বানিজ্য মেলায় একটা মাইক্রো ওভেনের দোকানে ঢুকেছি। দোকানের কর্মচারী বলল, স্যার আমাদের আখেরি অফার চলছে।
আমি বললাম, আখেরী অফার আবার কী রে! বানিজ্য মেলার পর তোরা মালিক কর্মচারী সব মরে যাবি?
ছেলেটা বলল, না স্যার। একটা মাইক্রো ওভেন কিনলে আরও দশটা আইটেম ফ্রী। এটাই শেষ সুযোগ। আমরা সারা মেলায় মাত্র পাঁচটা ওভেন বিক্রি করবো। অলরেডি চারটা বিক্রি হয়ে গেছে। আপনি শেষ ভাগ্যবান কাস্টমার!
বউ আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, দেখলা, ভাগ্যে থাকলে কী হয়? তুমি তো আসতে চাও নাই,,,
টিভি দেখছি।
বউ কাছে এসে খুবই মিষ্টি মধুর, আদুরে গলায় বলল, এই শোন,আমার একটা কথা রাখবে?
বউ যখন মিষ্টি করে কথা বলে, তখন খুবই আতংকে থাকি। না জানি কোন দিক দিয়ে বিপদ আসে। এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। যেকোন সময় দশ নাম্বার বিপদ সংকেত আসতে পারে।
আমি বললাম, বউয়ের কথা শোনে না এমন স্বামী আল্লাহর দুনিয়ায় এখনো খুব বেশি পয়দা হয় নাই। হয়তো লাখে এক দুই পিস হইতে পারে। কাহিনী বল।
বউ অভিমানী গলায় বলল, সেই লাখে একটাই হইছো তুমি। তুমি আমার কোন কথাই শোন না! তুমি আমাকে তো মানুষই মনে করো না! আমার কথার কোন দাম আছে তোমার কাছে?
শেষ কথাটা বলার সময় নাক নিয়ে একটা সুর করল। গলা দিয়ে হ্যাঁচকির মত একটা টান দিল।
বুঝে গেলাম,নিশ্চিত আমার মানিব্যাগের স্বাস্থ্য আজকে আরও পুষ্টিহীন করার মতলব আঁটছে।
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল।
আমি বললাম, সিনেমার ডায়লগ বাদ দিয়ে সংক্ষেপে কাহিনী বল। মুখে মাখার জন্য আলতা ময়দা লাগবে? কত লাগবে? আমি কিন্তু মার্কেটে যেতে পারবো না। যে হারে তোমার আলতা ময়দার বাজেট বাড়ছে, সে হারে যদি তোমার বুদ্ধিটা বাড়তো!
বউ আহ্লাদী গলায় বলল, তোমার কি ধারণা আমি সারাক্ষণ আলতা ময়দা নিয়ে ব্যস্ত থাকি? তোমাকে মার্কেটে যেতে হবে না। বানিজ্য মেলা চল।গতকাল সুমি ভাবি বানিজ্য মেলা গেল,আমরা না গেলে মান থাকবে?লোকজন আমাদের কিপ্টা মনে করবে না? তাছাড়া গত দুই বছর তো আমরা যাইনি! এবার আমি একটা নতুন মাইক্রো ওভেন কিনবো। আগেরটা নষ্ট হয়ে গেছে।
বলাবাহুল্য, সুমি ভাবি আমাদের পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া।
আমি বললাম, গত দুই বছর বাণিজ্য মেলা যাইনি, কারন করোনার কারনে বানিজ্যমেলা বন্ধ ছিল। নইলে প্রতি বছরই যাও। এবার যাবো না। চাঁন্দের দেশে নিয়ে যেতে বল নিয়ে যাবো। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বা ড্রোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দেখা করতে চাও? তাতেও সমস্যা নাই, শুধু বানিজ্য মেলা বাদ। মানুষের গাদাগাদি ভালো লাগে না। ওখানে কোন সুস্থ মানুষ যায়?
বউ বিরক্ত গলায় বলল, ফালতু অজুহাত দিবে না। ভীড় হইছে তো সমস্যা কী? লোকজন যাচ্ছে না? সবাই তোমার মতো ঘরে চুড়ি পরে বসে আছে?
আমি করুন গলায় বললাম, যা-ই বল বউ, লাইফের উপর রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। চাঁদে জমি কিনে দিতে বল, দিব। ওখানে গিয়ে লাউ,কুমড়া চাষ কর। বানিজ্যমেলা গিয়ে লাভ আছে কিছু? ফালতু!
কথা শেষ করে টিভি দেখায় মন দিলাম এবং বউয়ের কথা ভুলে গেলাম।
কিছুক্ষণ পর হেঁচকির মত একটা আওয়াজ পেলাম, কে যেন হেঁচকি দিয়ে কাঁদছে। তাকিয়ে দেখি বউ! একের পর এক নাক দিয়ে সেচ প্রকল্প চলছে।
আমি উঠে গিয়ে তার পিঠে হাত রাখলাম। সে এক হ্যাঁচকায় আমার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, এই খবরদার! আমার গায়ে হাত দিবা না, আমি যারেতারে আমার গায়ে হাত দিতে দেই না!
আমি বললাম, লে হাুলুয়া! নিজের বউয়ের গায়েও হাত দিতে পারবো না!
সে কান্নার স্পিরিট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, না। আজ থেকে আমি তোমার বউ না।
ওকে ডান। আজ থেকে তাহলে তুমি আমার শালী। ঠিক আছে?
না, ঠিক নাই। তোমার মতো এতো খারাপ মানুষ জীবনে দেখি নাই। আমি বলেই তোমার সংসার করে গেলাম, অন্য কেউ হলে,,,,, কথা শেষ না করেই কান্নার স্পিরিট আরও বাড়িয়ে দিল!
মানুষ এটম বোমাকেও জয় করতে পারে, চাঁদ সূর্যকেও এক রশিতে বাঁধতে পারে, বউয়ের চোখের জলের কাছে পরাজিত হয় নাই, এমন স্বামী দূনিয়ায় একটাও নাই।
অগত্যা আর কি করা! নিয়ে গেলাম বানিজ্য মেলা।
আমি বললাম, শুধু মাইক্রো ওভেন। অন্য কিছুর দিকে ফিরেও তাকাবা না। মনে থাকবে?
বউ বালিকা বধূর মত মিষ্টি করে করে বলল, ওকে, ডান।
মেলায় বিভিন্ন অফার চলছে। সব জিনিসই নাকি ওরা খুব সস্তায় দিচ্ছে। ধামাকা অফার,শেষ অফার, গোল্ডেন অফার, আখেরী অফার,ধুমধড়ক্কা অফার!
ওদের অফারের বহর দেখলে মনে হয়,বাড়িঘর বিক্রি করে হলেও ওদের পন্য কিনি।
বউ ফিসফিস করে বলল, মেলায় আমার সাথে আসার কারনেই শেষ ভাগ্যবান কাস্টমার হতে পারলা। এমন ভাগ্য কয়জনের হয়? দেখলে বানিজ্য মেলায় কত সুবিধা! একটা ওভেন কিনলে সাথে দশটা আইটেম ফ্রী দিবে। ভাবতেই ভালো লাগছে। আহা!বানিজ্যমেলা সারা বছর জুড়ে কেন যে হয় না!!
বউ আমার কিছুটা সহজ সরল টাইপ শ্রেণীর। যা শোনে সবই বিশ্বাস করে।
আমি বললাম,ভাই, কি কি আইটেম ফ্রী পাচ্ছি?
কর্মচারী বলল, স্যার, বহু কিছু ফ্রী পাবেন। পানির জার,ব্লেন্ডার, ইস্ত্রি, কড়াই,ব্যাগ, জগ মগ,গ্লাস,কলম, ফ্লাস্ক হাঁড়ি পাতিল অনেক কিছু। যেসব মাল পাচ্ছেন এগুলো বাংলা বা চায়না মাল নয়। মেইড ইন ইতালি!
বউ আমার কানে কানে বলল,বাহ! আমাদের তাহলে আর কিছু কিনতে হচ্ছে না। তাড়াতাড়ি কিনে ফেল, না হলে কেউ এসে নিয়ে যাবে। শুনছো না এটাই শেষ? ইতালির পন্য বলে কথা!
আমি বললাম, দূর! এই ব্যাটারা আমার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় নয় যে সব কিছু ফ্রী দিয়ে দিবে। নিশ্চয়ই কাহিনী আছে। আমার শ্বশুরই আমাকে বিয়ের সময় বাংলা এবং চায়না মালের সাথে তোমার মতো ময়দা সুন্দরি গছিয়ে দিয়েছে, এই ব্যাটারা দিবে ইতালির মাল! ছ্যা ছ্যা!!
বউ কিছুক্ষণ আমার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার সব কিছুতেই খালি সন্দেহ!
আমি ওভেন দেখতে চাইলাম। কর্মচারী ওভেন দেখালো। আমি বললাম, দাম কতো ভাই?
বত্রিশ হাজার পাঁচ,শ টাকা।
আমি আঁতকে উঠলাম। গত সপ্তাহে শো রুমে SONY কোম্পানির মাইক্রো ওভেন দেখেছিলাম। সেইম ওভেন ওদের PRICE লেখা দেখলাম ষোল হাজার টাকা। এখানে চাইছে বত্রিশ হাজার পাঁচ,শ টাকা!
তাহলে কাহিনী এই? এই হচ্ছে আখেরি অফারের নমুনা?
আমি বউকে জোর করে বাইরে বের করে আনলাম। বউ আমার গাধামি দেখে রাগে গজগজ করতে লাগলো।
তার ধারণা আমি আখেরী অফারের মতো বিরাট অফার মিস করলাম!
মেয়েদের কাপড়ের দোকানে গোল্ডেন অফার চলছে। বউ দোকানে ঢুকলো আমি চা খাওয়ার জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো তিন সেট সালোয়ার কামিজ নিয়ে। গোল্ডেন অফারে একটা কিনলে দুইটা ফ্রী!
একটার দাম দিয়ে তিনটা পেয়েছে। মানুষ খুশিতে আটখানা হয়, সে নয়খানা হয়ে আছে।
আমি কাপড়ে হাত দিয়ে দেখি একেবারে ত্যানা ত্যানা টাইপ। আমি নিশ্চিত এই মাল সে একদিনের বেশি পরবে না।
কিছুক্ষণ হাঁটাহাটি করার পর আমার ওয়াসরুমে যাওয়ার দরকার হলো। আমি বউকে দাঁড় করিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকলাম। প্রচুর ভীড়। লাইন ধরে যেতে হচ্ছে। ফিরে এসে দেখি বউ আমার জন্য একটা ব্লেজার কিনেছে ধামাকা অফারে!
আমি আসা মাত্র জোর করে পরিয়ে দিয়ে বলল, একেবারে ফাইন হয়েছে। সস্তায় পেয়ে গেছি। ওদের ধামাকা অফার চলছে।
আমি বললাম, দাম কতো?
বউ খুশিতে গদগদ হয়ে বলল, বাইশ শো টাকা নিয়েছে। সস্তা না?
আমি বললাম, মোটেই সস্তা না। এই মাল বায়তুল মোকাররম মার্কেটে এক হাজার থেকে বার,শ টাকায় পাওয়া যায়।
বউ অবাক হয়ে বলল, বল কি? ওরা যে বলল, ধামাকা অফার!!
পেটে টান পড়েছে, খিদেটা ভালোই লেগেছে। মিল্কশেক আমার খুব প্রিয়।বউ এই চিজ খাবে না। সে বলল, মদ গাঁজা খেতে বল খাবো,এই আবোল তাবোল জিনিস খাবো না!
দুধ মিল্কশেক খেতে গিয়ে মনে হলো শুধু দুধের সাথে জাস্ট হরলিক্স মিশিয়ে দিয়েছে। এখানেও জোচ্চুরি!
বিরানি আমার বউয়ের প্রিয় খাবার। আমারও
হাজী বিরানি দোকানের অভাব নাই। কোনটা আসল কোনটা নকল, আল্লাহ মালুম! একটা দেখলাম অরিজিনাল হাজীর বিরানি লেখা। বউ বলল, চল অরিজিনাল হাজীর বিরানি খাই।
আমি বললাম, অরিজিনাল হাজীর বিরানি যেহেতু লিখেছে,ধরে নিতে হবে এটা আসল হাজী নয়, নকল হাজী। এটা অরিজিনাল নকল!
বউ বলল,তোমার খালি সবকিছুতেই সন্দেহ!
আরেকটা পেলাম, আদি হাজির বিরানি দোকান! এই আদি হাজি বেটা যে কে,অনেক খুঁজেও তা বের করতে পারলাম না!!
নান্না বিরানি দোকান দেখলাম কয়েকটা। এক দোকানের নাম দেখলাম আরও সরস। হাজী নান্না বিরানি দোকান! হাজী এবং নান্নার মিলিত ফসল!
বউ একটা ব্যাগ কিনলো এক হাজার টাকা দিয়ে। বাইরে বের হয়ে দেখি সেই ব্যাগ ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে ছয়,শ টাকায়।
বউ তিন সেট সালোয়ার কামিজ কিনেছে বারো,শ টাকায়। সেই জিনিস ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস তিন,শ করে!
SONY শো রুমে ঢুকে একটা মাইক্রো ওভেন কিনলাম ষোল হাজার টাকা দিয়ে।
বউ অবাক হয়ে বলল, হায় হায়! ওরা তাহলে কি অফার দেয়? ওরা তো বিশ্ব চিটার!!
আমি বললাম, আরও অফারের ফাঁদে পা দিবা?
বউ কান ধরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, মাথা খারাপ!
হানিফ_ওয়াহিদ