বাবাকে নিয়ে স্ট্যাটাস বাংলা
বাবা রাতে খেতে বসেছিলেন। খাবার শেষ না হতেই হটাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল।
আমি ড্রইং রুমে টিভি দেখছিলাম।
বললাম, ‘বাবা একটু বসেন আমি চার্জ লাইট নিয়ে আসি।’
চার্জ লাইট নিয়ে দু’ মিনিট বাদে ফিরে এসে দেখি বাবার খাওয়া শেষ।
অবাক হয়ে বললাম, ‘অন্ধকারেই দেখি খাওয়া শেষ করে ফেলেছেন!’
বাবা বললেন, ‘কারেন্ট চলে গেছিল নাকি?
‘জ্বি’
‘কী যেন বাবা চোখে দেখি না। আজকাল আলো ও অন্ধকারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারিনা।’
আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। বাবা যে সত্যি সত্যি চোখে দেখেন না বুঝতে বাকী রইল না।
..
বাবা আর মা দু’জনেই অসুস্থ। মা কানে কম শুনেন। বাবা নাকি চোখে দেখতে পান না। এর আগেও তাদের দু’বার ডাক্তার দেখানো হয়েছে। আজ তৃতীয় বারের মতো এলেন। ঢাকায় আমার বাসায় উঠেছেন।
পর দিন অফিস ছুটি নিয়ে দু’জনকে স্পেশালিষ্ট ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। বাবার চোখের অবস্থা খুবই খারাপ। নার্ভ শুকিয়ে গেছে নাকি। দুজনকেই কয়েক দিন পরীক্ষা- নিরীক্ষার পর ঔষধ দেয়া হয়েছে।
..
গ্রাম থেকে আমার বাবা-মা আসলে আমার ন’বছরের একমাত্র মেয়ে তিতলি বাধ ভাঙা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কিন্ত আমার স্ত্রী সোমা খানিক বিরক্ত । উনারা আসার কারনেই যে বিরক্ত তা কিন্তু না। দাদা-দাদি আসলে মেয়েটার লেখাপড়া চাঙ্গে উঠে। যতদিন তারা থাকেন ততদিন কোন রকম লেখাপড়ার ধার দিয়ে যায় না।
লেখাপড়ার কথা বললে বলে, ‘দাদা-দাদু কত কষ্ট করে গ্রাম থেকে এসেছে, কী হয় কয়দিন লেখাপড়া না করলে?’
..
তিতলি ওর দাদু ভাইয়ের ন্যাওটা। সারাক্ষন দাদুর সাথে আঠার মত লেগে থাকে। দাদুর গল্প শুনে। কখনো ভুত-প্রেতের গল্প, কখনো দৈত্য দানবের গল্প,কখনো দাদু ভাইয়ের ছোট বেলাকার গল্প ।
ও যাতে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করে এজন্য বাবা দেখি মাঝেমাঝে বানিয়েও গল্প বলেন। সেদিন শুনলাম বাবা বলছেন, শুনো দাদু ভাই তোমার বাবা কিন্তু ছোটকালে খুব ভাল ছিল। একদম দুষ্টামি করতো না। সারাক্ষণ লেখাপড়া করতো। মাঝেমাঝে আমি রেগে বলতাম, আর পড়ালেখা লাগবে না, এবার খেলগে যা । কিন্তু তোমার বাবা যেত না। পড়তেই থাকত। দাদু ভাই তোমারে কিন্তু বাবার মত হতে হবে।
শুনে আমি থ। ছোটকালে আমি ছিলাম খুব বাউণ্ডুলে টাইপের। পড়ালেখায় একদম মনোযোগ ছিল না। এমন কোন দিন ছিল না বাবার চড়,থাপ্পড় খাইনি । অথচ বাবা অবলীলায় কী সব বলে যাচ্ছেন!
..
আমার মা একটু চুপচাপ স্বভাবের। ঢাকায় আসলে সোমাকে এটা ওটা কাজে সাহায্য করেন। সোমা উচ্চশিক্ষিত মেয়ে বলেই কীনা মা তাকে সমীহ করে নাকি ভয় পায় ঠিক বুঝা যায় না।
এক বিকেলে অফিস থেকে ফিরে দেখি মা মনমরা হয়ে বসে আছেন।
বললাম, ‘কী হয়েছে মা?’
মা ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘বাবারে একটা ভুল করে ফেলছি।’
‘কী ভুল ?’
‘গোসল করার সময় তোমার বউ নতুন একটা লাক্স সাবান দিল, হটাৎ সাবানটা হাত ফসকে ইয়েতে পড়ে গেছে ‘
আমি হেসে উঠলাম, ‘কমোডে পড়ে গেছে?’
মা মাথা নাড়ে।
‘এটা কোন ব্যাপার না মা।’
‘তোর বউ কী ভাববে?’
‘কিছুই ভাববে না। তুমিত আর ইচ্ছে করে ফেলনি। তা ছাড়া এটা তোমার ছেলের সংসার । বুক ফুলিয়ে চলতে শিখ।’
কিন্তু মা কেন জানি পারেনা।
ঘুরেফিরে প্রায় আমার মনে এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খায়– আমি যখন ছোট ছিলাম যতোটা সহজ, স্বাভাবিক ভাবে তাদের কাছে বড় হয়েছি, অথচ এখন কেন তারা আমার কাছে ততটা সহজ, স্বাভাবিক হতে পারেনা?
মাকে একদিন জিজ্ঞেস ও করলাম। মা মৃদু হেসে এড়িয়ে গেলেন।
আরেক দিন মা’কে শুধালাম, ‘আচ্ছা মা কীসের আশায় মানুষ এত কষ্ট করে ছেলেমেয়ে বড় করে?’
‘এই যে তুই আমাকে মা বলে ডাকলি।’
আমার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল। পরম মমতায় মাকে জড়িয়ে ধরলাম।
..
সন্ধ্যায় অফিস থেকে যখন বাসায় ফিরলাম আমার মেয়ে তিতলি ফিসফিস গলায় বলল, ‘বাবা আম্মু প্রচন্ড রেগে আছে।’
‘কেন?’
‘দাদু ভাই আমাদের নতুন ফ্লাটে পানের পিক ফেলেছে।’
আমি নীরবে অফিসের জামাকাপড় ছাড়লাম।
সোমা থমথমে চেহারায় গ্লাসে খাবার পানি দিয়ে গেল।
..
সে রাত্রে আমি একবার বাবার ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম বাবা অন্যদিনের চেয়ে আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাবার চেহারা দেখে কেন যেন মনে হল বাবা একটা গিল্টি ফিলিংস নিয়ে ঘুমিয়েছেন। আমি একবার আলতোভাবে বাবার কপালে চুমু খেলাম।
..
রাতে ঘুমাতে গিয়ে সোমা বলল, ‘কেমন হল কাজটা?’
‘কোন কাজ?’
‘নতুন ফ্লাটে বাবা পানের পিক ফেললেন।’
‘বাবা চোখে দেখেন না । বোধ হয় খেয়াল করতে পারেনি। বুয়াকে দিয়ে যতটুকু পারো পরিষ্কার করে নিয়ো। পরে দেখা যাবে।’
সোমা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়।
..
এমনিতেই তিতলির টনসিলের সমস্যা। তার উপর কয়েকদিন ঘনঘন আইসক্রিম খাওয়ায় হটাৎ টনসিল আর জ্বরে ওর একাকার অবস্থা।
এদিকে বাবাও বাড়ি যাবার জন্য দিন গুনছিল।
হটাৎ সেদিন বললাম, ‘বাবা অফিসের গাড়ি কাল ফ্রি আছে। আপনারা যদি বাড়ি যেতে চান যেতে পারেন।’
বাবা ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। ‘তোমার কি মাথা ঠিক আছে? দাদু ভাইটা জ্বরে পড়ে আছে। এই অবস্থায় ওকে ফেলে বাড়ি যাব?’
বুঝলাম নাতনীর প্রতি বাবার মায়া পড়ে গেছে। আর কথা বাড়ালাম না।
..
দু’দিন পরের এক রাত্রি । আমি আর সোমা রাতে খেতে বসেছিলাম।
খাওয়ার মাঝে সোমা একবার বলল, ‘একটা কথা বলবো?’
‘কী কথা?’
‘বাবা বোধহয় এখনি যেতে চাচ্ছে না। আরো কিছুদিন থাকতে চাচ্ছে।’
‘চাইতেই পারে, এতদিন পরে এসেছে। আপনজনদের সাথে থাকতে কার না ভাল লাগে?’
‘ কিন্তু একবার তিতলির কথা ভাববে না? গত এক সপ্তাহে একদিনও ওকে পড়াতে বসানো যায়নি।’
‘ যে কয়’টা দিন বাবা-মা আছে সে কয়েকটা দিনই তো। তারপর দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আর হয়েছে।’ সোমা খাওয়ার মাঝে উষ্মা চেঁপে বলল।
..
পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি মা আর বাবা গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বসে আছেন।
অবাক হয়ে বললাম, ‘কি ব্যাপার, এত সকালে?’
মা বললেন, ‘বাবারে অনেকদিন তো হল। এবার বাড়ি না গেলেই নয়।’
‘আশ্চর্য! বলা নাই কওয়া নাই হুট করে বললে কি আর যাওয়া যায়?’
বাবা বললেন, ‘তোমার অফিসের গাড়ি যদি দিয়ে আসতে পারে পারল আর না পারলে আমরা বাসেই চলে যাব।’
বাবাকে খুব জেদি মনে হল। অবশ্য ছোটকাল থেকেই দেখেছি বাবা খুব জেদি। একবার মুখে যা বলেন তাই করেন।
আমি একটু শঙ্কিত হলাম। বাবা কি আমাদের কোন কথায় কষ্ট পেয়েছেন নাকি কে জানে! শুনেছি বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়েরা খুব অভিমানী হয়।
বললাম, ‘অন্তত আর দু’একটা দিন থেকে যান বাবা।’
বাবা কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন।
মা তাকে থামিয়ে বললেন, ‘বাবারে আরো আগেই চলে যেতাম। কিন্তু তোমার বাবার এক কথা তোমার মেয়ে পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যাবে না। প্রতিবারই তোমার বাবা এখান থেকে বাড়ি গিয়ে কয়েক দিন মন খারাপ করে বসে থাকে। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না। ঘুমের মধ্যেও তিতলি তিতলি করে।’
মুহুর্তে ঘরের পরিবেশ ভারি হয়ে গেল। এতক্ষনে সোমাও এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।
সোমা বলল, ‘কী হয় মা আরো দু’একটা দিন থাকলে?’
মা বলল, ‘বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে মা।’
সোমা একটু চুপ থেকে বাবাকে বলল, ‘ কোন ভুল ত্রুটি হয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিয়েন বাবা।’
বাবা পাল্টা গলায় বললেন, ‘আমাদের সবারই উচিত একজন আরেকজনের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দেয়া।’
‘অবশ্যই বাবা ।’
..
বিল্লালকে ফোন দিয়েছিলাম গাড়ির জন্য। কিন্তু ও যে এত তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে চলে আসবে ভাবতে পারিনি।
এসেই হাকডাক। ‘স্যার চইল্লা আইছি, খালাম্মা খালুরে রেডি হইতে কন ‘
‘আচ্ছা বসো। ‘
..
ঘুম ভাঙতেই তিতলি দৌড়ে আসে।
‘তোমরা কি চলে যাচ্ছ দাদুভাই?’
‘হ্যা দাদু ভাই ‘
‘কিন্তু কেন?’
‘তুমিত এখন সুস্থ হয়ে গেছ দাদু ভাই।’
‘কে বলেছে সুস্থ হয়েছি ?
দাদুর হাতটা টেনে নিয়ে বলে ‘এই দেখ দেখ এখনো একটু জ্বর আছে..দেখ ‘
তিতলিকে জড়িয়ে বাবা আমাকে বললেন,
‘বাবারে তোমারে এখন আর এত টান লাগেনা, তোমার মেয়েটারে যত লাগে। দাদু ভাইটারে কেন এত মায়া লাগে বুঝিনা?’ বলতে বলতে বাবার গলা ধরে আসে।
মা’কেও দেখলাম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে।
জানলা দিয়ে আমি দূরের আকাশে তাকিয়ে থাকি। কী অদ্ভুত এক মায়ার বন্ধন এই পৃথিবী ! কে এই বন্ধন তৈরি করে? কেনই বা করে? আদর,স্নেহ,ভালবাসা,মায়ার এই বাঁধন আছে বলেই কী পৃথিবীটা এত সুন্দর!
# সাঁজের মায়া
মেহেরাব মাশুক