মধ্যবিত্ত ফেসবুক স্ট্যাটাস
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে একটা চমৎকার ট্রেডিশন হল মেহমানদের জন্য নিজের খাট বা রুম ছেড়ে দেয়া। এটা অবশ্য পুরোপুরিই সম্পর্কের আন্তরিকতার উপর নির্ভরশীল।
অনেকে হয়ত দূর সম্পর্কের আত্মীয় কিংবা কোন বন্ধুর জন্যে নিজের মাস্টার বেডটাও ছেড়ে দেন। হয়ত অন্য রুমগুলোতে এটাচ বাথরুমের সুবিধাটুকু নেই। হয়ত টিভি আর অন্যান্য সুযোগ সুবিধাগুলোগুলোও নেই। আবার আন্তরিকতার অভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারো জন্য হয়ত অনেকে ছাড়েন না।
এসময় পরিবারের সদস্যরা কিছুটা সমস্যায় পড়লেও হাসিমুখেই এসব বিড়ম্বনা মেনে নেন। হয়ত অন্যান্য রুমের ছোট খাটে গাদাগাদি করে থাকেন নইলে ড্রইং-ডাইনিং রুমের মেঝেতে চাদর আর বালিশসহ বিছানা পেতে মশার কামড় খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার সন্তানদের কাউকে কাউকে হয়ত গোপনে রাতটা থাকার জন্য অন্য বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
আবার হয়ত কোন ধনী আত্মীয় বেড়াতে এসেছেন। উনাদের তো বেশী কষ্ট করার অভ্যাস নেই। তাই বিশেষ বিবেচনায় নিজেরা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে হলেও উনাদের সর্বোচ্চ সুবিধাটুকু দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও দেখা যায়, এই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো যখন সেইসব ধনী আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যায়, তখন রুম বা খাট ছেড়ে দেয়া দূরে থাকুক, ডাইনিং টেবিলেও দেখাশুনা করে গৃহকর্মীরা।
আবার নতুন প্রজন্মে এই ত্যাগ স্বীকার গুলো দিন দিন কমে আসছে। এর প্রধান কারণগুলো হল পরিবার ছোট হয়ে যাওয়া, নিজেদের প্রাইভেসি নিয়ে জীবনযাপন, শেয়ারিং এর অনভ্যাস, সামাজিকতা কমে যাওয়া, মানুষ মানুষকে না চেনা ইত্যাদি। এসব কারণে পরিবারগুলোর সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি তৈরি হয়। তাই ইদানিং অনেকে কারো বাসায় দূরে থাকুক বরং হোটেলে গিয়ে উঠেন।
রাতে অবস্থান করা মেহমানদের জন্য নিয়মিত ভাল মেনু আয়োজন করতে গিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কিছুটা বিব্রত হলেও যে কোন ভাবেই হোক ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। হয়ত মাসের শেষ, কিছুটা হাতটান আছে। তবুও সঞ্চয় ভেঙ্গে নইলে ধারদেনা করে হলেও প্রতি বেলা টেবিলে ভাল-মন্দের আয়োজন করা হয়।
কারণ, চক্ষু লজ্জা আর মান-সম্মান হল মধ্যবিত্তের অলংকার। আর তারা সবকিছু অবলীলায় বিসর্জন দিলেও এসব বিসর্জন দেয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।
আবার মেহমান চলে যাবার পর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে টেবিলে পড়ে থাকা নাস্তাগুলো সন্তানদের আকর্ষণ এর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
এমন নয় যে, প্রতিদিন বাসায় নাস্তা তৈরি হয় না। কিন্তু প্রচুর যোগ বিয়োগ করে পুরো মাস চলা পরিবারগুলোতে প্রতিদিন নাস্তার মধ্যে বিলাসিতা দেখানোর সুযোগ থাকে না।
তাই হয়ত চা এর সাথে বিস্কুট, নুডুলস, সিঙারা, সমুচা, ফিরনি, ঝালমুড়ি, চানাচুর ইত্যাদি একটা দুইটা করে ঘুরে ফিরে টেবিলে আসে। মায়েদের মুড ভাল থাকলে বড়জোর হালুয়া, পায়েস, ক্ষীর, পুডিং কিংবা কোন ঝাল নাস্তা তৈরি হয়, তাও এক বেলায় একপদের বেশী নয়।
কিন্তু মেহমান আসবে বললেই, বাসায় কিছুটা সাজ সাজ রব পড়ে যায়। সোফার কুশন, টেবিল ক্লথ কিংবা ফার্নিচারের সাজসজ্জাও কিছুটা হয়ত বদলে যায়। বাসা ঝাড়ু, মোছা করে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়।
আমন্ত্রিত মেহমানরা মধ্যবিত্ত পরিবারেই সবচেয়ে বেশী আন্তরিকতা আর ভালবাসার সাথে আপ্যায়িত হয়ে থাকে। হ্যাঁ, ধনীদের মত দামী আইটেম হয়ত কম থাকে কিন্তু সেবাযত্ন সেই ঘাটতি অনায়াসে পূরণ করে দেয়।
এখন রেডিমেড অনেক কিছুই পাওয়া যায়। ফ্রোজেন আইটেম এনে ভেজে দেয়া যায়, ঝাল-মিষ্টি অনেক কিছুই সহজলভ্য। আমাদের শৈশব কৈশোরে সবই বানাতে হত। মা, বড় বোন বা দাদীদের তৈরি সেই নাস্তাগুলো যেন অনেক বেশী সুস্বাদু আর মুখরোচকও ছিল।
প্রতিবারই মেহমানদের জন্য বাসায় তৈরি হয় বেশ কয়েক পদের বিশেষ ধরনের নাস্তা। সন্তানদের কড়া ধমক দিয়ে বলে দেয়া হয়, যেন কেউ সাধলেও টেবিল হতে বেশী না খায়। মেহমানদের কুলালে তারপর দুই একটা খেয়ে দেখতে পারবে।
আর যদি কোন মেহমান সব খাবার প্রায় সাবাড় করে দিতেন, তখন মেহমান যাবার পর সন্তানরা সবাই মিলে তার গুষ্টি উদ্ধার করত।
– এ কেমন মেহমান কিচ্ছু রাখে নাই, মনে হয় যেন জীবনে কোনকিছু খায় নাই!!
সাধারণত সন্তানরা এক আধটু চেখে দেখার পর হতেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে কখন মেহমানরা বিদায় নিবে। এই অপেক্ষা শেষ হওয়া মাত্র, মা এসে টেবিল দখলে নেয়ার আগেই সন্তানরা বিন্দুমাত্র দেরী না করে টেবিলের সেই বেঁচে যাওয়া নাস্তাগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে….।
কখনো কখনো বাবা কিংবা অন্য সদস্যরাও সন্তানদের সাথে এই ভাগাভাগিতে অংশ নেয়। আর মায়েদের দেখা যায়, কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে পরিতৃপ্তির হাসি হাসছেন।
# মধ্যবিত্তের মেহমানদারি
Atique Ua Khan