- অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
- অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা।
- শিক্ষার ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা।
- শিক্ষার মান উন্নয়নে মায়ের ভূমিকা।
1.অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য
japanKahini নাম্বার ওয়ান নাকি অনলি ওয়ান?
জাপানে দশ বছর আগেও আত্মহত্যার হার অনেক বেশি ছিল। দিনে ৯০ জন। বড় এক সামাজিক সমস্যা। সরকার সমস্যাকে লুকালেন না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাইলেন। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেন। এই দশ বছরে আত্মহত্যার হার দেড় গুণ কমে গেল। এখন দিনে ৬০ জনের মত। র্যাঙ্কিং এ ১২ নম্বরে আছে। ভারত ১১ নবরে। বাংলাদেশের কোন তথ্য নেই।
নব্বই সালের শেষের দিকে হঠাৎ করে চেইন রিএকশনের মত স্কুলের কয়েকজন ছাত্র আত্মহত্যা করে বসলো। সরকার সমস্যা লুকালেন না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাইলেন। কারণ বের করলেন।
বাংলাদেশে ইয়াং ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যা করে কেন? ব্যর্থ প্রেম, পরীক্ষার অসন্তোষ ফলাফল, বাবা মার কাছে আবদারে বিফল। আর কি কি কারণ আছে? এগুলো ঠেকানোর উপায় কি? কোন গবেষণা নিশ্চয়ই আছে। আত্মহত্যা বাড়ছে না কমছে তা জানতে ইচ্ছে করছে।
জাপানি ছাত্রদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ বের হলো। আঙ্গুল পড়লো স্কুলের ওপর। স্কুলের বুলিং। জাপানি ভাষায় বলে ইজিমে। শক্ত সবল বাচ্চাদের দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রদের ওপর অত্যাচার। ধমকানি, ভয় প্রদর্শন, ছোটখাট ঠোকাঠুকি এসব।
এই কাজটা ছোট বেলায় আমরা ও করেছি। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। শহর থেকে এক ছেলে এসে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হলো। ওর শুদ্ধভাবে বাংলা বলা আমাদের পছন্দ হলো না। ওকে গ্রামের ভাষার ওপর ট্রেইনিং দেয়া শুরু করলাম। এখলাসপুরি টোন না আসলেই মাইর। দেশি কুত্তা বিলাতি ডাক দিবি ক্যান? এজন্যই শাস্তি। কি আজিব চাইল্ড সাইকোলজি।
কুমিল্লা জিলা স্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। আমি গ্রাম থেকে আগত। কাউকেই চিনিনা। লাঞ্চ ব্রেকে বোম্বাশটিং (টেবিল টেনিস বল দিয়ে কে কাকে হিট করতে পারে) খেলছিলাম। মডার্ন স্কুল, মিশনারি স্কুল থেকে আগত ছেলেগুলো গ্রুপ করে ফেললো। আমি লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হলাম। দুইদিনে আমার পিঠ লাল করে ফেলল। বাসায় গিয়ে বলার সাহস পাইনি। গ্রামে আমরা মাটি ঢিলা, ডুম্বুর ঢিলা দিয়ে পাখি মেরেছি, ফল পেড়েছি। আমাদের স্কিল ন্যাচারাল। দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি আমার স্কিল প্রদর্শনের সুযোগ পেলাম। এক সিনিয়র ভাইয়ের কান ফাটিয়ে দিলাম। সবলের দলে স্থান পেয়ে গেলাম। কি আজিব চাইল্ড সাইকোলজি।
নবম শ্রেণিতে সিলেট পাইলট স্কুলে ভর্তি হলাম। সবাই সিলেটি ভাষায় কথা বলে। আমি শুদ্ধ ভাষায়। আমি সিলেটি জানিনা। আমার এখলাসপুরের কাহিনি মনে পড়ে গেল। ভয়ে নীল হয়ে থাকতাম। নাহ সিলেটি ছেলেগুলো অনেক ভদ্র। মাইর দিল না। একদিন শুধু স্যারের কাছে বিচার দিল, “স্যার ইগু শুদ্ধ মাতের”- এই ছেলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে।
বাচ্চাদের সাইকোলজির ওপর গবেষণা জাপানে কম হয়নি। প্রাইমারি স্কুলে পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করা হলো। এ সময়টা বাচ্চাদের ক্রিয়েটিভিটি প্রসার করার বয়স। প্রতিযোগিতা করার বয়স নয়। হাইস্কুল থেকে প্রতিযোগিতা আছে ঠিকই কিন্তু কে প্রথম হলো কে দ্বিতীয় হলো তা জানানো হয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ও তাই। আমরা বলে দেই না তোমার র্যাঙ্ক এতো। জানানো হয় বিচ্যুতি। গড় নম্বর থেকে তোমার স্কোর কত দুরে সেই মান। রাঙ্কিং জানানো হলে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের কনফিডেন্স লেভেল যেন কমে না যায় সে জন্যই এই নিয়ম।
তারপরে ও ছাত্ররা এই পড়াশুনার যুদ্ধ থেকে বের হতে পারছেনা। কোম্পানিগুলোতে অন্য এক ধরণের প্রতিযোগিতা। বেতন আর পজিশন বড় করা চাই। রাত দিন খেটে কেপিআই রিচ করো। এটাকে বলে Rat Race বা ইঁদুর দৌড়। আমেরিকান এক এক্সপার্ট বলেছিলেন, Even if you win a rate race, you are still a rat. ইন্দুর দোউড়াইস না রে মনু। ইন্দুর দৌড় দোউড়াইস না।
জাপান সরকার নতুন করে বিশেষজ্ঞদের ডাকলেন। স্কুলের বুলিং কিভাবে কমানো যায় – সে নিয়ে। বুলিং এর জন্য কতটুকু আর শাস্তি দেবেন? শুরু হলো সচেতনতা বৃদ্ধি প্রকল্প। কাকে সচেতন করবেন?
বুলিং এর শিকার যে হচ্ছে তাকে যেভাবে মানসিকভাবে এম্পাওয়ার করলেন, সেটা অভিনব।
খালেদা জিয়া স্টাইলে স্লোগান দিলেন –
শ্রেষ্ঠ হওয়া ভালো। তবে ইউনিক (অনন্য) হওয়া আরো ভালো।
সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি কাজ করে সেলিব্রেটিদের মুখের কথা। জাপানের জনপ্রিয় সঙ্গীত ব্যান্ড SMAP এর ডাক পড়লো। মাকিহারা নরিয়ুকি নামক একজন গায়কের লেখা একটি গান SMAP কে দিয়ে গাওয়ানো হলো। গানের টাইটেল ছিল –
সেকাই নি হিতোৎসু দাকে নো হানা (পৃথিবীতে একটিমাত্র অনন্য ফুল)
যে তথ্যটি দিতে চাইলেন তা হলো –
তোমার শ্রেষ্ঠ হবার দরকার নেই, তুমি ইউনিক হও।
নাম্বার ওয়ান হবার দরকার নেই, অনলি ওয়ান হও।
পৃথিবীর সমস্ত ফুলই সুন্দর।
কোন ফুল সবচেয়ে সুন্দর সেটা বিচার করার শক্তি মানবকুলের নেই। আপনার কাছে শাপলা ফুল সর্বশ্রেস্ট মনে হতে পারে কিন্তু রহিম ভাইয়ের কাছে শাপলা একটা সবজি।
ফলের রাজা আম না কাঁঠাল, মাছের রাজা ইলিশ না রুই
খাট-পালঙ্ক ছাইড়া দিয়া পাটি বিছাইয়া শুই
নজরুল নজরুল হিসাবে শ্রেষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হিসাবে শ্রেষ্ঠ- দুজনের মধ্যে তুলনায় যেও না।
বাচ্চাদেরকে শ্রেষ্ঠ বানানোর প্রতিযোগিতায় নামলেই ভুল করবেন। সে কোন বিষয়ে পারদর্শি – সেটাকে উৎসাহ দিন।
দুর্বলের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিল।
একটা শিশু হয়তো পড়াশুনায় ভালো না। কিন্তু খেলাধুলায় ভালো। খেলাধুলায় ভালো না। কিন্তু ভালো আর্ট করতে পারে। ভালো আর্ট করতে পারে না। কিন্তু ভাল গান গাইতে পারে। ভাল গান গাইতে পারে না কিন্তু ভালো রান্না করতে পারে। কত কত ইউনিক জিনিস বের হয়ে আসবে যেখানে শিশুরা আত্মতৃপ্তি পায়।
এই গানটা কাজে দিল। দুর্বলরা আত্মশক্তি ফিরে পেল। কিভাবে পরিমাপ করলো জানিনা। তবে ছাত্রদের আত্মহত্যার সংবাদ কমে গেল।
নিজে ও চিন্তা করছি। শ্রেষ্ঠ হওয়াটা কি আসলেই দরকার? এক নম্বর না হয়ে দশ নম্বর হলে ক্ষতি কি? আমি এমন কি জানি যা অন্য কেউ জানেনা। আমি এমন কি পারি যা অন্য কেউ পারে না। আমার মধ্যে এমন কি আছে যা অন্য কারোর নেই।
নাম্বার ওয়ান নয়, আপনার বাচ্চা কেন অনলি ওয়ান – সেটা বের করুন।
——
2.অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা
#সিরিয়াস টপিক
খুব বিরক্ত হয়ে এই লেখা লিখছি।লেখা টা অভিভাবক দের জন্যে।কেউ আমার উপরে রাগ করলেও কিছু করার নেই।
আমি সিংগেল প্যারেন্ট।কন্যার যখন বয়স ৭ বছর,তখন থেকেই আমি ওকে একা ই দেখি।এর আগেও অনেক টা ই একা ই বড় করছিলাম,কারণ,মেয়ে তাই।মেয়ে দের অনেক কিছুই বাবা রা বুঝবেনা,কেউ বুঝলেও অনেক সময় লজ্জায় বা আড়ষ্টতায় বুঝিয়ে বলতে পারেনা।
আমি কন্যা কে কোন সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে একাউন্ট খুলে দেইনি।আমি ফেসবুক ইউজ করি।আমার টুইটার একাউন্ট আছে,তাও ফলো করার জন্যে।আমার কোন পোস্ট নেই সেখানে।কন্যার অনেক ফ্রেন্ডের ফেসবুক আছে।এখন দিন দিন বাড়ছে সেটা।ও আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিলো,কারণ ক্লাসের টিচার রাই মেসেঞ্জারে গ্রুপ করেছেন ফর ডিস্কাশন।আমি আমার মেসেঞ্জার ই ইউজ করতে দিয়েছি।আর এমনিতেও ও আমার পাসওয়ার্ড জানে আগে থেকে।কিন্তু পারমিশন ছাড়া ইউজ করেনা কখনো।
কদিন আগে থেকে ও আমাকে বার বার বলছে ইন্সটাগ্রাম একাউন্ট খুলবে।আমার আছে যদিও,পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি আমি।উদ্ধার করে ভেতরে ঢুকতেই আমি অবাক।ওর অনেক ফ্রেন্ড দের একাউন্ট দেখলাম,তারা প্রচুর স্ট্যাটাস এবং ছবি দিচ্ছে।বলা বাহুল্য,সব কিছু তাদের বয়সের উপযোগী নয়।আমার মেয়ের সাথে কথা বলে এমন একজন “F” দিয়ে গালি ইউজ করার পরে আমি কন্যা কে ডেকে সাবধান করেছি,আমি তার মায়ের সাথে কথা বলবো।moreover they are sharing many personal matters of their parents.আমি সব ই জানি।কিন্তু বাকি অভিভাবক রা জানেন কি?এরা মেসেজ ও রাখেনা এখন।ভিডিওকলে কথা বলে।
আজকের এই যুগে এভাবে এই বয়সে বাচ্চা দের এই জগত টা একেবারে পুরোপুরি ওদের হাতে ছেড়ে দেওয়া কত টুকু যুক্তিযুক্ত?হয়তো বলবেন,আমি পাসোয়ার্ড জানি,মনিটর করি।কত টুকু পসিবল আসলে?ইন্সটাগ্রাম থেকে ছবি পাচার হয়ে যায়,বিভিন্ন সাইট থেকে চলে যায় চাইল্ড পর্ন সাইটে।আমি এদের আলোচনার টপিক্স জানি।কারণ,আমি আমার মেয়ের থেকে সব ই জেনে নেই।এবং ইদানীং ওকে বকা ও দিচ্ছি অনেক।যেটা আমি করিনা কখনো।
আমি বলছিনা,আমি মা হিসেবে পারফেক্ট।আমি একা সব কুলিয়ে উঠতে পারিনা।আর ওদের মধ্যে যা পরিবর্তন হচ্ছে,এই বয়সে খুব ই স্বাভাবিক।ওদের কে বুঝিয়ে বলতে হবে। ভুল করবে,শিখবে।কিন্তু যদি না শেখাই,কিভাবে শিখবে?
সময় টা ভালো নয়।আমি অনেক কিছু ঠেকে শিখেছি,তাই সিদূরে মেঘ দেখলে ডরাই…
অনলাইন ক্লাসের জেরে ওরা এখন প্রযুক্তি তে অনেক এডভান্সড।অনেক কিছুই জানতে চায়,খুঁজে বের করে ফেলে।আমি আপনি জানবো ও না।পাশে বসে থেকেও না।
ভুল বুঝবেন না।সতর্ক হোন।বাচ্চা দের একাউন্ট চেক করুন।গুগোল সার্চে প্রাইভেসি রাখুন।ইউ টিউবেও।অনেক সময় বাসায় কয়েক টা সেট -সিম থাকলে বাচ্চা রা একটা ইউজ করে।যদি মা বাসায় থাকেন,তাহলে আলাদা দেবার প্রয়োজন নেই।
সাবধান হতে তো ক্ষতি নেই।ভয়ংকর সময় আসছে আসলে।
বি দ্র:বহির্বিভাগে রোগী দেখার সময় ১৩-১৪ বছরের মেয়ে পেয়েছি,যারা অনলাইন ক্লাসের পর থেকে বিভিন্ন সাইটে ঢুকে গেছে বন্ধু দের সাথে কথা বলে।এখন ডিপ্রেশনের সাইন ডেভেলপ করেছে।আমি কাউন্সেলিং এর জন্য পাঠিয়েছি।
3.শিক্ষার ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা
এক্সকিউজ মি,
আপনি না সেই অভিভাবক, যিনি গত একবছর নাওয়া খাওয়া ভুলে মেয়েকে নিয়ে কোচিংএ কোচিংএ দৌড়াইছেন যেন আপনার মেয়েটা এই স্কুলে চান্স পায়?
আপনি না সেই অভিভাবক, যিনি ভোর ৬ টায় যেয়ে লাইন ধরছেন এই জাতীয় স্কুলের ফর্ম কেনার জন্য?
আপনি তো সেই অভিভাবক, যিনি আপনার বাচ্চাকে বলছিলেন এই স্কুলে চান্স না পেলে আমারে মুখ দেখাবি না।
আপনি না সেই অভিভাবক, যিনি বাচ্চা এসব স্কুলে চান্স পায় নাই বলে শোকে লজ্জায় ১ সপ্তাহ ঘর থেকে বের হন নাই?
আপনি তো সেই অভিভাবক, যে এলাকার এমপি/মন্ত্রীর সুপারিশের জন্য কত কিছু করছেন অন্তত মেয়েটাকে যেন এই স্কুলে নেয়!
আপনি না সেই অভিভাবক, যিনি বলেছিলেন আমার মেয়েটা ভর্তি করাক আমি ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি আছি!
হ্যাঁ, আপনিই সেই অভিভাবক, যে এসব স্কুলকে দেবালয় বানিয়েছেন। আর তার শিক্ষকরা আপনাদের আস্কারা পেয়ে নিজেদের দেবতুল্য ভাবা শুরু করেছে!
জি, আপনিই সেই অভিভাবক, যিনি নিজের বাচ্চার শৈশব কৈশোর কেড়ে নিয়ে স্কুল টিউশনি কোচিং মিলায় তার প্রায় সারাটা দিন রাত কেড়ে নিয়েছেন!
হ্যাঁ, আপনিই সেই অভিভাবক, যাদের সহযোগিতায় স্কুলগুলা আখ মাড়াইয়ের মত পিষে আপনার বাচ্চার কাছ থেকে জিপিএ বের করেছে!!
এখন কাঁদেন কেন?? যান, জিপিএ ফাইভের মালা বানিয়ে বাচ্চার ছবিতে ঝুলিয়ে দিন!
আরে, আপনি তো আপনার বাচ্চাকে অনেক আগেই মেরে ফেলেছিলেন অসুস্থ্য প্রতিযোগিতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে! অথচ সেই মৃত বাচ্চাটাও আপনার এতটুকু অপমান সইতে পারেনি। লজ্জায় ক্ষোভে আরেকবার আত্মহত্যা করেছে!
আমি কার বিচার চাইব?
আমি কাকে ধিক্কার জানাব??
আমি কাকে অভিশাপ দিব???
#BabuMehedi
4.শিক্ষার মান উন্নয়নে মায়ের ভূমিকা
#গল্প অভিভাবক
আমি নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে যখন আমার মেয়ে জয়ীকে স্কুলে দিতে যাই তখন অন্য অভিভাবকরা আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকে। আমি সেদিকে দৃশ্যতঃ খেয়াল করি না। তবে সানগ্লাস পরা থাকলেও তা আমার চোখ এড়ায় না। জয়ী স্কুলের গেইট পার হয়ে ভেতরে চলে যাওয়া পর্যন্ত আমি তাকিয়ে থাকি।
ও ভেতরে ঢুকে পেছন ফিরে আমার দিকে হাত নেড়ে আবার হনহন করে সোজা চলে যায় ক্লাসরুমের দিকে। আর আমার বুকের ভেতরে কেমন যেনো খচখচ করে উঠে। আমি জানি, কয়েক ঘন্টা পরই ওর সাথে আমার দেখা হবে তবুও প্রতিটি বিদায়ই কেমন যেন কষ্টের, বেদনার। সেটা কয়েক মিনিটের জন্য হলেও। আমার চোখ ভিজে উঠে।
জয়ী ক্লাস করার সময়ে আমি অফিসে চলে যাই আবার স্কুল ছুটি হলে ওকে নিয়ে বাসায় রেখে আবার অফিসে আসি। আমার নতুন অফিসের কাছের স্কুলেই ওকে এবার ভর্তি করে দিলাম।
আমি প্রথম প্রথম জয়ীকে নতুন স্কুলে দিতে এলেই অভিভাবকরা আমার দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকে।
আজ আমি জয়ীকে স্কুলে দিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি আর অমনি একজন অভিভাবক আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-‘ভাবী, আপনি কি নতুন ভর্তি করালেন মেয়েকে?’
-‘হ্যাঁ।’
– ‘কোন ক্লাস?’
– ‘ক্লাস ফাইভ।’
এতটুকু কথার মাঝেই আরও কয়েকজন অভিভাবক এগিয়ে এসেছেন আমার দিকে। আমি বুঝতে পারছি তারা বেশ কৌতুহলী। এদিকে আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নেবো এমন সময়ই একজন জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘ ভাবী, আপনাকে একা দেখি সবসময়, নিজেই গাড়ি চালান, ভাইয়া খুব ব্যস্ত তাই না? উনি কী করেন?’
আমি বললাম,
-‘ জানি না, কী করেন এখন! আমার সাথে ওর ডিভোর্স হয়ে গেছে।’
বলে ভাবীদের বিদায় সম্ভাষণ দিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ির লক খুলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট করে সাইড মিররে দেখতে পাচ্ছিলাম কতগুলো বিস্মিত, কৌতুহলী চোখ আমার গাড়িকে অনুসরণ করছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমি গাড়ি নিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলাম ওদের কাছ থেকে।
জয়ীকে যখন স্কুল ছুটির পর নিতে আসি, আমি গাড়িতেই বসে থাকি, জয়ী গাড়ির কাছে চলে আসে।
আমি গাড়ি নিয়ে চলে আসি আমাদের বাড়িতে। এই এক ঘন্টায় আমার জয়ীকে স্কুল থেকে বাসায় এনে খাবার দিয়ে, নিজে খেয়ে আবার ওকে রেডি করে কোচিংয়ে দিয়ে অফিসে ছুটতে হয়। আমার নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। সেটার প্রধান আমি, তাই অনেক দায়িত্ব আমার। যদিও আমার নিজের কারও কাছে জবাবদিহি করার নেই। কিন্তু সবাই যেনো আমাকে দেখে ফাঁকি না দেয় সেটারই চেষ্টা করি আমি।
সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে আমার আর জয়ীর আরামের, বিশ্রামের সময়। এই সময়ে আমরা অনেক গল্প করি, ওকে পড়া দেখাই, টিভি দেখি, কখনও ঘুরতে যাই, কখনও আত্মীয় বন্ধুরা আসে, শপিং করি, বই পড়ি। আমরা নিজেদের মত করে বাঁচি।
সেদিনের পর একদিন স্কুলে একটা পরীক্ষা ছিলো জয়ীর, এক ঘন্টার। পরীক্ষা থাকলে জয়ীর স্কুলে কিছুক্ষণ বসতে হয়, নাহলে ও খুব ভয় পায়। আমি অন্যান্যদের সাথে অভিভাবকদের বসার নির্ধারিত স্থানে বসে আছি। আজ অফিসে আগেই বলে এসেছি, দেরি করে আসবো।
এসময় স্কুলের কয়েকজন অভিভাবক আমার সাথে গল্প করতে এলেন। ওদের বাচ্চারাও জয়ীর সাথেই পড়ে। যদিও আমি আমার ছোট্ট ল্যাপটপটা কোলের ওপর রেখে অফিসের কিছু কাজ সেরে রাখছিলাম। একই সাথে গল্প করতে আসা ভাবীদের সাথেও কথা বলছিলাম। আমি ওদের সাথে কয়েকটি কথা বলতেই বুঝতে পারলাম, বেশ প্ল্যান করে সবাই একসাথে আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন। জয়ীর পড়া নিয়ে কয়েকটি কথা জিজ্ঞেস করেই আমাকে এক ভাবী বললেন,
-‘ভাবী, জয়ীকে দেখলে এত্ত মায়া লাগে! এতটুকু মেয়েকে রেখে বাবা যায় কীভাবে!’
আমি উত্তর দেওয়ার আগেই আরেক ভাবী বললেন,
-‘ভাবী, আপনি এত সুন্দর, স্মার্ট, এত মায়াবী, আপনাকে ভাইয়ের ভালো লাগলো না? কিছু পুরুষ মানুষ আছে ভাবী, নিজের বউ ভালো লাগে না। নাহলে এত সুন্দরী বউ রেখে চলে যেতে পারে?’
আমি এবার ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে বললাম,
-‘ভাবী আমাকে রেখে কেউ চলে যায়নি। আমিই চলে এসেছি, মেয়েকে নিয়ে।’
আমার কথা শুনে ভাবীরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। আমি দূর থেকে দেখলাম জয়ী পরীক্ষা শেষ করে আমার দিকেই আসছে। আমি ওদের ‘এক্সকিউজ মি, আমাকে যেতে হবে’ বলে উঠে চলে গেলাম জয়ীকে নিয়ে।
অফিসে ফিরে অনেক কাজ শেষ করে আবার জয়ীকে কোচিং থেকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে আজকে অফিসের কিছু কাজ করতে হবে। আমি অফিসের কাজ করি আর জয়ী ওর পড়া তৈরি করে।
আমি অল্প অল্প করে আমার প্রতিষ্ঠানটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। আমার মেয়েকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি আমার নিজের ব্যবসায় সময় দেওয়া দুটো কাজ মাঝে মাঝে জটিল মনে হয়। কিন্তু আমি সব সামলে নিতে পারি, সামলে নিতে জানি। ঠিক সাত বছর আগে এই জায়গাতেই, এই প্রশ্নেই আমার সাথে সৈকতের প্রথম ঝামেলা শুরু। জয়ীর বয়স তখন চার বছর।
দুই বছরের সম্পর্কের পর আমার আর সৈকতের বিয়ে হয়েছিলো ঘটা করে। আমার মাস্টার্স শেষ করার সাথে সাথেই। বিয়ের পরের বছরই জয়ীর জন্ম। তাই আলাদা করে চাকরি করা বা খোঁজা আমার তখনও সম্ভব হয়ে উঠেনি। জয়ীর জন্ম হওয়ার পর ওকে সময় দেওয়া, একা হাতে সব সামলানো আমার অনভ্যস্ত হাতে খুব কঠিন ছিলো। আমার মা-ও বেশি থাকতে পারতেন না আমার সাথে।
জয়ীর বয়স যখন চার বছর তখন ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। জয়ীকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে গেটের বাইরে অপেক্ষা করি । তখনই আমি ভাবি, এই সময়টুকু আমি কিছু কাজে লাগাতে পারি নিশ্চয়ই। বাঁধাধরা চাকরি না করলেও আমি নিজে কিছু শুরু করতে পারি, যেখানে অন্যান্যদের কর্মসংস্থান হবে।
সেই চিন্তা থেকেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে নারীদের তৈরি বিভিন্ন জিনিস নিয়ে প্রথম শুরু করি আমার কাজ। আমি খুব স্বল্প পরিসরেই শুরু করেছিলাম। স্বল্প পরিসরেই আমি ভালো করতে পারছিলাম। সৈকত প্রথম প্রথম কোন আপত্তি করেনি। আমাকে বলেছিলো,
‘ শুরু করছো, পারবে তো?’
আমি বলেছিলাম,
‘ নিশ্চয়ই পারবো।’
অল্প অল্প করে শুরু করা আমার উদ্যোগ, প্রচেষ্টা আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করে। আমি সকালে মেয়েকে স্কুলে নিয়ে যাই। তারপর থেকে আমার উদ্যোগের পেছনে পুরোটা সময় দেই। কেনো জানিনা, আমার এই প্রচেষ্টার পেছনে আস্থা তৈরি হয় সবার, আমার পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে আমার সাফল্য। কিন্তু সৈকত এই বিষয়ে কিছু বলতো না। মাঝে মাঝে মুখ গোমড়া করে থাকতো। আমি বুঝতাম ও হয়তো আমার ব্যস্ততা মেনে নিতে পারছে না।
কিছু বলতে গেলেই বলতো,
-‘তোমার এসব হাবিজাবি কাজের জন্য সংসার উচ্ছন্নে যাচ্ছে।’
ওর এই কথা আমি হেসে উড়িয়ে দিতাম। ভাবতাম ও হয়তো দুষ্টামি করে এসব বলছে। কিন্তু ওর কিছু কথায় আমি বুঝতে পারি নিশ্চয়ই আমার ব্যবসা করা নিয়ে কেউ ওকে কিছু বলছে। মাঝে মাঝেই সৈকতের সাথে আমার রাতে ঝগড়া হতো। কিন্তু আমি মনে মনে ভেবেছিলাম সৈকত ঠিক বুঝবে একদিন। সৈকতকে দেখতাম আমার ফোন চেক করতো, আমি বারণ করলে রেগে যেতো।
এসবের মধ্যেই একদিন স্কুল থেকে জয়ীকে নিয়ে আমি আবার আমার প্রতিষ্ঠানে গিয়েছি দুপুরের পর। প্রতিষ্ঠান বলতে তখনও বড়সড় কিছু দাঁড়ায়নি। খুব ছোট একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে তাতেই চালাচ্ছিলাম আমি। কর্মী মোট দশ জন।
তখন রিক্সা নিয়েই চলাফেরা করি আমি। সৈকত নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে অফিস যায়, আবার ফেরে। ড্রাইভার রাখা হয়নি কখনও, প্রয়োজন পড়েনি। আমার প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পর হঠাৎ সন্ধ্যার আগে বিশাল ঝড় শুরু হয় আকাশ কালো করে। সেসময় আমি জয়ীকে নিয়ে বের হতে পারছিলাম না। রাস্তায় একটাও রিক্সা নেই। বাসায় ফেরার উপায় নেই একদম। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ঝড়-বৃষ্টির জন্য বিদ্যুৎ নেই, ফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তায় গাছ উপড়ে পড়েছে। কয়েকবার সৈকতকে ফোন দিলাম, কল যাচ্ছে না।
রাত নয়টার দিকে পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে আমার অফিসের একজন স্টাফ, ওর নাম মিনহাজ, আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়। কারণ জয়ীকে নিয়ে দুর্যোগের মধ্যে বাসায় আসা, রিক্সা খোঁজা কষ্টকর ছিলো। বাসায় পৌঁছে ওকে বসতে বলেছিলাম আমি। মিনহাজ ভদ্রতা করে বসেছিলো ড্রইংরুমে।
সৈকত তখন অফিস থেকে ফিরেছিলো বাসায়। আমাকে মিনহাজের সাথে ফিরতে দেখে তালজ্ঞান হারিয়ে ওর সামনেই জোরে চিৎকার করতে থাকে, আমাকে গালিগালাজ করতে থাকে। মিনহাজ হকচকিয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়।
সৈকত আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে,
-‘ এই জন্যই তুই এত প্রতিষ্ঠান নিয়ে লাফাস, তাই না? রাত-বিরেতে প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ি ফিরবি? ঝড়-বৃষ্টি হলে তো আরও সুবিধা, তাই না?’
আমি বুঝতে পারি না, সৈকতের কবে থেকে এত রাগ-ক্রোধ-ক্ষোভ জমা হয়েছিলো আমার উপর! ও এই ক’দিনে এত বদলে গেলো কীভাবে? আমাকে তো এসব ব্যাপারে কিছু বলেনি।
সৈকত ক্রোধান্ধ হয়ে বলতেই থাকে,
-‘আসিফ আজকেই আমাকে বলেছিলো, প্রতিষ্ঠান চালাতে দিলেই তুই বেলেল্লাপনা করবি। খোঁজ নেওয়ার দরকার হলো না আলাদা করে। তুই নিজেই প্রমাণ করলি। আমি তোকে খাওয়া পরা দেই না?’
আমি বললাম,
‘ তুই-তোকারি কেনো করছো তুমি? আমি আটকে গিয়েছিলাম বৃষ্টিতে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না সৈকত? ফোন যাচ্ছিলো না তোমার মোবাইলে। দেখো কতবার কল দিয়েছি! তুমিও তো একটু খোঁজ করতে পারতে!’
আমার কথা শুনে সৈকত এসে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো আমার গালে। আর বিড়বিড় করে বলতে থাকলো, ‘বের হয়ে যা তুই, আমি তোর চেহারা দেখতে চাই না।’
আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। নিঃশব্দে জল গড়িয়ে পড়তে থাকলো গাল বেয়ে। জয়ী ভয়ে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার কাছে৷
আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ছোট্ট প্রতিষ্ঠানের সাফল্য কেউ সহ্য করতে পারছে না। আসিফ ভাই সৈকতের বন্ধু কিন্তু নানাভাবে আমার সাথে নোংরা ঠাট্টা করার চেষ্টা করেছিলেন একসময়। সৈকতকে এসব বলায় আমার কথা বিশ্বাস করেনি, উলটে আমাকে কথা শুনিয়েছিলো। এখন সেই আসিফই আমার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে আর সৈকত বোকার মতো তাতে তাল দিচ্ছে৷ সে-ই আমাদের সংসারে ঝামেলা বাঁধাচ্ছে।
আমি সেদিন চড় খেয়ে এক রাত কাটিয়েছিলাম সৈকতের বাসায়, একা বেরিয়ে যেতে পারিনি। তবে সকাল হতেই সৈকত অফিসে বেরিয়ে গেলে আমি জয়ীকে নিয়ে চলে আসি, আপাতত বাবার বাসায়।
আমি বাবার বাসায় চলে আসার পর ভেবেছিলাম সৈকত হয়তো ওর ভুল বুঝতে পারবে। হয়তো একদিন ‘সরি’ বলবে, আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসবে। কিন্তু সৈকত এসব করেনি। উলটে আমার বাবা-মা, ভাইয়ের কাছে খবর পাঠিয়েছে, আমি যতদিন না নিজের ব্যবসা বন্ধ করবো, ততদিন ওর বাড়ির দরজা আমার জন্য বন্ধ। একথা শুনে আমারও মনে মনে জেদ চেপে যায়। আমাকে তো সৈকতকে বিশ্বাস করতে হবে, আমার উপর থেকে ওর কবে বিশ্বাস উঠে গেলো আমি নিজেই বুঝতে পারিনি। আমার সাথে বোঝাপড়া না করে অন্যের কথায় আমাকে ভুল বুঝলো, আসিফই ওর কাছে বড় হলো! এসব চিন্তা আমাকে ভেতর থেকে আরও বেশি জেদী করে তুলছিলো।
তারপর থেকে আমি সৈকতের কথা আর ভাবিনি। মেয়েকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো, আমি যেতে দেইনি। আমার বাবা-মাও বোঝানোর চেষ্টা করেছে আমাকে, আমি বিষয়টা মেনে নেইনি। কিছুদিন পর বাবার বাসা ছেড়ে আমি ছোট্ট বাসা ভাড়া নিয়েছি। সেই থেকে আমার জীবন নতুন করে শুরু।
সেই ঘটনার এক বছর পর আমি সৈকতকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছি। কিছুদিন পর আমার আর সৈকতের আইনত বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আমার কষ্ট হয়নি তা না, কষ্ট হয়েছে সৈকতের নির্বুদ্ধিতার জন্য।
আমি এখন তিনশ’ কর্মী নিয়ে আমার প্রতিষ্ঠান চালাই। গত সাত বছরে আমি নিরলস, প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছি আমার প্রতিষ্ঠানটিকে একটি অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রায় আড়াইশ’ নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে আমার প্রতিষ্ঠানটি ঘিরে। আমার পণ্যের চাহিদা রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। দু’বার লন্ডনে এক্সিবিশনে অংশ নিয়েছে আমার প্রতিষ্ঠান। কয়েকদিন আগে নতুন একটি বড় জায়গা নিয়ে আমার প্রতিষ্ঠানটি সাজিয়েছি। কাছের স্কুলেই জয়ীকে ভর্তি করে দিয়েছি যেনো আমি খুব সহজে জয়ীকে আর প্রতিষ্ঠানকে সমভাবে সময় দিতে পারি।
আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিয়েছি এটা জানানোর পরদিন যখন জয়ীকে স্কুলে নিয়ে গেলাম তখন খেয়াল করলাম ভাবীরা একটু দূরে দূরেই থাকছেন আমার কাছে থেকে। তবে সবাই নয়। শিখা ভাবী, মেহজাবিন ভাবী আর অন্তরা ভাবী কিন্তু আমার সাথে স্বাভাবিক কথাই বললেন, বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে কথা বললেন, শিখা ভাবী আমার জন্য আচার এনেছিলেন সেটা দিলেন।
জয়ীকে স্কুলে দিয়ে আমি যখন গাড়ির দিকে যাচ্ছি তখন কয়েকজন ভাবী আমাকে শুনিয়ে বললেন,
-‘ দেখেন গিয়ে, প্রেম-ট্রেম করে নিজের স্বামীকে ছেড়ে এসেছে। অফিসের নামে গাড়ি চালিয়ে কোথায় কোথায় যায়! মাথার উপর অভিভাবক নেই, যা খুশি তাই করতে পারে। ডিভোর্সি তো!’
ওদের মুখের উপর জবাব দিতে গিয়েও আমি দাঁতে দাঁত চেপে চলে আসলাম শুধু নিজের মেজাজ, নিজের সুন্দর দিনটা নষ্ট করবো না বলে।
সেদিন থেকেই খেয়াল করেছিলাম স্কুলের কিছু কিছু অভিভাবকদের আলোচনার একটা টপিক হয়ে গিয়েছি আমিঃ নাতাশা আহমেদ, ‘ডিভোর্সি’ বলে যাকে হেয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমি কোথায় যাই, কী করি, আদৌ আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি কী, কেন আমি স্বামীকে ছেড়ে এলাম এসব নিয়ে চলে জল্পনা, কল্পনা।
যাদের মনে ধারণা আছে পিএনপিসির জায়গাটি শুধু নারীরাই দখল করে আছে, ধারণাটি একেবারে ভুল। পুরুষ অভিভাবকরাও কম যান না। তারাও ভাবীদের সাথে পাল্লা দিয়ে এসব গসিপে অংশ নিয়ে আমার জীবন নরক বানানোর প্রতিযোগিতায় নামলেন। দুয়েকজন আড়ালে, আবডালে আমাকে নোংরা ইঙ্গিতও দিলেন।
একদিন আমি গাড়ি খুলে ড্রাইভিং সিটে বসতে যাবো এসময় একজন অভিভাবক আসাদ ভাই এসে আমাকে বললেন,
-‘আপা, আপনাকে দেখলে কষ্ট লাগে, কত একা আপনি! আহারে! আমিও মাঝে মাঝে বাসায় একা থাকি। খুব একা। একা লাগলে আমাকে ফোন দেবেন, এই যে কার্ড, এতে নম্বর আছে।’
আমি বললাম,
-‘ভাবীর নম্বর আমার কাছে আছে আসাদ ভাই। কখন কখন আপনার একা লাগে ভাবীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নেই, তারপর ফোন দিচ্ছি আপনাকে।’
একথা শুনে উনি সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে যান। পরে আমাকে সরি বলে অনুরোধ করেছেন যেনো ভাবীকে আমি কিছু না জানাই।
আমি জানি, আমি কেনো আমার স্বামীর সাথে থাকি না, কেনো একা মেয়েকে নিয়ে থাকি, কেনো আমার অভিভাবক নেই, কেনো আমি স্বাবলম্বী হতে চেষ্টা করছি, কেনো গসিপে অংশ নেই না, কেনো গাড়ি চালিয়ে ‘পুরুষের মতো’ চলাফেরা করি এসব কিছুতে এই ভাই-ভাবী তথা গোটা সমাজেরই আপত্তি। ‘পুরুষ ছাড়া নারীরা অরক্ষিত’ এই তত্ত্বটিই তারা নানাভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
কেউ কেউ আমাকে আমার স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দেন, কেউ কেউ আমাকে বিয়ে করার পরামর্শ দেন, কেউ তাদের বিপত্নীক দেবর বা বরের বন্ধুর সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। অথচ স্বাবলম্বী আমাকে পুরুষ ছাড়া মেনে নিতে পারেন না।
আমাকে এত সব ঝামেলা, ঝড়-ঝঞ্ঝা মোকাবেলা করেই টিকে থাকতে হয়, সব কথা উপেক্ষা করেই বাঁচতে হয়, প্রতিদিনের কাজ করতে হয়, জয়ীকে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে হয়। যেজন্য আমাকে ভীষণ অপমানিত হয়ে সৈকতের বাড়ি থেকে চলে আসতে হয়েছিলো, সেই স্বপ্ন কিছুতেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। সর্বোপরি, আমি যে নিজে কিছু করার চেষ্টা করেছিলাম সেটা সফল আমাকেই করতে হবে। তাই এসব ভাই-ভাবীদের মন মানসিকতা, তাদের ব্যবহার আমাকে কখনোই দমাতে পারেনি।
একদিন সকালে আমার খুব ব্যস্ততার মাঝে আমি একটা সুসংবাদ পাই। যে খবরটা আমার জীবন কিছুটা হলেও বদলে দিয়েছে। আমি নাকি এবছর শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তার পুরস্কার পাচ্ছি। নাকি বলছি কারণ সত্যি কি না সেটা বিশ্বাস করতে আমার একটু সময় লেগেছিলো। গায়ে চিমটি কেটে দেখলাম, নাহ, আমি স্বপ্ন দেখছি না। বরং আমার স্বপ্নটাকেই বাস্তবে দেখছি। আগামী বৃহস্পতিবার আমাকেসহ অন্য নারীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হবে, সম্মাননা দেওয়া হবে। আমি খুশিতে তাড়াতাড়ি আমার বাবা-মা, ভাই, অফিসের সবাইকে জানালাম খবরটা।
সেই বৃহস্পতিবার ছিলো আমার জীবনে একটি অন্যরকম, বিশেষ দিন, অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিন,আমার জয়ী হওয়ার দিন। সেদিন একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আমি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের পুরস্কার নিলাম।
আমাকে পুরস্কৃত করার খবর সব মিডিয়ায় এলো। আমার সাক্ষাৎকার বড় করে পত্রিকায় ছাপা হলো। টিভি চ্যানেলগুলো আমার সাক্ষাৎকার প্রচার করলো। আমি আমার পাওয়া বিশাল পদকটি আমার প্রতিষ্ঠানে সাজিয়ে রাখলাম আর প্রাপ্ত অর্থ কিছু দুঃস্থ নারীদের দান করলাম আর নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজে লাগালাম।
এরপর স্কুলে যেতেই শিখা ভাবী, মেহজাবিন ভাবী আর অন্তরা ভাবী আমাকে দেখে দৌড়ে এলেন। ওরা অবশ্য আগেই ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। সেদিন ফুলের একটা তোড়া নিয়ে এসেছিলেন ভাবীরা। অন্যান্য ভাবীরাও এলেন হাসিমুখে এতদিন যারা আমার পেছনে আমার কাজ নিয়ে, চরিত্র নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। বললেন,
-‘ ভাবী, আপনি যে এত বড় পর্যায়ের মানুষ তা তো বুঝিনি।’
আমি ওদের থামিয়ে দিলাম। আজ ওদের কথা বলার দিন নয়। আজ আমি বললাম,
-‘ভাবী, সম্পর্কে যখন তিক্ততা থাকে, বিশ্বাস থাকে না, বিস্বাদ হয়ে যায় সেই বিষাক্ত সম্পর্ক টেনে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে, অন্যের উপর নির্ভর করে থাকার চেয়ে, আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজে নিজের অভিভাবক হয়ে থাকা কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়? শুধু অন্যের সমালোচনা নয়, অভিভাবক থাকা না থাকা বড় কথা নয়। স্বামী থাকলেও নিজের জন্য কিছু করুন, নিজের জোরে বাঁচুন, আত্মতৃপ্তি পাবেন।’
সেদিন কয়েকজন ভাবী, আসাদ ভাইসহ আরও কয়েকজন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
(গল্পের সকল চরিত্র কাল্পনিক)
সোমা দেব