আমার তুমি সিজন ২ পর্ব ৩৮
তানিশা সুলতানা
রাত বারোটা ছুঁই ছুঁই। নিস্তব্ধ পরিবেশ। মাঝেমধ্যে কুকুরে ঘেউ ঘেউ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তুলতুল বারান্দায় মোড়া টেনে বসে আছে। চোখে ঘুম নেই। সেই বিকেলে বসেছে এখানে। এখনো কেউ ডাকতে আসে নি আর নিজেও ওঠে নি।
ইদানীং নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায় তুলতুল। কোথায় গেলো সেই চঞ্চলতা? কোথায় গেলো সেই ননস্টপ বকবক করা?
এখন তো কথা বলতেই ইচ্ছে করে না। প্রয়োজনীয় কথাটাও বলা হয় না।
বাবা খালি হাতে বাসায় ফিরলেও চকলেটের জন্য কান্নাকাটি করা হয় না। তনুর পেছনে লাগা হয় না। এখন শুধু একটু পরপর কান্না পায়। মনটা বিষন্ন হয়ে থাকে। সবটা শুধুমাত্র একটা ছেলের জন্য।
আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোতে তুলতুলের চোখের পানি চিকচিক করছে। সায়ান এখন ভালো আছে। বিকেলে তন্ময় বাবা মা আর তনু ভিডিও কলে দেখছিলো সায়ানকে। তুলতুল আড়াল থেকে দেখেছে এক পলক। শুনেছে সায়ানের কন্ঠ। তুলতুলকে অবশ্য অনেকবার ডেকেছে সবাই। কিন্তু তুলতুল যায় নি। কথা বলার ইচ্ছে নেই।
হঠাৎ করে তুলতুলের ফোনটা বেজে ওঠে। চমকে ওঠে তুলতুল। চাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে ফোনের স্কিনে তাকায়। নিজের কোলের ওপর রাখা ছিলো ফোনটা। স্কিনে “হনুমান” নামটা জ্বলজ্বল করছে। এই সেই নাম্বার যেই নাম্বারে কাল পর্যন্ত কল দিয়ে বন্ধ পেয়েছে তুলতুল।
কালকে এই কলটা পেলে তারাহুরো করে রিসিভ করতো। কিন্তু আজকে রিসিভ করার ইচ্ছে বা এনার্জি কোনোটাই নাই।
তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কল কেটে যায়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছে ফেলে তুলতুল।
অভিমানটা আসলে কার ওপর বুঝতে পারছে না তুলতুল? কিন্তু এইটুকুই বুঝতে পারছে কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
পরমুহূর্তেই মনে পড়ে যায় কোন পরিস্থিতিতে বিয়েটা হয়েছিলো।আর কেউ হয়ত বিয়েটা মানে না। তুলতুলের সায়ানের প্রতি কানসান থাকতে পারে এটা কারো মাথাতেই নেই।
এবার কল না দিয়ে মেসেজ দেয় সায়ান।
“দ্বিতীয় কলটা রিসিভ না হলে আমি এখুনি তোর বাড়িতে চলে আসবো। আমার কিন্তু দুটো পা ই ভে*ঙে গেছে। বুকে আটটা সে*লাই পড়েছে। এই অবস্থায় হাসপাতাল থেকে বের হলে নির্ঘাত মা*রা যাবো। এবার তোর যেমনটা ইচ্ছে।
মেসেজটা পড়ে বুক কেঁপে ওঠে তুলতুলের। চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায়।
সাথে সাথেই কল বেজে ওঠে। সময় নষ্ট না করে রিসিভ করে তুলতুল।
ফোনটা কানে নিয়ে চুপ করে থাকে।
সায়ান মুচকি হাসে। একটু আগে হাসিব নতুন ফোন কিনে তাতে সায়ানের সিম ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর এখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।
সায়ান একটু ওঠার চেষ্টা করে আর বুকে টান পড়ে। চোখ মুখ খিঁচে যেমন ছিলো তেমনই থাকে।
” কি রে কথা বলবি না?
সায়ান বলে। তুলতুল হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়।
“আমি কেনো কথা বলবো? আপনি কল দিছেন আপনি কথা বলবেন। কি বলতে কল দিছেন বলে তাড়াতাড়ি কল কাটেন। আমি ঘুমবো। কথা বলার ইচ্ছে নেই।এমনিতেও আমি বেশি কথা বলা পছন্দ করি না। জলদি বলে ফুটেন।
বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলে তুলতুল। সায়ানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে আছে। কতোদিন পর হাসলো জানা নেই।
“তোকে খুব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
গম্ভীর গলায় বলে সায়ান। তুলতুল কেঁপে ওঠে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়।
” আমার কাউকে দেখতে ইচ্ছে করছে না। কেউ নেই আমার আমি এতিম। কাউকে লাগবেও না আমার। তুলতুল একা চলতে পারে। তার কাউকে প্রয়োজন নেই।
বলেই কল কেটে দেয় তুলতুল। সায়ান হতদম্ভ হয়ে যায়। হঠাৎ করে মেয়েটার কি হলো বুঝতে পারলো না সায়ান। শুধু মস্তিষ্কে একটা কথাই চলে আসে খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে যেতে হবে। তুলাকে কাছে নিয়ে আসতে হবে।
“আম্মা আমি বলছি এই মেয়েকে সায়ানের জীবন থেকে বের করুন। সেইদিন ঢাকা থেকে ফিরে যদি ঢাকা করেই ওই মেয়েটার বাড়িতে যেতে না চাইতো তাহলে কি এমন অঘটন ঘটতো? ছেলেটাকে কিভাবে মে*রে*ছে একবার দেখছেন? আমার হাসিব যদি ওই রাস্তা দিয়ে না ফিরতো তাহলে তো সায়ানকে দেখতেই পেতো না। না দেখতে পেলে কি হলো?
হামিদা খুকি বেগমের পাশে বসে বলে। সালমা তার পাশে বসে আছে। আর সুমু দাঁড়িয়ে আছে।
” কাকিমা তুমি
“আমার ছেলেটা অসুস্থ। আর তোমরা এখানে কে দোষী কে নিদোষ এটা নিয়ে ভাবতো?
চুপ করে থাকো। আমার ছেলের ভালোটা আমি বুঝে নেবো।
সালমা রেগে বলে। চুপ হয়ে হামিদা। সুমু চলে যায় ওখান থেকে।
এই কয়দিনে তন্ময় হারে হারে টের পেয়েছে সে সুমুকে ছাড়া অসহায়। প্রতিটা মুহুর্তে টের পাচ্ছে সুমুকে ছাড়া দু সেকেন্ড থাকা কষ্টকর। প্রতিটা মুহুর্তে শুধু মনে হয় সুমুর কাছে ছুটে চলে যেতে। বুকের ভেতর শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে বলতে ” বুকের বা পাশটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে”
তন্ময় ভাবতে ভাবতে তুলতুলের রুমে যায়। তুলতুল বেরোনোর জন্য সাজুগুজু করছিলো। আজকে একটু বিকেলের হাওয়া খেতে যেতে চাই ছিলো।
“কি রে বোনু? কি করছিস?
তন্ময় তুলতুলের রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলে।
তুলতুল আয়নার ভেতর দিয়েই ভাইয়ের দিকে তাকায়।
” এই তো দাভাই একটু বের হবো। তাই সাজুগুজু করছিলাম।
মুচকি হেসে বলে তুলতুল।
“আজকে আমি তোকে ঘুরতে নিয়ে যাবো। যাবি আমার সাথে?
তুলতুলের হাসি মুখটা চুপসে যায়। মাথা নিচু করে ফেলে।
” আমি আসলে তিথিকে বলে ফেলেছি ওর সাথে যাবো। এখন ওকে না করলে কেমন দেখায় বলো? তোমার সাথে অন্য দিন যাবো।
মাথা নিচু রেখে বলে তুলতুল। তন্ময় তুলতুলের মুখোমুখি মোড়া টেনে বসে।
“ইগনোর করতে চাইছিস?
” এ মা একদম না।
“তাহলে মিথ্যে কেনো বলছিস?
” আমি ওনাকে দেখতে যেতে চাই না। হাসপাতালে যাবো না আমি। যার খারাপ সময়ে আমাকে কেউ একটু জানানোর প্রয়োজন মনে করে নি। তার ভালো সময়েও আমাকে বলার প্রয়োজন নেই। তাকে দেখার এতোটুকুও ইন্টারেস্ট নেই আমার।
তুলতুল চোখ মুখ শক্ত করে বলে।
“তোর এক্সাম ছিলো। আর
” আর কি? একটা মানুষের জীবনের থেকেও এক্সাম বড় হলো? ঠিক আছে ভালো। এখনো আমার এক্সাম শেষ হয় নি। আমি এসব ঝামেলায় জড়াতে চাইছি না আসছি
তুলতুল ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে পার্স নিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। তন্ময় দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
সায়ান হাসপাতালে থাকবেই না। সে এখনই চলে যাবে
ডাক্তার ছাড়তে নারাজ। সায়ান স্পষ্ট বলে দিয়েছে “দুই ঘন্টার মধ্যে বাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা না করে দিলে একাই চলে যাবে”
সায়ানের স্পষ্ট কথায় সকলেই ভরকে গেছে। এই শরীরে গাড়ি জার্নি করা রিস্ক। রাস্তায় ঝাঁকি গেছে সি*লি ফেঁ*টে গেলে আরেক ঝামেলা হবে। পায়ে ঝাঁকি লাগলেও সমস্যা হবে।
কিন্তু এসব কথা শুনতে নারাজ সায়ান। সে যাবে মানে যাবেই।
“ভাই তুই তো একা একা বসতেই পারছিস না। তাহলে তুই জার্নি করবি কিভাবে?
হিমু সায়ানের পাশে বসে বলে।
” তা তো তোর কি? আমি বাসতে পারি না। তাতে তোর তো কোনো পবলেম হওয়ার কথা না? নিজের রাস্তা দেখ।
সায়ান রাগী গলায় বলে। হিমু শুকনো ঢোক গিলে।
“তুই ই পারবি জার্নি করতে।।বসতে পারছিস না তো কি হইছে? হাঁটতে পারবি। পা ভা*ঙা তাতে কি উড়ে উড়ে যাবি। আমার কোনো সমস্যা নাই ভাই।
হিমু বলেই চলে যায়।
চলবে……