না দেওয়া চিঠি (ছোটগল্প)
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
না বলা প্রেমের চিঠি প্রথম অংশ
আষাঢ় মাস। গাঢ় ধূসর রঙের মেঘে আকাশ ঢেকে আছে, সেখান থেকে মৃদু আওয়াজে হঠাৎ হঠাৎ ভেসে আসছে মেঘের গর্জন। বোঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পরবে, নিজের সিগ্ধ ছোঁয়ায় জাগিয়ে তুলবে সবুজ প্রকৃতিকে। বাতাস তার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। নদীর স্রোত যেন এখন আরও তীব্র বেগে ছুটছে। এমন পরিস্থিতিতে গ্রামের সবাই ছোটাছুটি করে যত দ্রুত সম্ভব বাইরের কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরায় চেষ্টা করছে। কিন্তু তিশান চুপচাপ বসে আছে নদীর পাড়ের নারকেল গাছটার নিচে। আশেপাশে কী হচ্ছে সেটা নিয়ে তার কোনরকম মাথা ব্যাথাই নেই। আপাতত মারাত্মক মন খারাপে ঢুবে আছে সে। বৃষ্টি তাকে ভিজিয়ে দিলেও আপাতত তার কিছু যায় আসেনা। পরপর দুবার বিসিএস পরীক্ষা দিয়েও কোন লাভ হলো না। এই নিয়ে মা আজ সকালে কয়েকটা কড়া কথাও শুনিয়ে দিয়েছে ওকে। তাই ভাতের থালায় অর্ধেক ভাত রেখেই উঠে চলে এসছে। চাকরি না হয় হচ্ছেনা। যেভাবেই হোক সংসার তো ওই টানছে না-কি? এতো কথা শোনানোর কী আছে? এরমধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ধীরে ধীরে বৃষ্টির গতি বৃদ্ধি পেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিজে চুবচুবে হয়ে গেল তিশান। কিন্তু তবুও ওভাবেই বসে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। হঠাৎ কেউ বলে উঠল,
” হ্যালো? আপনিও কী বৃষ্টিতে ভিজতে বেড়িয়েছেন?”
এক মিষ্টি নারী কন্ঠ শুনে চমকে উঠল তিশান। সেই কন্ঠস্বর অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিশান ভ্রু কুচকে মেয়েটাকে দেখল। পরনে একটা কালো কুর্তি আর জিন্স, গলায় একটা নীল ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে। বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে সে। ফর্সা শরীরে ভেজা কালো রঙটা বেশ ফুটে উঠেছে। কিন্তু মেয়েটার মুখ অপরিচিত। সে যে এই গ্রামের মেয়ে নয় সেটা বুঝতে পারছে তিশান। মেয়েটা হালকা হেসে আগের চেয়ে উঁচু আওয়াজে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘আপনিও কী আমার মত বৃষ্টিতে ভিজতে ভালোবাসেন?’
তিশান মুখ ঘুরিয়ে নিজের দৃষ্টি আবার নদীর দিকে নিক্ষেপ করে বলল,
‘ না, আমার বৃষ্টি তেমন পছন্দ না।’
মেয়েটা বোধ হয় বেশ অবাক হল। বৃষ্টি পছন্দ না? তবুও এভাবে বসে বসে ভিজছে? পাগল না-কি ছেলেটা? সে দু-কদম এগিয়ে এসে বলল,
‘ পছন্দ না? তাহলে এভাবে বসে বসে বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন?’
তিশান মেয়েটার দিকে না তাকিয়েই সোজাসাপ্টাভাবে উত্তর দিল,
‘ মন ভালো নেই তাই।’
মেয়েটা এবারও মুখে হাসি ধরে রেখে বলল,
‘ তারমানে আপনিও বৃষ্টি পছন্দ করেন। কারণ মন খারাপ বলে আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন। আর বৃষ্টিতে ভিজলে আপনার মন ভালো হয়ে যায়। সেজন্যই ভিজছেন নিশ্চয়ই? তাহলে মিথ্যে বললেন কেন?”
তিশান আবার ভ্রু কুচকে তাকাল মেয়েটার দিকে। ও নিজে বলছে ওর বৃষ্টি অপছন্দ। কিন্তু মেয়েটা কীসব যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেই ছাড়ছে ওর বৃষ্টি পছন্দ। অদ্ভুত! মেয়েটা কোন যুক্তিবিদ না-কি? যা ইচ্ছে হোক, ওর তাতে কী? বৃষ্টির গতি অনেকটাই কম এখন। মেয়েটা তিশানের পাশে বসে পরল। এরপর তিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি মহুয়া। আপনি?’
তিশান বেশ অবাক হল। চেনা নেই, জানা নেই, একটা অপরিচিত একটা ছেলের পাশে বসে পরল? তাও এমন পরিবেশে? তারওপর বকবক করেই যাচ্ছে। কী চাইছে কী এই মেয়ে? এসব ভাবনা মনে থাকার পরেও সৌজন্যতার খাতিরে বলল,
‘ আমি তিশান।’
‘ বাহ ভালো নাম তো।’
‘ আপনার নামটাও সুন্দর।’
‘ থ্যাংক ইউ। বাই দা ওয়ে আমি কী আপনাকে তুমি করে বলতে পারি? আমার না ‘আপনি’ বেশিক্ষণ পোষায় না।’
তিশান কোন উত্তর দিলোনা। কিন্তু মেয়েটার এতোটা মিশুক স্বভাব ওর মন্দ লাগল না। মহুয়া তিশানের মৌনতাকেও সম্মতি ধরে নিয়ে বলল,
‘ জানো আমার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিলো গ্রামে থাকার। কিন্তু কয়েকবছর যাবত বাংলাদেশেই আসা হয়না। দুদিন আগে বাংলাদেশে এসছি আর আজ গ্রামে।”
তিশান বুঝতে পারল যে মহুয়া বিদেশে ছিলো। এইজন্যই হয়ত এতো ফ্রি মাইন্ডে কথা বলছে। আর এই গ্রামে নতুন এসছে বলেই ও চেনেনা। তবে মেয়েটার কন্ঠস্বর তিশানকে তীব্রভাবে আকৃষ্ট করছে। এতো সুন্দর করে কথা বলে কেন মেয়েটা? মহুয়া আবার বলল,
‘দেখো আমার কী ভাগ্য! আসতে না আসতেই কী সুন্দর বৃষ্টি উপহার পেলাম। আসলে এরা হয়তো আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তাই আসতে না আসতেই সাদরে বরণ করে নিল।”
তিশানের হাসি পেল। বৃষ্টিও কারো জন্যে অপেক্ষা করে বুঝি? বর্ষাকালে যে এখানে প্রায় রোজই বৃষ্টি হয়ে মেয়েটা কী জানে না? কিন্তু মেয়েটার এই ভুল ধারণা ভেঙ্গে দিতে মোটেও ইচ্ছে করল না তিশানের। কেন জানিনা কল্পনার জগতে বিচরণকারী এই মেয়ের বাচ্চাসুলভ কথাই ওর ভালো লাগছে। প্রথমে বিরক্ত লাগলেও এখন মেয়েটার কথাবার্তায় মন নিমেষেই ভালো হয়ে গেল। মেয়েটা খুব মিশুক আর মিষ্টি। তাঁর প্রতিটা বাক্যে যেন মন ভালো করার ঔষধ আছে। তিশান এবার নিজেই প্রশ্ন করল,
” বৃষ্টি এতো ভালো লাগে?”
মহুয়া উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
” ভীষণ ভালো লাগে। যাদের বৃষ্টি ভালো লাগেনা তারা আসলে বৃষ্টিকে অনুভব করতেই পারেনা। আপনিই ভাবুন, এতো বিশাল আকাশ, সেখানে ভেসে বেড়ানো সুন্দর সুন্দর মেঘ, আর সেই মেঘ গলে পরা অসংখ্য পানির ফোটা আমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। কত চমৎকার না ব্যাপারটা?’
তিশান হাসলো। অনেকটা সময় পর ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল ওর। মেয়েটার চঞ্চলতা, আর এতো সুন্দর বাচনভঙ্গি ওর মন নিমেষেই ভালো করে দিলো। তিশান এবার হাসি মুখে প্রশ্ন করল,
‘ এখানে কোথায় এসে উঠেছেন আপনি?’
‘ আমি নানাবাড়ি এসছি। ইদ্রিস মাদবরের বাড়ি চেনো নিশ্চয়ই? ওটাই! একমাসের জন্যে বেড়াতে এসছি।”
‘ ও, আপনি চেয়ারম্যান সাহেবের নাতনি?”
‘ হ্যাঁ। আর হ্যাঁ, তুমি এসব আপনি-টাপনি বাদ দিয়ে তুমি করেই ডাকো আমাকে। না হলে নিজেকে সিনিয়র সিটিজেন বলে মনে হচ্ছে।’
তিশান এবারও হেসে দিয়ে বলল,
‘ আচ্ছা।’
‘ এভাবে বসে বসে ভিজতে ভালো লাগে না-কি? চলো না হাটি?’
মেয়েটা এমনভাবে বলল যে তিশান ‘না’ করতে পারল না। না করার ইচ্ছাও ছিলোনা। তিশান নিজের শার্টটা খুলে মহুয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এটা ওপর দিয়ে পরে নাও। এটা গ্রাম তো, এভাবে দেখলে লোকে খারাপ বলবে।’
মেয়েটা বিষ্ময় নিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে সরল কন্ঠে বলল,
‘ কেন? আমিতো ছোট কোন পোশাক পরিনি?’
‘ না তা পরোনি। কিন্তু তুমি ভিজে আছো তাই।’
‘ তো?’
তিশান ঠিক কী বলে ব্যপারটা বোঝাবে মহুয়াকে সেটা বুঝতে পারছে না। তাই নিজেই শার্টটা মহুয়ার গায়ে জড়িয়ে দিল। মহুয়া ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে রইল তিশানের দিকে। তিশান মহুয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে হাটা শুরু করল। মহুয়া কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে তিশানের পাশ দিয়ে হাটা শুরু করল।
মহুয়া বকবক করেই যাচ্ছে আর তিশান শুধু ওর কথার সাথে ‘হুঁ, হ্যাঁ’ করছে। কিন্তু মেয়েটার কথা শুনে ওর অদ্ভুতরকম ভালোও লাগছে। যদিও মেয়েটার বেশিরভাগ কথারই বিষয়বস্তু ছিল গ্রামের সৌন্দর্য, ওর কোন জিনিসটা কত ভালো লেগেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ধীরগতির বৃষ্টি এখনো ওদের ভিজিয়ে দিচ্ছে ওদের। কিন্তু প্রথম দেখায় কারো সাথে এতো মিশে যাওয়া যায়, এতো কথা বলা যায় সেটা তিশান জানতোনা। তিশান একটু পরপর আড়চোখে মহুয়ার দিকে তাকাচ্ছে। মহুয়াকে দেখতে দেখতে অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল ওর।
বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই। ওরা এখনো হাটছে। তখনই ‘মহুয়া’ বলে পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল। ওরা দুজনেই পেছনে তাকালো। মহুয়া দেখল ওর মামী রেশমা দাঁড়িয়ে আছে। মহুয়া সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে জিবে কামড় দিল। ও বাড়িতে কাউকে না বলেই বেড়িয়ে চলে এসছিল। নিশ্চয়ই সবাই খুঁজে মরেছে। রেশমা শাড়ি দুহাতে একটু উঁচুতে তুলে এগিয়ে বলল,
‘ তুমি এখানে? জানো সবাই কত চিন্তা করছে? এমনিতেই এই গ্রামের কিছুই চেননা। তারওপর বাইরে এতো বৃষ্টি। চল বাড়ি চল।’
বলে একবার তিশানের দিকে তাকিয়ে মহুয়ার হাত ধরে হাটা দিল। তিশান তাকিয়ে রইল মহুয়ার যাওয়ার দিকে। মহুয়াও একবার ফিরে তাকাল তিশানের দিকে। একটু দূরে গিয়েই রেশমা মহুয়াকে বলল,
‘ এসব ছেলেদের সাথে যতটা সম্ভব দূরত্ব রেখে চলবে বুঝলে। এরা কিন্তু ভালো হয়না। একা পেয়ে কোন ক্ষতি করে দিলে?’
মহুয়া কোন উত্তর দিলোনা। ওর তো তিশানকে ভালোই লেগেছে। খারাপ কিছুই মনে হয়নি। মহুয়া চোখের আড়াল হতেই তিশান একবার আকাশের দিকে তাকালো। ডান হাত দিয়ে ভেজা চুলগুলো নেড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। এখন মনটা বেশ ফুরফুরে হয়েছে। খিদেও পেয়েছে বড্ড।
তিশানদের টিনের চৌচালা ঘর। মাঝখানে টিন দিয়ে দুটো রুমের মত করা আছে। বাড়ি ফিরে তিশান দেখল উঠনে মাটির চুলায় ওর মা রান্না করছে। তিশান ভেতরে গিয়ে একটা গামছা নিয়ে বেড়িয়ে এসে বলল,
‘মা ভাত দাও আমার জন্যে। আমি দু-মিনিটে গোসল করে আসছি।’
আমেনা তিশানের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বলল,
‘ তখন তো খুব অর্ধেক থাল ভাত ফেলে উঠে চলে গেলি। কী পেয়েছিস আমাকে? সারাদিন তোর ভাতই বাড়বো আমি? আমার ঢের কাজ আছে। আমি পারবোনা।’
তিশান আমেনার কথায় পাত্তা না দিয়ে চলে গেল গোসল করতে। গোসল সেড়ে ফিলে এসে দেখল যে ঠিকই পাটি বিছিয়ে থালায় খাবার ঢেকে রেখে দিয়েছে আমেনা। তিশানও চুপচাপ খেতে বসে গেল। খুব খিদে পেয়েছিল। তবে সারাদিনই ওর মহুয়ার কথা মনে পরেছে ওর। কিছুক্ষণ পরপর মেয়েটার খিলখিল করে হাসার শব্দটা ওর কানে এখনো বাজছে।
___
সকাল সাড়ে সাতটার মত বাজে। আজ আকাশটা বেশ পরিষ্কার। তাই সকালের উজ্জ্বল রোদ ঝলমল করছে। রোদের আলো পেয়ে ভেজা সবুজ প্রকৃতি সতেজ হয়ে উঠেছে। তিশান কম দামি সস্তার জিন্সের সাথে একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে, কোমরে গামছা বেঁধে ওর সবজির ক্ষেতটার আগাছা পরিস্কার করছে। হঠাৎ কেউ ডেকে উঠল
‘ তিশান?’
নিজের নাম নেওয়াতে কাচি চালানো থামিয়ে সামনে তাকাল তিশান। তাকিয়ে অবাক হল কারণ মহুয়া দাঁড়িয়ে আছে। মহুয়ার হাতে ওর সেই শার্ট। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ তুমি এখানে?’
মহুয়া এগিয়ে এসে শার্টটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ তোমার শার্টটা ফেরত দিতে এসছিলাম।’
‘ কিন্তু আমার বাড়ি কীকরে চিনলে?’
‘ আমার মামাতো বোনের সাথে এসছি। ওর প্রাইভেট ছিল। যাওয়ার আগে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে।’
‘ একটা শার্ট ফেরত দেওয়ার জন্যে এতো কষ্ট করে আসার দরকার ছিলোনা।’
‘ আরে, শার্ট ফেরত দেওয়াতো বাহানা। এই সুযোগে গ্রামটা আরেকটু ঘুরতে পারব সেজন্যই এলাম।’
তিশান হেসে গামছাটা কোমর থেকে খুলে গলায় ঝুলিয়ে বলল,
‘ এতো প্রকৃতি প্রেম? এটা কী বিদেশে থেকেছো বলে?’
মহুয়া সবজির গাছগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল,
‘ উমহুম, যখন দেশে ছিলাম তখনও ভালো লাগত। এই ক্ষেতটা তোমার?’
‘ হ্যাঁ আমারই। আসলে এই জমিতে আমার বাবাই বিভিন্ন সবজির গাছ লাগাতো। এখন আমি লাগাই।’
‘ তোমার বাড়িতে আর কে কে আছে?’
‘ আমার মা আর আমি। বড় বোন আছে একটা, বিয়ে হয়ে গেছে তাঁর।’
মহুয়া একটু অবাক হয়ে বলল,
‘ একটু আগে যে বললে তোমার বাবা এখানে সবজি চাষ করতেন?’
‘ করতেন। কিন্তু এখন করেন না। উনি মারা গেছেন পাঁচবছর হল।’
কথাটা বলতে বলতে মন খারাপ হয়ে উঠল তিশানের। মহুয়া বুঝতে পারল ব্যাপারটা। এখন ‘সরি, বুঝতে পারিনি’ বললে লেম সিমপ্যাথি বলে মনে হবে। তাই মহুয়া কিছু একটা ভেবে বলল,
‘ খুব সুন্দর কিন্তু। আচ্ছা দূরে আরও ক্ষেত দেখতে পাচ্ছি। আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে?’
তিশান মনে মনে খুব অবাক হয়েছে। এরকম বড় ঘরের একটা মেয়ে ওর সাথে পায়ে হেটে ক্ষেতে ঘুরতে চায়? এরকম অদ্ভুত কেন মেয়েটা? কিন্তু এবারও না করতে ইচ্ছে করছেনা তিশানের। তবুও বলল,
‘ এখন?’
‘ হম, কেন তোমার কাজ আছে এখন?’
‘ না, তেমন কোন কাজ নেই। আজ বাড়িতে বলে এসছো তো?’
‘ হ্যাঁ, আজ ফোনও আছে আমার সাথে। চলো না?’
‘ এক মিনিট দাঁড়াও আমি আসছি।’
বলে দৌড়ে গেল বাড়ির দিকে। তিন/চার মিনিট পর ওপরে একটা শার্ট পরতে পরতে এলো তিশান। এরপর দুজনেই দূরের ক্ষেতগুলোর উদ্দেশ্যে হাটতে শুরু করল। হাটতে হাটতে মহুয়া বলল,
” আচ্ছা তুমি কী কর? মানে প্রফেশন কী?’
তিশান হেসে ফেলল। হাসিটায় হয়তো একটু তাচ্ছিল্যই মিশে আছে। মহুয়া ভ্রু কুচকে বলল,
‘ হাসছো যে?’
‘ বিশেষ কিছু না। কয়েকটা টিউশন করাই। আর ঐ সবজি চাষ। কয়েকটা কম্পানিতে জব ইন্টারভিউ দিয়েছি কিন্তু হয়নি। আর দু-বার বিসিএস দিয়েছি কিন্তু টিকতে পারিনি।’
তিশান মুখে হাসি ফুটিয়ে কথাগুলো বললেও তার মধ্যে যে নিজের প্রতিই তাচ্ছিল্য মিশ্রিত ছিল সেটা বুঝতে মহুয়ার সময় লাগেনি। তাই আর কিছু বলল না মহুয়া।
তিশান মহুয়াকে নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত দেখাচ্ছে। মাঝেমাঝেই মহুয়া বিভিন্ন গাছের নাম জিজ্ঞেস করছে। আর তিশানও বেশ খোশমেজাজে মহুয়াকে গাছ চিনিয়ে দিচ্ছে। বেশ ভালো লাগছে ব্যাপারটা তাঁর। নিজেকে বেশ জ্ঞানী জ্ঞানী মনে হচ্ছে। মহুয়াও খুব খুশি। ও চারপাশ দেখতে দেখতে খুশি হয়ে বলল,
‘ এই শোন। আমি যেই একমাস এখানে আছি। এই এক মাস তুমি আমাকে পুরো গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাবে। আশেপাশের গ্রামেও নিয়ে যাবে কিন্তু।’
তিশান মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আমিই কেন?’
‘ তুমি খুব ভালো এক্সপ্লেইন কর সবকিছু। আমার বেশ ভালো লাগে।’
‘ তোমার বাড়ির লোক কিছু বলবে না?’
‘ ওদের আমি সামলে নেব।’
বলে মহুয়া খানিকটা এগিয়ে গেল। ও খুব উপভোগ করছে এই প্রকৃতিকে। বাতাসে মহুয়ার খোলা চুল উড়ছে, বেশ স্নিগ্ধ লাগছে ওকে। তিশান হাত ভাজ করে তাকিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহুয়ার দিকে। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করছে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎই তিশানের হুশ ফিরল। কী সব চিন্তা করছিল ও? এই ভালোলাগার কোন মানে নেই। কোথায় মহুয়া আর কোথায় ও। তাই দ্রুতই নিজের মস্তিষ্ক থেকে এসব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মহুয়ার দিকে এগিয়ে গেল।
চলবে…
না দেওয়া চিঠি
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
না বলা প্রেমের চিঠি শেষ অংশ
প্রায় বেলা করেই বাড়ি ফিরল মহুয়া। বসার ঘরে এসে দেখে ওর দুই মামা বাদে বাড়ির সবাই ওখানেই বসে আছে। ওর মামারা যার যার ইদ্রিস মাদবর পেপার পড়তে পড়তে চা খাচ্ছিল। এটা ওনার রোজকার অভ্যাস। এই সময় খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চিনি ছাড়া দুধ চা খায় সে। মহুয়াকে দেখে ইদ্রিস চায়ের কাপটা রেখে বলল,
‘ কী ব্যাপার মেমসাহেবা? সকাল সকাল কোথায় গিয়েছিলে।’
‘ কোথাও না নানুভাই। তোমাদের গ্রামের ক্ষেত দিয়েই ঘুরছিলাম। কত সুন্দর সুন্দর ক্ষেত ছিল! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।’
‘ তুমিতো এখানের কিছুই চেনোনা। একা একা ঘুরলে কীভাবে?”
‘ একা একা ঘুরেছি কে বলল? তিশান নামের ছেলেটা আছেনা? ওর সাথেই ঘুরেছি। ছেলেটা কিন্তু খুব ভালো।’
মহুয়ার মা নিলু খানিকটা শক্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘ এমন অপরিচিত ছেলের সাথে এভাবে একা একা বেড়িয়েছো কেন? এটা নিউইয়র্ক নয় মহু। এখানে কে কেমন তুমি জানো?’
রেশমাও মাথায় শাড়ির আচলটা টেনে এগিয়ে এসে বলল,
‘ তোমাকে তো কাল বললাম মহুয়া এসব ছেলেদের কাছে ঘেঁষতে দিওনা। এরা সুবিধার হয়না। তবুও আজ গিয়েছিলে?’
মহুয়া ভ্রু কুচকে ফেলল। সবাই এভাবে কেন বলছে? ওর তো তিশানকে খুব ভালো একটা ছেলে বলেই মনে হলো। ইদ্রিস বলল,
‘এতো চিন্তার কিছুই নেই। ওকে চিনি আমি। ছেলে ভালো। আমায় খুব শ্রদ্ধা করে।’
মহুয়া বেশ খুশি হল ইদ্রিসের কথা শুনে। উচ্ছসিত কন্ঠে বলল,
‘ জানো নানাভাই। ও আমাকে বলেছে পুরো গ্রাম ঘুরে দেখাবে। আসলে আমিই বলেছিলাম ওকে। আমিতো কখনও সেভাবে গ্রাম দেখিনি তাই।’
নিলু সাথেসাথেই বলে উঠল,
‘ না, একদম না। পাগল হয়ে গেছো তুমি? কেমন না কেমন ছেলে। ওর সাথে কোথাও বেড় হবেনা। খুব বেশি ঘুরতে ইচ্ছে হলে তোমার ভাইদের বলে দেব। ওরাই ঘুরিয়ে দেখাবে।’
মহুয়া অনেকটা মন খারাপ করে বলল,
‘ কিন্তু ভাইয়ারা তো রোজ অফিসে যায়।’
মহুয়ার বাবা ইজহার খান বলল,
‘ আচ্ছা, এভাবে বলছ কেন? এলাকার ছেলেই তো। এখানকার সবাই চেনে বাবাকে। ওর সাথে খারাপ কিছু করার সাহস করবেনা। মেয়েটা একটামাস গ্রামে আছে ঘুরে দেখুক। আবার কতবছর পর আসবে ঠিক আছে? মাস শেষে না হয় ছেলেটার হাতে কয়েকটা টাকা ধরিয়ে দেব।’
ইদ্রিসও সম্মতি জানিয়ে বলল,
‘ হ্যাঁ, এমনিতেই ছেলেটা বেকার। এই সুযোগে কয়েকটা টাকাও রোজগার করতে পারবে। এই নিয়ে আর কথা বাড়িও না।’
কেউ আর কিছু বলার সাহস পেলোনা। আসলে ইদ্রিসের মুখের ওপর কেউ কিছু বলার সাহস পায়না এ বাড়িতে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিল সবাই। তবে মহুয়া খুব খুশি হয়েছে। পুরো গ্রামটা ঘুরে ঘুরে দেখবে, তাই ভীষণ উত্তেজনা কাজ করছে ভেতরে ভেতরে।
__
আজ বেশ সকাল সকাল খুব থেকে উঠে পরল তিশান। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে আজ, খুব অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কাল রাতে যদিও বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তবুও তুলনামূলক বেশিই শীত শীত লাগছে। তবুও কলের ঠান্ডা পানি দিয়ে বেশ লম্বা সময় নিয়ে গোসল করল। ধুয়ে রাখা বেশ ভালো একটা শার্ট আর জিন্স বের করে পরে নিলো। এরপর সুন্দর করে চুল আচড়ে, টিনের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা ছোট্ট আয়নায় নিজেকে ভালোভাবে দেখে নিলো। বেশ ভালোই লাগছে। ঠান্ডায় হাতের তালু ঘষতে ঘষতে পাশের রুমে গিয়ে বিছানো পাটিতে বসে বলল,
‘ মা, তাড়াতাড়ি খেতে দাও আমাকে। বেড় হবো।’
আমেনা ভাতের পাতিল এনে রাখতে রাখতে বলল,
‘ কী ব্যাপার? আজ এতো সকাল সকাল কোথায় বেড়োনো হচ্ছে?’
‘ চেয়ারম্যান সাহেবের নাতনি এসছে না? ওকেই একটু আশপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে দেখাব।
‘ এখানে আর দেখার মতো কী আছে?’
‘ বিদেশে থেকেছে, এরকম পরিবেশ আগে পায়নিতো। তাই এতো আগ্রহ। কাল এতো করে বলল, ভাবলাম বসেই তো আছি, একটু ঘুরিয়ে দেখাই। একি? শুধু ডাল কেন?’
আমেনা কর্কশ কন্ঠে বলল,
‘ তো এখন বিরিয়ানি রেঁধে দেব? শেষ কবে বাজার করেছিলি শুনি? যা আছে তাই দিয়েছি।’
তিশান বিরক্তি নিয়ে খেতে শুরু করে দিল। আমেনা আবার বলল,
‘এতো লেখাপড়া করে হল টা কী? কোন চাকরি-বাকরির বালাই নেই। এভাবে কতদিন? এমন বেকার ছেলের হাতে কোন বাপ তার মেয়ে দেবে? তারওপর ঋতুর বিয়েতে যে হারটা দেওয়ার কথা ছিল সেটাও দেওয়া হয়নি। দু-দিন পর যখন মেয়েটাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবে তখন বুঝবি। কোন কাজেরই তো হতে পারলি না। নবাবজাদা আবার ডালভাত দেখে নাক কুচকাচ্ছে।’
তিশান ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
‘ ভুল হয়ে গেছে। আর বলব না, মাফ চাই। তবুও খাওয়ার সময় মাথা নষ্ট করোনা আমার। রোজ রোজ ভালোলাগেনা এসব আর।’
আমেনা আর কিছু বলল না। তিশান কোনরকম খেয়ে উঠে বেড়িয়ে গেল। আমেনার সাথে রোজই একদফা কথা কাটাকাটি হয় ওর। ঝগড়ার মূল বিষয় হল তিশানের চাকরি। কিন্তু ছেলেটারও দোষ কী? চেষ্টাতো কম করছে না ও? কিন্তু আজকাল চাকরির বাজারে যোগ্যতার চেয়ে পকেটের ভারটাই বেশি প্রাধান্য পায়। সেটা আমেনাকে কীভাবে বোঝাবে? আর বিসিএস এ টেকার জন্যেও পড়াশোনায় যথেষ্ট সময় দিতে হয়। কিন্তু সেই সময়টা কই?
ইদ্রিস মাদবরের বাড়ির গেইটের সামনে গিয়ে তিশান দেখল যে মহুয়া ওখানে দাঁড়িয়ে পাইচারী করছে আর বারবার হাত ঘড়ির দিকে দেখছে। তিশান এগিয়ে গেল মহুয়ার দিকে। মহুয়া তিশানকে দেখে নিজেও এসে বলল,
‘ যাক এলে তাহলে। আমিতো ভেবেছিলাম আসবেনা?’
তিশান হেসে দিয়ে বলল,
‘ সারারাত ঘুমাও নি না-কি? মনে হচ্ছে যাবে বলে এখানেই বসে ছিলে?’
মহুয়া মুখ গোমড়া করে বলল,
‘ আরে না। আসলে এখানে ঘুমাতে প্রবলেম হচ্ছে খুব। নিউইয়র্ক এর সাথে এখানকার টাইম ডিফারেন্স অনেক তো। তাই এডজাস্ট করতে সমস্যা হচ্ছে।’
‘ আচ্ছা চল।’
তিশান আর মহুয়া পাশাপাশি হাটতে শুরু করল। মাটির রাস্তা আর রাস্তার দুপাশ দিয়ে বড় বড় গাছ। সম্পূর্ণ মন ভালো করার মত পরিবেশ। আর মহুয়া তো আগে এসব দেখেনি। তাই ওর অনেক বেশি ভালো লাগছে। মহুয়া চারপাশ দেখছে আর ওর ক্যামেরায় ছবি তুলছে। ছবি তুলতে তুলতে মহুয়া বলল,
‘ আজ কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
তিশান এতক্ষণ মহুয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিল। এই সামান্য জিনিসে এতো আনন্দ মন কাড়ছিল ওর। কিন্তু মহুয়ার ডাকে ওর হুশ ফিরল। ও নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
‘ কালতো ক্ষেত ঘুরে দেখেছো। আজ গ্রামের রাস্তাগুলোই দেখাই? রাস্তার আশপাশ দিয়ে অনেককিছুই দেখতে পাবে। আসলে বিকেলে আমাকে আবার পড়াতে যেতে হবে তো তাই__’
‘ কোন সমস্যা নেই। আমি তো এখানেই আছি আস্তে আস্তে সব দেখব।’
এরপর ওরা গ্রামের রাস্তাগুলো দিয়েই অনেকক্ষণ হাটাহাটি করলো। মহুয়া প্রচুর ছবি তুলছে। কারণ এরকম পরিবেশের সাথে ও খুব একটা পরিচিত নয়। আর তিশান পকেটে হাত রেখে হাটছে আর মহুয়ার অপরিচিত জিনিসগুলোকে ভালোভাবে চিনিয়ে দিচ্ছে। মহুয়া ছবি তুলতে তুলতেই বলল,
‘ তুমি কী রেগুলার টিউশন করাও?’
‘ হ্যাঁ। বেকার ছেলে। সংসার তো চালাতে হবে?’
‘ কে বলেছে তুমি বেকার? ছাত্র পড়ানোটাও একটা কাজ। আই থিংক চাকরির চেয়েও সম্মানের কাজ। টাকা হয়তো কিছুটা কম পাওয়া যায়। কিন্তু তারমানে এটা নয় ছেলেটা বেকার।’
‘ সবাইতো বেকারই বলে।’
‘ সবাই কী বলে আই ডোন্ট কেয়ার। আমার পয়েন্ট অফ ভিউ দিয়ে দেখলে তুমি কাজ করছ। ইন ফ্যাক্ট যথেষ্ট সম্মানের কাজ করছ।’
তিশান মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মহুয়ার দিকে। মেয়েটার বলা এই কথাগুলো যেনো ওর হৃদয়ে গিয়ে স্পর্শ করল। ভালোলাগা নামক অনুভূতিটা যেন মনকে আরো আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল। মহুয়া তাকিয়ে দেখল তিশান মহুয়ার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। মহুয়া ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে? তিশানও মাথা নেড়ে বোঝালো কিছুই না। মহুয়া বলল,
‘ এখানে কোথাও রেস্টুরেন্ট নেই? খিদে পেয়েছে খুব।’
‘ এসব এলাকায় রেষ্টুরেন্ট পাবেনা। তবে বাজারের দিকে আছে ছোট একটা। কিন্তু খুব দূরে। আজ যাওয়া যাবেনা। সামনে একটা হাই স্কুল আছে। ওখানে ফুচকা, চটপটি, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম সবই পাওয়া যায়। কিন্তু তুমি ওসব খাবে?’
‘ কেন খাবোনা? এগুলো মানুষ খায়না?’
তিশান হেসে ফেলল মহুয়ায় কথায়। তারপর হাতের ইশারায় রাস্তা দেখিয়ে বলল,
‘ চল!’
স্কুলে গিয়ে মহুয়া সব দেখে বলল ও ঝালমুড়ি খাবে। কারণ ফুচকা আগে খেলেও কখনও ঝালমুড়ি খায়নি। কিন্তু ঝালমুড়ি খেতে গিয়ে ঝালে মহুয়ার অবস্থা নাজেহাল। সেটা দেখে তিশানের সে-কি হাসি। হাসতে হাসতে খেয়াল করল যে ঝালে অস্হির অবস্থাতেও মহুয়াকে খুব সুন্দর লাগে। কিন্তু হঠাৎ এটাও খেয়াল করল যে মহুয়া ওর দিকেই দেখছে।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছে। তিশান মহুয়াকে নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বেড় হয়। আশেপাশের গ্রাম, বিভিন্ন সবজির ক্ষেত, ইটভাটা, নদীর বিভিন্ন পার, কলাবাগান, কাঠবাগান সবকিছুই একটু একটু করে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে মহুয়াকে। আর এই ছোট ছোট জিনিসগুলো দেখে মহুয়া কতটা খুশি হতো তা ভাবার বাহিরে। আস্তে আস্তে ওদের দুজনের মধ্যে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মহুয়ারতো তিশানের সাথে খুব ভালোভাবে মিশে গেছিল। যেন খুব পুরোনো বন্ধু। প্রথমে মহুয়ার পরিবার এটা পছন্দ করত না। কিন্তু মহুয়ার আবদারও ফেলতে পারত না। কিন্তু যখন দেখল যে তিশান নিয়ম করে মহুয়াকে বাড়ি এসে নিয়ে যাচ্ছে আবার নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছে। আর মহুয়াও ভীষণ খুশি। তখন আর তারা আপত্তি করেনি। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিল তিশান মহুয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছিল। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে তা বাড়ছিল। তিশান বুঝতে পারত এর ফল ভালো হবেনা। কিন্তু মনের ওপর কী নিয়ন্ত্রণ চলে? একদিন মহুয়া বায়না করে বসল যে নদীর মাঝের ঐ চরে যাবে দেখতে। তিশান অনেক কষ্টে নৌকা জোগাড় করে মহুয়াকে নিয়ে গেছিল ওখানে। কিন্তু ওখানে পৌঁছতেই আবার বৃষ্টি নামে। সেদিন মহুয়া আর তিশান আবার একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছিল। তিশানের সেদিন বৃষ্টি মোটেও অসহ্য লাগেনি। বরং ভালো লাগছিল। সেদিনই তিশানের অনুভূতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বুঝতে পারে প্রেমে পরে গেছে মহুয়ার? কিন্তু মহুয়া? তার মনে কী চলছে?
সেদিন বাড়ি ফিরে তিশান নিজেই নিজেকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করে যে মহুয়ার মত মেয়ের সাথে ওর কোনভাবেই যায়না। বিলাশবহুল অট্টালিকায় যে মেয়ে বড় হয়েছে সে এই টিনের চৌচালা ঘরে কীকরে থাকবে? তাছাড়া ও বেকার। মহুয়াকে দুবেলা ঠিকভাবে খাওয়ানোর যোগ্যতাও নেই ওর। কিন্তু ভালোবাসা? ভালোবাসা কী এসবের কাছে মূল্যহীন? যদি মহুয়ার মনেও এরকম অনুভূতি বাসা বেঁধে থাকে? ও কী পারবেনা এখানে মানিয়ে নিতে? কিন্তু যদি মহুয়া পারেও ওর পরিবার কী মেনে নেবে? এরকম মনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। দেখতে দেখতে একটা মাস পার হয়ে গেল।
তিশান আর মহুয়া নদীর পারে ঘাসের ওপর বসে আছে। দুজনেই চুপচাপ। তিশান একটু পরপর নদীতে ঢিল ছুড়ছে। বেশ লম্বা সময়ের নিরবতার পর মহুয়া বলল,
‘ আমি সামনের শুক্রবার ফিরে যাবো?’
কথাটা শুনে তিশানের ভেতরে কেমন যেন করে উঠল অদ্ভুত অস্হিরতা কাজ করছে ওর ভেতর। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
‘ ওহ।’
‘ মিস করবে আমাকে?’
তিশান অবাক দৃষ্টিতে তাকাল মহুয়ার দিকে। আজ মহুয়ার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল। মহুয়া তাকাতেই তিশান চোখ সরিয়ে হাতের নখ দেখতে দেখতে বলল,
‘ এতোদিন একসঙ্গে ছিলাম। মিসতো একটু করবই।’
‘ কিছু বলার নেই আমায়?’
তিশান আবার অবাক হল। কিন্তু কোন উত্তর দিলোনা। মহুয়া হঠাৎই একটা অদ্ভুত কাজ করল। তিশানের হাতের ওপর নিজের হাত রাখল। তিশান ভ্রু কুচকে তাকাল মহুয়ার দিকে। মহুয়া একটা মলিন হাসি দিয়ে বলল,
‘ আমি কিন্তু খুব মিস করব তোমাকে।’
__
রাতের বেলায় গভীর ভাবনায় মজে আছে তিশান। আজকে কেন জানিনা ওর মনে হচ্ছিল মহুয়ার ব্যবহার স্বাভাবিক না। আচ্ছা মহুয়াও কিছু অনুভব করে ওর জন্যে ? কিন্তু এটা কী সম্ভব? এতদিনে এমনিতেই অনেক দ্বিধাগ্রস্ত ছিল ওর মন। কিন্তু আজ তা আরও বেড়ে গেল। রাত প্রায় দু’টো পর্যন্ত অনেক ভেবে ঠিক করল, ও ওর মনের কথা মহুয়াকে জানাবে। এরপর যা হওয়ার হবে। অন্তত আফসোস তো থাকবেনা যে ও মহুয়াকে বলেই নি। এতোদিন সাহস না হলেও আজ মহুয়ার আচরণ কিছুটা সাহস জুগিয়েছে ওর মনে। তিশান উঠে বসে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে একটা খাতা নিলো। একটা ভালো দেখে পৃষ্ঠা ছিড়ে খাতার ওপর রেখে লিখতে শুরু করল,
‘ প্রিয় মহু,
মহু! হ্যাঁ এই নামটাতে তোমাকে ডাকার বরাবরই খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ডাকার সাহস করে উঠতে পারিনি। কারণ এভাবে ভালোবেসে ডাকতে শুধু কাছের মানুষগুলোই পারে। কিন্তু আমি হয়তো সেই দলে পরার যোগ্য নই। তাই অনেক চেষ্টা করেছিলাম আমার মনে অনিচ্ছাকৃত জাগা অনুভূতিকে মুছে ফেলতে। কিন্তু পারিনি। সময়ের সাথে সাথে এই অনুভূতি আরও গাঢ় হয়েছে। তোমার আর আমার মধ্যকার এতো পার্থক্য দেখিয়েও, এতো যুক্তি দিয়েও মনকে মানাতে পারিনি। উল্টে মন অামাকে বোঝালো যে ভালোবাসতে তো কোন যোগ্যতার প্রয়োজন পরেনা। শুধু প্রয়োজন পরে ভালোবাসার। আচ্ছা? তুমিও কী তাই ভাবো? হয়তো এই চিঠিটা পড়ার পর তুমি আমার সম্পর্কে অনেক খারাপ ধারণা পোষণ করবে। কিন্তু বিশ্বাস কর, এই চিঠির একটা বাক্যও মিথ্যা নয়। এক বৃষ্টিভেজা দুপুরে তুমি আমার জীবনে এসছিলে। আমি বৃষ্টি মোটেও পছন্দ করতাম না। কিন্তু সেদিনের পর থেকে বৃষ্টি ভালো লাগতে শুরু করল। তার সাথে তোমাকেও। আরেক বৃষ্টি ভেজা দুপুরে সেই ভালোলাগা আরও তীব্র রূপ ধারণ করল। হয়তো সেটাইকেই ভালোবাসা বলে। কিন্তু নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছিলাম। নিজের অনুভূতিকেও দমিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। জোর করে মনকে মানাতে চেয়েছিলাম যে আমি তোমার যোগ্য না। কিন্তু মনের ওপর তো কারো জোর চলেনা, তাইনা? আমারও চলল না। তোমাকে বলতে চাইনি এসব। ভেবেছিলাম মনেই রেখে দেব কথাগুলো। কিন্তু এখন নিজেকে আটকানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। পারলাম না নিজের অনুভূতিকে দমিয়ে রাখতে। সাধারণ মানুষ তো, তাই। সামনাসামনি বলার সাহস আমার নেই। তাই চিঠি লিখছি। আমি জানিনা এটা পড়ে তুমি কী করবে। আমাকে ফিরিয়ে দেবে নাকি একটা সুযোগ দেবে। সে যাই হোক, কিন্তু আমি নিজের মনকে এটা বলে সান্ত্বনা দিতে পারব যে আমি তোমাকে নিজের মনের কথা বলে দিয়েছি। শুধু এইটুকু অনুরোধ এই চিঠিটা পাওয়ার পর তুমি সেটাই করবে যেটা তোমার মন বলবে। আমি শুধু তোমার কাছে তোমার হাত চাইতে পারি। তুমি নিজের হাত বাড়িয়ে দেবে কি-না সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তোমার।
তিশান।’
মনে যা এসছে লিখে দিয়েছে ও। হয়তো লেখাগুলো বড্ড অগোছালো। স্বাভাবিক, প্রথম প্রেমপত্র তো। একটু হেসে কাগজটা যত্ন করে ভাজ করে রেখে দিল তিশান। কাল এটা মহুয়াকে দেবে। আচ্ছা মহুয়া কী ভাববে চিঠিটা পড়ে? লজ্জায় ওর গাল দুটো কী লাল হয়ে উঠবে? ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফুটে উঠবে? চোখ বন্ধ করে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরবে? নাকি রাগে চোখ লালচে হয়ে উঠবে? চিঠিটা দুমড়ে_মুচড়ে ফেলে দেবে মাটিতে? কী করবে সে? কেমন প্রতিক্রিয়া হবে তাঁর? এসব নানারকম চিন্তা করতে করতেই একটা নির্ঘুম রাত কেটে গেল তিশানের।
পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে একটু তাড়াতাড়ি উঠল তিশান। আজও প্রথমদিনের মত সকাল সকাল গোসল করে, ওর কাছে থাকা সবচেয়ে ভালো জামাটা পরে নিল। এরপর ভাজ কর রাখা সেই চিঠিটায় খুব যত্নে একবার হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বুক পকেটে রেখে, না খেয়েই বেড়িয়ে পরল তিশান। আমেনা বেশ কয়েকবার পেছন থেকে ডেকেছে ওকে খেয়ে যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তিশান শুনেও শোনেনি। ওকেতো আজ ওর মহুর কাছে যেতে হবে, নিজের মনের কথাটা জানাতে হবে তাঁকে। ইদ্রিস মাদবরের বাড়ির সামনে গিয়ে অনেকটা অবাক হল ও। কারণ গেইটের কাছে বড় বড় দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তিশান ভ্রু কুচকে ফেলল তা দেখে। আস্তে আস্তে গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখল সবাই রেডি হয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে, আর একটা একটা করে লাগেজ গাড়িতে তুলছে। মহুয়াও রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখমুখ গম্ভীর হয়ে আছে। এসব দেখে হালকা চমকে উঠল তিশান। আজ কী মহুয়া চলে যাবে এখান থেকে? কিন্তু ওর যে অনেককিছু বলার আছে এখনো মহুয়াকে। না বলা অনেক কথাই তো রয়ে গেছে তিশানের মনে। সেগুলোর কী হবে? তিশানকে দেখে মহুয়া মুচকি হাসল। এরপর এগিয়ে তিশানের সামনে এসে বলল,
‘ ভালো হয়েছে তুমি এসছো। আসলে আমি আজই ফিরে যাচ্ছি।’
তিশানের হৃদপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করল কথাটা। ও কম্পিত কন্ঠে বলল,
‘ কিন্তু তোমার তো দুদিন পর যাওয়ার কথা ছিলো তাইনা?’
‘ হ্যাঁ কিন্তু আজই যেতে হবে।’
‘ আমাকে ফোন করে জানাতে পারতে তো।’
ফোনের কথা উঠতেই মহুয়ার চোখ-মুখ আবার বিষণ্ন হয়ে উঠল। ও কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে রাখল। ইজহার খান একটু কাছে দাঁড়িয়েই ওদের কথা শুনছিলেন। সে আরেকটু কাছে এসে তিশানের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বললেন,
‘ আসলে মহুয়ার বিয়ের ডেটটা এগিয়ে এসছে তো। তাই আরকি তাড়াতাড়ি যেতে হবে। মহুয়ার উড বি আজ নিজে নিতে এসছে আমাদের।’
তিশান বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে একবার মহুয়ার দিকে তাকাল। মহুয়ার চোখেমুখে কোন ভাবান্তর নেই। ও ওর লাগেজ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মহুয়ার আগে থেকে বিয়ে ঠিক ছিল? কই? ওকে তো বলেনি? যদিও ও মহুয়ার তেমন বিশেষ কেউ ছিলোনা যে নিজের সব কথাই ওর কাছে শেয়ার করবে। ইজহার পকেট থেকে কিছু টাকা বেড় করে তিশানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ এটা রেখে দাও। এতোদিন মহুকে নিয়ে ঘোরাফেরা করেছ। তার টিপস। আর শুনলাম তুমি এখনো বেকার। আমার কার্ড দিয়ে দিচ্ছি, তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রেখ। একটা ছোটখাটো চাকরি ধরিয়ে দেব।’
বলে পকেট থেকে কার্ড বেড় করতে নিলেই তিশান মুচকি হেসে ইজহারের হাত ধরে টাকাটা আবার তাঁর হাতে দিয়ে দিয়ে বলল,
‘ আপনার মেয়ে গ্রামের অতিথি হয়ে এসছিল। আমি শুধু ওকে একটু ঘুরিয়ে দেখিয়েছি সবটা। আমার নিজের ইচ্ছেতেই। এটা আমার জব না যে আমি এটার জন্যে টাকা নেব। আর রইল চাকরির কথা? কপালে থাকলে নিজের যোগ্যতায় ঠিক একটা চাকরি পেয়ে যাবো। তবে আপনার অনুগ্রহের জন্যে ধন্যবাদ স্যার।”
তিশানের এরকম উত্তরে হালকা অপমানিত বোধ করলেন ইজহার। তাই ওখান থেকে দূরে সরে দাঁড়াল গম্ভীর মুখ নিয়ে। এসব গরিব ছেলেপুলেকে ওনাদের মত বড়লোকরা টাকা ছুড়ে দেবে, তারা সেটা নিয়ে চুমু খেয়ে ওনাদের সালাম ঠুকবে। এটাই তো নিয়ম। এদের এতো ব্যক্তিত্ব কেন থাকবে? এরমধ্যেই বাড়ির ভেতর থেকে লম্বা করে একটা ছেলে বেড়িয়ে এলো। সুট-বুট পরে রেডি হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব উচ্চবংশের ছেলে। সবার তোষামোদ আর কথাবার্তায় তিশানের বুঝতে বাকি রইল না যে এটাই মহুয়ার হবু স্বামী। তবুও নিশ্চিত হতে মহুয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ ইনিই তোমার উড বি?’
মহুয়া একপলক সেই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বোঝাল হ্যাঁ। তিশান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ তোমাদের একসাথে ভীষণ মানাবে।’
মহুয়া রিক্ত দৃষ্টিতে তাকাল তিশানের দিকে। কিন্তু কিছুই বলল না। তিশানের কেমন সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করল। দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। আচ্ছা এখানে তো খুব অস্বাভাবিক কিছুই হচ্ছেনা। মহুয়ার বিয়ে আগে থেকে ঠিক থাকতেই পারে। আর মহুয়ার মত মেয়েদের বিয়ে তো এরকম ছেলেদের সাথেই হবে। এই অতি স্বাভাবিক বিষয়টাও ওকে এতো কষ্ট কেন দিচ্ছে? ভেতরটাকে এভাবে কেন পোড়াচ্ছে? মনের যে হাজারো অনুভূতি মেশানো কথা জমা ছিল তা আজ মনেই রয়ে যাবে? না বলা কথাগুলো আজ না বলাই থেকে যাবে?
এরমধ্যেই সবাই একে একে গাড়িতে উঠতে শুরু করে দিল। মহুয়ার ডাক পরতেই মহুয়া তিশানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ আসছি, ভালো থেকো।’
তিশান কিছুই বলল না। শুধু একটা মলিন হাসি দিল। মহুয়া গাড়ির দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে তিশানের বুকের ব্যথাটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নিশ্বাসও ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। ও নিচের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে আবার গাড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পেল মহুয়া গাড়িতে বসে কাঁদছে। তিশান কিছু বুঝতে পারার আগেই গাড়ি দুটো একে একে ওর সামনে দিয়ে চলে গেল। ও একদৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইল সেদিকে। কিন্তু মহুয়া কাঁদছিল কেন? এরপর ভাবল হয়তো নানা-নানীকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না তাই। মাথার চুলগুলো উল্টে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তিশান। এই মুহূর্তে কান্নাটা খুব দরকার ছিল নিজেকে হালকা করার জন্য। কিন্তু কান্নাও আসছেনা। কিছুক্ষণ পর আবারও আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হল। তিশানের আবার বৃষ্টিকে অসহ্য লাগতে শুরু করল। বৃষ্টি কেন হচ্ছে এখন? কী দরকার? কর্দমাক্ত রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে হাটতে হাটতে বাড়িতে ফিরে গেল তিশান। বাড়ি ফেরার পর আমেনা ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
‘ আজ আবার ভিজে এসছিস? আমাকে কী তোর চাকর পেয়েছিস? দিনে দু-তিনবার তোর কাপড় ধুতে থাকব শুধু?’
কিন্তু তিশান কোন উত্তর না দিয়ে ভেতরে গিয়ে শার্ট খুলে ফেলল। তখনই পকেট থেকে নিচে পরল সেই চিঠিটা। তিশান চিঠিটা হাতে তুলে দেখল ভিজে চুবচবে হয়ে গেছে। ফেলে দিতে গিয়েও ফেলতে পারল না ও। খুব যত্ন করে বিছানায় মেলে দিল শুকানোর জন্যে। এরপর একটা গামছা নিয়ে বাইরে গিয়ে গোসল করে নিল। ওদিকে আমেনা তো রোজকার মত তিশানের ওপর চিৎকার করেই যাচ্ছে। কিন্তু তিশান কোন উত্তর না দিয়ে নিজের রুমটায় চলে গেল। আমেনার এবার টনক নড়ল। তিশানতো এভাবে চুপ করে থাকেনা। সবসময় মুখেমুখে উত্তর দিয়ে দেয়। আজ কী হল ছেলেটার? সে গিয়ে দেখল তিশান চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে। আমেনা গিয়ে বিছানায় তিশানের পাশে বসে বলল,
‘ কী হয়েছে কী? খাবার নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব? খেয়ে একটু উদ্ধার কর আমায়!’
কিন্তু আমেনাকে অবাক করে দিয়ে তিশান ধীর কন্ঠে বলল,
‘ মা, তোমার কোলে মাথা রেখে শুই?’
আমেনার বুক কেঁপে উঠল। ছেলে তাঁর এর আগে এরকম বায়না কখনও করনি। সে দ্রুত তিশানের মাথায় হাত রেখে দেখল ওর গা গরম। আমেনা উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
‘ জ্বর এসছে তো? কতবার তোকে বলেছি এভাবে ভিজিস না। কিন্তু আমার কথা আর কেন শুনবি? আমি কী মানুষ না-কি?’
তিশান আমেনার কোলে মাথা দিয়ে গুটিয়ে শুয়ে পরল। আমেনার চোখ ভিজে উঠল ছেলের এমন অবস্থা দেখে। নিশ্চয়ই আজ কেউ কিছু বলেছে। সে তিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
‘ আজ আবার কেউ কিছু বলেছে তাইনা? তুই এদের কথা কানে তুলিস কেন? ওরা কী জানে তোর ভবিষ্যত? একদিনেই কী সবাই ওপরে উঠে যায় না-কি? দেখিস খুব তাড়াতাড়ি তোর চাকরি হয়ে যাবে। একদিন বড় অাফিশ্যার হবি তুই। আমি বলছি। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আল্লাহর কাছে যে দোয়া করি। মায়ের দোয়া কবুল হবেনা? অবশ্যি হবে। তুই একদম মন খারাপ করবি না।’
তিশান চোখ বন্ধ করে রেখেছে। বন্ধ চোখ দিয়ে ধীর গতিতে জল গড়িয়ে পরছে। আমেনা চোখ মুছতে মুছতে দেখলেন খাটে একটা ভেজা কাগজ বেছানো। তিনি তিশানকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ এটা কীসের কাগজ রে বাবা?’
তিশান চোখ না খুলেই দুর্বল গলায় বলল,
‘ কিছুনা মা। একটা চিঠি, না দেওয়া চিঠি।’
সমাপ্ত