেলো বছর বিয়ের প্রায় সাত বছর পেরিয়ে তাদের এক শহরে থাকার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হলো। গত ছয় বছরে কিভাবে যেন নীলাশ্রীর জন্মদিন পড়েছে সবসময় সপ্তাহের মাঝামাঝি বা একদম শুরুর দিনে। তাই রাহাতের সাথে একসাথে একটা সুন্দর জন্মদিন কখনোই সেভাবে তার কাটানো হয়নি। বান্ধবীদের গল্প শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলা আর মনে মনে স্বপ্ন দেখা তারও একদিন আসবে এমন ভেবেই কেটেছে এতোগুলো বছর।
জন্মদিন নিয়ে নীলাশ্রীর একটা অদ্ভুত হুজুগ ছিল সেই বুঝতে শেখার বয়স থেকেই। তাকে সেদিন সবাই উইশ করবে, সুন্দর সব উপহার দেবে। কিন্তু বেছে বেছে সেই সময়ই তাদের পরিবারে কোন না কোন ঝামেলা থাকতো, নয়তো কারো পরীক্ষা থাকতো, নয়তো কেউ অসুস্থ থাকতো। আর তাই খুব দায়সারাভাবে মা হয়তো একটু পায়েস রাঁধতো তাও নীলাশ্রীর পীড়াপীড়িতেই। সে কারণেই বুঝি বড়বেলায় নিজের কাছের মানুষের কাছে প্রত্যাশাটুকু একটু বেশীই থাকতো। এ বছর যেহেতু একসাথে আছে সাথে সেদিন ছুটির দিন পড়েছে নীলাশ্রীর মনে হলো এবারের জন্মদিনে নিশ্চিত একটা দারুন দিন কাটবে।
রাতের বারোটা থেকে অপেক্ষার শুরু তার। এই বুঝি রাহাত একটা কেক আর ফুল নিয়ে এলো। অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গেলো টেরও পায়নি নীলাশ্রী। রাত পেরিয়ে সকাল হলেও রাহাত নির্বিকার। থাক নিজেই নিজেকেই ট্রিট দেবে ভেবে নিজের পছন্দের নাস্তা বানাতে রান্নাঘরে ঢোকে সে। টেবিলে ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর আলুভাজি দেখে রাহাত নীলাশ্রীকে না ডেকে নিমিষেই বসে খাওয়া শুরু করে।
– আজ কি বার?
শুক্রবার।
– আমাদের জন্য কি দিন?
ছুটির দিন।
– অন্য কিছু মাথায় আসেনি?
হুম এসেছে।
– কি?
তোমার নামটা পাল্টে নীলাশ্রী থেকে খাদ্যশ্রী করে দেয়া যায়। পরোটা ভাজি এতো মজা হয়েছে কি বলবো।
– আকিকা কি আজই দেবে? চলো তাহলে ছাগল কিনে আনি।
আইডিয়া খারাপ না। তোমার নাম পছন্দ হয়েছে?
এই লোকের সাথে আর জন্মদিন নিয়ে আলাপ করা বৃথা বলেই নীলাশ্রী উঠে চলে আসে টেবিল থেকে। জন্মদিনে পরবে বলে একটা সবুজ জামদানী কিনেছিল। রাহাতই কিনে দিয়েছিল গতমাসে। ওটাতে একটু হাত বুলিয়ে আবার তাকে তুলে রাখে। থাক সবার জন্য হয়তো সবদিন পালন করার না।
ছুটির দিনে ঘরের কাজের ব্যস্ততা থাকে অন্যদিনের চেয়েও বেশী। আর তাই সব ভুলে বুয়ার পেছন পেছন হাত চালানো, জমে থাকা কাপড় ধোয়া, সপ্তাহের বাকী দিনের রান্নাবান্না গুছিয়ে রাখা, মেয়েকে একটু বাড়তি সময় দেয়া এসব করেই টুক করে দিনটা কেটে যায় নীলাশ্রীর। বিকেল পেরোতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবে বলে বেরিয়ে যায় রাহাত। নীলাশ্রীর ফোনে অবশ্য সারাদিনই টুকটাক মেসেজ এসেছে পরিচিতজনের। শুধু প্রিয় মানুষটাই জানালোনা কোন শুভেচ্ছা বার্তা। উপহার দূর অস্ত। জন্মদিনের শুভেচ্ছা উত্তরে ধন্যবাদসূচক মেসেজ পাঠাতে পাঠাতেই ফোন আসে প্রিয় বান্ধবী তিথির।
– কি রে কেমন হলো জন্মদিন?
আর বুড়ো বয়সের জন্মদিন।
– কি দিলো ভাইয়া জন্মদিনে?
যথারীতি ভুলে তো গেছেই, উল্টো সকালে নাস্তা খেয়ে বলে আমার নাম নাকি পাল্টে আকিকা করে খাদ্যশ্রী করে দেয়া উচিত। কেমন লাগে বল?
– থাক মন খারাপ করিসনা। সবাই কি আর সবকিছু বোঝে? সন্ধ্যায় ফ্রি আছিস? চল কোথাও বসি একসাথে।
রাহাত তো গাড়ি নিয়ে বের হলো। আজ বাদ দে। আরেকদিন বসবো না হয়। আকাশেও মেঘ করেছে অনেক।
– তোর জন্য একটা গিফট কিনেছিলাম। জন্মদিনে না দিলে কিভাবে? তুই গিফট নিবি সাথে আমাকে ট্রিট দিবি। গাড়ি পাঠাবো?
না থাক। আমি উবার কল করে নেবো। কোথায় বসবি?
– বনানী বুমারসে আয়।
আর কাউকে বলিসনি তো?
– তুই বললে নীপা, সুপ্তি ওদের বলতে পারি।
না না থাক। তারপর ওরা সব শুনে হাসাহাসি করবে।
জন্মদিনের জন্য তুলে রাখা জামদানীটাই পরে নেয় নীলাশ্রী। মেয়েকে তৈরী করে বের হতে হতে বেজে যায় প্রায় আটটা। রাহাতকে টেক্সট করে দেয় সময় করতে পারলে ওদের যেন বুমারস থেকে তুলে নেয়।
রেস্টুরেন্টে ঢোকার মুখেই তিথি দাঁড়িয়ে ছিল। রেস্টুরেন্টের ভেতরে কেমন যেন অস্বাভাবিক নীরবতা।
ছুটির দিনে কেউ নেই রেস্টুরেন্টে। অদ্ভুত ব্যাপার না তিথি?
– কি জানি কেন? ভালোই তো হলো। আমরা হাহা হিহি করবো উচ্চস্বরে।
শোন রাহাত আসতে পারবে কিনা ঠিক নেই। তাড়াতাড়ি অর্ডারটা দে। খেয়ে বিদায় হই।
বেয়ারাকে ডাকতেই কাছে দাঁড়ানো জন জবাব দেয়, ম্যাডাম খাবারের অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে। আসছে শিগগির।
– তিথি তুই আগে অর্ডার করে দিয়েছিস খাবার?
না তো।
– তাহলে, অর্ডার কে দিয়েছে?
পাশ থেকে ভীষণ চেনা কন্ঠে কেউ বলে ওঠে, আজ আকিকা দিয়ে নাম পাল্টে ফেলার কথা হয়েছিল বোধহয়।
রাহাতের হাতে ধরে থাকা কেকের ওপর নজর চলে যায় নীলাশ্রীর। ওপরে লেখা আজ মেঘবালিকার জন্মদিন।
রেস্টুরেন্টের আলো আঁধারি থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রিয় মুখ সব। স্পিকারে তখন বাজছে নীলাশ্রীর প্রিয় গান।
কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন।
#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস