আমি একশ ভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি তোমার প্রেমিক তোমাকে ধোকা দিয়ে চলে যায়নি। সে আবার ফিরে আসবে । তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে , পরপুরুষের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ সংসার করেছ জানার পরও মেনে নেবে।
আমার বউ বিছানা থেকে কিছুটা কৌতূহলী হয়ে আমার দিকে তাকালো। আমি বিছানার পাশের টেবিল লাগোয়া চেয়ার থেকে পুরোপুরি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আবার বললাম:
আমার অনুমান শক্তি কখনো ভুল হয় না। ছোট বেলায় আমাদের বাড়িতে একটা মহিলা কাজ করতো। একদিন তার ৮ বছরের বাচ্চা মেয়ে গেল হারিয়ে। সেতো কেঁদে – কেটে অস্থির । আমি গিয়ে তাকে বললাম , আপনার মেয়েটার কিছু হবে না। সে ফিরে আসবে। এর কয়দিন পর সত্যি সত্যিই মেয়েটা ফিরে আসে।
আবার একবার বাড়ির পাশের এক গরুর ফার্মে দুধ আনতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি একটা বাছুর মরার মতো খড়ের স্তুপের ওপর শুয়ে আছে। ফার্মের মালিক জানালেন , কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে বাছুরটা। ৩ দিন ধরে অসুস্থ। আমি বাছুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলাম , এইটা মরবে না। আপনার খামারের সবচেয়ে সুস্থ আর স্বাস্থ্যবান গরু হবে এটা।
তার ২ সপ্তাহ পর দেখি ৫ লিটার দুধ হাতে ফার্মের মালিক আমাদের বাসায়। জানালো বাছুরটা আসলেই মরেনি।
আরো মজার কথা হচ্ছে বাড়ির সামনে চায়ের দোকানদার মামাকে আজ সকালেও বলেছিলাম এই বাড়ির মেয়েটার বিয়ে আজ ভেঙে যাবে। যদিও বুঝতে পারিনি তখন আমাকেই আবার তোমাকে বিয়ে করতে হবে।
বউ তবুও কোনো কথা বলল না। চুপচাপ আবার বিছানার দিকে মনোযোগ দিল , যেন বিছানার চাদরে একটা ম্যাপ আছে আর সে মহিলা শার্লক হোমস, সেই ম্যাপ ধরে নিজের পালিয়ে বা হারিয়ে যাওয়া প্রেমিককে খুঁজবে।
এরমধ্যেই বাসর রাত সম্পর্কে আমার সব আগ্রহ হারিয়ে গেছে। যেইভাবে বিয়ে হয়েছে এতে অবশ্য ঘরে ঢোকার আগেও তেমন কোনো আগ্রহ , কৌতূহলতা লাগেনি বাসর ঘর নিয়ে।
শম্মী আর আমার বিয়েটা নাটকীয়ই বলা যায়। কারণ এই ধরণের কাহিনী নাটক ছাড়া বাস্তবে খুব একটা ঘটে না। সিনেমাতে এইসব গল্প পাবলিক আর খায় না বলে একে সিনেমাটিক বলা যায় না।
আমি এই বাড়িতে ছোট্ট একটা ঘর নিয়ে ভাড়া থাকি প্রায় ৬ মাস হলো। আজকে এই বাড়িরই মেয়ে শম্মী এর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার নিজের পছন্দ করা এক ছেলের সাথে। দুই পরিবার মেনে নিয়েছে সব ঠিক-ঠাক। করোনার কারণে প্যান্ডেল-ট্যান্ডেল বিয়ে হবে না । যে ধরণের বিয়ে হবে সেটাকে বলে ” চুপি চুপি বিয়ে ” । কেবল কাছের আত্মীয়স্বজন এর উপস্থিতি। এইটুকুই পাশের ঘরের সালমা ভাবীর কাছ থেকে রান্না করার সময় জেনেছিলাম।
আমরা কেউই দাওয়াত পাইনি। তাই বিয়ে বাড়ি সম্পর্কে আগ্রহ ছিল না। মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে বিছানায় শুয়েছি। এমন সময় বাড়িওয়ালি আন্টি এসে হাজির । নাটকীয় ভাবে বিয়ের ঠিক আগে শম্মীর প্রেমিক হাওয়া হয়ে গিয়েছে পরিবার সহ। এখন তাদের মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য তাদের মেয়েকে আমার বিয়ে করতে হবে। আমি যখন প্রস্তাবটা পাওয়ার পর মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে লুফে নিলাম। তখন আমার হবু শাশুড়ি আম্মা হতভম্ব হয়ে বললেন :
আমি কী বললাম , সবটা বুঝতে পেরেছ তো ?
আমি তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বললাম , আপনি মায়ের মতন। আপনার কথাই শেষ কথা।
নতুন জামাইয়ের মত মাথা নিচু করে বসে রইলাম। তিনি চলে গেলেন হতচকিত ভাবেই। খুশি হলেন কিনা বুঝতে পারলাম না। এত সহজে একটা ছেলে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাবে ভাবেননি হয়তো তিনি। বিয়ে নিয়ে তখন আমার যতটা ফ্যান্টাসি ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল একটা বিপদ থেকে উদ্ধারের চিন্তা। বাবা-মা মরার পর ক্লাস টেন পর্যন্ত মামা-মামীর সঙ্গে ছিলাম। এরপর থেকে শহরে এসে নিজের সব খরচ নিজেই চালাই। অনার্স ৩য় বর্ষের ছাত্র। বিপদে ফেলল , করোনা , লকডাউন , কোয়ারেন্টাইন নামের তিনটি শব্দ।
পার্ট টাইম চাকরি গেল। স্কুল কলেজ বন্ধ তাই দুটো টিউশনি গেল। বাকি একটা ৪ মাস আগে ছাত্রীর পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে ৩শ টাকা চুরির অভিযোগে গেছে। ৪ মাস ধরে বাড়ি ভাড়া বাকি। আমার যে শেষ একটা টিউশনি আছে , পথে বসিনি এটা বোঝানোর জন্য রোজ সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘুরে ফিরে সাড়ে ১০ টায় বাড়ি ফিরতে হয়। ধার-দ্যানা করে খাচ্ছি বর্তমানে। এমন সময় বিয়ের প্ৰস্তাব আসার পর সবার প্রথমে মাথায় চিন্তা এলো , বাড়ি ভাড়ার চিন্তা করতে হবে না। শশুর আব্বার ( হবু) অবস্থা ভালো। শম্মী তাদের একমাত্র মেয়ে। আমার জীবন সেটল। খাওয়ার চিন্তাও করতে হবে না। ঘর-জামাই অফার।
চেয়ে-চিন্তে , ধার করে খেয়ে , বাড়ি ভাড়া না দিতে পেরে বাড়ির মালিকের গালি-গালাজ খেয়ে আমার মধ্যে নূন্য ব্যক্তিত্ববোধও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। যদিও একবার ভাবলাম আমাদের ধর্মে তো লগ্ন বলে কিছু নেই , তাছাড়া বিরাট আয়োজন করে লোক ডেকেও বিয়ে হচ্ছিল না যে লোকের কাছে লজ্জা পেতে হবে। তাদের পারিবারিক অবস্থা এমন যে , যে কোনো ভালো ঘরের ছেলে এই বাড়ির জামাই হতে উদগ্রীব থাকবে। সেক্ষেত্রে আরো সময় নিয়ে দেখে-শুনে আরো ভালো ছেলের সাথে শম্মীর বিয়ে দিতে পারতো। আমি কেন ?
অবশ্য শম্মীর মা আমার জীবন বৃত্তান্ত জানার পর থেকেই এক ধরণের সমীহ অনুভব করতেন। একটা ভালো ছেলে হওয়ার জন্য যেসব লক্ষণ বা গুন প্রয়োজন সবটাই আমার আছে। খারাপ যেসব লক্ষণ আছে তা খুব যত্ন করে রাখি। কারো দেখতে পাওয়ার কথা না। তাছাড়া গত তিন মাস ধরে এলাকার তাবলীগ-জামাতের লোকদের নজরে পড়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজের অভ্যাস করে ফেলেছি। এটাও পাত্র হিসেবে আমার পজিটিভ পয়েন্ট। এই বিয়েটাকে তাই হঠাৎ আল্লাহর রহমতও বলা যায়। তাছাড়া একমাত্র মেয়েকে সারাজীবন কাছে রাখতে সহায়-সম্বলহীন একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়াটাও স্বাভাবিক এই মায়ের ।
তো , আর কিছু না। তারপরেই সংক্ষিপ্তভাবে বিয়ের বাকি কাজ হয়ে গেল। এবার অবশ্য আমার জন্য সব ভাড়াটিয়ারাও দাওয়াত পেল।
বউ যে আজরাতে আনন্দে নেই, তার প্রেমিকের শোকে বিহ্বল , সাধারণ আট-দশটা বাসর রাতের মতো আমার বাসর হবে না তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বইতে পড়েছিলাম উদ্ভট কথা-বার্তা বললে ইন্ট্রোভার্ট মেয়েরা মুগ্ধ হয় সহজে। সেই চেষ্টাই এতক্ষণ করছিলাম। কিন্তু আর পারছি না। এত সুন্দর ঘর আর বিছানা দেখে সত্যিই লোভ হলো। এটা শম্মীর ঘর। আমি তাকে একসাইডে সড়ে বসতে বলেই শুয়ে পড়লাম বিছানায়। আলো জ্বালা ছিল। সে প্রায় আধা-ঘন্টা সেভাবে বসে থেকে, আলো নিভিয়ে , মাঝখানে কোলবালিশের সীমান্ত একে শুয়ে পড়লো।
আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছি। সে বিড়বিড় করে একবার আমাকে বলল , সে সত্যিই ফিরে আসবে তাই না ? আমি কোনো উত্তর দিলাম না।
আসারইতো কথা। যতটুকু শুনেছি সেই কলেজ জীবনের বন্ধু ছিল ছেলেটা শম্মীর। এরপর এখন অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ে সে। এইরকম একটা ছেলে পরিবার সহ বিয়ের দিন উধাও হয়ে যাবে এর কোনো মানে হয় ! ফিরে আসবেই।
পরদিন সকালে খাবার টেবিলে শশুর আব্বা বললেন , তুমি ছোট থেকে মামা-মামীর কাছে বড় হয়েছে। তাদের না জানিয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। তারা নিশ্চই রাগ করবেন।
জ্বী না । করবেন না।
এমনটা কেন বলছ ?
কারণ আপনারা অনেক বড়লোক। তারা খুশিই হবেন।
শশুর , শাশুড়ি অপস্তুত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকালেন। শাশুড়ি আম্মা বললেন , তাদের আসতে বলেছ তো ?
বলিনি। আপনারা অনুমতি দিলে আসতে বলবো।
এ কেমন কথা! এখনই কল দিয়ে জানিয়ে দাও।
সবাইকে আসতে বললেও আমি জানতাম মামা একাই আসবেন এই পরিস্থিতিতে। পরদিনই চলে এলেন তিনি। এমন বাড়িতে আমার বিয়ে হয়েছে দেখে চোখ ছানা-বড়া হয়ে গেলেও অভিমান করে শশুর-শাশুড়ির সামনে বললেন :
আমরা কারা ? মা মরলে মামা শত্তুর। জানানের দরকার কী বিয়া করার আগে !
শাশুড়ি আম্মা তাকে বোঝালেন আমার কোনো দোষ নেই। তাদের জন্যেই তাড়াহুড়োয় ঘটে গেছে বিষয়টা।
অবশ্য আমাকে একা পেয়ে জড়িয়ে ধরে পিঠে চাপর মেরে বললেন , দারুন দাও মারছস ভাইগ্না , তোর জীবনে আর কোনো চিন্তা নাই। এতদিনে শান্তিতে মরতে পারুম। মরার পর আপারে মুখ দেখাইতে পারুম। তুই যেই বোকা, সরল। আল্লায় সঠিক বিচার করছে।
সেই দিনই গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগে কেঁদে-কেটে আমার জীবনের দুঃখ-কষ্টের বর্ণনা দিয়ে এই নতুন বাবা-মার কাছে আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন তিনি।
আমার জীবন আগের মতই চলতে লাগলো। তবে এবার চিন্তা-ভাবনাহীন। ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি , সকাল , দুপুর এলাকার চায়ের স্টল গুলোতে আড্ডা দিয়ে বেড়াই। বিকেলে খেলার মাঠে গিয়ে খেলা দেখি। লকডাউনের বালাই নেই। সময় মতো খাবার টেবিলে বসে পড়ি, সন্ধ্যার পর শম্মীর ঘরে সেট করা নতুন টিভির সামনে বসি। টিউশনি, কাজ খোঁজার চিন্তা নেই। যাকে বলে স্বর্গসুখ।
বাঙালি হওয়ার এই আরেক সুবিধা , এখানের অভিভাবকরা রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে স্বামী-স্ত্রী এক ঘরে থাকলেই হলো। এরপর কী ঘটলো এ নিয়ে তাদের মাথা-ব্যাথা নেই।
শম্মীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হতে লাগলো তার প্রেমিককে নিয়ে কথা বলায়। আমি সব সময় পজিটিভ কথা বলি। আর পজিটিভ কথা শুনতে কে না পছন্দ করে! তার প্রেমিক ফিরে আসবে , ফিরে আসার সম্ভাবনা কতটা বেশি নানা কথা। আমার অনুমান শক্তি কতটা ভালো , কী বলেছি আর হয়নি এমন অসংখ্য উদাহরণ।
এখানে অবশ্য আমি পজিটিভ চরিত্র। স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় থাকার পরও তার প্রেমিকের সম্মানে তাকে স্পর্শ না করা , তাকে নানান আশার বাণী শুনিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে দূরে রাখা। অবশ্য এক বিছানায় শুয়েও পাশের মেয়েটার শরীর স্পর্শ না করা যে আমার চরিত্রের আরো একটি সুন্দর দিক প্রকাশ করে তা হয়তো শম্মী অনুভবই করতে পারে না। সে ভাবে এইতো স্বাভাবিক। যা হোক! আমি কাউকেই না করতে পারি না। শম্মী তেমন ভাবে অনুরোধ করলে হয়তো তার প্রেমিককে খোঁজার জন্য গোয়েন্দাগিরিও শুরু করে দিতাম।
তাছাড়া আমি আমার এই জীবন নিয়ে খুবই আনন্দে ছিলাম। শুধু কল্পনা করে নিচ্ছিলাম এটা বউ ছাড়া বিয়ে। থাকা-খাওয়া ফ্রি হোটেল। তাই শম্মীর অবহেলা কিংবা তার প্রেমিক নিয়ে সারাদিন দুশ্চিন্তা করার দিকটা আমি গায়ে মাখাতাম না। ওকে নিয়ে ভাবতেই পছন্দ করতাম না। আমার সব চিন্তা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল।
দিন কাটতে লাগলো। এ ধরণের নাটকে সাধারণত নায়িকাদের প্রেমিককে নেগেটিভ রোলে দেখানো হয়। মেয়েটা হয়তো পজিটিভ রোলের ( যেমন স্বামীর ) সাহায্যে তার প্রেমিককে খুঁজে পেল একসময়। তার আশার গুঁড়ে বালি! জানতে পারলো তার প্রেমিকটা জোচ্চোর ছিল, তার বাপ-মা থেকে টাকা খেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। বা সে ছিল একটা প্লে বয়। তাকে নিয়ে খেলেছে। বিয়ের কথা উঠতেই বিয়ের পিঁড়িতে তাকে বসিয়ে শেষ খেলায় অনুপস্থিত থেকেই বিদায় নিল।
শম্মীর ক্ষেত্রে এমন কিছুই হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমার অনুমান তাই বলে। এভাবে একইভাবে প্রায় ৬ মাস কাটলো। এরমধ্যে শম্মী সম্পর্কে সব আগ্রহ আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার এই জীবন-যাপন অবশ্য আমার শশুর-শাশুড়ির ভালো লাগলো না। তারা চেয়েছেন আমি তাদের মেয়ের জীবনের কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে তাকে সুখী করবো। তাদের মেয়ের বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহহীনতা তাদের তাই ভালো লাগলো না।
আমি পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে না তুললে যে শম্মী আমাকে পছন্দ করবে না , শম্মীর জীবন সুখের হবে না , তা আমার শাশুড়ি ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই একদম মেইন শহরের দিকের একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিলেন আমাদের । সাথে একটা চাকরির ব্যবস্থা। আমি কিছুই না করতে পারি না , তাই নতুন এই জীবনে ভাবনা চিন্তা ছাড়াই প্রবেশ করলাম।
ফ্ল্যাটে উঠলাম বউ নিয়ে। ৮ টা থেকে ৫ টা অফিস। রান্না করার লোক রাখা আছে। অফিস থেকে বের হয়ে আড্ডা দিয়ে মোটামুটি ১০ টায় বাড়ি ফিরি, টিভি দেখি তারপর ঘুম। আবার ঘুম থেকে উঠে অফিস। কমন রুটিন।
এখানে এসে কয়দিন এক বিছানায় ঘুমালেও পরে একদিন দেখলাম শম্মী পাশের ঘরের বিছানায় শুতে গেল। আস্তে আস্তে পরিধেয় জামা-কাপড় , প্রসাধনী সব আলাদা ঘরে নিল। এবং আমরা পৃথক হলাম কোনো চুক্তি ছাড়াই। প্রতিবাদ করলাম না। আমার কোনো জীবন-যাপনই খারাপ লাগে না।
শম্মীর প্রতি আমার কোনো অনুভূতি ছিল না যেহেতু। টুকটাক কথা হতো , সে তার মতো থাকতো আমি আমার মতো। সারাদিন তার কিভাবে কাটে, কী করে কিছুই জানতাম না।
শম্মীর মা-বাবা আসলেই কেবল আমরা একটু হাসি-খুশি থাকতাম। এইভাবেই আরো ৬ মাস কাটলো। আমি উপার্জন করা শুরু করার পর অবশ্য আমার মধ্যে ব্যক্তিত্ববোধ জন্মালো। একটু গাম্ভীর্যের সঙ্গে চলাচল শুরু করলাম বাড়িতে।
শম্মীর মা কিন্তু আমাদের দুজনের সম্পর্ক কেমন তার আঁচ করতে পারলেন। তিনি বুদ্ধিমতী মেয়ে। শম্মী তখন ফ্ল্যাটে নেই। আমার শাশুড়ি আম্মা আমাকে একা ঘরে পেয়ে আমার পাশে বসলেন। কিছুক্ষণ আমার দিকে কেন তাকিয়ে রইলেন বুঝলাম না। হয়তো খুঁজে দেখছেন কী এমন গুন আমাকে এমন নিরামিষ , নিজের চারপাশের সবকিছু থেকে আগ্রহহীন করে রেখেছে।তারপর বলতে আরম্ভ করলেন :
তুমি কী জানো শম্মীর বিয়ে কেন ভেঙে গিয়েছিল ? ওর হবু স্বামী নাহিদ কেন বিয়ের দিন পরিবার সহ ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে ?
জ্বী না।
কখনো জানতে ইচ্ছা হয়নি ?
না।
ও অসুস্থ ছিল।
ক্যানসার নাকি ব্রেইন টিউমার ?
কণ্ঠের কৌতূহলতাটা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারিনি বলেই হয়তো হতাশ দৃষ্টিতে শাশুড়ি আম্মা আমার দিকে তাকালেন। আমি আবার যুক্ত করলাম:
এগুলো কমন তো । তাই বললাম।
তোমার কাছে কী এসব মজা মনে হচ্ছে ?
জ্বী না।
ছেলেটা শম্মীকে ভয়ংকর রকম ভালোবাসতো। কিন্তু বিয়ের দিন সকালে সে আমাকে কল করে আর জানায় তার ক্যানসার। সে বিয়ে করবে না।
আমি মুচকি হাসলাম। বললাম:
ক্যানসার! মানে বিয়ের আগের রাতে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেল। বাপ-মা এম্বুলেন্স ডেকে এনে হাসপাতালে ভর্তি করলেন। আর ডাক্তার ছুটে এসে পরীক্ষা করেই বলে দিল তার ক্যানসারের লাস্ট স্টেজ চলছে। কিছুদিন পরেই মারা যাবে! এমন ?
আমার শাশুড়ি রাগ নিয়ন্ত্রন করে বললেন :
বুঝতে পারছি , তুমি জানতে চাইছ ছেলেটা যে মিথ্যে কথা বলে শম্মীর জীবন থেকে সরে যায় নি তার প্রমাণ কী ? তার প্রমান ছেলেটা গত সপ্তাহে মারা গেছে। সে শহর ছেড়ে চলে যায়নি। শহরের একটা হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা চলছিল তার। সে শম্মীর জীবন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল শম্মী যাতে বাকি জীবন তার মৃত্যুর স্মৃতি নিয়ে না বাঁচে তাই। আর আমি তাড়াহুড়ো করে তার বিয়ে তোমার সাথে দিয়েছিলাম যাতে নতুন জীবন নিয়ে সে ব্যস্ত থেকে নাহিদ সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তুমি তোমার পুরো জীবনে তেমন করে ভালোবাসা পাওনি। তাই হয়তো ভালোবাসতেও জানো না। অথচ আমি ভেবেছিলাম যে জীবনে এত ভালোবাসা পায়নি সে শম্মীকে পেলে ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখবে। আমারই ভুল ছিল।
এই বলে তিনি উঠে দরজার দিকে গেলেন। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আবার আমার দিকে ঘুরে বললেন :
নাহিদ ঠিক বিয়ের আগের দিন ক্যানসারের কথা জানতে পারেনি। আরো অনেক আগেই জানতে পেরেছিল। তার পরিবার , তার ডাক্তার তাকে আশা দিচ্ছিল সে বাঁচবে। অপারেশনের মাধ্যমেই এর চিকিৎসা সম্ভব। যেই মুহূর্তে জানতে পারলো তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা দিতে মিথ্যা আশা দিচ্ছে সবাই তখন থেকে সে দ্বিধায় ভুগতে থাকে বিয়ে নিয়ে তবে শম্মীর মায়াও কাটিয়ে উঠতে পারছিল না।
ঠিক শেষ মুহূর্তে তাই সে সিদ্ধান্ত নেয় দূরে সরে যাবে শম্মীর জীবন থেকে। এবং আমাকে সব জানায়।
তিনি চলে গেলেন। আমার জীবনে এত বড় আঘাত বা ধাক্কা এর আগে আমি খাইনি। এই প্রথম শম্মীর জন্য আমার মায়া হলো। মনে হলো মেয়েটার আসলে অনেক দুঃখ। এই দুঃখী মেয়েটাকে এতদিন এড়িয়ে চলা উচিত হয়নি । আরেকটু আগ্রহ দেখানো উচিত ছিল। মেয়েটার জীবনে একটা ভালোবাসার মানুষ চাই । শত দুঃখেও যাকে জড়িয়ে ধরে সে কাঁদতে পারবে। সেই মানুষটা আমি হলে ক্ষতি কী ?
হঠাৎ করে মেয়েটাকে খুব করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা হচ্ছে কেন , বুঝলাম না। এই অনুভূতি এতদিন কই ছিল! চুপচাপ ঘরে বসে শম্মীর ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলাম। তাকে জানানো দরকার আমার অনুমান শক্তি খুব খারাপ। সেই মহিলাটি আর কখনো তার মেয়েকে খুঁজে পায়নি আর সেই ফার্মের বাছুরও ওইদিনই মারা গিয়েছিল।
• * * * সমাপ্ত * * *
#চুপি_চুপি_বিয়ে
.
লেখা : Masud Rana