অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ৩১
শুক্রবারের দিন। মাসখানেক পর সেদিন পরিপূর্ণ ঘুম হল আমার। সাররাতের লম্বা ঘুম দিয়ে সকালে উঠে দেখলাম সাড়ে ন’টা বাজে। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। তবুও উঠলাম না। সেদিন বৃষ্টিবিলাসী সত্তার ঘুমবিলাসী হতে ইচ্ছে হলো। অলসতার চাদরে নিজেকে জড়িয়ে আবার বন্ধ করে ফেলেলাম চোখজোড়া। উঠলাম প্রায় বারোটায়।
তাতেই ক্ষান্ত হইনি। আবারও ঘুমানোর উদ্দেশ্যে শুয়ে পড়লাম বিকেলের দিকে। তবে তখন আর গভীর ঘুম এলোনা। নিদ্রা আর জাগরণের মধ্যভাগে বিচরণ করল মস্তিষ্ক। এমন আলস্য আর ঘুমের কারণ শুক্রবার মোটেও নয়। সেইসময় আমার কাছে শুক্রবার আর বাকি অন্যসব দিনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। সবটাই বন্ধের দিন। লোকে বলে মন ভালো থাকলে নাকি ঘুম ভালো হয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল বোধ হয়। দীর্ঘ প্রায় একটা মাস দিশেহারা পাখির মতো উড়তে উড়তে যখন নীড়ের সন্ধান পেলাম। তখনই বোধহয় চোখ জুড়ে ক্লান্তির ঘুম নেমে এলো। সুখ আর তৃপ্তির ক্লান্তি।
অর্ধঘুমে থেকেই গতদিন বিকেলের কাঠবাগানের মুহূর্তগুলো মনে কড়া নাড়ছিল। সেই গভীর বাদামি চোখের সম্মোহনী দৃষ্টি, বাকা দাঁতের হাসি, হৃদয় কাঁপানো বাক্য, শুষ্ক গোলাপি ঠোঁটের স্পর্শ, সাদা জবা ফুল। সেই শীতল স্মৃতির কোমল মেঘে যেন ভেসে বেড়াচ্ছিলাম আমি।
চুলে নরম আঙুলের স্পর্শ পেতেই নিদ্রভঙ্গ হল আমার। চোখ বন্ধ রেখেই বোঝার চেষ্টা করলাম স্পর্শটা সত্যি না-কি ভ্রম। যখন বুঝলাম সত্যি সত্যিই কেউ আমার চুলে আঙুল বুলাচ্ছে, আস্তে আস্তে চোখ খুললাম আমি। দেখলাম আমার বেডের কর্ণারে বসে আছে জাবিন। ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। চোখে খেলা করছে দুষ্টুমি। আমাকে চাইতে দেখে বলল, ‘গুড মর্নিং অনিপু!’
এইমুহূর্তে ওকে এখানে দেখে এমনিতেই অবাক হয়েছি আমি। তারওপর মর্নিং বলাতে ভ্রু কোঁচকালাম। কুনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে বসতে বসতে বললাম, ‘মর্নিং?’
জাবিন চমৎকার ঝলমলে হাসি দিয়ে বলল, ‘তুমিইতো বলো, ঘুম থেকে উঠলেই মর্নিং।’
আমি হেসে ফেললাম। এলো খোলা চুলগুলোকে ওপরে তুলে কাঠি দিয়ে বললাম, ‘কেমন আছো বলো?’
জাবিন হাত দিয়ে আমার সামনের ছোট করে ছাটা চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল, ‘আমিতো ভালো আছি। বন্ধ ছিল তাই বাবার সঙ্গে চলে এসেছি। ভাবলাম তোমাদের সঙ্গে দেখা করে যাই।’
‘ভালো করেছো। খেয়েছো কিছু?’
‘আন্টি শরবত আর কী কী যেন দিয়েছিল। শরবতটা খেয়ে চলে এসেছি।’
‘কফি?’
‘মন্দ হয়না।’
আমি হেসে বিছানা থেকে নামলাম। তখনই কাব্য রুমে এসে ঢুকলো। দু হাতে দুটো কফির মগ। ওকে দেখে আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘রুমে ঢুকতে গেলে নক করে ঢুকতে হয়। এইটুকু কার্টেসী নেই? বেয়াদব!’
কাব্য আমার টেবিলে ‘ঠাস’ করে কফির মগদুটো রেখে বলল, ‘আম্মু তোর কফি আমাকে দিয়ে পাঠায় ক্যান? নিজের জিনিস নিজেরই আনতে হয়। এইটুকু কার্টেসী নেই? আলসের ঢেঁকি।’
আমি বোকার মতো দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ধমকের সুরে বললাম, ‘বিদায় হ। কাব্বা-ডাব্বা কোথাকার!’
বিচ্ছুটা বিদায় হল ঠিকই। সঙ্গে বলে গেল ‘সত্যি কথা ফোসকা পড়ার মতোই হয়।’
আমি ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে লম্বা শ্বাস ফেললাম। কফির মগদুটো নিয়ে জাবিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হাসছে। আমিও হাসলাম। কফির মগটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ড্রয়ার থেকে চানাচুরের বক্সটাও বের করলাম। কফি আর চানাচুরের সঙ্গে কিছু সময় ভালোই গল্প চলল দুজনের। কথায় কথায় বললাম, ‘সারা এলোনা কেন?’
‘প্রাইভেট পড়া আছে ওর। পরীক্ষা আছেতো।’
‘তোমারওতো সামনে এইচএসসি। প্রিপারেশন কেমন?’
‘বাড়িতে অমন দজ্জাল থাকতে প্রিপারেশন ঠিকঠাক না হয়ে উপায় আছে? বড্ড খাটায় অনিপু।’ অসহায় গলায় বলল জাবিন।
আমি হেসে কফির মগে চুমুক দিলাম। জাবিন বলল, ‘কাকে আর কী বলছি? তোমারতো হোম টিউটর সে। নিশ্চয়ই জানো কী পরিমাণে প্যারা দেয়?’
আমি সহাস্যে বললাম, ‘অমন একটা বড়ভাই থাকলে আমি বনবাস নিতাম।’
জাবিনের উদাস চেহারা আরও উদাস হল। হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তে চোখমুখ ঝলমল করে উঠল ওর। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল, ‘আরেহ্! ভাইয়ার কথায় মনে পড়ল। তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।’
বলেই পাশ থেকে ওর ব্যাগটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থেকে বোঝায় চেষ্টা করছি এই মেয়ে আসলে কী করতে চাইছে। জাবিন ব্যাগ থেকে মোচড়ানো তিনটা কাগজ বের করে রাখল বিছানার ওপর। আমি সেগুলোর দিকে দু সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘কী এগুলো?’
জাবিন ভ্রু দিয়ে কাগজগুলোর দিকে ইশারা করে বলল, ‘খুলে দেখো।’
আমি সন্দিহান মন নিয়ে একটা কাগজ খুললাম। জাবিনের দিকে একবার তাকিয়ে পড়তে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পড়ার পরেই চোখ বড়বড় হয়ে গেল আমার। ওভাবেই তাকালাম জাবিনের দিকে। জাবিন ঠোঁট চেপে হাসছে। কিছু বলব তার আগেই চোখের ইশারায় বলল, বাকি কাগজগুলো খুলে দেখার জন্যে। আমি খুললাম। বাকি কাগজদুটো পড়েও আমি থম মেরে গেলাম। হাসব নাকি কাঁদব ঠিক করে উঠতে পারলাম না। তিনটে চিরকুট জুড়েই আদ্রিয়ান ভাইয়ের প্রতি প্রেম এদের উতলে পড়ছে। বোকা চোখে জাবিনের দিকে তাকাতেই জাবিন অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ল। ওকে এভাবে হাসতে দেখে আমি ভ্রু কুচকে বললাম, ‘তুমি হাসছো? তোমার ভাই এসব করে বেরায় আর তুমি কি-না হাসছো!’
জাবিন কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, ‘ভাইয়ার কী দোষ বলো? গতকাল ভাইয়া রাতে বাড়ি ফেরেনি। সকালে খালা ভাইয়ার ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে ব্যলকনিতে পেয়েছে। ভাইয়ার ব্যালকনির সামনেই রাস্তা। ওখান থেকেই মেয়েগুলো কাগজগুলো ছোড়ে বোধ হয়।’
‘ছোড়ে? তারমানে এসব আরও আগেও হয়েছে?’ অবাক কন্ঠে বললাম আমি।
‘তাইতো মনে হচ্ছে। প্রতিদিনই ভাইয়ার ঝুড়িতে এরকম মোড়ানো দু তিনটে করে কাগজ পাওয়া যায়। এতোদিনতো ভাবতাম পড়াশোনা করে হয়তো ওয়েস্ট পেপারগুলো ফেলে। এখনতো দেখছি অন্য কেইস। আম্মু আর সারাতো এগুলো পড়ে হাসতে হাসতে অস্থির।’
আমি কাগজ তিনটে সরিয়ে রাখতে রাখতে বললাম, ‘ভালোইতো এদের মধ্যে একজনকে ভাবি বানিয়ে ফেলো। ঝামেলা শেষ। তবে বাকি হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এই যা আফসোস!’
‘লাইক কাঁচের গ্লাস।’ বলে হেসে ফেলল জাবিন। আমিও হাসলাম। জাবিন বলল, ‘তবে বিয়ের কথা আর বলোনা বোন। সেই তান্ডব দেখার সখ আর কারোর নেই। ভালোয় ভালোয় ইউকে ফিরে যাক। পিএইচডি করে ফিরুক। তারপর দেখা যাবে।’
আমি কিছু বললাম না। গালে হাত দিয়ে অলস ভঙ্গিতে একবার তাকালাম মুড়িয়ে রাখা কাগজগুলোর দিকে। তখনই আমাকে চমকে দিয়ে জাবিন বলে উঠল, ‘এই অনিপু! তোমার এই ব্রেসলেটটা না আমি ভাইয়ার রুমে দেখেছিলাম।’
চমকে উঠলাম আমি। নিজের বাঁ হাতের দিকে একবার তাকিয়ে ইতস্তত করে বললাম, ‘এইটা?’
‘হ্যাঁ, এটাইতো।’
‘এটাতো আমার। অন্যটা দেখেছো হয়তো তুমি।’
‘আরেহ্ না। একদম সেইম ডিজাইন। এরকমই কালো, আর ‘এ’ অ্যালফাবেট ঝোলানো। ভাইয়ার টেবিলে দেখেছিলাম আমি। ওর ছবির ফ্রেমের ওপর ঝুলিয়ে রাখা ছিল।’
আমি কোনরকমে বললাম, ‘কিন্তু এটাতো আমার। ওখানে কীকরে যাবে বলো?’
‘তাও ঠিক।’ বলে কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তাহলে কী গার্লফ্রেন্ডের জন্যে কিনেছে না-কি? আর তোমার সঙ্গে হুবহু মিলে গেল কীকরে?’
আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘আমি কী জানি?’
জাবিন বিজ্ঞ ব্যক্তির মতো মাথা নাড়ল। যেন অনেক কিছু বুঝে গেছে। মনে মনে হাঁফ ছাড়লাম আমি। আর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে ঝাড়লাম। ওপেনলি নিজের ছবির ওপর এটা ঝুলিয়ে রাখার কী ছিল? জাবিন বলল, ‘ভাইয়াতো আবার রবিবার আসবে তোমাকে পড়াতে তাইনা?’
হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম আমি। আর মনে পড়ল একগাদা ম্যাথ ধরিয়ে দিয়ে গেছেন সে। অথচ আমার কিছুই করা হয়নি। সন্ধ্যার পরপরই বসতে হবে ওগুলো নিয়ে।
সেদিন বিকেলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে তবেই প্রস্থান করল জাবিন। বিদায়ের সময় মানিক আঙ্কেলের সঙ্গেও কথা বললাম। প্রতিবারের মতো আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, ‘আম্মু’ ডেকে যেতে ভোলেন নি উনি।
সন্ধ্যায় ফিজিক্সের অঙ্ক করতে বসলাম ঠিকই। কিন্তু অঙ্কে বিন্দুমাত্র মন বসাতে পারলাম না। বারবার চোখ যাচ্ছিল সেই মুড়িয়ে রাখা কাগজগুলোর দিকে। রাগ হচ্ছিলো কি-না বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু মোটেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। স্থির হয়ে বসাটাই দায় হচ্ছিলো। বারবার শুধু মাথায় ঘুরছিল, এরকমও হয়? সত্যি সত্যিই হয়? সিরিয়াসলি! কই আগে কখনও তো এমন কিছু দেখিনি? মানছি ছেলে দেখতে মাশাআল্লাহ্। পার্সোনালিটিও হাই। তাই বলে এভাবে জেঁকে ধরার কী আছে ভাই! সত্যিই কী চিরকুটে যেভাবে লিখেছে সেভাবেই অবসার্ভ করে ওরা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে? কেন ভাই? কী দরকার? সিনেমা পেয়েছে না-কি? এতোসব সিনেম্যাটিক ব্যাপারস্যাপার দেখে লাইফটাকেই সাক্ষাৎ সিনেমা মনে হচ্ছে।
সিনেম্যাটিক লাইফে গালি দিতে দিতে আরেকটা সিনেম্যাটিক ব্যপার ঘটে গেল। বেজে উঠল মুঠোফোন। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম আনভীর ভাইয়ার কল। অবাক হলাম। সেই রাতে ছাদের কথোপকথনের পর আর ফোনকল করেন নি উনি আমায়। করার কথাও না। এসব ফোনটা রিসিভ করে সালাম দিলাম। সালামের জবাব দিয়ে উনি বললেন, ‘কেমন আছো, কন্ঠসুন্দরী?’
ওনার গলায় এই ডাকটা শুনে খানিকটা অস্বস্তিবোধ করলাম আমি। তবুও বললাম, ‘ভালো। আপনি?
‘আছি।’
‘কোন দরকার ছিল, ভাইয়া?’
‘দরকার ছাড়া কল করতে পারিনা?’
‘আমার জানামতে, না।’
আমার সোজাসাপ্টা রুক্ষ জবাব শুনে হয়তো অপ্রস্তুত হলেন উনি। আমার প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘সরি বলার ছিল। আগেই বলব ভাবছিলাম। কিন্তু ঐ ঘটনার পরপরই মেডিকেল চলে আসতে হলো। আর পরপর পরীক্ষার প্রেশারে আর কথা বলার সুযোগ করে উঠতে পারিনি আমি। মেডিকেলের প্রেশারটা বোঝইতো।’
ব্যপারটা বুঝলাম না আমি। বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললাম, ‘তা বুঝি। কিন্তু সরি কেন?’
আবারও কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন উনি। বললেন, ‘সেদিন রাতে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম আমি।’
‘ভুল? আপনি কী প্রপোজ করার ব্যপারটা নিয়ে বলছেন? কিন্তু সেসবতো চুখে গেছে।’
‘ব্যপারটা তা না।’
বিরক্ত হলাম আমি। যা বলার সোজাসুজি বলছেনা কেন? নাটকবাজি! তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললাম, ‘তাহলে?’
আনভীর ভাই আরও কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেন। অবশেষে বললেন, ‘আসলে তোমাকে প্রপোজ করার আগে আমি দোলা ওদের বলে রেখেছিলাম যে করব। আর আমি যখন তোমার সঙ্গে কথা বলছিলাম দূর থেকে ওরা দেখছিল।’
‘হ্যাঁ তো?’
‘ওরা পরে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে তুমি কী বললে। কিন্তু_’
ব্যপারটা কিছুটা অনুমান করে ফেললাম আমি। তবুও প্রশ্নমাখা কন্ঠে বললাম, ‘কিন্তু?’
‘ওদের আমি বলতে পারিনি যে তুমি না করে দিয়েছো। তবে বিশ্বাস করো আমি এটাও বলিনি যে তুমি হ্যাঁ বলেছো। জাস্ট প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়েছিলাম। আর ওরা ভেবে নিয়েছিল যে তুমি হ্যাঁ বলেছো। আর ওরা ব্যপারটা নিয়ে অনেকের সঙ্গে আলোচনা করে ফেলেছে।’
এইটুকু বলে থেমে গেলেন উনি। ঠিক যেভাবে নিজের অপরাধ স্বীকার শেষে মানুষ নিশ্চুপ হয়ে যায় সেভাবেই। আমি কিছু বললাম না। আসলে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু রাগ হচ্ছিলো ভীষণ। কখন ভীষণ রাগে খাতাটা খামচে ধরেছি আমি জানিনা। আনভীর ভাইয়া নরম গলায় বললেন, ‘আ’ম সো সরি অনি। আমি জানতাম না ওরা এমন করবে। তবে আমি ব্যপারটা জানার সঙ্গে সঙ্গে ওদের সবটা ক্লিয়ার করে দিয়েছি।’
আমি আরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে থমথমে গলায় বললাম, ‘আমি আপনাকে বলেছিলাম, রিজেকশনাটাও প্রোপজ করার মতোই স্বাভাবিক। সেটা মানতে না পারাটাই অস্বাভাবিক। যাই হোক, রাখছি তাহলে।’
আনভীর ভাই হন্তদন্ত হয়ে বললেন, ‘আরেকটা কথা।’
‘আবার কী?’
‘আদ্রিয়ান দিয়েছে তোমাকে তোমার ব্রেসলেটটা?’
আমি অবাক হলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘আপনি কীকরে জানলেন?’
‘ছাড়ো এসব। আমি সত্যিই সরি অনিমা।’ অনুনয়ের স্বরে বললেন আনভীর ভাইয়া।
আমি বললাম, ‘ভুলে যাচ্ছি। তবে ভবিষ্যতে এমনটা করবেন না বলেই আশা রাখছি। আমার এখন পড়া আছে ভাইয়া রাখতে হবে। আল্লাহ্ হাফেজ।’
উনি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আল্লাহ্ হাফেজ।’
ফোন কেটে বিরক্তির শ্বাস ফেললাম আমি। সবরকমের উট্কো ঝামেলা আমার ভাগ্যে এসেই জোটে। একজনকে উডবি ডক্টরের মাথা এতোটা নিরেট হয়? নাকি ইচ্ছে করে করেছে এসব? আর ব্রেসলেটের কথা কী বলছিল?
মস্তিষ্কে জ্ব/লে ওঠা রাগের মধ্যেই হঠাৎ মনে পড় আদ্রিয়ান ভাইয়ের কথা। তারমানে ওনার হঠাৎ অমনভাবে রেগে ওঠার অন্যান্য কারণের মধ্যে এটাও আরেকটা কারণ? দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে।
দোলা আপুর কথা ভাবলাম। কী বাঁশটাই না দিল মেয়েটা আমায়। দু-দিন একটা ছেলেকে দেখেই এতোটা ডেস্পারেট হয়ে গেল যে এসব পাঠাল তাকে এটেনশন পাওয়ার জন্যে। অন্যের মেয়ের আর কী দোষ দিচ্ছি। আমার নিজের ফুপাতো বোনই তো আরেক পাগল। সব পাগলের মেলা বোধ হয় শরীয়তপুরেই লেগেছে। মোড়ানো চিরকুটগুলোর দিকে চোখ পড়তেই হাসি পেল আমার। মারাত্মক হাসি। কলির কেষ্ট! আসুক রবিবার।
–
‘প্রিয় আদ্রিয়ান ভাই,
আপনি এখন আর সকালে ব্যালকনিতে আসেন না কেন? কতবার চিঠিতে বলেছি আমি সাড়ে ছ’টায় এই রাস্তা দিয়ে যাই প্রাইভেট পড়তে। ঐসময়টাতে এখন আর ব্যয়াম করতে আসেন না কেন? আগেতো আসতেন। কতদিন দেখিনা আপনাকে। চিঠিগুলো পড়েন কি-না সেটাও জানিনা। আপনি জানেন? আপনি যখন স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে ওখানে ওয়ার্কআউট করতেন, কটা হার্টবিট মিস করতাম আমি? ইচ্ছে করতো_’
এইটুকু পড়ে থেমে গেলেন আদ্রিয়ান ভাই। সামান্য গলা ঝাড়লেন। তার সেই বিখ্যাত ভঙ্গিতে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমি সঙ্গে সঙ্গে চোখ-মুখ ভীষণ স্বাভাবিক করে ফেললাম। টেবিলে দুই হাত রাখা। একটার ওপর আরেকটা। দু হাতের আঙ্গুলগুলো তবলা বাজানোর ভঙ্গিতে টেবিলে ওঠানামা করছিল। উনি তাকাতেই থেমে গেছে তারা। উনি ভ্রুদয় কুঁচকে আবার কাগজটায় চোখ দিলেন। আর সেই সঙ্গে আবার ঠোঁট চেপে হাসা শুরু করলাম আমি। আঙুলগুলোও নিজের কাজ শুরু করল। পারছিনা ‘হু হা’ করে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে। উনি আবার পড়তে শুরু করলেন,
‘সামনেই আমার এইচএসসি পরীক্ষা। এরপর আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন তো?’
থেমে গিয়ে আবার আমার দিকে তাকালেন উনি। আমিও ভীষণ সিরিয়াস হওয়ার ভান করে বললাম, ‘পাঠাবেন তো?’
উনি উত্তর দিলেন না। চিরকুটটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে আরেকটা চিরকুট খুললেন, ‘এইযে ক্রাশবয়! আপনি জানেন আমি না এবার সাইন্স নিয়েছি। শুধুমাত্র আপনি ইঞ্জিনিয়ার তাই। আপনার যা পছন্দ, আমারও তাই পছন্দ। কতবার আপনার নাম্বার চেয়েছি। দিলেনই না। তাই আমারটা নিন। কল করবেন কিন্তু। 01_’
স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওনার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। শেষ কাগজটা খুলে দেখলেন একটা কবিতা ছেপে দিয়েছে। যার একেকটা লাইন মুখে আনা দায়। উনি ঠোঁট উল্টে কাগজের টুকরোগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন আরেকবার। বিড়বিড় করে বললেন, ‘কারা এরা?’
‘গোপিস্।’ ব্যঙ্গ করে বললাম আমি।
উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথা থেকে ঝেপেছিস সেটা বল।’
‘আপনার ব্যালকনি থেকে তুলেছিল খালা। ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে। জাবিন নিয়ে এসেছে, আমায় দেখাবে বলে।’
উনি বিস্ময় নিয়ে বললেন, ‘পুঁটি পড়েছে এগুলো?’
আমি দেঁতো হেসে বললাম, ‘আপনার মাও পড়েছে।’
একপ্রকার বিষম খেলেন উনি। ভ্রু কুঁচকে তীব্র বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘মানসম্মানের ফালুদা করে দিচ্ছে এরা। বাড়ি গেলেই আম্মু পেছন লাগবে। শিওর! আর পুঁটি তোকে এগুলো দিয়েছে কোন সুখে? এমনতো না তুই এগুলো পড়ে হিংসার-দুঃখে ইহকাল ত্যাগ করবি বা আমায় ঝাড়বি। অমন নরমাল হিউম্যান অ্যাকশন, রিঅ্যাকশন, ইমোশন তোর কাছে এক্সপেক্টেড না।’
আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললাম, ‘আপনার তো ঈদ ঈদ ফিলিংস আসার কথা। কত দিওয়ানীর স্বপ্ন পুরুষ আপনি। তা রাতে ঘুম হয়?’
উনি স্কেলটা দিয়ে টেবিলে আঘাত করতেই আমি থতমত খেয়ে গিয়ে বললাম, ‘আরে ভাই রাগ করেন ক্যান? ভালো কথা জিজ্ঞেস করি। কবে থেকে চলে এসব?’
উনি কাগজগুলোর একটি দেখে নিয়ে বললেন, ‘আগে যদি জানতাম এমন ইঁচরেপাকা মেয়েগুলো ওখান দিয়ে পাস করে। ভুল করেও ঐসময় বারান্দায় ব্যয়াম করতে যেতাম না। ম্যাক্সিমাম দিন সকালে দুই তিনটে করে কাগজ ফেলতে হয়। এখন পড়েও দেখিনা এসব। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েগুলোর কীসব ভাষা! একটা সবে এইচএসসি দিয়েছে। আরেকটার কথায়তো মনে হল সবে নাইন। পড়াশোনা ছেড়ে এসব শিখছে! বলে কি-না বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে! একদিন গিয়ে কানের নিচে কয়েকটা দিলে ‘বাপ’ ডাকবে। ঠিক সময় বিয়ে করলে এদের মতো বাচ্চাকাচ্চা থাকতো আমার।’
আমি গালে হাত দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললাম, ‘তাই?’
উনি বোধ হয় টের পেলেন রাগের বশে কী বলছেন। তাই খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘অব্ অতোটাও না।’
আমি হাসি চেপে বললাম, ‘পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে পনেরো ষোল বছরের বাচ্চা! চমৎকার! বায়োলজিটা একদমই গিলে ফেলেছেন দেখছি?’
হঠাৎই জ্বলে উঠলেন উনি। ধমকে বলে উঠলেন, ‘ঐ! তোর সঙ্গে এখানে আড্ডা দিতে এসেছি আমি? খালি ফাঁকিবাজি! আমার সঙ্গে তর্ক করার ভয়ানক সাহস কে দিল তোকে?’
ধমক খেয়ে গাল ফোলালাম আমি। কিছুটা ভয় পেয়েছি বটে। বললাম, ‘পড়া শেষ হওয়ার পরেইতো এগুলো দেখালাম।’
উনি আরও তেঁতে উঠলেন। স্কেল তুলে ধরে বললেন, ‘পড়ার কোন শেষ নেই।’
আমি গাল ফুলিয়ে রেখেই বললাম, ‘সে না হয় নেই। কিন্তু মার খাওয়ার একটা বয়স থাকা উচিত। কুড়ি বছর হতে চলল আমার। আপনি এখনো কথায় কথায় স্কেল তোলেন আমার দিকে। এ কেমন অন্যায়?’
উনি চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘উইল ইউ প্লিজ শাট আপ?’
তখনই রান্নাঘর থেকে আম্মু হাঁক ছাড়ল, ‘আদ্রি? তোমার পড়ানো হলো? বিরিয়ানি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও বাবা। গরম গরম না খেলে ভালো লাগবে না।’
আসলে আজ বিকেলে না সকাল দশটার পরে পড়াতে এসেছেন আদ্রিয়ান ভাই। আম্মুই বলেছে এইসময় আসতে। আজ আমাদের বাড়িতে দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত তার। বাবাও তাই আজ বাড়িতে। দুজনের যা ভাব। খেতে বসলে এদের দুজনের আড্ডায় বাকিরা পাত্তাই পাবোনা আমরা।
আম্মুর ডাকে উঠে দাঁড়ালেন উনি। কাগজগুলো তিনটা একত্র করে বলের মতো বানিয়ে ছুড়ে মারলেন ঝুড়িতে। কিন্তু যাওয়ার সময়টাতেও ওনাকে বিরক্ত করার লোভটা সামাল দিতে পারলাম না আমি। তাই মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে এমন ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘একি করলেন! এতো প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ মিশিয়ে লেখা চিরকুটগুলো আবর্জনার মতো, আবর্জনার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন? কী নিষ্ঠুর আপনি আদ্রিয়ান ভাই! একটুও দয়ামায়া নেই আপনার?’
বলে আফসোসের ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে ‘চু’ ‘চু’ শব্দ করলাম আমি। কথাটা শুনে যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে গেলেন উনি। আমি আবার বললাম, ‘ওদের জন্যে সত্যিই কষ্ট হয়। একদম নির্দয় অপাত্রে অনুভূতি দান করছে।’
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব খেয়ে ফেলব টাইপ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। আমি বিশাল এক ধমকের পূর্ণ প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু আমায় অবাক করে দিয়ে উনি ধমক দিলেন না। বরং অদ্ভুত ধূর্ত হাসি ফোঁটালেন শুষ্ক, পাতলা ঠোঁটে। খলনায়ক ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। কিন্তু আমি নায়িকা ভঙ্গিতে পিছিয়ে যেতে পারলাম না। পা দুটো যেন জমে গেল জায়গাতে। টেবিলের সঙ্গে লেগে বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। আজ এতো অতিরিক্ত সাহস দেখানোর জন্যে নিজেই নিজেকে ভয়ানক কয়েকটা গা-লি দিতে শুরু করলাম। কিন্তু সেগুলো শেষ হওয়ার আগেই আমার দুপাশ দিয়ে টেবিলের ওপর দুহাত রাখলেন উনি। এতোটা কাছে আসাতে চোখ বুজে এলো আমার। দম বন্ধ করে ফেললাম। উনি ঝুঁকে একদম আমার কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘যদি আমি ওদের ওপর সদয় হওয়া শুরু করি। মায়াবিনীর সহ্য হবেতো?’
চোখ খুলে ফেললাম আমি। সরাসরি তাকালাম ওনার গভীর বাদামি চোখে। অদ্ভুত দৃষ্টি বিনিময় হল কয়েক সেকেন্ড। উনি হালকা একটা ফুঁ দিতেই আমি আবার চোখ বন্ধ করতে বাধ্য। কানে আবারও আম্মুর ডাক ভেসে এলো। উনি সরে গেছেন উপলব্ধি করে ধীরে ধীরে চোখ খুললাম আমি। ততক্ষণে চলে গেছেন উনি। নিজের অজান্তেই অনিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাস শুরু হল আমার। এতক্ষণ ব্যপারটা নিয়ে মজা করলেও হঠাৎই বোধ হয় ভয়ানক হিংসে হল আমার। প্রচন্ড রাগ হল। ঐ চিরকুটদাত্রী কন্যাত্রয়, দোলা আপু, নূর, অর্পা আপু আরও সবাইকে সেই রাগে ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে হল বুঝি। দুনিয়াতে ছেলেসংকট হয়েছে না-কি? দুর্ভিক্ষে ভুগছে এরা? আবার লিখেছে, ব্যয়াম করতে গিয়ে হার্টবিট মিস করেছে। হার্টের ডাক্তার দেখা গিয়ে! আর ঐ লোককেই বা সকাল সকাল স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বের হতে কে বলে? আচ্ছা ছেলেদের জন্যে বোরকা টাইপ কোন পোষাক হয়না? হওয়া উচিত!
আমার এসব উদ্ভট ভাবনায় ছেদ ঘটল ফোনের আওয়াজে। তাকিয়ে দেখি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ফোন রেখে গেছেন। স্কিনে ‘আম্মু’ লেখা। মানে মামণী। আমি কলটা রিসিভ করে সালাম দিলাম। মামণী সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আদ্রি কোথায়?’
‘ফ্রেশ হতে গেছে। আজ তোমার নবাবজাদাকে চিকেন বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াচ্ছে আম্মু। ভোজ চলবে ভোজ।’
মামণী হেসে দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা। এইজন্যই রাজি হয়েছে। চিকেন বিরিয়ানি ও না করেনা কখনও।’
‘রাক্ষস তো।’
‘মারব এক চর। আমার ছেলের খাওয়া নিয়ে কিছু বলবে না।’
‘আচ্ছা বললাম না। খাক তোমার ছেলে। তা তোমার সোনার গহনাগুলো কোথায় রাখো মামণি?’
‘কোথায় আবার? লকারে। কে বলোতো?’ অবাক কন্ঠে বললেন মামণী।
আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘তা মিসেস রত্নগর্ভা। নিজের রত্নটাকেও তো লকারে তুলে রাখতে পারো নাকি? এভাবে খোলা ছেড়ে দিচ্ছোতো দেখবে নজরে-কুনজরে তোমার ধরাচাঁদ কালাচাঁদ হয়ে যাবে। তখন আর মেয়ে খুঁজে পাবেনা। তোমার কুমার ছেলে চিরকুমার হয়ে যাবে। এখনো বলছি ঘরের জিনিস ঘরে আটকে রাখো। পরে কপাল চাপড়েও কাজ হবেনা।’
বলে ফোনটা কেটে দিয়ে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেললাম আমি। আর মনে মনে ভাবলাম, ঐ তালগাছ টাইপ সুঠাম শরীরটাকে তালা লাগানোর জন্যে সিন্দুকের আর্দশ সাইজ কত হতে পারে?
…
[ এই পর্বের আরও একটা পার্ট হবে। সেটা আগামী তিন চারদিনের মধ্যেই পাবেন।
এটার জন্যে মেসেজ, পোস্ট করে কাঁপিয়ে ফেলছিলেন সবাই। এবার পর্যাপ্ত রেসপন্স আর গঠনমূলক মন্তব্যও চাই।]