
japanKahini নাম্বার ওয়ান নাকি অনলি ওয়ান?
জাপানে দশ বছর আগেও আত্মহত্যার হার অনেক বেশি ছিল। দিনে ৯০ জন। বড় এক সামাজিক সমস্যা। সরকার সমস্যাকে লুকালেন না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাইলেন। মানুষ কেন আত্মহত্যা করে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করলেন। এই দশ বছরে আত্মহত্যার হার দেড় গুণ কমে গেল। এখন দিনে ৬০ জনের মত। র্যাঙ্কিং এ ১২ নম্বরে আছে। ভারত ১১ নবরে। বাংলাদেশের কোন তথ্য নেই।
নব্বই সালের শেষের দিকে হঠাৎ করে চেইন রিএকশনের মত স্কুলের কয়েকজন ছাত্র আত্মহত্যা করে বসলো। সরকার সমস্যা লুকালেন না। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ চাইলেন। কারণ বের করলেন।
বাংলাদেশে ইয়াং ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যা করে কেন? ব্যর্থ প্রেম, পরীক্ষার অসন্তোষ ফলাফল, বাবা মার কাছে আবদারে বিফল। আর কি কি কারণ আছে? এগুলো ঠেকানোর উপায় কি? কোন গবেষণা নিশ্চয়ই আছে। আত্মহত্যা বাড়ছে না কমছে তা জানতে ইচ্ছে করছে।
জাপানি ছাত্রদের আত্মহত্যার প্রধান কারণ বের হলো। আঙ্গুল পড়লো স্কুলের ওপর। স্কুলের বুলিং। জাপানি ভাষায় বলে ইজিমে। শক্ত সবল বাচ্চাদের দ্বারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছাত্রদের ওপর অত্যাচার। ধমকানি, ভয় প্রদর্শন, ছোটখাট ঠোকাঠুকি এসব।
এই কাজটা ছোট বেলায় আমরা ও করেছি। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। শহর থেকে এক ছেলে এসে আমাদের ক্লাসে ভর্তি হলো। ওর শুদ্ধভাবে বাংলা বলা আমাদের পছন্দ হলো না। ওকে গ্রামের ভাষার ওপর ট্রেইনিং দেয়া শুরু করলাম। এখলাসপুরি টোন না আসলেই মাইর। দেশি কুত্তা বিলাতি ডাক দিবি ক্যান? এজন্যই শাস্তি। কি আজিব চাইল্ড সাইকোলজি।
কুমিল্লা জিলা স্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। আমি গ্রাম থেকে আগত। কাউকেই চিনিনা। লাঞ্চ ব্রেকে বোম্বাশটিং (টেবিল টেনিস বল দিয়ে কে কাকে হিট করতে পারে) খেলছিলাম। মডার্ন স্কুল, মিশনারি স্কুল থেকে আগত ছেলেগুলো গ্রুপ করে ফেললো। আমি লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হলাম। দুইদিনে আমার পিঠ লাল করে ফেলল। বাসায় গিয়ে বলার সাহস পাইনি। গ্রামে আমরা মাটি ঢিলা, ডুম্বুর ঢিলা দিয়ে পাখি মেরেছি, ফল পেড়েছি। আমাদের স্কিল ন্যাচারাল। দ্বিতীয় সপ্তাহে আমি আমার স্কিল প্রদর্শনের সুযোগ পেলাম। এক সিনিয়র ভাইয়ের কান ফাটিয়ে দিলাম। সবলের দলে স্থান পেয়ে গেলাম। কি আজিব চাইল্ড সাইকোলজি।
নবম শ্রেণিতে সিলেট পাইলট স্কুলে ভর্তি হলাম। সবাই সিলেটি ভাষায় কথা বলে। আমি শুদ্ধ ভাষায়। আমি সিলেটি জানিনা। আমার এখলাসপুরের কাহিনি মনে পড়ে গেল। ভয়ে নীল হয়ে থাকতাম। নাহ সিলেটি ছেলেগুলো অনেক ভদ্র। মাইর দিল না। একদিন শুধু স্যারের কাছে বিচার দিল, “স্যার ইগু শুদ্ধ মাতের”- এই ছেলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে।
বাচ্চাদের সাইকোলজির ওপর গবেষণা জাপানে কম হয়নি। প্রাইমারি স্কুলে পরীক্ষা নেয়া বন্ধ করা হলো। এ সময়টা বাচ্চাদের ক্রিয়েটিভিটি প্রসার করার বয়স। প্রতিযোগিতা করার বয়স নয়। হাইস্কুল থেকে প্রতিযোগিতা আছে ঠিকই কিন্তু কে প্রথম হলো কে দ্বিতীয় হলো তা জানানো হয় না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ও তাই। আমরা বলে দেই না তোমার র্যাঙ্ক এতো। জানানো হয় বিচ্যুতি। গড় নম্বর থেকে তোমার স্কোর কত দুরে সেই মান। রাঙ্কিং জানানো হলে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের কনফিডেন্স লেভেল যেন কমে না যায় সে জন্যই এই নিয়ম।
তারপরে ও ছাত্ররা এই পড়াশুনার যুদ্ধ থেকে বের হতে পারছেনা। কোম্পানিগুলোতে অন্য এক ধরণের প্রতিযোগিতা। বেতন আর পজিশন বড় করা চাই। রাত দিন খেটে কেপিআই রিচ করো। এটাকে বলে Rat Race বা ইঁদুর দৌড়। আমেরিকান এক এক্সপার্ট বলেছিলেন, Even if you win a rate race, you are still a rat. ইন্দুর দোউড়াইস না রে মনু। ইন্দুর দৌড় দোউড়াইস না।
জাপান সরকার নতুন করে বিশেষজ্ঞদের ডাকলেন। স্কুলের বুলিং কিভাবে কমানো যায় – সে নিয়ে। বুলিং এর জন্য কতটুকু আর শাস্তি দেবেন? শুরু হলো সচেতনতা বৃদ্ধি প্রকল্প। কাকে সচেতন করবেন?
বুলিং এর শিকার যে হচ্ছে তাকে যেভাবে মানসিকভাবে এম্পাওয়ার করলেন, সেটা অভিনব।
খালেদা জিয়া স্টাইলে স্লোগান দিলেন –
শ্রেষ্ঠ হওয়া ভালো। তবে ইউনিক (অনন্য) হওয়া আরো ভালো।
সচেতনতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি কাজ করে সেলিব্রেটিদের মুখের কথা। জাপানের জনপ্রিয় সঙ্গীত ব্যান্ড SMAP এর ডাক পড়লো। মাকিহারা নরিয়ুকি নামক একজন গায়কের লেখা একটি গান SMAP কে দিয়ে গাওয়ানো হলো। গানের টাইটেল ছিল –
সেকাই নি হিতোৎসু দাকে নো হানা (পৃথিবীতে একটিমাত্র অনন্য ফুল)
যে তথ্যটি দিতে চাইলেন তা হলো –
তোমার শ্রেষ্ঠ হবার দরকার নেই, তুমি ইউনিক হও।
নাম্বার ওয়ান হবার দরকার নেই, অনলি ওয়ান হও।
পৃথিবীর সমস্ত ফুলই সুন্দর।
কোন ফুল সবচেয়ে সুন্দর সেটা বিচার করার শক্তি মানবকুলের নেই। আপনার কাছে শাপলা ফুল সর্বশ্রেস্ট মনে হতে পারে কিন্তু রহিম ভাইয়ের কাছে শাপলা একটা সবজি।
ফলের রাজা আম না কাঁঠাল, মাছের রাজা ইলিশ না রুই
খাট-পালঙ্ক ছাইড়া দিয়া পাটি বিছাইয়া শুই
নজরুল নজরুল হিসাবে শ্রেষ্ঠ, রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ হিসাবে শ্রেষ্ঠ- দুজনের মধ্যে তুলনায় যেও না।
বাচ্চাদেরকে শ্রেষ্ঠ বানানোর প্রতিযোগিতায় নামলেই ভুল করবেন। সে কোন বিষয়ে পারদর্শি – সেটাকে উৎসাহ দিন।
দুর্বলের সংজ্ঞাটাই পাল্টে দিল।
একটা শিশু হয়তো পড়াশুনায় ভালো না। কিন্তু খেলাধুলায় ভালো। খেলাধুলায় ভালো না। কিন্তু ভালো আর্ট করতে পারে। ভালো আর্ট করতে পারে না। কিন্তু ভাল গান গাইতে পারে। ভাল গান গাইতে পারে না কিন্তু ভালো রান্না করতে পারে। কত কত ইউনিক জিনিস বের হয়ে আসবে যেখানে শিশুরা আত্মতৃপ্তি পায়।
এই গানটা কাজে দিল। দুর্বলরা আত্মশক্তি ফিরে পেল। কিভাবে পরিমাপ করলো জানিনা। তবে ছাত্রদের আত্মহত্যার সংবাদ কমে গেল।
নিজে ও চিন্তা করছি। শ্রেষ্ঠ হওয়াটা কি আসলেই দরকার? এক নম্বর না হয়ে দশ নম্বর হলে ক্ষতি কি? আমি এমন কি জানি যা অন্য কেউ জানেনা। আমি এমন কি পারি যা অন্য কেউ পারে না। আমার মধ্যে এমন কি আছে যা অন্য কারোর নেই।
নাম্বার ওয়ান নয়, আপনার বাচ্চা কেন অনলি ওয়ান – সেটা বের করুন।
——