- জামাই বউ এর রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প।
- নিজের বিয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস
- বউ নিয়ে গল্প।
- বিয়ে নিয়ে কষ্টের স্ট্যাটাস
২.জামাই বউ এর রোমান্টিক ভালোবাসার গল্প
আমার স্ত্রী ইদানীং তার তিহাত্তর কেজি ওজন নিয়ে বেশ চিন্তায় পরে গেছে। বিয়ের সময়কার একটা ব্লাউজও গায়ে আঁটছে না,বোরকা পরলে চেপেচুপে শরীরে এঁটে থাকে, সালোয়ার-কামিজ পরলে পেট উঁচু হয়ে থাকে। তার এতসব পরিবর্তনে যদিও আমার কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। বরঞ্চ শরীরে ওজন গেইন করায় গায়ের রঙ আগের চেয়ে আরো টুকটুকে ফর্সা হয়েছে।হাসলে গালে গোলাপি আভা ওকে আরো প্রানবন্ত লাগে। ওর তুলতুলে পেটে হাত রেখে ঘুমানো আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।কিন্তু দুঃখজনক সত্যি হল,
-নারী জাতি পুরুষের মুখে সত্যি কথা কোনোদিন বিশ্বাস করে না।
একশটা সত্যি কথা বলার পর তাদের একটা মিথ্যা বলবেন অবললীয়ায় বিশ্বাস করে নিবে।আমার স্ত্রী নীলিও ব্যতিক্রম নয়। তার আজকাল ধারণা হয়েছে,
আমি তাকে আর ভালোবাসি না,পছন্দ করি না।
তার দিকে তাকানোর ইচ্ছা পর্যন্ত হয় না।
কাহিনীর শুরুটা বলা যাক,গত শুক্রবার আমার চাচাতো বোনের বিয়ের রিসিপশনের দাওয়াত ছিল। স্ত্রী,আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে হাজির হলাম। নীলি সেজেগুজে তার পছন্দের বেনারসি কাতান পরে রেডি হয়ে গেল। বিয়ে উপলক্ষ্যে সাড়ে আট হাজার টাকায় এই শাড়িটা কিনেছে। নীল ওর পছন্দের রঙ।
সবাই ওর শাড়ির খুব পছন্দ করল।কত দাম, কোথা থেকে কিনেছে প্রশ্নের জবাবে ও হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছিল। আমার ছোট খালার মেয়ে নীরা ফ্যাশন সচেতন। বলল,
-শাড়িটা খুব সুন্দর ভাবী কিন্তু মোটা মানুষদের হালকা রঙ পরলে স্লিম দেখায়।
অন্য একজন মন্তব্য করল,
-আরে কাতান পরলে এমনিতেই মোটা দেখায়। আর তোমার তো স্বাস্থ্য মাশা-আল্লাহ।
এই কথাগুলো নীলি সহজভাবেই নিচ্ছিল বাঁধ সাধল
বাড়িতে এসে।নীলি বলল,
-ইশ! আমার শাড়ির সাথে ঝুমকো কানের দুল পরলেই ভালো লাগত। এটা একদম খেত লেগেছে দেখতে।
-কোনটা?
-তুমি দেখো নাই আমি কোন কানের দুল পরেছি?
-খেয়াল করি নাই।
-আচ্ছা।
ততক্ষণে মিসেসের মুখ শক্ত হয়ে গেছে। ঘটনা যে এতদূর গড়াবে বুঝতে পারি নাই নয়ত তখনই কান মলে মাফ চেয়ে নিতাম।
রাতে ঘুমাতে গেছি ওর পেটে হাত রাখতেই বলল,
-সরো।গরম লাগছে।
হাত সরিয়ে নিলাম। সত্যি খুব গরম পরেছে। সারাদিন বিয়েবাড়িতে খুব খাটুনি গেছে ঘুমিয়েই পরেছিলাম।ঘুম ভাঙল রাত একটার দিকে। কানের কাছে মশা যেমন
প্যানপ্যান শব্দ করে তেমনি প্যানপ্যান শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম মশা আবার পাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। প্যানপ্যানানির ভলিউম আরো বাড়লে বুঝতে পারলাম মশা না আমার বউ। সে তার বিখ্যাত কান্না শুরু করেছে। একটা মানুষ কত বেশি সময় ধরে কান্না করতে পারে তার প্রতিযোগিতা হলে আমার বউ নীলি গিনেজ বুকে নাম উঠাতে পারত। যতক্ষণ না ওকে স্পর্শ করব ননস্টপ কান্না করে যেতে পারে।
ঘুমচোখে উঠে ওর হাত ধরলাম,
-কি হয়েছে?
কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না।তারমধ্যে যতটা বুঝতে পারলাম, মোটা হবার কারণে ওরদিকে আমি আর নজর দেই না। অবসর সময় আগে ওর সাথে গল্প করতাম এখন টিকটক মেয়েদের নাচাগানা দেখি৷ শুধু আমি সবাই ওকে মোটা বলে। স্কুলে ছেলের বন্ধুর মায়েরা বলে, মোটা ভাবী। বাজার করতে গেলে লোকে হাসাহাসি করে। ইত্যাদি। ইত্যাদি।
নীলিকে কেউ মোটা বললে আমার কষ্ট হয়। বিয়ের পর যখন সবাই বলত, বউ শ্যামলা তখনও কষ্ট হত। নীলি আমার ভালোবাসার মানুষ। এই মানুষটার কপালের ব্রণ,হাঁটুর পোঁড়া দাগ, তলপেটে সিজারিয়ানের দাগ নিয়ে আমি ভালোবেসে যাই। ভালোবাসার জন্যে একটা অবয়ম দরকার৷ সেই অবয়ব কালো না ফর্সা,বেটে না লম্বা তা দেখার প্রয়োজন হয় না। নীলি আমাকে ভুল বুঝছে। যতই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলি,ভালোবাসি তবু ওর কান্নার প্রকোপ বাড়ে। প্রায় দেড়ঘণ্টা ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না করবার পর সিদ্ধান্ত নিল ও ডায়েট শুরু করবে। এগারো বছরের বিবাহিত জীবনে আমি আমার নীলিকে খুব ভালো করে চিনি৷ একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সহজে পিছপা হয় না।বললাম,
-আচ্ছা।তোমার যা ভালো লাগে করো। এখন ঘুমাও। সকালে ছেলেদের পরীক্ষা।
সকাল না হতেই এবাড়িতে যুদ্ধ শুরু হয়।সেনাপতি নীলি পানির ঝাপ্টা, ফ্যানের সুইচ অফ করে দুই ছেলেকে অতিকষ্টে ঘুম থেকে উঠায়। রুটি বেলে,চা করে, সবজি-ডিম খাবার টেবিলে দুটোই থাকর আবার টিফিনক্যারিয়ারে স্বামী-সন্তানদের জন্যে খাবার গুছিয়ে দিয়ে চুল আঁচড়ে রেডি হয়। ছেলেদের নিয়ে স্কুলে যেতে হবে যে! বারোটা অবধি ছোটটার ক্লাস। বড়টার দুইটা। দুপুরে মাছ,ডাল, ভাজি কোনোদিন শাকের সাথে মাংস। জানি না দেড় ঘণ্টার মধ্যে নীলি এতসব রান্না করে আবার কিভাবে দুইটায় বড়টাকে স্কুল থেকে আনতে ছোটে। দুজনকে খাইয়ে,গোসল করিয়ে কোচিংএ পাঠিয়ে বিকালবেলা নীলির এক চিমটি অবসর। ওইসময়টুকু ও ঘুমায়। হাত-পা ছড়িয়ে স্কুলে পড়ুয়া মেয়েদের মত নাক ডেকে ঘুমায়। ছুটির দিনে আমরা বাপ-বেটা যখন চার্লি চ্যাপলিন দেখি।নীলির তখনও ঘুমানো চাই না। আমি বিরক্ত করি না।সন্তপর্ণে কপালের চুলগুলো সরিয়ে চুমু খেয়ে। আহা ক্লান্ত মেয়েটা!
ডায়েট শুরু করবার পর নীলি বিকালে আর ঘুমায় না। রোজ অফিস থেকে ফিরে দেখি ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে নীলি সন্ধ্যার নাস্তা তৈরি করছে। নিজের জন্যে গ্রীন টি বানাচ্ছে। দুপুরে সুপের বাটিতে এক বাটি ভাত খাচ্ছে। প্রথমে তো কিটো ডায়েটই শুরু করেছিল বহু কষ্টে নিবারণ করিয়েছি। এত পরিশ্রম করা একজন মানুষের দুপুরে ওইটুকু ভাত খেলে পেট ভরে! আমরা বাঙালি সবজির সাথে ভাত নয়, ভাতের সাথে সবজি খেতে অভ্যস্ত। বাচ্চাদের সন্ধ্যায় পিৎজা,বার্গার, সমুচার আবদার থাকে। অফিস থেকে ফেরার সময় একটু বেশিই কেনা হয়৷ ছেলেদের মত ছেলের মাও যে ফাস্টফুুড খেতে ভালোবাসে। এখন বাড়ি ফিরি খালি হাতে। হোক ও দুই ছেলের মা। আমার চেয়ে নয় বছরের ছোট নীলি এখনও কিশোরী মেয়েটিই যে রয়ে গেছে। বাচ্চারা খাবে, ওর খেতে ইচ্ছা করবে খাবে না।ভাবতে কষ্ট হয়।
রাতে বাচ্চাদের পড়াশোনা করিয়ে,খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়াতে ১১ টা বেজে যায়। বাচ্চারা ঘুমায় আমি আর নীলি খেতে বসি। আমার প্লেটে মাংস,ডাল, সবজি।নীলি ছোট একটা রুটি আর এক চামচ সবজি খায়। সবজি তো আর মুখেই রুচে না।চোখ বন্ধ করে গিলে খায়। ওর প্লেটের দিকে তাকালে মাংস-ভাতও আমার মুখে রুচে না
বিশ্বাস করুন,সেই মুহূর্তে সেইসব মানুষগুলোর প্রতি তীব্র ঘৃনা জন্মে যারা বাজারে,পথে-ঘাটে, নামকাওয়াস্তে আত্মীয়-স্বজন আমার স্ত্রীকে মোটা বলে,হাতি বলে। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ শুধুমাত্র হাভাতের মত খেলেই মোটা হয় না,হরমোনাল সমস্যা থাকলেই মোটা হয় না। কিছু মানুষ জন্মগতভাবে ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। তাদের হাওয়া খেলেও ওজন বাড়ে।নীলি বিয়ের সময়ও সুন্দর স্বাস্থ্য ছিল। দুটো বাচ্চা হয়েছে। ওজন বেড়েছে। সিজারের পর পেট বেড়েছে।সারাদিন গাধার মত খাটুনি করে দুটো ভাত বেশি খায় তাতে যদি ওজন বাড়ে তাতে কার কি এসে যায়!বাঙালি মেয়েরা স্বামী-সন্তানকে সর্বস্ব দান করে নিজের চুল আঁচড়ানোর সময়টুকু পায় না। ভালো-মন্দ খাবে তাও সমাজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে,
-তুমি মেয়ে মানুষ।বেশি খেও না। ওজন বেড়ে যাবে।
যা বলছিলাম, নীলি ডায়েট করছে পনের দিন চলছে। ওজন কমেছে কি না জানি না কিন্তু চোখের নীচে কালসিটে পরে গেছে। ওইটুকু খেয়ে প্রায় অভুক্ত পেটে ঘুমাতে যায়। ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাতে ভালো ঘুম আসে না। আবার সকাল না হতেই রেলগাড়ি তো ছুটছেই।
যতবার ওকে বোঝাতে চাই, ওজন কমানোর দরকার নাই। সুস্থ আছ আলহামদুলিল্লাহ, চেষ্টা করো আর যেন না বাড়ে ততবারই রেগে যায়।আমি নাকি ওর ভালো চাই না।
কালকে নীলির জন্মদিন। ওর পছন্দের রেড ভেলভেট কেক নিয়ে বাসায় ঢুকলাম।বারোটার পর হৈচৈ করে বাচ্চাদের কেক কাটব। বাড়ি ফিরে দেখি,বাসা নিস্তব্ধ। দুষ্ট দুটোর মুখ শুকনো। মা মাথা ঘুরে পরে মেঝেতে পরে গেছে। সোফার কোণা লেগে মাথা ফেটেছে এই এতখানি। নীলি শুয়ে আছে। দুই ছেলে অপরাধীর ভঙ্গিতে পাশে দাঁড়ানো।বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম,
-তোমরা যাও। আমি তোমাদের মায়ের পাশে আছি।
নীলি চোখ মেলল,
-কি জানি হল! চোখে অন্ধকার দেখলাম আর মাথা ঘুরে পরে গেলাম।
তোমার এই ডায়েট-ফায়েট রাখো। চেহারার কি অবস্থা হইছে আয়নায় দেখেছ?
-ওজন কত জানো?
-কত?
-তিহাত্তর কেজি পাঁচশ গ্রাম। আরো মোটা হয়ে গেছি।
পরম যত্নে নীলির মাথায় হাত রাখলাম,
-নীলি, এই পৃথিবীতে লক্ষকোটি সুন্দরী নারী কিন্তু তুমি একমাত্র নারী যে আমার একান্ত ব্যক্তিগত। আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে। ভালো থাকার জন্যে এই কি যথেষ্ট নয়?
নীলি চোখ বন্ধ করে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
-কাল থেকে আমার জন্যে রাত ১১ টা পর্যন্ত না খেয়ে বসে থাকবে না। আটটার মধ্যে পেট ভরে খেয়ে নিবে। কেমন? আর বাড়িতে ফাস্টফুড আনা হবে সপ্তাহে একদিন। তোমার আর ছেলেদের ফলমূল খাবার অভ্যাস করতে হবে।ঠিক আছে?
-ঠিক আছে।
নীলির ৩৫ তম জন্মদিন পালিত হচ্ছে।ঘরভর্তি আলো নেই। মোমবাতি জ্বালানো হয় নাই। ছেলেদেরও ঘুম থেকে তুলি নাই।নীলি বিছানায় বসে ওর পছন্দের রেড ভেলভেট কেক একটু একটু করে খাচ্ছে আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
ঠিক বারো বছর আগের মত সেই আমি এখনও ওর হাসির প্রেমে পরে যাই।
গল্পঃনীলির কথা বলছিলাম
হাবিবা সরকার হিলা
৩.নিজের বিয়ের ফেসবুক স্ট্যাটাস
বিয়ে নিয়ে আমার তিনটা সুখস্মৃতি আর ভাললাগার অনুভূতি আছে।
প্রথমটা ছিল, নিজের টাকায় বিয়ে করা। কৈশোর হতেই আমার ইচ্ছা ছিল নিজে সঞ্চয় করে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জমাব। আমি কখনোই অপব্যয়ী ছিলাম না। তাই ২১-২২ বছর বয়সে চাকুরি শুরু করার পর হতেই অল্প অল্প সঞ্চয় করা শুরু করি।
মেরিনে থার্ড অফিসার হয়ে ১টা দীর্ঘ কন্ট্রাক্ট করে আসায় বিয়ের জন্য আমার প্রয়োজনীয় বাজেট জমানো সহজ হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের সব গহনা, বেডরুম ফার্নিচার, কনের শপিং এবং অন্যান্য বাজার নিজের টাকা দিয়েই সব করেছি। তবে আব্বা আমাকে ওয়ালিমার কোন দায়িত্ব নিতে দেননি, নিজেই আয়োজন করেছেন।
সেবার নির্দিষ্ট কন্ট্রাক্ট বাড়িয়ে বাড়তি দুইমাস পরিশ্রম করেছিলাম যাতে বিয়ের পর অতিরিক্ত কিছু সপ্তাহ স্ত্রীর সাথে কাটানো যায়। আমাদের দেশে অনেককেই দেখি, বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর পারষ্পরিক বুঝাপড়া তৈরি হবার আগেই স্বামী বিদেশে পাড়ি জমান। মাত্র কয়েক সপ্তাহ বা এক-দুই মাসে হয়ত দুজনের পরিবারসহ সবার সাথে জানাশোনা হওয়া সম্ভব না। তাই বিয়ের পর প্রায় ৭-৮ মাস দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে পরের শিপে জয়েন করি।
বিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় সুখস্মৃতি হল, কোন যৌতুক ছাড়া বিয়ে করা। সেসময় যৌতুক ছাড়া বিয়ের সংখ্যা ছিল নগন্য। বিয়ের ১ মাস আগেই আমি বেডরুমের পর্দা, কার্পেট, মিউজিক প্লেয়ার, বেডশিট, বেডকাভার, বালিশ, ওয়ারড্রব, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্কিং টেবিল, পোশাকের আলমিরা, খাটসহ সবই বানিয়ে নইলে কিনে ফেলেছিলাম। আমার খালা-মামাদের কয়েকজনও উপহার দিয়েছেন আমার সংসারের প্রয়োজন অনুসারে।
এরপর বেডরুম সাজিয়ে আমার শ্বশুরপক্ষের কয়েকজনকে আমন্ত্রণ করে ঘুরিয়ে দেখিয়ে জানিয়েছি, উনারা যাতে এসব কোন আইটেম দেয়ার চিন্তাও না করে। উনারা খুবই খুশী হয়েছিলেন এবং নিঃসন্দেহে গর্বও অনুভব করেছেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ির জন্য।
আমার শ্বশুর মেয়েকে কিছু নগদ অর্থ দিতে চেয়েছিলেন। আমরা বলে দিয়েছিলাম, সেই টাকায় যেন মেয়েকে স্বর্ণের গহনা কিনে দেয়া হয় যা শুধুমাত্র মেয়ের তত্ত্বাবধানে থাকবে। সেই থেকে গহনা গুলোর জন্য এত বছর ধরে যাকাত দিয়ে যাচ্ছি।
যৌতুক না নেয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, সারাজীবন কখনোই বউয়ের খোঁটা খেতে হয় না। শ্বশুরবাড়িতেও অন্যরকম একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। তাই শ্বশুরবাড়িতে সবসময় মাথা উঁচু করেই যাওয়া যায়। তাছাড়া নিজের কেনা খাটে নিজে ঘুমানোর মজাও তো আলাদা, ঠিক না?
বিয়ে নিয়ে ৩য় ভাললাগার জায়গা ছিল, বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে দেনমোহর পরিশোধ করা। তখনো ইসলামিক জ্ঞানের মাত্রা কম ছিল, নইলে দেনমোহর আরো কমিয়ে আরো দ্রুত পরিশোধ করার জন্য চেষ্টা করতাম।
এত বছর পরেও অবাক হয়ে দেখি, আমাদের সমাজ আরো পিছিয়ে গেছে। অথচ আমাদের মন-মানসিকতা আরো অনেক উন্নত হবার কথা ছিল এবং বিয়ের অনুষ্ঠানও আমাদের ধর্ম, সমাজ আর আর্থিক মাপকাঠিতে সহনীয় হবার কথা ছিল।
বিয়েতে এসব কিছুই করেছিলাম, আমার জীবনসঙ্গিনীকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার জন্য। সে যাতে গর্ববোধ করে যে, স্বামীর পরিশ্রমলব্ধ টাকায় তার বিয়ে হয়েছে, কোন যৌতুক ছাড়াই সে শ্বশুরবাড়ি এসেছে এবং কোন ডিভোর্স ফাইল হওয়া ছাড়াই তার দেনমোহর পরিশোধ করা হয়েছে।
Atique Ua Khan
৪. বউ নিয়ে গল্প
“বউ তোমার জন্য কি আনবো বললে না তো।”
“আগে মেয়েটার জন্য একটা লাল ফ্রক কিনবেন। পাশের বাড়ির মিনিকে দেখছে তার বাবা নাকি লাল ফ্রক কিনে আনছে। সেই থেকে মেয়ে বায়না ধরছে তারও লাল ফ্রক লাগবে। আমি বলছি, বাবা আসার সময় সবচেয়ে সুন্দর লাল ফ্রকটা তোমার জন্য নিয়ে আসবে। তাই সবার আগেই মেয়ের জন্য একটা লাল ফ্রক কিনবেন আপনি।”
“আচ্ছা সে নাহয় কিনবো। কিন্তু তোমার কি লাগবে সেটাই তো বললে না।”
“আব্বার জন্য একটা সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি আনবেন। তার গত বছরের পাঞ্জাবিটা ইঁদুরে কেটে দিয়েছে জায়গায় জায়গায়। এই কথা তিনি আমারে বলতে নিষেধ করছে আপনারে। তিনি নাকি ওই ফুটো পাঞ্জাবি দিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে যাবেন। আমি যে আপনারে বলছি এই কথা তারে বলেন না। মনে করে একটা ভালো পাঞ্জাবি কিনবেন তার জন্য। আর মায়ের জন্যও একটা সুতির শাড়ি আনবেন। গরমের সময়ও যাতে পরতে পারে।”
“আচ্ছা সবই বুঝলাম বউ। কিন্তু তোমার কি লাগবে তাই তো এখনো বললে না।”
“আপনার বোন যে আপনার উপর গোস্বা করে আছে, সে খবর জানেন?”
“ওমা ক্যান? সে গোস্বা করছে ক্যান?”
“বিশটা রোযা চলে গেলো, এখনো তার কাছে ফোন করে শুনেন নাই তার কি লাগবে। তাই নিয়েই মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।”
মতিন নিঃশব্দে হাসে। বোনটা তার ভীষন ছেলেমানুষ। তার ছোট্ট মেয়েটার থেকেও যেনো বেশি ছেলেমানুষ। কারণে অকারণে রাগে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। মতিন বউকে বলে,” দাও ফোনটা তানিয়ার কাছে। দেখি কেমন গোস্বা করে আছে ভাইয়ের উপর।”
মতিনের বউ সাথী ফোনটা ননদ তানিয়ার কাছে নিয়ে দেয়।
“নাও তোমার ভাই কথা বলবে তোমার সাথে।”
তানিয়া একটু রাগ দেখিয়ে বলে,”আমার সাথে কি কথা? আমার কিছু লাগবে না তারে বলে দাও।”
সাথী মুচকি হাসে। মতিনের সাথে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে দেখছে তার ননদ তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। তানিয়া মনে করে বিয়ে করার পর তার ভাই পর হয়ে গেছে। বউকে বেশি ভালোবাসে। আর মেয়ে হওয়ার পর যেনো আরো বেশি দূরে চলে গেছে তার ভাই। এতোগুলো রোযা চলে গেলো তাও তার কি লাগবে না লাগবে একবারও তার ভাই শুনতে চায়নি তার কাছে।তাই সে রাগ করে বসে আছে।
সাথী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার স্বামী যে এখনো বেতন পায়নি এটা সে ভালো করেই জানে। বোনাস পাবে কিনা তারও ঠিক নেই। টাকা হাতে পেলে সে অবশ্যই বোনের কি লাগবে অনেক আগেই শুনে নিতো।
সাথী জোর করে মোবাইলটা তানিয়ার কানের কাছে নিয়ে দিয়ে বলে,”বেশ তো তোমার কথা বলতে হবে না। তোমার ভাই বলবে, তুমি শুধু শুনো।”
এই বলে সাথী ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যায়। বোন তার ভাইয়ের কাছে কি চাইবে এটা তার না শুনলেও হবে।
“হ্যা ভাইজান বলো কি বলবে।” গলা শক্ত করে বলে তানিয়া।
মতিন হাসে। অভিমানী বোনটার কণ্ঠটা বড্ড ভালো লাগে তার।
“কি রে তানি? এতো রাগ করে থাকলে হবে? ঈদ তো চলে আসলো। ভাইজানকে বলতে হবে না কি লাগবে না লাগবে?”
“আমার কি লাগবে তা শুনে আর কি করবে তুমি ভাইজান? তোমার বউ আর মেয়ের কি লাগবে তা নিয়েই তো তোমার দুশ্চিন্তার কমতি নেই। তোমার যে একটা বোন আছে তাতো বিয়ের পর ভুলেই গেছো তুমি। আমার কিছু লাগবে না। তুমি সাবধানে বাড়ি ফিরে আসো তাই চাই।”
মতিন একটু মন খারাপ করে। বিয়ের পর থেকেই তানিয়া কেনো জানি সাথীকে সহ্য করতে পারে না। এরপর তুলি হওয়ার পর থেকে আরো বেশি একরোখা আর জেদী হয়ে গেছে সে। এ নিয়ে মতিনও কিছু বলতে পারে না তানিয়াকে। একমাত্র আদরের বোন। দুইদিন পর অন্যের বউ হয়ে চলে যাবে। তখন কি আর ভাইয়ের কাছে এতো বায়না ধরবে?
মতিন জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে,” এতো গোস্বা করিস না বোন। কারো জন্যই কিছু কেনা হয়নি এখনো। আসার সময় সবারটাই একসাথে আনবো।”
এবার তানিয়া একটু হাসে। দাঁত দিয়ে নখ কামড়ে বলে,”গতবার ঈদে যে গোলাপী রঙের জামাটা দিয়েছিলে, ওটার কাপড়টা বেশি ভালো ছিলো না ভাইজান। এবার ভালো কাপড় দেখে একটা মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ আনবা আমার জন্য।”
মতিন তৃপ্তি পায়। তার বোন যে অভিমান ভুলে তাকে তার পছন্দের কথা জানিয়েছে। এটা ভেবে খুব শান্তি পায় সে।
“আর কিছু লাগবে না? শুধু সালোয়ার কামিজ?”
তানিয়া ঠোঁট উলটে বলে,”স্নো, পাওডার,লিপস্টিক তো সেই কবেই শেষ হয়ে গেছে। কিছুই তো বলতে পারিনা তোমাকে।”
মতিন একটু অবাক হয়ে বলে,”কবেই শেষ হয়ে গেছে এতোদিন কেনো বলিস নি?”
“আমার কি আর মোবাইল আছে ভাইজান? ভাবীর কাছে থাকে মোবাইল। কিভাবে বলি তোমাকে?”
“ভাবীকে বলবি যে ভাইজানের সাথে কথা বলবো। ভাইজানকে ফোন দাও।”
তানিয়া একটু দুঃখ পাওয়ার ভান করে বললো, “ভাবী সবসময় দিতে চায়না ভাইজান। আমি তোমার কাছে কিছু চাইতে গেলে মুখের সামনে দাঁড়ায় থাকে। কি চাই না চাই সব শুনতে চায় সে। এজন্যই তো ভাবীর কাছে মোবাইল চাইনা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোর ভাবীকে বলে দিবো আমি আজকেই। তুই যখন চাস তখন যেনো তোকে মোবাইল দেয় কথা বলতে।”
তানিয়া মুখ টিপে হাসে। ভাইজানের কাছে ভাবীর নামে মিথ্যা নালিশ করতে ভালোই লাগে। আরো একবার দুঃখ প্রকাশ করে বললো,”না রে ভাইজান, ভাবীকে কিছু বলতে হবে না। আমার জন্য তোমাদের সংসারে অশান্তি হোক তা আমি চাইনা। তুমি বরং আমাকে একটা আলাদা মোবাইল কিনে দিও।”
মতিন খুব ভালো করেই জানে তানিয়ার স্বভাব। আর তার বউকেও খুব ভালো করে চেনে সে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”বেশ পরের বার তোকে একটা মোবাইল কিনে দিবো আমি। আর এবার সালোয়ার কামিজ, স্নো, পাওডার,লিপস্টিক যা যা লাগে সব এনে দিবো।”
খুশিতে ডগমগ হয়ে ওঠে তানিয়া,”সত্যি বলছো ভাইজান?”
“হুম সত্যি বলছি। এবার মোবাইলটা তোর ভাবীর কাছে দে।”
তানিয়া ভেঙচি দেয় একটা। এমন বউ পাগল বর কোনোদিন দেখেনি সে। তার ভাইটাই কিনা শেষ পর্যন্ত এমন হলো। রাগে গজগজ করতে করতে মোবাইলটা তার ভাবীর কাছে দিয়ে আসে সে।
মোবাইল কানে নিয়ে মুচকি হাসে সাথী। মানুষটার সাথে কথা বলতে এতো ভালো লাগে তার। সারাদিন কথা বলতে ইচ্ছা করে। কতোদিন পর মানুষটা আসছে বাড়িতে। ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে সাথী।
আস্তে করে বললো,”কি বলবেন আবার?”
“বলতে তো কতো কিছুই ইচ্ছা করে বউ। কিন্তু ডিউটির জন্য মন খুলে কথাও বলতে পারিনা তোমার সাথে।”
খুব মন খারাপ করে সাথী মতিনের কথা শুনে। ইদানীং তার স্বামীর সাথে খুব কম কথা হয়। সারাদিন রোযা রেখে ডিউটি করার পর নিজের রুমে যেয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে মতিন। যদিও মতিন কথা বলতে চায় রাতে। কিন্তু তার ক্লান্তশ্রান্ত কণ্ঠ শুনে সাথীর আর মন সায় দেয় না তার সাথে কথা বলতে। ব্যস্ত আছি, মেয়েকে খাওয়াচ্ছি, আব্বা মা কে খেতে দিবো এসব বলে ফোন রেখে দেয় সে।
সাথী চুপ করে থাকে। কিছু বলে না।
মতিন আবার বলে,”বউ চুপ করে আছো কেনো তুমি? সবার সব দাবি তো শুনলাম। তোমার কি লাগবে আমারে বলবা না?”
সাথীর মনটা হু হু করে ওঠে। গায়ের রক্ত জল করে মানুষটা সারাদিন খাটাখাটনি করে। সেই কষ্টের টাকায় কেনা শাড়ি তার পরতে খুব খারাপ লাগে।
ফিসফিস করে সাথী বলে,”আমার কিচ্ছু লাগবে না তুলির আব্বু। আপনি শুধু তাড়াতাড়ি করে চলে আসেন। কতোদিন আপনারে দেখিনা। কবে আসবেন আপনি?”
মতিনও মন খারাপ করে। একটু উদাস হয়ে বলে,”আসবো বউ। খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবো দেখো। তোমার জন্য একটা খয়েরি রঙের টাঙ্গাইল শাড়ি আনবো। সাজগোজের জিনিসপত্র আনবো। তুমি সুন্দর করে সাজবা ঈদের দিন। আমি তোমারে মন ভরে দেখবো।”
ভীষণ লজ্জা পায় সাথী। মতিনের মতো একজনকে জীবনে পেয়ে নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে সে। শত অভাবের মধ্যেও ভালোবাসা সেই আগের মতোই আছে,একটুও ফিকে হয়নি।
“আপনি বাড়িতে এলেই আমার ঈদ শুরু হয়ে যাবে। আর কিছু লাগবে না।”
বলেই আবারও লজ্জায় লাল হয়ে যায় সাথী। মতিন যেনো মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকেই তার স্ত্রীর সেই হাসিমাখা মুখটা দেখতে পায়। হৃষ্টচিত্তে মতিনও হাসে বউয়ের সাথে।
প্রায় পঁচিশ রোযার দিকে মতিনের অফিস থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় এ বছর অর্ধেক বোনাস দেওয়া হবে তাদের। কোম্পানি নাকি অনেক বড় লসের মধ্যে পড়ে গেছে। তাই এই ঈদে সব কর্মচারীর বোনাস অর্ধেক কেটে নেওয়া হবে।
ঘৃণায় এক দলা থুথু ফেলে মতিন। সব লসের ভাগ শুধু এই গরীব মানুষগুলোর। যখন লাভ হয়, কই তখন তো এই মানুষগুলোর বোনাস দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়না। অথচ কোম্পানি চলে এই গরীবগুলোর পেটে পাড়া দিয়ে।এই দুর্মূল্যের বাজারে তারা যে ছেলেমেয়েদের কিছু কিনে দিয়ে শান্তি করে একটা ঈদ পালন করবে তা এরা হতে দিবে না। মতিনের ইচ্ছা করে মালিকপক্ষের সামনে যেয়ে তাদের ভালোমতো গালাগালি করতে। কিন্তু সে তা পারে না। তারা কোটিপতি, আর মতিন একটা কেরানি মাত্র। মতিনদের মতো মানুষদের ইচ্ছা থাকলেও তারা সবসময় সব কিছু করতে পারে না।
মতিন ঠিক করে রেখেছে বোনাস থেকে কিছুই সে নিজের জন্য রাখবে না। সবটা দিয়ে সবার জন্য কেনাকাটা করবে। আর ঈদের দিনের জন্য কিছু বাজারসদাই করবে। মেয়েটা পোলাও খেতে চায় মাংস দিয়ে। ঈদের দিন মেয়েটা যেনো মন ভরে পোলাও মাংস খেতে পারে তবেই তার শান্তি।
সামান্য কিছু টাকাই পেয়েছে মতিন। এই টাকা দিয়ে মন মতো সব হবে কিনা তাও সে জানেনা। তবুও ইফতারের পরে সে বেরিয়ে পড়ে মার্কেটের উদ্দেশ্য। মনে মনে ভাবে, আজকে সম্পুর্ন বোনাসটা পেলে কতো ভালো হতো। এতো ভয় ভয় নিয়ে মার্কেটে যেতে হতো না। মাত্র ছয়টা হাজার টাকার মধ্যে এতোকিছু কীভাবে হবে ভেবেই ঘেমে যায় মতিন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মার্কেটের দিকে পা বাড়ায় সে।
প্রথমেই মেয়ের একটা লাল ফ্রক কিনে নেয় সে। যদিও দাম বেশি বলছিলো দোকানদার। দরদাম করার পরও আটশোটা টাকা নিয়ে নিলো। অনেক গুলো টাকা শুধু মেয়ের ফ্রকেই চলে গেলো। সে যাক,তবুও পরিতৃপ্ত হয় মতিন। ফ্রকটা বড্ড সুন্দর হয়েছে। মেয়েটাকে পড়লে একদম পরীর মতো লাগবে।
এরপর মতিন তার বাবার জন্য একটা সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবি আর মায়ের জন্য একটা গোলাপি রঙা সুতি শাড়ি কিনে নেয়। বেশ সস্তাতেই দুটো জিনিস হয়ে যায়। শাড়ি পাঞ্জাবি মিলে বারোশ টাকা লাগে তার। এরপর তানিয়ার জন্য সালোয়ার কামিজ কেনার পালা। কোনোভাবেই পছন্দ করতে পারে না মতিন। হয় কাপড় পছন্দ হয়না আর হলেও দামের সাথে সংকুলান হয়না। অনেক খোঁজার পর অবশেষে একটু বেশি দাম দিয়ে একটা সুন্দর মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ কিনতে পারে সে। হাজার টাকা দাম নিলেও মনে মনে খুব খুশি মতিন। বোনটা এবার নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে জামা পেয়ে। আরো তিনশ টাকা দিয়ে কিছু কসমেটিকসের জিনিস কিনে নেয় সে বোনের জন্য। কয়দিন পর শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে তো আর চাইতে আসবে না।
সব কেনাকাটার পর এবার একটা ভালো শাড়ির দোকানে আসে সে। বউটাকে অনেকদিন কিছু কিনে দেওয়া হয়না। মাত্র কয়টা টাকার বেতনে বাড়িতে পাঠিয়ে শহরে নিজের চলতেই নাভিশ্বাস উঠে যায় মতিনের। কিন্তু এবার সে ঠিক করেছে, সাথীকে এবার সে অনেক ভালো একটা শাড়ি কিনে দিবে। অনেক ভালো বলতে তার যেমন সাধ্য তার মধ্যেই।
শাড়ি বাছতে বাছতে একটা রানী গোলাপি রঙের শাড়িতে চোখ আটকে গেলো মতিনের। শাড়িটা যেনো সাথীর জন্যই বানানো হয়েছে। কাঁপা কাঁপা গলায় শাড়িটা নামাতে বলে দোকানদারকে। রানী গোলাপি জমিনের উপর সোনালী সুতোর কাজ। পাড় আর আঁচলটাও কি সুন্দর। এই শাড়ি পড়লে তো সাথীকে একদম রানীদের মতো লাগবে ভাবে মতিন। কিন্তু দাম শুনতে ভীষণ ভয় করছে তার। এমন সুন্দর শাড়ির তো অনেক দাম হবে। কিন্তু এমন শাড়ি দেখার পর তো অন্য কোনো শাড়ি পছন্দও হবে না। মতিন ঠিক করে ফেলে যে কোনো মুল্যে এই শাড়ি সে কিনবে। যতো টাকাই লাগুক।
ভয়ে ভয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে, “ভাই এই শাড়ির দাম কতো?”
দোকানদার বিরস মুখে উত্তর দেয়,”পনেরোশ টাকা।”
বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে মতিনের। এতো দাম দিয়ে শাড়ি নিলে তো বাজারের টাকা থাকবে না বেশি। আর বোনাস বাদে বেতনের টাকাটাও তো এতো খরচ করা যাবে না। সারামাস চলতে হবে
আস্তে আস্তে মতিন বলে,”ভাই একটু কমে হবে না?”
দোকানদার মনে হয় খুব বিরক্ত ক্রেতাদের উপর। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বলে,”একদরের দোকা দ্যাখেন নাই? দামাদামি চলে না এখানে।”
দমে যায় মতিন। খেয়ালই করেনি একদরের দোকানে এসেছে সে। অনেকবার ভাবে থাক, অন্য দোকানে দেখি। কমের মধ্যে পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সে এই শাড়িতে তার সাথীকে কল্পনা করে ফেলেছে। এখন ইচ্ছা করলেও অন্য শাড়ি তার পছন্দ হবে না। পরে অনেক ভেবেচিন্তে, যা হবে দেখা যাবে এসব ভেবে শাড়িটা কিনেই ফেললো মতিন।
মতিন মার্কেট থেকে যখন বের হলো তখন তার পকেটে রয়েছে নয়শো টাকা। তিনশো টাকা দিয়ে সে এর মধ্যে সে সাথীর জন্য একটা গলার আর কানের সেট কিনে নিয়েছে সে। কিন্তু মার্কেট থেকে বের হয়েই তার দুশ্চিন্তা হয়। এই নয়শো টাকা দিয়ে কিভাবে সে বাজারসদাই করবে এই দুর্মূল্যের বাজারে? নিজের জন্যও আর কিছু কেনার প্রয়োজন মনে করে না সে। তবুও নিজের মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা শান্তি হচ্ছে। সবার জন্য পছন্দমতো কেনাকাটা করতে পেরেছে। সবাই নিজেদের পোষাক পেয়ে কতো খুশি হবে সেই দৃশ্যের কথা ভেবেই মনে একটা প্রশান্তির স্রোত বয়ে গেলো মতিনের।
নিজের রুমে ফিরে সাথীকে ফোন করে মতিন। ফোন ধরে তার চার বছরের মেয়ে তুলি। ফোন ধরেই বলে,”তুমি কি তুলির বাবা ফোন দিয়েছো?”
মেয়ের কথা শুনেই হেসে দেয় মতিন। মেয়েটা এতো মায়া মায়া করে কথা বলে। শুনলেই কোলে নিয়ে আদর করতে মন চায়। মতিনও বাচ্চাদের মতো করে বলে,”জ্বি জ্বি। আমিই তুলির বাবা।”
“তুমি কি তুলির জন্য লাল ফ্রক কিনেছো বাবা?”
“কিনেছি গো কিনেছি। বাবা তুলির জন্য কিনবো না তো কার জন্য কিনবে?”
খুশিতে হাততালি দেয় তুলি। এরমধ্যে হাসিমুখে এসে ফোন ধরে সাথী।
“কি ব্যাপার? মেয়ে এতো খুশি কেনো?”
“শুধু মেয়ের খুশিই দেখলে বউ? মেয়ের বাবার খুশি দেখলে না?”
সাথী মিটিমিটি হাসে। বলে,” তা কি নিয়ে বাপ মেয়ের এতো খুশি? আমরাও একটু শুনি।”
“মেয়ের বাবা আজকে সবার জন্য কেনাকাটা করে এলো যে। তাই তো এতো আনন্দ তার মনে।”
এরপর কি কি কিনেছে আজকে সবকিছুর বিবরণ দিলো মতিন সাথীকে। শুধু সাথীর শাড়ির দামটা সে বললো না। বললেই এতো দাম দিয়ে কেনার জন্য চিল্লাপাল্লা শুরু করবে।
সাথী উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”আমার জন্য আবার কেনো কিনতে গেলেন বলেন তো। আমার তো নতুন শাড়ি তোলা আছেই।”
মতিন কিছু বলে না,চুপ করে থাকে। কেমন শাড়ি যে সাথীর তোলা আছে সে খুব ভালো করেই জানে।
সাথী বললো,” সবারটা তো শুনলাম। আপনার নিজের জন্য কি কিনলেন তাতো বললেন না।”
মতিন শুনে আমতা আমতা করে। এবার তো বউ রেগে যাবে। কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে থাকে সে।
সাথীর খুব কষ্ট লাগে। মানুষটা ঈদে নিজের জন্য কিছুই কিনবে না? যদিও সে নিজে তুলির আব্বুর জন্য একটা পাঞ্জাবি সেলাই করছে, এটা সে এখন তাকে বলবে না। ঈদের দিন গোসলের পর সে বের করে দিবে। ওই পাঞ্জাবি পড়েই তুলির আব্বু নামাজ পড়তে যাবে।
উনত্রিশ রোযায় রাতে ডিউটি শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্য লঞ্চে উঠে পড়ে মতিন। মনে তার খুশির বান ডেকেছে। প্রায় চারমাস পর বাড়ি যাচ্ছে সে। এতোদিন পর প্রিয় মানুষদের মুখ দেখতে পাবে। ভিতরে ভিতরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তার ক্ষণে ক্ষণে। তার কেনা উপহার দেখে তুলি কি করবে? আর তানিয়ার পছন্দ হবে তো? সাথীকে কেমন লাগবে শাড়িটায়। এসব মনে মনে ভাবছে সে। লঞ্চের প্রচন্ড ভিড়ে ডেকের একটা পাশে নিজের ব্যাগগুলো বুকে চেপে চুপচাপ বসে থাকে মতিন। মাঝে মাঝেই ঝিমিয়ে পড়ছে ঘুমে। রোযা রেখে সারাদিন ডিউটি করার পর শরীরটা ভীষণ দূর্বল লাগছে তার। কোনোভাবেই জেগে বসে থাকতে পারছে না। যতোই চেষ্টা করছে জেগে থাকতে, ততই যেনো আরো বেশি ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে। একটা পর্যায়ের আর থাকতে না পেরে ব্যাগটা কোলে রেখেই ব্যাগের উপর মাথা ঝুকিয়ে ঘুমিয়ে যায় সে।
হঠাৎ প্রচন্ড চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় মতিনের। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গায় শরীর কাঁপতে থাকে তার। কিছুক্ষণ বুঝে উঠতে পারে না সে কোথায় আছে। সে দেখতে পায় লঞ্চের সব মানুষ উন্মাদের মতো দৌড়াচ্ছে। কোনোরকমে নিজের ব্যাগটা তুলে উঠে দাঁড়ায় সে। বোঝার চেষ্টা করে কি হতে যাচ্ছে। কিন্তু যে যার জীবন বাঁচাতেই যেনো ব্যস্ত। কেউ কিছু বলছেও না কি হচ্ছে। হঠাৎ একজনের কাছে শুনতে পারে লঞ্চের ইঞ্জিনরুমে নাকি ভয়াবহ আগুন ধরেছে। দাউদাউ করে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে লঞ্চের চারদিকে। মতিনের যেনো পা স্থবির হয়ে গেছে। মাথা একদম ফাঁকা হয়ে গেছে তার। সবাই ছুটোছুটি করছে জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্য কিন্তু তার পা দুটো যেনো লেগে আছে। হঠাৎ কারো ধাক্কাতে সম্বিত ফিরে পায় সে।
কেউ চিৎকার করে বলছে,”ভাই বাঁচতে চাইলে পানিতে ঝাপ দেন। সাঁতার পারেন তো?”
গ্রামের ছেলে মতিন। সাঁতার তো পারেই। কিন্তু গতবছর একটা সিএনজি অ্যাক্সিডেন্টে তার মেরুদণ্ডের ভয়াবহ ভাবে ক্ষতি হয়।
কীভাবে সে এতো বড় নদীতে সাঁতার কাটবে? মেয়েটার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার। বয়স্ক বাবা মায়ের হাসিটা, ছোট বোনের অভিমানী মুখটা। আর ভেসে ওঠে সাথীর মায়াময় মুখটা। তবে কি আর দেখা হবে না? শেষ দেখাটাও আর পাবে না মতিন? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে মতিনের। ব্যাগটা বুকের সাথে চেপে এদিক ওদিকে ছূটতে থাকে সে-ও।
কোনোভাবে ব্যাগটা কাছ ছাড়া করতে চায়না সে। এদিকে আগুন ক্রমশ লঞ্চের উপরেও ছড়িয়ে পড়ছে। মতিন ঠিক করলো যা হয় হোক। সে লাফ দিবে নদীতে।
নিজের ব্যাগটা ভালো করে বুকের সাথে বেঁধে নিলো মতিন। শেষবারের মতো একবার লঞ্চের দিকে তাকালো সে। সবাই ভয়ার্ত ভাবে ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ ইতোমধ্যে পানিতে ঝাপ দিয়েছে। কোনো কিছু না ভেবে পাটাতনে উঠে দাঁড়ালো সে। লাফ দিতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে “ভাইজান” চিৎকার শুনে থমকে গেলো মতিন। ঠিক যেনো তানিয়ার গলা। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো আনাড়ি হাতে শাড়ি পড়া একটা মেয়ে কোলে একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে ভয়ার্ত মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মতিন একটু পিছিয়ে এলো। মেয়েটার কাছে গিয়ে বললো, “বলো বোন।”
মেয়েটা ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। কান্নার দমকে হেঁচকি উঠে গেলো মেয়েটার। মতিনের খুব মায়া হলো,মনে হচ্ছে যেনো তানিয়া কাঁদছে।
কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা বললো,”ভাইজান আমার স্বামী সাঁতার জানে কিন্তু আমি জানিনা। সে আমাকে আর আমার বাচ্চাটাকে ফেলেই পানিতে ঝাপ দিয়েছে। এতো করে বললাম আমাকে তোমার নিতে হবে না। আমার মাসুম বাচ্চাটিকে তুমি তোমার সাথে নিয়ে যাও। কিন্তু সে আমাদের এভাবে ফেলেই চলে গেলো। আপনি আমার ভাইয়ের মতো। আমার এই ছোট বাচ্চাটিকে আপনি আপনার সাথে নিয়ে যান। ওকে বাঁচান ভাইজান, ওকে বাঁচান।”
একটা মায়ের আহাজারিতে চোখে পানি চলে আসলো মতিনের। সে মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে বললো,”ভাই যখন ডেকেছো, তোমাকে রেখেই বা যাই কিভাবে? আল্লাহর নাম নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরো বোন। আর তোমার বাচ্চাটিকে আমার কোলে দাও। বাঁচলে ভাইবোন একসাথে বাঁঁচবো,মরলেও একসাথে মরবো।”
মেয়েটা যেনো মতিনের কথা বিশ্বাস করতে পারলো না। থরথর করে কাঁপতে থাকে সে।
মেয়েটাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিলো মতিন। এরপর মেয়েটাকে একহাতে ধরে লাফ দিলো পানিতে।
কাঁধে এক বোনের দায়িত্ব আর বুকে মতিনের ভালোবাসার চিহ্ন গুলো চেপে ধরে নিঃশ্বাস বন্ধ সাঁতরাতে থাকে মতিন। পিছনে পড়ে থাকে একটা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড।
৫.বিয়ে নিয়ে কষ্টের স্ট্যাটাস
#ছায়াসঙ্গী
দীপাকে বউ হিসেবে আমার কখনোই পছন্দ ছিল না শুধুমাত্র বাবার একগুয়েমির কারণে ওকে বিয়ে করতে বাধ্য হই। সংসারের বড় ছেলেদের বিশেষ করে যদি সেটা হয় মধ্যবিত্ত সংসার তাহলে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হয়। বাবা নাকি দীপার বাবাকে অনেক আগেই কথা দিয়ে ফেলেছিল। আমাদের বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন মাস কিন্তু ওকে আমার অসহ্য লাগে। চোখের সামনে ও যখন ঘুর ঘুর করে, কোন কারণ ছাড়াই ঠাস করে গালের মধ্যে একটা চড় দিতে ইচ্ছে করে। আমার মা, বোন খুব ভালো করেই বিষয়টা জানে।
মা প্রায়ই কেঁদে কেঁদে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, -পারলে তোর বাবাকে ক্ষমা করে দিস, তোর জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল রে, আসলেই আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে। বাবা রিটায়ার্মেন্টে যাওয়ার পরে পুরো পরিবারের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। আমার পরে আরো তিনটে ভাই বোন একটা বোনের বিয়ে দিয়েছি আর চৈতি মানে ছোট বোনটা পড়াশোনা করছে। ছোট ভাই নয়ন মাস্টার্স কমপ্লিট করে এখন চাকরির প্রত্যাশায়। মা আমাকে যতই বলুক বাবাকে ক্ষমা করে দিতে আমি কখনোই পারিনা এমনকি লোকটা মারা গেছে দিন পনেরো আগে, সত্যিকার অর্থে আমার কেন জানি দুঃখ লাগে নি। বাবা-মা আসলে কি ভাবে? ছেলে মেয়ে তাদের সম্পত্তি! যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যবহার করবে, তাদের মতামতের কোন মূল্য নেই ? আমি তো ভালবাসি আমার অফিস কলিগ তিন্নিকে, আমাদের প্রায় তিন বছরের সম্পর্ক।
যেদিন আমার বিয়ে হয়েছিল মেয়েটা প্রচন্ড কান্নাকাটি করেছিল। আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম যা কিছু হয়ে যাক না কেন আমি ওকে ছাড়া আর কাউকে আপন করে নেব না এবং সেই কথা আমি রেখেছি, দীপা নামমাত্র আমার বউ। আমার বেশিরভাগ সময় তো অফিসেই কাটে । সেটাই যেন আমার সুখের স্থান কিন্তু ঘরে এলেই আমার মেজাজ সপ্তম আকাশে চড়ে থাকে ইদানিং নাকি দীপার কর্তৃত্ব খুব বেড়েছে। এখন আর সে মায়ের কথাবার্তা তেমন একটা শুনছে না, নিজের ইচ্ছা মত রান্নাবান্না করছে, কেউ খেলে খাবে না খেলে নাই, ঘরের কাজকর্মেও নাকি তেমন একটা মন নেই।
আমার মা বোন চিরকালই শান্তশিষ্ট স্বভাবের। তারা কখনো এই বিষয় নিয়ে আমার কাছে কমপ্লেইন করতে আসে না কিন্তু চেহারা দেখলেই আমি বুঝতে পারি বাড়িতে কিছু একটা ঘটেছে, আমি নিজে থেকেই তাদেরকে জিজ্ঞেস করি। মা হাউমাউ করে কাঁদে একে তো স্বামি শোক তার ওপর নিজ হাতে গড়া সংসারের টা অন্য কারো দখলে চলে যাচ্ছে এটা কেউই মেনে নিতে পারে না। খুব প্রয়োজন না হলে সাধারণত আমি দীপার সাথে কথা বলি না কিন্তু আজ বলতে বাধ্য হলাম।
-তুমি কি পেয়েছো দীপা, তুমি কি ভাবছো যে আমি কিছুই জানিনা?
দীপা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো যেন সে ভীষণ অবাক হয়েছে
-একটা কথা মাথায় রাখবে তোমাকে আমি কখনোই আমার পরিবারের অংশ ভাবতে পারিনা ।বাবা তোমাকে পছন্দ করে এনেছিলেন, এখন কিন্তু বাবা নেই কাজেই বেশি বাড়াবাড়ি করো না তাহলে হিতে বিপরীত হবে।
-তুমি কি বলতে চাচ্ছ রাতুল?আমি যদি এই সংসারের অংশ না হয়ে থাকি তাহলে আমাকে রেখেছো কেন? বের করে দাও। কিছুটা ঝাঁঝের সুরে বললো দীপা।
সারাদিন কাজের মহিলার মত তোমার সংসারে শ্রম দিয়ে যাই সেটা কারো চোখে পড়ে না। অফিস থেকে ফিরে তো আরাম আয়েশ করে খেয়ে সোফায় পা তুলে টিভি দেখতে শুরু করো একবার ভেবে দেখেছো গোটা বাড়িটা কে সামলায়? দীপা প্রায় চিৎকার করে বললো।
আর সহ্য হলো না । আমি ছাদে চলে গেলাম মেয়েটার প্রচন্ড বার বেড়েছে এবার একটা কিছু করতেই হবে। আমার সাথে এই ভাবে কথা বলে, তার মানে আমার মা বোনের সাথে কি করে সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে
রাত একটার সময় ছাদ থেকে নিচে নেমে এলাম,মাথায় অনেক গুলো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে
-নামলে কেন? উপরেই থাকতে, দীপার কন্ঠ
-তোমার ওই অপয়া মুখটা দেখতে চাই না বলেই এত রাতে নেমেছি, ঘুমাওনি কেন এখনো?
-যার স্বামী অন্য একটা মেয়ের সাথে পরকীয়া করে, নিজের স্ত্রীকে কখনো স্ত্রীর মর্যাদা দেয় না তার চোখে কখনো ঘুম আসে না, প্রায় চিৎকার করে বললো ও । অনেক সহ্য করেছি আর করবো না।
এইবার আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। চুলের মুঠি ধরে কষে গালের মধ্যে একটা চড় দিলাম
-কাল সকালেই তোকে তোর বাপের বাড়িতে রেখে আসবো তারপর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিব আর হ্যাঁ তুই যে বলেছিস আমি পরকীয়া করি, হ্যাঁ করি আমি ওটাকে পরকীয়া বলি না, প্রেম বলি, ভালোবাসা বলি কারন তোর সাথে সম্পর্কের অনেক আগে থেকেই তিন্নির সাথে আমার সম্পর্ক। আমি ওকে ভালোবাসি, তোকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করবো আর নিজের জীবনটা সুন্দর করে সাজাবো।
এতগুলো কথা বলার পরেও দীপার ঝাঁজ কমলো না -আমাকে তোমার বাবার বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে না আল্লাহর রহমতে আমার হাত-পা সবই আছে আমি নিজেই চলে যাবো, রাত টুকু শুধু শেষ হোক আর ডিভোর্স লেটারটাও আমি নিজেই তোমাকে পাঠাবো, তৈরি থাকবে।
এত চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমার মা আর চৈতি দরজা ধাক্কাতে লাগলেন।
-রাতুল বাবা কি হয়েছে, দরজা খোল।
-কিছু না মা তোমরা যাও
-আরে ভাইয়া দরজা খোল, বাধ্য হয়ে দরজা খুললাম
-তোমাদের আর চিন্তা করতে হবে না ও কালই চলে যাবে
-আচ্ছা যাবে তুই আর চিৎকার করে মাথা গরম করিস না শরীর খারাপ করবে তো
– হ্যা, আপনার ছেলের তো শরীর খারাপ হবেই আমার আর শরীর না আমি তো যন্ত্র, সারা দিন পরে ছেলে আসলে কি কি বানিয়ে বলেন যে ছেলের মাথা গরম হয়ে থাকে আমার সাথে দুই দণ্ড ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে না। আপনারা এত খারাপ জানলে আমি কখনোই এই বিয়েতে রাজি হতাম না।
আমি আবার হাত তুলে দীপাকে মারতে গেলাম। মা আমার হাত চেপে ধরে কেঁদে উঠলেন, তারপর টানতে টানতে আমাকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে গেলেন।
-এসব ভালো না বাবা, ভদ্র ঘরের সন্তানরা কখনো বউয়ের গায়ে হাত তোলে না । ও অবুঝ মেয়ে, বুঝতে পারছে না
-তুমি তো আর অবুঝ না মা, তুমি নিজেই তো হাউমাউ করে কাঁদো। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে ওর সাথে আমার বনিবনা কখনোই ছিল না আর হবেও না
-জানি কিন্তু যাই করিস সুন্দরভাবে সুষ্ঠুভাবে কর,এসব ঝগড়াঝাঁটি ভালো না, দুইটা মানুষ যদি একসাথে সুখে থাকতে না পারে তাহলে আলাদা থাকাই ভালো।
-কত বড় সাহস আমার সামনে তোমাকে কথা বলে
-ভাইয়া এটা তো আর আজকের ব্যাপার না, ভাবি সবসময়ই এরকম করে। তোমাকে আমরা ঠিকঠাক মত বলি না তুমি কষ্ট পাবে ভেবে। তুমি সারাদিন এত পরিশ্রম করো, তোমার টাকাতেই আমাদের সংসার চলে তারপরও যদি তোমার বউয়ের নামে তোমার কাছে সব সময় নালিশ করতে থাকি তাহলে হয়তো তুমি বিরক্ত হবে তখন আমাদের কি হবে এসব ভেবে কখনো বলা হয়নি।
-তোরা না বললেও তোদের আচার-আচরণ দেখে আমি ঠিকই বুঝতাম। সে যাই হোক আগামী কাল থেকে ওকে আর চোখের সামনে দেখবি না।
সেই রাতটা আমি মায়ের ঘরে কাটিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হলো। অফিসে যাবার জন্য যখন তৈরি হচ্ছি তখন দেখি দীপা কোথাও নেই চৈতি নাস্তা বানাচ্ছে
-কিরে ওই অপয়াটা গেছে?
-কি যে বলো না ভাইয়া এভাবে বলতে হয় নাকি ?মুচকি হেসে চৈতি বললো
-গেছে নাকি আগে সেটা বল?
-প্রায় ঘন্টা খানেক আগেই চলে গেছে
-যাক আল্লাহ রহমত দান করেছে। আমি অফিস থেকে ফেরার আগেই উকিলের সাথে যোগাযোগ করবো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ওকে ডিভোর্স দিতে চাই
-আচ্ছা দিও ,এখন নাস্তা খেয়ে নাও।
আজ অফিসে গিয়ে তিন্নির সাথে খুব ভালো সময় কাটালাম কাজের চাপ কম ছিল। ওকে সবকিছু জানালাম তিন্নি তো খুশি ধরে রাখতে পারছে না
-তুমি সত্যি বলছো রাতুল আমরা এক হতে পারব!
-অবশ্যই বাবু শুধু কিছুদিনের ব্যাপার। ডিভোর্সটা কার্যকর হয়ে গেলেই আমি তোমাকে বিয়ে করে নেব
তিন্নি আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো, আমার ছোট ভাই নয়ন ফোন করেছে
-কিরে নয়ন কি হয়েছে?
-ভাইয়া তোকে একটা সুখবর দিই, আমার চাকরি হয়েছে।
খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসলো ওই অপয়াটা বিদায় হওয়ার সাথে সাথে আমার সংসারে খুশির ঢল নেমেছে।
সেদিন দুপুরেই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে গেলাম আমার পরিচিত এক উকিলের কাছে, ডিভোর্সের ব্যাপারে আলোচনা করতে। উনি কিছু কাগজপত্র সহ আমার সুবিধামতো দিনে দেখা করতে বললেন। নয়নের চাকরি পাওয়া উপলক্ষে মিষ্টি কিনে সিএনজি করে বাড়ি ফিরছিলাম। তারপর কি জানি কি হলো? চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার, আমি কি তবে এক্সিডেন্ট করেছি! আমার চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে আমি কি মারা যাচ্ছি?
যখন জ্ঞান ফিরলো তখন আমি হাসপাতালে । পরিবারের সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে। মায়ের দিকে তাকাতে পারছি না জানিনা কত সময় পার হয়েছে, তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে বুঝতে পারছি খুব কেঁদেছে। হঠাৎ চোখ গেল দীপার ওপরে, ও এখানে কি করছে? কিন্তু ডাক্তার নার্সদের সামনে সিনক্রিয়েট করলাম না। ও এখনো শরীয়ত মতে আমার স্ত্রী কাজেই এখানে আসার অধিকার আছে। যতটুকু জানতে পারলাম একটা মাইক্রোর সাথে আমার সিএনজির এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ড্রাইভার তৎক্ষণাৎ মারা গেছে আমি কপাল জোড়ে বেঁচে গেলেও স্পাইনাল কর্ডে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে যার কারণে হাঁটাচলা করা সম্ভব না, এক কথায় যাকে বলে প্যারালাইসিস। এর জন্য নাকি অপারেশন করতে হয়েছে একটা, পুরো সময়টাতেই আমি পুরোপুরি সজ্ঞানে ছিলাম না তাই কি হয়েছে না হয়েছে ঠিকঠাক মনে নেই। অপারেশনের দায়ভার বহন করেছে দীপার পরিবার কারণ নয়নের চাকরিটা একদমই নতুন, আমার কেমন যেন ইগোতে লাগলো বিষয়টা। এই প্রথম আমি কেঁদে উঠলাম, এর চেয়ে মরে গেলেই তো অনেক ভালো হতো। দিন কয়েক পরে আমাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়া হলো। তিন্নি এসেছিল এর মাঝে আমাকে দেখতে হাসপাতালে, দীপার সাথে এই প্রথম ওর মুখোমুখি দেখা হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম কোন একটা ঝড় বয়ে যাবে কিন্তু তেমন কিছুই ঘটলো না। তিন্নি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে সান্তনা দিলো তারপরে চলে গেল। দীপা একভাবে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখ ফুলে গেছে মনে হচ্ছে সেও কেঁদেছে।
শুরু হলো আমার বন্দি জীবন । যেহেতু আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করতাম চাকরিটা আর থাকলো না। এখন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব পড়েছে নয়নের কাঁধে, আমি বুঝতে পারি ওর কষ্ট কারণ এই দায়িত্ব বহুদিন ধরে আমি সামলে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম আর ওর তো সদ্য চাকরি হয়েছে। আমার জন্য আমার শ্বশুরমশাই একটা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করলেন । আমি তেমন কিছু বললাম না, দীপাকে আমি সহ্য করতে না পারলেও ওর বাবাকে আমি শ্রদ্ধা করি। মানুষটা বেশ ভালো, সরল মনের। আমার খাওয়া দাওয়া বাথরুম কাপড়-চোপড় চেঞ্জ করা সবকিছু এখন দীপাই সামলায়, ঠিক যেন ছায়াসঙ্গী। প্রতি সপ্তাহে ফিজিওথেরাপির জন্য হাসপাতালে দীপাই আমাকে নিয়ে যায় যদিও বাড়িতে ফিজিওথেরাপিস্ট এসে এটা করাতে পারেন কিন্তু সেই আর্থিক সঙ্গতি এখন আমার পরিবারের নেই।
এক রাতে ডাইনিং টেবিলে বসে নয়ন বললো
-ভাইয়া তোর কি কোন সেভিংস আছে?
হুইল চেয়ারে বসা আমি একটু চমকে উঠলাম কারণ সারা জীবন যা উপার্জন করেছি সবই এই সংসারের পেছনে ঢেলেছি
আস্তে করে মাথা নেড়ে বললাম,
– না
-ভাইয়া আমি তো আর পারছি না তোরা দুটো মানুষ এভাবে ঘাড়ের উপরে আসলে বুঝতেই পারছিস
-মাত্র এই কয়েকদিনে আমি তোর কাছে বোঝা হয়ে গেলাম! আর এই পুরো পরিবারটাকে টেনেছি আমি। তোর পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব বহন করেছি আমি, একইভাবে চৈতির টাও। আরেক বোনের বিয়ে দিয়েছি একা আমি। আমি তো তোদেরকে বোঝা মনে করিনি।
– এভাবে বলছিস কেন রাতুল? মা নয়নের পাতে মাছের বড় টুকরোটা দিতে দিতে বললেন, ওর নতুন চাকরি হয়েছে কুলিয়ে উঠতে পারছে না , তুই আর তোর বউ দুজন মানুষকে টানা তো আর চাট্টিখানি কথা না, তাছাড়া তোর ওষুধ পত্র আছে সবকিছু মিলিয়েই ও বলেছে
-মা তুমি এভাবে বলতে পারলে!
-ভাইয়া তুমি কিছু মনে করো না কিন্তু এটা তো সত্যি কথা, এভাবে তোমাদেরকে নয়ন ভাই কতদিন পালবে ? তোমাদেরকে টানতে গিয়ে এখন প্রায়ই আমাকে কলেজে হেঁটে যেতে হয়, হাত খরচের টাকাটাও ঠিকমতো পাইনা। আমি ভাইয়াকে কোন প্রকার দোষ দেই না ও একা কত দিক সামলাবে?
আমি হুইল চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ঘরের দিকে ফিরে এলাম আমার পেছন পেছন আমার ছায়াসঙ্গী এলো।
-তুমি এত মন খারাপ করছো কেন? আমি আছি তো তোমার সাথে। এই প্রথম দীপার দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন মায়া হলো, মেয়েটা এ কয়েকদিনে খুব শুকিয়ে গেছে
-আমি সারা জীবন কাদের পিছনে শ্রম দিলাম দীপা?
-সবাই এরকম হয়না তবে কিছু কিছু পরিবার এরকম হয়, যারা শুধুমাত্র যে সংসারটাকে টানে তাকেই প্রাধান্য দিতে পছন্দ করে। তুমি কখনোই আমার কথা বিশ্বাস করো নি, আমি সারাদিন ঘরের কাজ করতাম ,তোমার মা বোন আমাকে যথেষ্ট খাটাখাটনি করাতো কিন্তু দিনশেষে তোমার কাছে ভালো সাজতো । তার মধ্যে তুমি আমাকে একেবারেই পছন্দ করতে না, তোমার ওই বান্ধবী তিন্নি ওর সাথে ঘোরাফেরা করতে সব খবরই আমার কানে আসতো। আমি একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে এসব মেনে নিতে পারতাম না তাই তোমার সাথে উচ্চস্বরে বাজেভাবে কথা বলতাম। আমিও তো মানুষ আমারও তো মন খারাপ হতো, আমি এসব কিভাবে সহ্য করতাম বলো? আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো তিন্নির সাথে সেই শেষ বার হসপিটালে দেখা হয়েছিল এরপর থেকে ও আমার কোন খোঁজ খবর নেয়নি, একটা ভেজিটেবিলের সাথে সম্পর্ক রেখে করবেই বা কি?
-তুমি ভেঙে পড়ো না ফিজিওথেরাপিস্ট তো বলেছেনই আর কয়েকটা সেশন লাগবে তারপর তুমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।
-আমি জানি দীপা কিন্তু ডাক্তার বললেও সেটা তো আর হচ্ছে না আমি আর কোন থেরাপি নিতে পারবো না আমার কাছে তো কোন টাকা পয়সা নেই আর নয়ন তো আজকে আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল তাই না
-তোমার পরিবার সাহায্য না করলেও আমার পরিবার করবে
-আমি তোমার পরিবার থেকে কোন সাহায্য চাই না
-ঠিক আছে সাহায্য নিও না, লোন নিবে আর তাছাড়া বাবা আমার নামে যে জায়গা জমি দিয়েছে আমি সেসব বিক্রি করে দিব। সবার আগে তুমি তারপরে জায়গা জমি হলে হবে না হলে নেই, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।
দীপার কোলে মুখ গুঁজে আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
প্রায় ২৮ বছর পরে আমার ছেলের বিয়ে হচ্ছে। দীপা খুব ব্যস্ত সব দিকটা ওই দেখছে, আমি শুধু টাকা দিয়েই ক্ষান্ত। আমি বুঝতে পারি না আমার এই ছায়া সঙ্গী বউ কিভাবে সবকিছু এক হাতে ম্যানেজ করে। হ্যাঁ আমি ওর সেবা যত্ন ভালোবাসায় আর উৎসাহে সত্যি সত্যি ছয় মাসের মধ্যেই ভালো হয়ে উঠেছিলাম। ওর বাবার দেয়া পুঁজি তেই একটা ব্যবসা শুরু করলাম। না একা না তাতে আমার পার্টনার ছিল দীপা। একা হলে আমি কখনোই এতদূর আসতে পারতাম না। পরিবারকে ভুলে যাইনি, তাদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে কিন্তু ফোনে হাই হ্যালো বলা পর্যন্তই, কোন অনুষ্ঠানে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া পর্যন্তই। আমি তাদের আসল রূপটা ধরে ফেলেছি।
আমার ছেলে সৈকত কে ছাদে ডাকলাম
-কি হয়েছে বাবা?
-শোন কাল তোর বিয়ে তোকে কিছু উপদেশ দিবো
-উপদেশ !তাও ফ্রিতে! সৈকত মুখ বাঁকা করলো
আমি হেসে ফেললাম
-আমাদেরকে তুই চিনিস তোর জন্মের পর থেকে আর যেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস সে একেবারেই অপরিচিতা কিন্তু তার মানে কিন্তু এই না যে আমরা যা বলবো সব সময় তা সঠিক এবং মেয়েটি যা বলবে তা ভুল
-আমায় এসব কেন বলছো বুঝলাম না?
-যা বলছি শুধু শুনে যা। যা কিছুই ঘটে যাক না কেন অন্ধভাবে কাউকেই বিশ্বাস করবি না
-সে কি! তোমাকে আর মাকেও না! তোমরাই তো আমার সব।
-আমি বলিনি যে আমাদেরকে কখনো বিশ্বাস করবি না, আমি বলেছি যে অন্ধভাবে কাউকে বিশ্বাস করবি না । আগে বিষয়টা যাচাই-বাছাই করবি তারপর সঠিক যেটা তোর মনে হবে সেই কাজটাই করবি। এমনও অনেক সময় আসতে পারে যেখানে আমি আর তোর মা ভুল করে ফেলেছি
-যাহ, কি যে বলো বাবা তা হতে পারে নাকি?
-কোন মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে না, আমি চাই তুই সব সময় সঠিক পথে হাঁটতে শেখ। জীবনের পথে তোকে যেন হোঁচট খেতে না হয় । আমি চাই তোর মা যেমন আমার ছায়া সঙ্গী ঠিক তেমনভাবে তোর জীবনে একজন ছায়া সঙ্গী আসুক যাকে আঁকড়ে ধরে তুই বাঁচতে শিখবি।
-আচ্ছা বুঝেছি সৈকত অদ্ভুতভাবে কাঁধ ঝাকালো। আজকালকার ছেলেপেলেদের এই একটা অভ্যাস।
আমি মুচকি হেসে আকাশের দিকে তাকালাম , আকাশটা ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ কিন্তু কেন যেন সেই অন্ধকারের মাঝেও আমি অসীম ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি, যেন আমি পরিপূর্ণ একজন মানুষ।
৬.বিয়ে নিয়ে ফানি স্ট্যাটাস
চতুর্থ বিয়ে
————–
আমার চার নম্বর বিয়ের জন্য প্রস্তাব এসেছে । আমার বয়স পঞ্চাশ বছর । সন্তান হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই জেনেই পাত্রের ছেলে মেয়েরা আমাকে পছন্দ করেছে।
আমি যখন প্রথম বিধবা হই, তখন আমার বয়স ছিল বিয়াল্লিশ । আমার দুই ছেলে মেয়ে । ছেলেটার বয়স তখন পঁচিশ । বছর দুয়েক আগে বিয়ে করে আলাদা থাকে । মেয়েটার বয়স বাইশ। তিন বছরের একটা মেয়ে আছে তার । ছেলেমেয়েদের নিজেদের সংসার ই চলে না, আমাকে দেখবে কি ? খাওয়া পরার খুব কষ্ট হতো আমার । এর ভিতরেই একদিন আমার এক দূর সম্পর্কের খালা একটা বিয়ের প্রস্তাব আনলো আমার জন্য । লোকটার বয়স বাষট্টি বছর । বড় চাকরি করতো। প্রচুর সম্পত্তির মালিক । ছেলে মেয়েরা সব বিদেশ থাকে। বউ মরেছে দুই বছর আগে । দেখা শোনা করার কেউ নেই । সে নিজেই আমার সেই দূর সম্পর্কের খালাকে বলেছে, দেখতে শুনতে ভালো, সেবা যত্ন করতে পারবে এমন একটা গরীব ঘরের মেয়ে চায় সে। প্রথম প্রথম খুব সংকোচ হচ্ছিলো আমার । এই বয়সে আবার বিয়ে করবো, মানুষ বলবে কি ? কিন্তু বাকি জীবন একা একা কিভাবে চলবো, এই ভয়েই রাজি হয়ে গেলাম ।
আমার বাষট্টি বছরের স্বামী, হঠাৎ করে আমার মত সুন্দরী বউকে পেয়ে, হাতে যেনো স্বর্গ পেলো। আমার বয়স তখন বিয়াল্লিশ বছর হলেও দেখে মনে হয়, ত্রিশ এর বেশি হবে না । আমি প্রচুর পরিশ্রম করতে পারতাম, তাই তখনও আমার পেটানো দেহের গড়ন ছিল । আমার সতীন এর সব গহনা, শাড়ি আমার বর আমাকে দিয়েছিল। আদর, আহলাদ যত করতো, অল্প বয়সেও আমার প্রথম স্বামী তা করেনি। বরং সব সময়ই বকা ঝকা করতো। আমি জীবনে প্রথম, সুখ কাকে বলে তা জানলাম । কিন্তু বেশি বয়সে লাফালাফি করতে গেলে যা হয় আরকি, আমার দ্বিতীয় স্বামী বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্ট্রোক করলো। আমার সতীন এর ছেলে মেয়েরা প্রথম প্রথম আমাকে সহ্য ই করতে পারতো না। কিন্ত তাদের বাবা স্ট্রোক করার পরে, সবাই খুব ভালো ব্যবহার করা আরম্ভ করলো। অসুস্থ বাবার দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না, এটাই তাদের কাছে তখন বিশাল কিছু ছিল । তারা কিছুদিন বাবার কাছে থেকে আবার বিদেশ চলে গেল । মাঝে মাঝে ফোনে খোঁজ নিতো।
দীর্ঘ চার বছর আমার স্বামী শয্যাশায়ী ছিল । আমি তাকে মন থেকে সেবা যত্ন করেছি।
আমার দ্বিতীয় স্বামী মারা যাবার পরে, তার ছেলে মেয়েরা পারলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমাকে যতটা বোকা ওরা ভেবেছিল, ততটা বোকা আমি নই। আমি জানি, আমার স্বামীর সম্পত্তির যে অংশ আমি পাবো, তার মূল্য পঞ্চাশ লাখ তো বটেই, এক কোটিও হতে পারে । নানা রকম সালিশ , বিচারের পর শেষ পর্যন্ত পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ওরা আমাকে বিদায় করলো।
আমার কাছে মনে হলো, এটাও খারাপ নয়। যেসব পুরুষ মানুষ বুড়ো বয়সে বউ ছাড়া কষ্ট পাচ্ছে, তাদের বিয়ে করলে, খাওয়া পরার কোন সমস্যা থাকে না, তাদের ছেলে মেয়েরাও একটু খুশি হয়, বুড়ো বাপের দায়িত্ব নিতে হয় না বলে । এবার বিয়ে করলাম এক ক্যান্সার এর রোগীকে। প্রথমে ছেলে মেয়ে গুলো চেয়েছিল, আমাকে আয়া হিসাবে নিয়োগ দিতে । আমি রাজি হইনি । বলেছি একমাত্র বিয়ে দিয়ে ঘরে নিলেই আমি যাবো। তা না হলে পুরুষ মানুষ ক্যান্সার এর রোগী হলেও বিশ্বাস নেই। এক ঘরে দিন রাত থাকতে হবে । ছেলে মেয়েরা সবাই চাকরি করে । বেগতিক দেখে শেষ পর্যন্ত বিয়ে দিয়েই দিলো। না, আমার তৃতীয় স্বামী আমাকে কখনো পুরুষের দৃষ্টি দিয়ে বা স্বামীর দৃষ্টি দিয়েও দেখে নাই। বেচারা আমার সেবা যত্ন পেয়ে কৃতজ্ঞ ছিল খুব । ছয়মাস পরে সেও মারা গেল। এখান থেকেও বেশ কিছু টাকা পেলাম।
আমার তৃতীয় স্বামী মারা যাওয়ার পরে, আমার ডিমান্ড বেড়ে গেল । বিভিন্ন জায়গা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। আমার বেশ কিছু টাকা ব্যাংকে আছে। সেটা দিয়ে আমার চলে যায় কোন রকম । তাই সেসব প্রস্তাব আমি ফিরিয়ে দিই। কিন্তু এবার যে প্রস্তাব এসেছে, সেটা বেশ অবাক করা। এই লোকটার বউ, ছেলে, মেয়ে সবাই আছে। বউ নিজে আমাকে দেখতে আসছে । পাত্রের বয়স বেশি না। পঞ্চান্ন বছর বয়স। বউ এর বয়সও পঞ্চান্ন। একই সাথে দুজনে পড়াশোনা করেছে। বউটাও চাকরি করে ।
আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ” আপনি বেঁচে থাকতে, স্বামীকে বিয়ে দিতে চান কেন? ” মহিলা জানালো, স্বামী ইদানিং খুব রাগী হয়ে গেছে । কথায় কথায় ধমক দেয়। কোন কাজ তার পছন্দ হয় না । কিছুদিন আগে মারতেও গেছে । তাই তাকে আর একটা বিয়ে দিয়ে নিজে একটু শান্তিতে থাকতে চায়।
বেশ ধুমধাম করে আমার বিয়ে হলো। পাত্র মাশাআল্লাহ দেখতে খুব সুন্দর । শুধু ভয়ে ভয়ে আছি । কোন সময় না আবার মারধর শুরু করে । বাসর রাতে জড়সড় হয়ে বসে থাকলাম। ওমা, আমার চার নম্বর স্বামী দেখি খুব রোমান্টিক, রোমান্টিক কথা বলছে। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ” শুনেছি আপনি খুব রাগী । আমাকে বকা দিয়েন, কিন্তু কখনো মারধর করবেন না দয়া করে । ” আমার স্বামী খুব সোহাগ করে বললো, ” তুমি কি পাগল হয়েছো ছোট বউ ?! আমি মোটেও রাগী নই। আর একটা বিয়ে করার খুব শখ হয়েছিল । তাই কয়দিন ভান ধরেছিলাম। তোমার গায়ে আমি ফুলের টোকাটাও লাগতে দিবো না । ”
পরের দিন কাঁদতে কাঁদতে আমি আমার সতীন কে বললাম, ” আপাগো, আপনার কত বড় সর্বনাশ আমি করেছি। উনি তো মোটেও রাগী না। আর একটা বিয়ে করার জন্য ভান ধরছিল। ” ভাবছিলাম এই কথা শুনে আমার সতীন কান্না জুড়ে দিবে। আমাকে অবাক করে দিয়ে হাসতে হাসতে সে বললো, ” এইটা আমিও বুঝছি । তবে বাড়িতে কাজের লোকের বড় অভাব ছিল । তোমাকে এনে পারমানেন্ট একটা ব্যবস্থা করে ফেললাম। অনেকদিন দাসীগিরি করছি, এবার আমার মুক্তি । এবার তুমি ঠেলা সামলাও। ” আমি হা হয়ে রইলাম ।