যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ সারপ্রাইজ পর্ব ৪
মুন্নি আক্তার প্রিয়া
________________
(১ম অংশ)
উত্তুরে হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উশখুশ করছে অর্ষার মন। বক্ষস্থল বেদনাহত। হৃদয়ে ক্লেশের জলধি। আর মাত্র তিনদিন পরই রোজার ইদ। অথচ এখনই এই সময়ে আহনাফের জরুরী কাজ পড়ে গেছে। কাজটা বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে হলেও বোধ হয় তার এতটা খারাপ লাগত না। তার খারাপ লাগা মিশে আছে অন্য স্থানে। আহনাফ তার কাজের জন্য সুইজারল্যান্ড যাচ্ছে। সবকিছু গোছগাছ করা শেষ। আজ রাতেই তার ফ্লাইট। এখন দুপুর ১টা বাজে। এই ভরদুপুরে কড়া রোদের মাঝেও ছাদে উঠে মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে অর্ষা। রোদের তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তবুও সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার কান্না পাচ্ছে। আকাশ-পাতাল এক করা কান্না।
আহনাফ নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কাঁধে স্পর্শ করতেই অর্ষা আরক্তিম দৃষ্টিতে তাকাল। পরক্ষণে সঙ্গে সঙ্গেই সরিয়ে নিল তার দৃষ্টি। সেই সঙ্গে কাঁধ থেকে সরিয়ে দিল আহনাফের হাত। তার চোখের ভাষায় আহনাফের প্রতি থাকা অজস্র অভিমানের কাব্য পড়তে বেগ পেতে হয় না আহনাফের। সে শক্ত করে অর্ষার ডান হাত চেপে ধরে রোদ থেকে ছায়ার মধ্যে নিয়ে এলো। পকেট থেকে রুমাল বের করে অর্ষার মুখে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিয়ে বলল,
“এমন করছ কেন?”
অর্ষা ভীষণ অভিমানি কণ্ঠে বলল,
“কী করেছি আমি?”
“এই সময়ে কেউ ছাদে আসে?”
“আমি আসি। সমস্যা আপনার?”
“অনেক সমস্যা। এইযে রোদে থেকে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছ; তোমার কি ধারণা তুমি একাই কষ্ট পাচ্ছ?”
“আমি কষ্ট পাই, সুখ পাই সেটা আমার ব্যাপার। আপনার এত মাথা-ব্যথা কেন?”
“কারণ তুমি আমার।”
অর্ষা তাকাল আহনাফের দিকে। ঐ দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলানো দুষ্কর। ভয়ঙ্কর রকম প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অর্ষা এই মুহূর্তে সেটা যাচ্ছে না। তার অভিমানের মূল্য রয়েছে।
অভিমান ভাঙাতে আহনাফ অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“প্লিজ! এভাবে রাগ করে থেকো না। যাওয়ার আগে তোমার হাসি মুখটা দেখে যেতে চাই।”
কান্না আটকে রাখার বাঁধ ভেঙে গেছে আহনাফের শীতল ছোঁয়ায়। হুহু করে কেঁদে কেঁদে অর্ষা বলে,
“বিয়ের পর এটা আমাদের প্রথম ইদ। প্লিজ থেকে যান।”
“একটু বোঝার ট্রাই করো। আমাকে সেখানে দরকার। না হলে কি এতবার তোমায় অনুরোধ করতে হয় বলো?”
অর্ষা বুঝতে পারে, কাজটা জরুরী। কিন্তু তার অভিমানের পারদ কমতে নারাজ। নিজেকে আহনাফের থেকে ছাড়িয়ে নিল। দু’হাতে চোখ মুছে বলল,
“বেশ। যান। সাবধানে যাবেন।”
আহনাফকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে নিচে নেমে যায়। রাফির রুমে গিয়ে দরজা আটকে বসে থাকে। জহির চৌধুরী, আমেনা বেগম, আহিল, রেণু, রাফি, আহনাফ কারও কথাতেই সে দরজা খোলে না। ভেতর থেকে প্রতিবারই শুধু প্রত্যুত্তর করে বলেছে,
“আমার এখন ভালো লাগছে না। ঘুমাব আমি।”
এই ঘুমের বাহানা চলল আহনাফ চলে যাওয়ার মুহূর্ত পর্যন্ত। অনেকবার ডাকার পরও সে আহনাফের ডাকে সাড়া দেয়নি। সকলে যখন একত্রে এসে দরজা ধাক্কিয়েছে কেবলমাত্র তখনই দরজা খুলেছে অর্ষা। কিন্তু সেই সময়ে আর অর্ষাকে একা করে পাওয়ার, রাগ ভাঙানোর সুযোগ নেই আহনাফের। যাওয়ার পূর্বে বলল,
“এয়ারপোর্টে যাবে না?”
অর্ষা না তাকিয়েই বলল,
“না। শরীরটা ভালো লাগছে না।”
আহনাফ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,
“আচ্ছা। রেস্ট নাও। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কোরো। নিজের খেয়াল রেখো।”
অর্ষা কান্না লুকিয়ে রাখতে পারছে না আর। তাকাতেও পারছে না। আহনাফ চলে যাচ্ছে। তবুও সে পারছে না চোখ মেলে তাকাতে। অভিমান তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। সে চুপ করে বিছানায় বসে থাকে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে নোনাজল। সেই জলে গলে যায় অভিমানের পারদ। দৌঁড়ে বেরিয়ে যায় বাইরে। ততক্ষণে গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে রাশেদ। আহনাফ জানালা দিয়ে অর্ষাকে দৌঁড়ে আসতে দেখে উতলা হয়ে পড়ে। ব্যস্ত হয়ে রাশেদকে বলে,
“গাড়ি থামাও রাশেদ।”
গাড়ি থামানোর পর আহনাফ তড়িঘড়ি করে নেমে আসে। অর্ষা দৌঁড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আহনাফের বুকে। হাউমাউ করে কাঁদছে সে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আহনাফ। সে অর্ষার মুখ দু’হাতে তুলে কপালে, গালে চুমু খেয়ে বলে,
“প্লিজ! কাঁদে না জান। আমি চলে আসব। কাজটা শেষ করেই চলে আসব সত্যি।”
কান্নার জন্য অর্ষা কথাও বলতে পারছে না। কেবল শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে আহনাফের শার্ট। এতটা আবেগী যে সে কবে থেকে হলো কে জানে! কেন সে একটা মুহূর্তও আহনাফকে ছাড়া থাকতে পারে না, সে জানে না।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#সিজন_টু
#সারপ্রাইজ_পর্ব (৪)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_____________
(২য় অংশ)
আশিকের বাড়িতে আজ গ্যাঞ্জাম পার্টির ইফতারের দাওয়াত রয়েছে। সবাই তাই সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। আশিকের মা আসমা বেগম এবং কাজের মেয়ে বকুল আশিকের ঘরে বিছানায় বসে কাজ করছিলেন। আশিক সেখানে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আহিল ওর কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ফোন করেছি। দেখিস নাই নাকি?”
আশিক মুখ গোমড়া করে দাঁড়িয়ে আছে। বাকিরা আসমা বেগমকে আগে সালাম দিল। আসমা বেগম হাসিমুখে সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
“বসো আব্বু, আম্মু। আমি আসছি। আশিক, ওদেরকে নিয়ে যা।”
আশিক এবার মুখ খুলল। সে কাঠকাঠ গলায় বলল,
“মা, তুমি রোজা-রমজানের দিন ছারপোকাগুলোকে মারছ কেন?”
ওর এমন প্রশ্নে সকলে বিস্মিত। আশিক ফের বলল,
“কালকে ইদ। আর আজ তুমি ছারপোকা মারছ। ওদের কি ইদ করতে ইচ্ছে করে না?”
আসমা বেগম বললেন,
“শুনেছ? আহাম্মকের কথা শুনেছ তোমরা? ছারপোকা নাকি ইদ করবে!”
এরপর তিনি ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“গাধা! রাত হলেই যে কা’ম’ড়া’য়, র’ক্ত খায় এগুলো খুব ভালো না?”
“একটা রাতে র’ক্ত বেশি খেলে কী এমন হতো?”
অর্ষা আশিকের হাত ধরে বলল,
“হৃদয়বান ব্যক্তি, আপনি আসেন আমাদের সাথে।”
সবাই মিলে ড্রয়িংরুমে বসল। জুঁই হাসতে হাসতে বলে,
“ছারপোকার প্রতি তোর এত দরদ! তোর রাতের সঙ্গী নাকি ওরা?”
“বাজে কথা বলবি না। তোর কুইকুই করার স্বভাব জীবনেও যাবে না, না? ওরা ছারপোকা হলেও তো মানুষ।” মেজাজ দেখিয়ে বলল আশিক।
সবাই সমস্বরে বলল,
“কী?”
“না মানে বলতে চাইছি, ওরা ছারপোকা হলেও তো প্রাণী। ওদেরও তো ইদ করার অধিকার আছে। আছে না বল?”
আহিল ওর পিঠ চাপড়ে বলল,
“থাম ভাই! তুই প্রাণীবিজ্ঞানী হবি নাকি ভবিষ্যতে?”
“তোরা যে পাষাণ,নিষ্ঠুর বুঝলি?”
মুন বলল,
“বুঝছি। এবার চুপ কর। স্বাভাবিক হ।”
“আমি অস্বাভাবিক?”
“তোর কোনো সন্দেহ আছে?”
“রোজা আছি তাই কিছু বললাম না।”
“তোর কিছু বলতেও হবে না। তুই আকাশে যা। সবাই তোকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।”
“তুই কি আমাকে ইনডিরেক্টলি ম’র’তে বললি? আকাশে যাব মানে কী?”
“দশ লাইন বেশি বোঝে। তোর নাম কী? মুন? মুন মানে চাঁদ। আর আজ চাঁদ রাত। সবাই আজ চাঁদ দেখবে না?”
মুনের মুখটা এবার হাসি হাসি হলো। উবে গেল কপালের কুঁচকানো ভাঁজ। মুখের ওপর হাত রেখে হেসে বলল,
“যাহ্! কী যে বলিস না।”
গল্প তখন আর বেশিদূর এগুলো না। ইফতারের সময় প্রায় হয়ে গেছে। আসমা বেগম সবাইকে খেতে ডেকেছেন। ইফতার সামনে নিয়ে অর্ষা মনে মনে দোয়া করে, যাতে করে আহনাফ জলদিই ফিরে আসে। ইফতারের সময় করা দোয়া কবুল হয়। আর এই সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না মোটেও। সবাই মিলে একসাথে ইফতার করে ছাদে চলে যায়। পাটি বিছিয়ে একসাথে বসেছে। এখন সবাই মিলে হাতে মেহেদি দেবে। ছাদে লাইটিং এর ব্যবস্থা থাকায় কোনো অসুবিধা হবে না। রাতের ডিনারও আশিকের বাসায় করতে হবে। আসমা বেগম আগেই বলে দিয়েছেন। মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মেহেদি দিতে পারে রেশমি। সবাইকে আজ সে-ই মেহেদি দিয়ে দেবে। আহিল একটা মেহেদি নিয়ে চলে গেল ছাদের কর্ণারে। আশিক আর দিদার বক্সে ইদের গান বাজাচ্ছে। মেহেদি দেওয়া শেষ হলে সবাই একসাথে তারাবাতি, আতশবাজি ফুটাবে।
আহনাফ বেশ কয়েকবার অর্ষাকে হোয়াটসএপে কল দিয়ে না পেয়ে আহিলকে কল করে। আহিল ফোন এনে বলল,
“ভাইয়া ফোন করেছে।”
অর্ষা আড়দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে ফোন কানে নিল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো মন ভালো করা কণ্ঠস্বর।
“কী করছ?” জানতে চাইল আহনাফ।
“মেহেদি দেই।”
“ছবি দিও।”
“আচ্ছা।”
“ইফতার করেছ?”
“হ্যাঁ।”
“মন খারাপ?”
“একটু।”
“কেন?”
“আপনি কখন আসবেন?”
আহনাফ হেসে ফেলে। বলে,
“সকালেই পৌঁছে যাব।”
“আমি কি এয়ারপোর্টে আসব?”
“না। তুমি রেডি হয়ে থেকো। আমি এসে ঘুরতে নিয়ে যাব।”
“আচ্ছা।”
“রাখছি তাহলে এখন। তুমি মেহেদি দাও।”
“আপনি খেয়েছেন? না খেলে খেয়ে নিয়েন।”
“ঠিকাছে।”
অর্ষা ফোন রেখে আহিলকে ডাকল। ফোন দেওয়ার সময় আহিলের হাত চেপে ধরে সে। আহিল ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায়। অর্ষা চোখের ইশারায় হাত দেখিয়ে বলে,
“এসব কী?”
আহিল হাতের দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে যায়। মেহেদি দিয়ে সকালের নাম লিখেছে সে। মুন হেসে বলে,
“বুঝিস না কী? তলে তলে টেম্পু চালায় মামা। আর আমরা বললেই হরতাল।”
আহিলের কাছে কোনো জবাব নেই। সে ফোনটা নিয়ে তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে চলে যায়। কেমন যেন চোর চোর ফিল হচ্ছে তার।
মুন আশিক আর দিদারকে ডেকে বলল,
“কিরে তোরা কারও নাম লিখবি না হাতে?”
আশিক প্রলম্বিত শ্বাস নিয়ে বলল,
“তোরাই দে বইন মেহেদি,
আমরা তো দুজন সিঙ্গেল কয়েদী!”
“বেচারা দেবদাস!” আফসোস করে বলল রেশমি।
চাঁদ রাতে বন্ধুরা একত্রে থেকে আড্ডা দিয়ে বেশ ভালো একটা সময় কাটিয়েছে। ডিনারের সময় আদিব এসেছিল। আসমা বেগমই ফোন দিয়ে আনিয়েছেন। ডিনার করা শেষ হলে আদিব মুনকে নিয়ে বাড়িতে চলে যায়। লামিয়া, জুঁই আর রেশমিকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে আশিক এবং দিদারের ওপর। আর অর্ষাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আহিল। পথে অর্ষা বলে,
“চল একটু আমাদের বাড়িতে যাই।”
আহিল হাত-ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
“রাত এগারোটা বাজে। এখন যাবি?”
“হ্যাঁ। যার নাম হাতে লিখেছিস তার মেহেদি রাঙা হাতটা দেখবি না?”
আহিল লজ্জা পেয়ে হাসল। তবে কোনো দ্বিমত করল না। বরং অর্ষার এই সিদ্ধান্তে সে ভীষণ খুশি হয়েছে।
বাড়িতে গিয়ে দেখল হাতে মেহেদি দিয়েই সকাল ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মাথার কাছে বসে ঘুমাচ্ছে প্যাটিস। দৃশ্যটা কী যে আদুরে লাগছিল! তাই পারমিশন ছাড়াই আহিল কয়েকটা ছবি তুলে নিল। অর্ষা চোখ পাকিয়ে বলে,
“এটা কী হলো?”
আহিল অর্ষার গাল টেনে বলে,
“রাগ করিস কেন? আমারই তো বউ।”
অর্ষা চোখ রাঙায়। আহিল থতমত খেয়ে বলে,
“না মানে, হবু বউ আরকি।”
অর্ষা অন্যপাশ ফিরে হাসল। বাবা-মা, ভাইয়া অনেকবার করে আজকে রাতটা থেকে যেতে বলল। কিন্তু উপায় নেই। জহির চৌধুরী বলে দিয়েছেন, প্রথম ইদটা ওই বাড়িতেই করতে হবে। পরেরদিন বাবার বাড়ি বেড়াতে আসবে। তাই কেউ আর বেশি জোরাজুরি করল না।
_____
সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে নেয় অর্ষা। সে আর রেণু মিলে সেমাই, পায়েস, খিচুড়ি রান্না করে। পোলাও, মাংস পরে রেণু রান্না করবে। রান্না করতে করতে অর্ষা আহনাফের আসার অপেক্ষা করছিল। রান্না শেষ হলে খাবার টেবিলে নিয়ে যায় অর্ষা। সেই সময়ে বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠে। মন বলছে আহনাফ এসেছে। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে, মন ভুল কিছু বলেনি। হাসি হাসি মুখ করে আহনাফ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আদ্যোপান্ত কোনো কিছু না ভেবেই অর্ষা শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। আলিঙ্গন করে নেয় আহনাফও। পরপর তিনটে চুমু খায় অর্ষার মাথায়। ভালোবাসায় ভাগ বসাতে দৌঁড়ে আসে অ্যানিওন আর ক্যাথিওনও। ওরা আহনাফের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে ডাকছে,’ম্যাও, ম্যাও’
অর্ষা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“এই বিড়াল দুটো এত হিংসুটে!”
আহনাফ হাসল। অ্যানিওন আর ক্যাথিওনকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। অর্ষা গম্ভীরকণ্ঠে বলে,
“আজ ইদ বলে, তোদের কিছু বললাম না বিচ্ছু!”
আহনাফ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে গোসল করে নিল। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পাঞ্জাবি পরে তৈরি হয়ে নেয় নামাজ পড়তে যাওয়ার জন্য। নিচে জহির চৌধুরী, আহিল এবং রাফি অপেক্ষা করছিল। আহনাফের দেরি হচ্ছে দেখে অর্ষা ডাকতে আসে। দরজায় দাঁড়িয়েই আহনাফকে দেখে মিষ্টি হাসে। এগিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে বলে,
“আপনি এত সুন্দর কেন?”
“আমার প্রজাপতির দেখার চোখ সুন্দর তাই।”
“উঁহু! এছাড়াও আপনি ভীষণ সুন্দর। নিশ্চয়ই খুব যত্ন করে আল্লাহ্ আপনাকে বানিয়েছেন। এত নিঁখুত আপনি! আমার তো ভয় হয় মাঝে মাঝে।”
“ভয় কেন?”
“কখনো হারিয়ে না যান আমার থেকে!”
আহনাফ অর্ষার কোমর চেপে ধরে আরেকটু কাছে টেনে বলল,
“এই জীবন থাকতে সেটা কখনো সম্ভব নয়। ইহকালে যে ক’টা দিন বাঁচি তোমাকেই জীবনসঙ্গিনী করে বাঁচব ইন-শা-আল্লাহ্। চোখের আড়ালই হতে দেবো না; হারানো তো দূরের ব্যাপার। আল্লাহকে বলব, যদি একটাও পূণ্য জীবনে করে থাকি তাহলে সেই পূণ্যের বিনিময়ে হলেও আল্লাহ্ যেন পরকলেও আমাদের একসাথে রাখেন।”
অর্ষা কিছুই বলতে পারল না। আনন্দে তার চোখ-মুখ চকচক করছে। সে আলগোছে মাথা রাখল আহনাফের বুকে। আহনাফ অর্ষার মুখটা তুলে দু’গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে বলল,
“নামাজে যেতে হবে না?”
অর্ষা হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়ল। অর্ষার হাতে রান্না করা সেমাই, পায়েশ খেয়ে বাবা, দুই ছেলে এবং রাফি ইদের নামাজ পড়তে চলে যায়।
ওরা যাওয়ার পর অর্ষা আমেনা বেগমকে গোসল করিয়ে ইদের নতুন শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে দেয়। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলে,
“আপনাকে কত সুন্দর লাগছে মা!”
তিনি হেসে বলেন,
“আমার পাশে থাকা মিষ্টি মেয়েটার চেয়ে কম। যাও যাও, তুমিও গিয়ে রেডি হও।”
আমেনা বেগমকে খেতে দিয়ে অর্ষা নিজের রুমে এলো। বাড়িতে ভিডিয়ো কল করে সকাল আর মায়ের সঙ্গে কথা বলে। বাবা আর ভাই নামাজে গেছে তাই কথা হয়নি। কথা শেষ করে অর্ষা গোসল করে রেডি হয়ে নেয়। বেবি পিংক কালার একটা গাউন পরেছে সে। আহনাফ পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল। হালকা মেকাপ করে দুই হাতে চুড়ি পরেছে। পায়ে পরেছে পাথরের পায়েল। সেজেগুজে সে অপেক্ষা করছে আহনাফের আসার জন্য। সে ফিরলে বন্ধুদের সঙ্গে একসাথে ঘুরতে যাবে। অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে নামাজ শেষ করে আহনাফ বাড়িতে ফেরে। অর্ষা দৌঁড়ে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে,
“আমার সালামি?”
আহনাফ হেসে ফেলে বলে,
“সালামি দিতেই হবে?”
“অবশ্যই।”
“দেবো। আগে বাকিদের থেকে নিয়ে নাও। আমারটা প্রাইভেট তো। সবার সামনে দেওয়া যাবে না।”
“ভুজুংভাজুং বলে লাভ নেই। আমার সালামি চাই।”
“বলেছি তো দেবো। দশটা না, পাঁচটা না; আমার একটা মাত্র বউ। সালামি না দিয়ে কোথায় যাব? ঠিকাছে রুমে চলো।”
“রুমে কেন?”
“বললাম না প্রাইভেট।”
এরপর সে অর্ষাকে টেনে রুমে নিয়ে গেল। ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে অর্ষার কাছে এসে দাঁড়ায়। বিব্রতবোধ করে অর্ষা। আহনাফ আরও কাছে এসে ঘাড়ে এক হাত রেখে অন্য হাত চুলের মাঝে ডুবাতেই ছিটকে দূরে সরে যায় অর্ষা। কাঠকাঠ গলায় বলে,
“একদম না! নতুন জামা পরে, সেজেগুজে রেডি হয়েছি। এখন কিছু করা চলবে না।”
আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে তাকায় আর জিজ্ঞেস করে,
“কী করা চলবে না?”
“আপনি যা চাচ্ছেন।”
অর্ষা কী বলতে চাইছে বুঝতে পেরে আহনাফ শব্দ করে হেসে ওঠে। অর্ষা রেগে যায়।
“হাসির কী হলো?”
আহনাফ হ্যাঁচকা টানে অর্ষাকে কাছে টেনে আনে। নাকের ডগায় চুমু খেয়ে বলে,
“তুমি যা ভাবছ এখন সেসব কিছু করব না। পুরো রাত তো পড়েই আছে। এখন কাছে টেনেছি অন্য কারণে।”
“কী কারণ?”
“আগে চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করো।”
“কেন?”
“খোঁপা করলেই সুন্দর লাগবে।”
“ঠিক আছে।”
চুল খোঁপা করার জন্য অর্ষা ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসল। পেছন থেকে আয়নায় তাকে দেখছে আহনাফ। খোঁপা করা শেষ হলে অর্ষা বলে,
“হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
এরপর আহনাফ মানিব্যাগ বের করে এক হাজারের পাঁচটা নোট বের করে অর্ষার হাতে দিয়ে বলে,
“আপনার সালামি বিবিজান।”
অর্ষা হেসে ফেলে। আহনাফকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে,
“থ্যাঙ্কিউ।”
আহনাফ অর্ষাকে ঘুরিয়ে সামনে দাঁড় করায়। পাঞ্জাবির পকেট থেকে তাজা ফুলের গাজরা বের করে খোঁপায় জড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
“এবার সুন্দর খোঁপাটি পূর্ণতা পেল।”
অর্ষা আয়নার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আর আমার পূর্ণতা?”
আহনাফ হেসে অর্ষার ঠোঁটে গাঢ় চুমু খেয়ে বলে,
“পূর্ণতা দিতে গিয়ে লিপস্টিক খেয়ে ফেললাম।”
অর্ষা হেসে আহনাফের বাহুতে কিল বসায়। আহনাফ একহাতে অর্ষার কোমর ধরে গালে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার বউটা!”
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]