রিমি আমার মামাতো বোন। একটু চঞ্চল স্বভাবের, তবে জীবনের জটিলতা না বুঝা একদম সরলমনা একটা মেয়ে। ফার্স্ট টাইম মেডিকেল এডমিশান টেস্টের রাতে আমাকে ফোন দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিল, “ভাইয়া, বেশী করে দোয়া করো তো আমার জন্য। অনেক নার্ভাস লাগছে। কি যে হবে কাল! ভালো লাগছে না কিছু।”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে শেষ করেছিল রিমি।
প্রত্যেক বংশের মধ্যে দু-একটা ছেলে-মেয়ে থাকে যাদের লেখাপড়া কিংবা বিশেষ কিছু গুণের কারণে সবাই খুব আদর করে। আমাদের বংশে রিমিও তেমন। ছোটবেলা থেকেই সব ক্লাসে ফার্স্ট ছিল সে, ফাইভ এবং এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি, এস এস সি এবং এইচ এস সি তে গোল্ডেন এ প্লাস, সবই তার অর্জনে আছে।
আমি রিমিকে সাহস দিয়ে বললাম, “টেনশান করিস না তো, বাংলাদেশে একটা মেয়ে চান্স পেলেও তুই পাবি। তুই না পেলে কে চান্স পাবে শুনি?” আমার কথায় খুশিই হলো সে। বললো, “ঠিকাছে ভাইয়া রাখি, তাই যেন হয়। আমার মামা কি বলেছে জানো? আমি চান্স পেলে ওইদিনই আমাকে ল্যাপটপ কিনে দেবে এবং ভর্তির আগেই ফ্যামিলি ট্যুরে সবাইকে নিয়ে সেন্টমার্টিন আর কক্সবাজার ঘুরে আসবে।”
কথাগুলো বলেই ফোন রেখে দিলো রিমি। মনে হয় পড়তে বসেছে আবার।
অবশেষে পরীক্ষা হয়ে গেল, রেজাল্টও হলো। রিমির চান্স তো হলোই না, মার্কসও আশানুরূপ পেলো না। সবাই হতাশ হয়ে পড়লো। একেকজন একেকরকম কথা বলতে লাগলো। কেউ কেউ ওর আম্মুকে দোষারোপ করে বলছিল, মেয়েকে এত বিশ্বাস করলে হয় নাকি এই যুগে! ও যে সারাক্ষণ দরজা লাগিয়ে থাকতো রুমের মধ্যে, পড়তো নাকি মোবাইল নিয়ে সময় কাটাতো তা খেয়াল করেছো? কিছু কিছু (অ)শুভাকাঙ্ক্ষী তো একলাইন বেশীই বলা শুরু করলো। এদের বেশীরভাগই আশেপাশের আন্টিগণ। বললেন, রিমির মত এত ভালো স্টুডেন্ট চান্স পাবেনা এটা কিভাবে হয়? নিশ্চয়ই প্রেম-টেম করে বেড়াইছে। আহারে! সোনার টুকরা মেয়েটাও এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো! কন্ঠে সবার কৃত্রিম মমতার সুর।
রিমির যে মামা ওকে ল্যাপটপ দিতে চেয়েছিলো সেই মামা তো ফোন করে উল্টো ঝাড়ি দিয়েছে। রিমির আম্মুকে বলেছে ওর কাছ থেকে ফোন কেড়ে নিতে, বাইরে গেলে সাথে সাথে যেতে, সব সময় চোখে চোখে রাখতে। কিছুদিন আগেও প্রাণচঞ্চল মেয়েটা ছিল সবার মধ্যমণি, একটা ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট তাকে করে দিলো কত অসহায়! সবাই এখন তার সব কাজে ভুল ধরে বেড়ায়। তার কোন আনাড়ি কাজে যে মানুষগুলো মিষ্টি হেসে বলতো, আরে বাদ দাও তো, মেয়েটা পড়াশুনা নিয়ে এত ব্যস্ত, এসব পরে জানবে-শিখবে, ঠিক সেই মানুষগুলোই এখন উল্টো বলে, আগে তো ভালোই ছিলো রিমি, এখন সব কিছুতেই অমনোযোগী। এজন্যই তো চান্সটা পেলোনা। কেউ কেউ তো এটাও বলে ফেলে যে, মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও, আর কিছু হবে না ওর দ্বারা।
এভাবেই চলছিল বেচারির জীবন, একদিন ফোন করে বললো বাড়িতে নাকি অসহ্য লাগছে তার। এতকিছুর পরেও পরিবারের একজন মানুষ রিমির পাশে ছিল, ওর বাবা। কিন্তু তিনি বিদেশে থাকেন, তাই খুব কাছে কেউই ছিলনা মেয়েটার। সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষার জন্য মামাকে বললাম রিমিকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে। পরিবারের সবার সাথে যুদ্ধ করে রিমি ঢাকায় আসলো, বান্ধবীদের সাথে বাসা ভাড়া করে কোচিং করতে লাগলো। খাওয়ার সমস্যা, পানি সমস্যা, ওয়াশরুমের দুরবস্থা সবকিছুতে নাজেহাল হয়ে একদিন সে কান্নাকাটি করতে লাগলো আমার কাছে। কিছুদিন আগে যে মেয়েটা না চাইতেই সারাক্ষণ ওর মা ফল, জুস, দুধ ইত্যাদি জোর করে খাওয়াতো সেই মেয়েটাই আজ বুয়া না আসলে নিজে রান্না করে আলুভর্তা আর ডিমভাজি দিয়ে ভাত খায়। খুব দরকার ছাড়া কারো সাথে সে কথা বলেনা, কারো ফোন রিসিভ করেনা, বিষন্ন মনে বসে থাকে নইলে পড়াশুনা করে।
দেখতে দেখতে আবার ভর্তি পরীক্ষা চলে আসলো। সেকেন্ড টাইম ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের পর দেখা গেলো রিমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে এবং মেরিট লিস্টে প্রথম দিকে স্থান পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রিমিকে ফোন করে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই চিন্তিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেল রেজাল্ট হবে শুনে সে ঘুমের ওষুধ খেয়ে লম্বা ঘুম দিয়েছিল, ঘুম থেকে উঠে রেজাল্ট শোনার পর কিছু বলেনি, আবার ঘুমিয়েছে।
পরেরদিন সব লাগেজপত্র সহ রিমিকে বাড়িতে নিয়ে গেলাম, ওর আব্বুও দেশে এসেছেন। মেয়ের রেজাল্টে তিনি হাউমাউ করে কান্নাকাটি করেছিলেন আর সবাইকে বলছিলেন, তোমরা আমার মেয়েকে আমার থেকে বেশী জানো না। যারা ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো, ওর সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছো আজকে দেখো- মা আমার ডিএমসি তে পড়বে। রিমির আব্বু খুশিতে ছোটখাট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফেললেন। ঘনিষ্ঠ সকল আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করলেন খাওয়ানোর জন্য। রিমির মামা তো আনন্দে আত্মহারা। তিনি ঘোষণা দিলেন ওইদিনই রিমির ল্যাপটপসহ আরো অনেক গিফট নিয়ে হাজির হবেন ।
সকলেই মহাখুশি, রিমিকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। গত এক বছর যারা রিমির খোঁজও নেয়নি, তারাও এসে বলছে, আমি জানতাম তুই অনেক ভালো করবি। মেয়েটা চুপচাপ সব কিছু দেখছে আর বিস্মিত হচ্ছে। এরা কি তারাই যারা গত একটা বছর তাকে সীমাহীন কষ্টে রেখেছিল! দেখতে দেখতে সেই দাওয়াতের দিনটা চলে আসলো, রিমিদের বাড়ির ছাদ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, সবাই সেখানে ডিনার করবে, রিমির আব্বুর সাথে আত্মীয়-স্বজনেরা দেখা করবে। একটা ফ্যামিলি গেট টুগেদার হয়ে যাবে অনেক দিন পর।
আর সবার মত আমিও গেলাম। মোটামুটি সকলেই এসেছে। প্রত্যকেই রিমির জন্য সুন্দর সুন্দর গিফট এনেছে। সকলের মুখেই রিমির প্রশংসা, ঠিক এক বছর আগের মত, ছোটবেলা থেকে সবাই যে রিমিকে চেনে এখন সেই রিমিকে নিয়েই আলোচনা চলছে। মাঝখানে একটা বছর সবাই ভুলে গেছে, ভুলে গেছে রিমির সাথে করা নিজেদের ব্যবহারগুলো, অবিচার আর কটুকথাগুলো। কিন্তু রিমি কি এত সহজে ভুলতে পেরেছে? সে যে ভুলতে পারেনি তার প্রমাণও সে রেখে দিল বেশ ভালোভাবেই। সেদিন সন্ধ্যা থেকে সবাই যখন আনন্দ আর সকলের সাথে দেখা-সাক্ষাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই হঠাত কোথাও লুকিয়ে পড়েছে সে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই যখন রিমিকে খুঁজছে তখন তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওদিকে ছোট-খাটো একটা মঞ্চে বাচ্চারা যে যার মত গাইছে, নাচছে আর সামনে সবাই চেয়ারে বসে আছে। অনেক খোঁজাখুজির পর না পেয়ে ফোন করা হলো, রিমির আব্বু এসে আমাকে বললো যে সে নিরাপদেই আছে এবং আশেপাশে কোন বন্ধুর বাসায় গেছে, আজ কারো সাথে সে দেখা করবে না। আমার হাতে তিনি একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এতে কিছু একটা লিখে গেছে রিমি। তোমাকে বলেছে সবার সামনে রিমির পক্ষ থেকে পড়ে শুনাতে।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। অনেক কষ্টে সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। খাম থেকে এক পৃষ্ঠার একটা কাগজ বের হলো। শুরু করলাম পড়া, সুন্দর করে রিমি লিখেছে- “শুভ সন্ধ্যা, সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ এখানে উপস্থিত হবার জন্য। আমি রিমি বলছি, তোমাদের রিমি। যাকে নিয়ে তোমরা গর্ব করতে, যার গল্প করে তোমরা খুশি হতে। আমি সেই রিমি, যে গতবছর মেডিকেলে চান্স না পেয়ে তোমাদের মুখে চুনকালি পড়েছে, যে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তোমাদের দৃষ্টিতে। তোমাদের একটা কথাই বলতে চাই, গত এক বছর যে অবহেলার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, সেই এক বছর আমি আগের রিমিই ছিলাম। আগে যেমন সবাই আমাকে আদর করতে, মিষ্টি হেসে কথা বলতে, আমার প্রশংসা করতে , এই এক বছরও আমার সেরকম ব্যবহার পেতে ইচ্ছে করতো কিন্তু কে ছিল আমার পাশে? আব্বু আর ভাইয়া ছাড়া আমাকে কেউ তো একবার বলোনি যে এবার হয়নি তো কি হয়েছে! সামনে হবে। তাহলে আজ কেন প্রবঞ্চনার জন্য এসেছো? আমি জানি, এবারও যদি চান্স না পেতাম তাহলে তোমাদের কেউ এসব গিফট নিয়ে আসতে না, কেউ বলতে না যে চান্স পাস নি তো কি হয়েছে? প্রাইভেটে পড়েও তুই ভালো করতে পারবি। গত বছর যেমন হারিয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের কাছ থেকে, সেভাবেই হয়তো হারিয়ে যেতাম কালের আবর্তে।
ছোট বেলা থেকেই অবহেলায় বেড়ে উঠা এক জিনিস, আর সারাজীবন না চাইতেই সীমাহীন আদর আর ভালোবাসায় বেড়ে উঠে হঠাত সকলের অবহেলার পাত্রে পরিণত হওয়া যে কত কষ্টের সে কি তোমরা বোঝো? তোমরা এমন কেন? এই ছোট্ট জীবনে একাডেমিক সাফল্যই কি সব তোমাদের কাছে? ব্যক্তি ‘আমি’টাকে তোমরা কজন ভালোবেসেছিলে? তবে হ্যাঁ, আমি তোমাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কেননা এবার হয়তো চান্স পেতাম ঠিকই কিন্তু তোমাদের আচরণে পাওয়া কষ্টের সাথে জিদ করে একটু বেশীই পড়াশুনা করেছি যার ফলে ভালোও করতে পেরেছি একটু বেশীই। আর আব্বু এবং ভাইয়াসহ যারা সব সময় আমার পাশে ছিল তাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আমি জানি তোমরা কষ্ট পাচ্ছো আমার কথায় কিন্তু আজ আমার কিচ্ছু করার নেই। তোমরা অনেকেই অনেক দামী দামী গিফট এনেছো জানি, আজ আমার ওসবের কোন দরকার নেই।
শুধু হিমালয়ের চূড়ায় উঠে তালি পাওয়ার জন্য নয়, গভীর খাদে পড়ে গেলে টেনে তোলার জন্যও যে হাত এগিয়ে আসবে, এমন হাতই আমি চাই। সকল অবস্থায়ই যারা আমাকে ভালোবাসতে পারবে, আমার পাশে থাকতে পারবে শুধু তাদের গিফটই নেবো আমি, আমার আর কিছু লাগবে না। সবাইকে একটা কথা বলে শেষ করবো, মানুষকে ভালোবাসো, শুধু তার অর্জনকে নয়। ছোট-খাটো সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা যেই ভালোবাসা বাড়ায় কিংবা কমায় সে ভালোবাসা কখনো নিঃস্বার্থ হতে পারে না। সেই ভালোবাসা কখনো কাম্যও নয়। ভালো থেকো সবাই। — তোমাদের রিমি।।”
.
গল্পঃ রিমির চিঠি
লিখাঃ জাফর আহমদ
লিখার সময়কাল- ২০১৭