ফেইসবুকে দেখলাম আমার একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দিনা অস্ট্রেলিয়া থেকে আজ দেশে এসেছে। এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে হাসি হাসি মুখে ছবি দিয়েছে। পাশে তার বর, ছেলে ও ছোট ভাইও রয়েছে। আমিও খুশিতে গদগদ হলাম দেশের মাটিতে ওর হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি দেখে। কতোদিন পর দিনার সাথে দেখা হবে এই ভেবে উত্তেজনায় হাত পা কাঁপতে শুরু করে দিল। সেই যে উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর ও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো আর আমি একটা সাধারণ মানের অনার্স কলেজে ভর্তি হলাম। তারপর থেকে আর খুব একটা যোগাযোগ হয় নি। তারপর পড়াশোনা শেষ করে আমি একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি আর ও উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে চলে যায়। খুব ইচ্ছা ছিল দিনা বাইরে পড়তে যাওয়ার আগে ওর সাথে দেখা করার, সুন্দর সময় কাটানোর, কিন্তু হয় নি। মানে দিনা সময় করে উঠতে পারে নি। আর পারবেই বা কি করে। সে তো আমার মতো এতো সাধারণ জীবনের অধিকারী না! কতো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রী নিতে যাচ্ছে! তবে আমি সারাজীবন দিনার জন্য মন থেকে দোয়া করে এসেছি সে যেন জীবনে সফলতার চূড়ান্ত শেখরে পৌঁছায়। কারণ তার মতো এমন সংগ্রামী এবং আত্মপ্রত্যয়ী মেয়েকে আমি মন থেকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি।
এবার দিনার কথায় আসি। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমাদের একসাথে পথচলা। বলতে গেলে এক আত্মা হয়েই থাকতাম। স্কুলের স্যারেরা তো সবসময় বলতেন হরিহর আত্মা। ছোটবেলা থেকেই পিতৃহীন দিনা আর তার বিধবা মা থাকত দিনার ছোট চাচার আশ্রয়ে। তিনবেলা খেতে দিত, বিনিময়ে দিনার মা দিত তাঁর শরীরের সমস্ত শক্তি। চাচার পরিবারে জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সমস্তটাই করতে হতো তার মাকে। ছোটবেলা থেকেই অদম্য মেধাবী দিনা তার অধ্যবসায় আর ভালো রেজাল্ট দিয়ে শিক্ষকদের সুনজরে আসেন। তাই পড়াশোনার খরচ কিংবা স্কুলের বেতন, কোনকিছু নিয়েই দিনাকে দুঃশ্চিন্তা করতে হয় নি। আমরা যে স্কুলে পড়তাম, আমার বাবা ছিলেন সেই স্কুলের একজন বিএসসি শিক্ষক। কাজেই ম্যাথমেটিকস, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি কোন বিষয় নিয়েই আমাকে বা দিনাকে দুঃশ্চিন্তা করতে হতো না। বাবা খুব যত্ন করে আমাদের পড়াতেন। বরাবরই দিনা স্কুলে আমার থেকে অনেক ভালো ফলাফল করতো। তাই বাবাও আমার থেকেই দিনার পড়াশোনার ব্যাপারে বেশি সচেতন ছিলেন। আর আমার অসম্ভব মমতাময়ী মা তো কখনও আমাকে আর দিনাকে আলাদা চোখে দেখতেনই না। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার সুবাদে দিনা প্রায়ই আমাদের বাড়িতে রাতে থেকে যেতো। কত রাত আমরা দুটি আত্মা, দুটি প্রাণ না ঘুমিয়ে শুধু গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছি তার কোন ঠিকানা নেই। আমাদের বাড়ি এবং স্কুল বলতে গেলে একরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানে প্রকৃতি ও প্রাণী যেন একেকটা একেকটার পরিপূরক। আমাদের বিদ্যালয় থেকে দিনাই প্রথম ৬ টি বিষয়ে লেটার মার্কস নিয়ে প্রথম বিভাগে পাশ করে। ফলাফল প্রকাশের দিন সে কি জয়জয়াকার চারিদিকে দিনাকে ঘিরে। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। বাবা তাঁর সামান্য উপার্জন, অভাবের সংসারের কথা ভুলে গিয়ে পুরো গ্রামে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। আমার মা তাঁর সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে রান্না করে দিনা আর তার মাকে পেটভরে খাইয়েছিলেন। স্কুলের স্যারেরা গর্বিত চোখে কি এক স্বর্গীয় মায়ায় চারদিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন।চারিদিকে এতো এতো আনন্দ দেখে কোনরকম ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমিও এবার মোটামুটি ধরনের একটা ফলাফল করে এসএসসি পাশ করেছি। আমার আবেগ, অনুভূতির ঠান্ডা হাওয়াও যেন দিনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছিল। এরপর দুজনই একই কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম। এবারেও দিনা সেরাদের একজন হয়ে গেল। শুরু হলো ভর্তিযুদ্ধ। দিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করে দেশের বাইরে চলে যায় উচ্চ শিক্ষার জন্য।
উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর থেকেই দিনার সাথে আমার যোগাযোগ কমে যেতে থাকে, মানে দিনাই ঠিক সময় করে উঠতে পারতো না। বিভিন্ন ছুটিতে যখন ও বাড়িতে আসতো, আমি ছুটে যেতাম সেই পুরনো উত্তেজনা নিয়ে, পুরনো আবেগ নিয়ে। কিন্তু দিনার মধ্যে আমার জন্য সেই চিরচেনা আন্তরিকতা, উচ্ছাস আমি খুঁজে পেতাম না। তবুও যেতাম। দিনা গ্রামে এসেছে শুনলেই সম্মোহিতের মতো মরিয়া হয়ে ছুটে যেতাম। একদিন তো দিনা দেখা না করেই আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল ব্যস্ত আছে এই বলে। আমি সেদিনও কিছু মনে করি নি। কারণ ওর জগতটা তো আর আমার মতো ছোট্ট গন্ডিতে আবদ্ধ নয়। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের মেধাবী ছাত্রী দিনা দেশের সম্পদ, আমাদের গ্রামের গর্ব। তখন থেকেই দিনার সাথে আমার যোগাযোগ কমে আসতে আসতে একটা সময়ে এসে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এর মাঝখানে ওর মা মারা যান। আমিও কোনরকম পড়ালেখা শেষ করে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করি। পাশের গ্রামেই আমার বিয়ে হয়। লোকমুখে শুনতাম দিনা খুব ভালো রেজাল্ট করে দেশের বাইরে চলে গেছে। ওখানেই কোন এক বাংলাদেশী পরিবারের সাথে জানাশোনা হয় এবং সেই পরিবারেরই এক ছেলেকে বিয়ে করে অনেক সুখেও আছে। আমি ভীষণ খুশি হতাম এই ভেবে যে দিনা জন্ম থেকে যে সমস্ত না পাওয়া নিয়ে বড় হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা আজ তার সমস্তটাই সুদে আসলে উজাড় করে দিয়েছেন। আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসতো। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে আসতো।
অনেকবার ভেবেছি দিনার সাথে নতুন করে যোগাযোগ করবো। কিন্তু নানান শংকা ও সংকোচে পিছিয়ে আসতাম বারবার। শেষ পর্যন্ত একদিন সাহস করে ওকে ইনবক্স করলাম।
–দিনা, আমি সেতু। কেমন আছিস তুই?
দুইদিন পর দিনার রিপ্লাই এসেছিল, — কোন সেতু? আমি কি চিনি?
ভীষণ ধাক্কা খেয়েও নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলেছিলাম, তোর ছোটবেলার বন্ধু। চিনতে পারিস নি?
দিনা উত্তর দিয়েছিল,– আমি খুব ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো।
সেদিনের পর অবশ্য দিনা কোন যোগাযোগ করে নি আর আমিও সাহস পাই নি। আমিও সংসার, সন্তান, শিক্ষকতা, স্বামী এসব নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু মনের খুব একান্ত গোপন ঘর থেকে হঠাৎ হঠাৎ দিনার আবির্ভাব হতো। তখন এক দুঃসহ অস্থিরতায় আমি রক্তাক্ত হয়ে যেতাম। বন্ধুত্বহীন এক জোড়া রাক্ষুসে হাত আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরতো বারংবার। আমি অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একটা সময় নিস্তেজ হয়ে যেতাম। আমি জানি না আমার মতো এমনিভাবে কেউ কখনো বন্ধুত্বের কাঙাল হয়েছিল কি না। আসলে আমার জীবনে বন্ধু বলতে তো ঐ একজনকেই জেনেছি। দিনা যতটা না আমার বন্ধু, তার চেয়ে অনেকবেশি আমার ছায়া। তাই ছায়াহীন দুর্বিষহ জীবন আমার কাছে অন্ধকার মৃত্যুকূপের মতো মনে হতো।
শুনেছি দিনা গ্রামে এসেছে ওর স্বামী – সন্তান নিয়ে। এই কথা শোনার পর থেকে ভীষণ অস্থির হয়ে আছি। আমি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা আর গর্ভকালীন নানান শারীরিক জটিলতাও রয়েছে। তবুও আমার স্বামীকে রাজি করিয়ে দিনার সাথে দেখা করতে এসেছি। সঙে আমার সাত বছরের ছেলেও রয়েছে। অনেকক্ষন হলো বাইরের ঘরে বসে আছি, এখনো দিনা আসে নি। হয়তো প্রচন্ড ব্যস্ত। ওর ভাই ভাবি অবশ্য দেখা করে অনেক গল্পও করে গেছেন। ব্যস্ততা কমলে নিশ্চয়ই দিনা ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। সেই ছোট্টবেলার মতো গালে শক্ত করে কামড়ে দাঁতের দাগ বসিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে লুটিয়ে পড়বে!
আমি আর ধৈর্য ধারণ করতে না পেরে সরাসরি দিনার খোঁজে ভিতরে চলে এলাম। দিনার ঘরের দরজার সামনে পৌঁছাতেই শুনলাম দিনা রাগত স্বরে ওর ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। ওর ভাই বলছে, মেয়েটা অনেকক্ষণ হয় এসেছে, একটু দেখা কর।
দিনার উত্তর শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম,
— যার তার সাথে ফালতু সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই ভাইজান। আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার ঘুরতে যাবো আমি এখন সেই প্লান করছি। ওদের যেতে বলেন।
আমি ফিরে যাচ্ছি আমার স্বামীর হাত ধরে। আমার এভাবে আহত হওয়া যেনো তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। মুখে কিচ্ছু বলছে না, শুধু শক্ত করে আমার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোতে ধরে আছে মানুষটা। দিনা ছিল আমার জীবনের স্বচ্ছ ছায়াসঙ্গী। অবশ্য আজ বুঝতে পারলাম সেটা শুধুমাত্র আমার দিক থেকে। সেই স্বচ্ছ জলের মতো টলটলে ছায়াটার আজ সলীল সমাধি হলো। ভুল বললাম। মৃত্যু আসলে অনেক আগেই হয়েছিল। আজ শুধু তার শেষকৃত্যটুকু হলো। মিইয়ে যাওয়া জোছনার মতো আমার বন্ধুত্বও আজীবন দিনার কাছে ফিকে আর আলোহীন হয়েই ছিল। আমি বুঝিনি।
#আলোহীন বন্ধুত্ব
রুমানা নাসরীন।