বেপরোয়া ভালবাসা পর্ব ৪৮
#লেখনীঃ #মনা_হোসাইন
আজ বেশ বেলা করেই ঘুম ভেঙেছে আদিবার। এই দুদিনে যে ধকল গেল ঘুমিয়ে বেশ ফ্রেশ লাগছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল সে, সাথে সাথেই চারপাশে চোখ বুলিয়ে অবাক হল আদিবা। তার স্পষ্ট মনে আছে গতরাতে সে আদির ঘরে ঘুমিয়েছিল তাহলে এখন নিজের ঘরে আসল কি করে..? তবে কি আদি তাকে রেখে গিয়েছে? কিন্তু কেন? তবে কি আদির রাগ এখনো ভাংগেনি ..?
আদিবা তাড়াতাড়ি উঠে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। নিচে সবাই খাবার টেবিলে বসে আছে তবে আদি বাদে কেউ খাচ্ছে না। সবাই খাওয়া বাদ দিয়ে আদির দিকে তাকিয়ে আছে আর আদি মনযোগ দিয়ে আপন মনে খেয়ে চলেছে।আদিবা নিচে নামতেই সবাই আদির দিক থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাল।
এমনভাবে তাকাল যেন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমায় বিশেষ চরিত্রের আগমন ঘটেছে। আদিবা ইতস্ততা নিয়ে এগিয়ে আসতেই আদি খাবারে মনযোগ রেখেই পা দিয়ে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” বস…
সবাই রাগী চোখে তাকাল আদির দিকে।আদিবাও হা হয়ে তাকিয়ে আছে। আদি খেতে খেতে শক্ত কন্ঠে বলল
-“কিরে আদিবা তোকে কি ভাল করে কথা বললে গায়ে লাগে না?বসতে বল্লাম না?
আদিবা বিচলিত হয়ে আদির পাশে বসল আদি এখনো খাবার প্লেটেই মনযোগ আটকে রেখেছে আদিবা বসার পর সে মুখ তুলে তাকাল।আর বলতে শুরু করল,
-“জানি আমার এমন সিধান্তে সবাই অবাক হয়েছো সাথে রেগেও গিয়েছো কিন্তু কি করব বলো ভাগ্যের লিখন কখনো বদলানো যায় না। আমাদের ভাগ্যে এমনটাই লিখা ছিল তাই এমন হলো…
আদির বাবা এবার রেগে বললেন,
-“ভাগ্যের দোহাই দিও না আদিত্য, জীবনটা ছেলে খেলা নয়। তুমি যখন আদিবার সাথে সংসার করবেই না তখন আদিবার জীবনটা নষ্ট করলে কেন? ও তোমায় বিয়ে করতে চায়নি তবুও জোর করে বিয়ে করে কোন অপরাধের সাজা দিলে?
-“আমি ওকে সাজা দেয়ার জন্য বিয়ে করিনি বাবা। একসাথে থাকার জন্যই বিয়ে করেছিলাম কিন্তু ওকে যখন হাসপাতালে দেখলাম তখন মনে হল এই দিনটা সত্যি আসার আগে আমার ওকে মুক্তি দেয়া উচিত। মানুষ নিজের স্বভাব যতই বদলানোর চেষ্টা করুক পুরোপুরি বদলাতে পারে না আমিও হয়ত পারব না। তখন দেখা যাবে আদিবা আমার হাত থেকে বাঁচতে দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সিধান্ত নিল তখন..?
-“তারমানে তুমি সিধান্ত নিয়ে নিয়েছো…?
-“হ্যা আর আমার সিধান্ত কোন কারনেই বদলাবে না। তবে তোমাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আদিবাকে প্রেসার দিও না। সবারেই নিজের মত করে বাঁচার অধিকার আছে। তাছাড়া আদিবার কোন কিছুর অভাব আমি রাখব না মাস শেষ হওয়ার আগেই ওর প্রয়োজনীয় সব কিছু পৌঁছে যাবে তাই তোমাদের উপড় বোঝা হয়ে থাকবে এটা ভেবো না। কাকিমনি তোমাকে বলছি আদিবা বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের নিজের ভাললাগা খারাপ লাগা প্রকাশ করতে পারেনা তাই ইতিমধ্যে অনেক কষ্ট পেয়েছে তাই তোমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করব ওকে আর নতুন করে কষ্ট দিও না।ওকে আমি ছেড়ে দিচ্ছি মানে এই না যে আমি ওর উপড় অসন্তুষ্ট,ওর বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ আছে।আদিবার উপড় আমার সত্যিই কোন অভিযোগ নেই।আমি কথা দিচ্ছি আমি ওর সমস্ত ভরণ পোষনের দায়িত্ব নিব। তাই দয়াকরে এই নিয়ে ওকে দোষারোপ করে ওর উপড় অ*ত্যাচার করো না. ছয় বছর তো অনেক অত্যা*চার করেছো আর না।
-“আদি তুমি তোমার পাগলের সংলাপ বন্ধ করো যাকে ছেড়ে দিচ্ছো তার প্রতি আর দরদ নাইবা দেখালে।
-“বাবা আবারও উল্টা পাল্টা কথা বলছো আমি ওকে ছাড়ছি না মুক্তি দিচ্ছি। যাইহোক শেষ একটা কথা বলি তোমরা যদি ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করো তাহলে ওকে অন্য কোথাও রাখব তবে ওকে যদি বাসা ছাড়তে হয় তাহলে আমিও এই বাসার সাথে কোন সম্পর্ক রাখব না। বলেই আদি হাত ধুয়ে নিল। আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে আমাকে বের হতে হবে..
বলতে বলতে আদি উঠে গেল সে নিজের ঘরে যেতেই আদিবাও গিয়ে হাজির হল,
আদি শার্ট চেঞ্জ করছিল আদিবাকে দেখে থেমে গেল, -“কিছু বলবি..?
আদিবা এবার আর সহ্য করতে পারলনা কেঁদে ফেলল,
-“আজব কাঁদছিস কেন..?
আদিবা কেঁদে কেঁদে বলল,
-“আমাকে এতবড় শাস্তি দিবন না প্লিজ।
আদি লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
-“আমি জানি তুই কিসের জন্য এত অস্থির হচ্ছিস কিন্তু আদিবা যা হওয়ার সেটা তো হয়ে গিয়েছে আমি চাইলেই তোর সতীত্ব ফিরিয়ে দিতে পারব না। তুই সেদিন কেঁদেছিলি কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমি ভুলে গিয়েছিলাম জোর করে সব করা উচিত না। আমি তোর উপড় অতিরিক্ত অধিকার দেখিয়ে ফেলেছি তার জন্য আমি দুঃখিত।তবে আমি আর কখনো এই ভুল করব না দেখ গতরাতে তোর সাথে কিছু করা তো দূর তোর সাথে থাকিনি পর্যন্ত।ঐ দিনের জন্য তুই আমাকে ক্ষমা করে দে প্লিজ আর শুধুমাত্র এই কারনে নিজেকে আমার সাথে থাকার জন্য ফোর্স করিস না। জীবন তো একটাই সমাজ কিংবা পরিবার কি বলবে সেভেবে নিজেকে কষ্ট দিস না। এসব কোন ব্যাপার না কিছুদিন পরেই ভুলে যাবি।
-“আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি বলছেন..?
আদি এবার এগিয়ে গিয়ে আদিবার হাত ধরে এনে নিজের কাছে বসাল।
-“আদিবা,আমি কোনদিনি তোর ক্ষতি চাইনি যেকোন সম্পর্কে তিনটা শর্ত থাকে
মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়া অথবা ছেড়ে দেওয়া
আমি সবগুলো ধাপেই ট্রাই করেছি প্রথমে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি সেজন্য তোর থাকে নিজেকে এত বছর দূরে রেখেছি যাতে আস্তে আস্তে তোর চালচলন মেনে নিতে পারি । বিশ্বাস কর মেনে নিতে শিখেওছিলাম, যেদিন আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল তুই সেদিন নীলয়ের সাথে ফিরেছিলি আমি জেনেও রিয়েক্ট না করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমার মেনে নেওয়াটা তোর কাছে যথেষ্ট ছিল না। তারপর চেষ্টা করলাম মানিয়ে নেওয়ার তোকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম, জোর করে মানিয়ে নিতে চেয়েছিলাম তাই জোর করে বিয়ে করলাম কিন্তু তাতেও ব্যার্থ হলাম তুই মেনে নিতে পারলি না তাই এবার ছেড়ে দেয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই। আমরা দুজন দুমেরুর বাসিন্দা আমরা একসাথে থাকলে দুজনের কারোর বড় ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।তাই এখন এই একটা পথই খোলা আছে।
আদিবা আদির কথার কোন জবাব দিতে পারছে না। ভিতরটা যেন ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে।মনের মাঝে হাজার কথা জমা থাকলেও গলায় এসে আটকে যাচ্ছে কিছু বলতে পারছে না। তবে আদির অনর্গল বলে চলেছে,
-“আর একটা কথা তুই যে অযথা সন্দেহের নাটক করছিলি আমি সেটা জানতাম আমি তোর হাত কা*টার কারন জানার জন্য যখন সিসিটিভি চেক করেছিলাম তখনী দেখেছিলাম আংকেলরা এসেছে তাই তুই যে অযথা সিনক্রিয়েট করছিস জানতাম সেই জন্যেই তোর সাথে এত রুড বিহেভ করেছিলাম। এসব আমাকে সন্দেহ করার জন্য ছিল না তুই ভুল করছিস সেটা বুঝানোর জন্য ছিল। কিন্তু তুই যখন হারিয়ে গেলি বুঝলাম আমার রুড বিহেভ করাটা উচিত হয়নি তারপর তোকে যখন হাসপাতালে দেখলাম আমি ভেবেছিলাম তুই সত্যিই এ*ক্সিডেন্ট করেছিস আমি সেটা মেনে নিতে পারিনি।তখন নিজেই নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি তোর যা করার কর আমি আর তোর জীবনে ঢুকব না। তুই বেঁচে আছিস এটাই আমার কাছে অনেক। ।আমি কখনো তোর ক্ষতি চাইনি সেই ছোটবেলা থেকেই তোকে ভালবাসতাম তাই যে বিষয়গুলো তোর জন্য ক্ষতিকর সেখান থেকে তোকে বিরত রাখার চেষ্টা করতাম।তুই ব্যাথা পেলে শাস্তি দিতাম যাতে পরেরবার আরও সাবধান হোস। সে যাইহোক আমার ভালবাসার পদ্ধতিটা ভুল ছিল তাই এখন থেকে দূর থেকে চাইব তুই ভাল থাক।
বলে আদি ওয়াশরুমের দিকে চলে গেল আদিবা বুঝতে পারল আদি তার আচারনে কষ্ট পেয়েছে আর আদির সিধান্ত কোন কারনেই বদলাবে না। আদি রেডি হয়ে বের হয়ে আসল,
আদিবা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে দেখে
আদি এগিয়ে এসে আদিবার মাথায় হাত বুলিয়ে মলিন হাসল তারপর কারো কাছে কোন বিদায় না নিয়েই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল…
আদিবা অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে আদি দ্বিতীয়বার ঘুরে তাকায় নি আদি বের হতে না হতেই অরিন ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-“আদিবা আদিবা….ভাইয়াকে তুই যেতে দিস না ওকে তুই আটকা যেকরেই আটকা…আদিবা একবার বাইরের দিকে আবার অরিনের দিকে দেখছে ..
-“তাকিয়ে কী দেখছিস মুখপুড়ি? ভাইয়া আজ তোকে ছেড়ে নয় এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার বের হয়ে গেল।
অরিনের কথা শুনে আদির মা এগিয়ে এসে বললেন
-“কিসব আবল তাবল বকছিস অরিন?
অরিন এবার চোখের পানি ছেড়ে বলল,
-“আমি আবল তাবল বকছি মা দেখো ও চিরকুট লিখে গিয়েছে।
বলে অরিন একটা চিরকুট এগিয়ে দিল আদির মা সেটা পড়তে শুরু করল,
-“মা বাবা তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার মুখ আমার নেই।আমি জানি না চিরবিদায় কী করে নিতে হয় তাই কাউকে বিদায় জানাতে পারলাম না। আর আদিবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সাহস আমার নেই এই মুখের দিকে তাকিয়ে বিদায়ের কথা বলার হিম্মত আমার কোনদিন হবে না তাই এভাবে বিদায় নিচ্ছি।
-‘যাই রে আদিবা… হয়ত আর কোনদিন আর দেখা হবে না তবে আমি যেখানেই থাকি না কেন সবসময় চাইব তুই ভাল থাক। দোয়া করি সুখী হ.. আমার জন্যেও দোয়া করিস এপাড়ে তো আমার বেপরোয়া ভালবাসা পূর্ণতা পেল না. ওপাড়ে যেন পূর্ণতা পায়।
।
।
।
চলবে…!!