কিছু জোড়া শালিকের গল্প পর্ব ৭
#কমনসেন্স
লেখিকা: #Lucky_Nova(কপি নিষেধ)
সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে এসেছে প্রয়াস। ও আসার পর থেকেই তিয়াসার মুখটা আবার সচ্ছল হয়ে গেছে। সে চুপচাপ পিছু নিয়ে চলে এসেছে প্রয়াসের ঘরে।
প্রয়াস গোসল সেড়ে বেরিয়েছে মাত্রই।
রেখা চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। প্রয়াস আসার পরে। আর যাওয়ার আগে কিছু কথাও বলে গেছে তিয়াসার বিষয়ে।
প্রয়াস আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিতে নিতে একবার তাকালো তিয়াসার দিকে।
প্রয়াস তাকাতেই তিয়াসার ঠোঁটের কোণটা আরেকটু প্রসারিত হলো।
প্রয়াস চোখ সরিয়ে চুল ঠিক করে নিলো। তারপর তিয়াসার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “কোথায় থাকো তুমি? মানে বাসা কোথায় তোমার?”
তিয়াসার হাসিটা উবে গেলো খানিক। একটু মলিন দেখালো চোখটা।
প্রয়াস খেয়াল করলো সেটা। বাসার কথা তুললেই মেয়েটার মুখ চুপসে যায়। কিন্তু কেনো?
প্রয়াস পরবর্তী প্রশ্ন করার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। প্রয়াস নিচে নেমে গেলো দরজা খুলতে। তিয়াসাও এলো।(লেখিকা লাকি নোভা)
দরজা খুলতেই দু’জন ভদ্রমহিলাকে দেখলো প্রয়াস।
তিয়াসাও ঘাড় উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করলো।
“আপনি কি প্রয়াস সিনহা?” হাসিমুখে প্রশ্ন করলেন একজন ভদ্রমহিলা। বয়স কমবেশ তেত্রিশ চৌত্রিশ।
“হ্যাঁ। আপনারা?”
“আমি রুবি আর ইনি এমা। আমরা ‘প্রেরণা’ থেকে এসেছিলাম। আপনি ফোন করেছিলেন আমাদের।”
প্রয়াস বুঝতে পেরে হ্যাঁবোধক ভাবে মাথা নাড়লো। ভিতরে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমিই। ভিতরে আসুন।”
ভিতরে এলেন তারা। কিন্তু বসতে চাইলেন না। তাড়া আছে।
প্রয়াস তিয়াসার দিকে একবার তাকিয়ে তারপর বলল, “আসলে ওর জন্যই কথা বলেছিলাম আমি। কিছুদিনের জন্য রাখলেই হবে। যতদিন না ওর বাসা থেকে খবর আসে।”
রুবি মিষ্টি হাসি দিয়ে তিয়াসার দিকে তাকালেন। বন্ধুসুলভ ভাবে বললেন, “ভারি মিষ্টি দেখতে তো তুমি।”
বলতে বলতে তিয়াসার কাছে এগিয়ে এলেন তিনি। তিয়াসার কিছুই বোধগম্য না হওয়ায় সে তাকিয়ে রইলো অবুঝ চাহনিতে। ড্যাবড্যাব করে।
রুবি হেসে হেসে কথা বললেন বেশ কিছুক্ষণ। ভাব জমাতে চাইলেন। হয়তো খানিকটা সফলও হলেন। কিন্তু বিপদ বেধে গেলো নিয়ে যেতে চাওয়ার সময়। এতক্ষণে হয়তো বিষয়টা বোধগম্য হলো তিয়াসার। তারা ওকে প্রয়াসের কাছ থেকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। বোঝার সাথে সাথে সে রুবির থেকে সরে প্রয়াসের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
অবাক হয়ে গেলো উপস্থিত সবাই।
প্রয়াস তিয়াসার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে স্বাভাবিক মুখে বলল,”ওনাদের কাছেই কিছুদিন থাকতে হবে তোমার। যতদিন না তোমার বাসা থেকে খবর পাচ্ছি।”
তিয়াসা অস্থির হয়ে উঠলো শুনে।
রুবি এগিয়ে এসে বলল,”তিয়াসা চলো আমাদের সাথে। অনেক মজা করবো আমরা। ওখানে অনেক ফ্রেন্ড হবে তোমার।”
রুবি তিয়াসার হাত ধরতে আসতেই তিয়াসা খামচে ধরলো প্রয়াসের পিঠের কাছের শার্ট।
হতভম্ব হয়ে গেলো প্রয়াস।
“ওনারা ভালো৷ তোমার খেয়াল রাখবে।” বুঝানোর চেষ্টা করলো প্রয়াস।
কিন্তু লাভ হলো না।
“দেখি ছাড়ো আমাকে।” নরম ভাবে বলে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই কেঁদে ফেললো তিয়াসা। আরো শক্তভাবে চেপে ধরলো প্রয়াসের শার্ট।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো প্রয়াস। সাথে রুবি আর এমাও।
প্রয়াস কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। মেয়েটা নাক টেনে টেনে কেঁদেই যাচ্ছে। নিঃশব্দ কান্না।
“ও মনে হয় আপনার কাছেই থাকতে চায়।” বলল এমা।
“অসম্ভব।” হুট করে বলে উঠলো প্রয়াস।
এভাবে বলে উঠে নিজেই অপ্রতিভ হয়ে পড়লো কিছুটা। আসলে মেয়েটার খামখেয়ালিপনা অনেক। নাহলে রাতে এভাবে একসাথে ঘুমোতে চায়? কোনো মানে হয় এসবের!
“ও তো মনে হয় যেতে চাইছে না। আর ও কী সত্যিই আপনার পরিচিত নয়? দেখে তো মনে হয় মেয়েটি আপনাকে ছাড়া আর কাউকে ঠিক ভরসা করছে না।” বলল এমা।
বিষয়টা অদ্ভুত ঠেকছে প্রয়াসের। মেয়েটা তো ওকে চেনেই না। তাও ভরসা করবে কেনো?
প্রয়াস আরেকবার তিয়াসাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়েও করলো না। মেয়েটা পিঠের সাথে মুখ গুজে কাঁদছে।(লেখিকা লাকি নোভা)
“আমার মনে হয় আপনার কাছেই রাখতে হবে কষ্ট করে।” মৃদু হেসে বলল রুবি।
“তাই-ই তো মনে হচ্ছে।” নিস্পৃহ চাহনিতে তিয়াসার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল প্রয়াস।
তিয়াসাকে না নিয়েই চলে যেতে হলো ওনাদের। এতক্ষণে কান্নাকাটি থামালো তিয়াসা। কিন্তু মুখটা এখনো একটু শুকনো। চিন্তা রয়েই গেছে ওর।
রাতের খাবার সেরে তিয়াসাকে প্রশ্ন করতে বসলো প্রয়াস। তিয়াসা বিছানায় বসে আছে। আর প্রয়াস সামান্য দূরে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে সূচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
“এখন বলো তো কী সমস্যা তোমার? কী লুকাচ্ছো তুমি?”
চোখ পিটপিটিয়ে তাকালো তিয়াসা।
“বাসা কোথায় তোমার? আমার তো মনে হয় তুমি ইচ্ছে করেই বলছ না। আর বাসায় যেতে চাইছো না কেনো? বলো।”
তিয়াসা আগের মতো চুপসে চুপ করে রইলো দেখে প্রয়াস গমগমে গলায় বলল,”এখনি যদি না বলো তাহলে ওদের ফোন করে আসতে বলবো। জোর করে পাঠাবো তোমাকে।”
তিয়াসার মুখটা দেখে মনে হলো ও বিশ্বাস করেছে। অর্থাৎ ভয় দেখানোটা কাজে লেগেছে।
“করবো ফোন?” তীক্ষ্ণ চাহনিতে চেয়ে বলতেই তিয়াসা দ্রুত নাসূচক মাথা নাড়লো। চোখে জল ছলছল করছে।
“তাহলে বলো..মানে লেখো।” চোখ দিয়ে নোটপ্যাডটার দিকে ইশারা করলো প্রয়াস।
তিয়াসা নত মুখে খুললো নোটপ্যাডটা। চোখের জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। মুখটায় বাচ্চাদের মতো অভিমানের ছাপ।
সময় নিয়ে লিখলো কিছু। কলম থামতেই প্রয়াস এগিয়ে এসে হাতে নিলো নোটপ্যাডটা।
মাত্র তিনটা শব্দ।
‘আমি যাব না।’
ভ্রু কুচকে গেলো প্রয়াসের। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে কড়া কিছু শুনাতে উদ্যত হবার আগেই তিয়াসা জড়িয়ে ধরলো ওকে। কেঁদে উঠলো ক্ষীণ শব্দ করে।
প্রয়াস থমকালো। এলোমেলো হয়ে গেলো চোখের দৃষ্টি। অস্বাভাবিক হয়ে গেলো হৃদযন্ত্র।
এই মেয়ের মাথায় সত্যিই সমস্যা আছে।
“ছাড়ো আমাকে।”
তিয়াসা বুকে মুখ গুজে রেখেই নাসূচক মাথা নাড়লো।
ভারি জ্বালা তো!
“আচ্ছা কোথাও যেতে হবে না, ছাড়ো।”
তিয়াসা মুখ তুলে তাকালো আগে। ভিজে চোখমুখের চাহনি বলতে চাইছে, ‘সত্যি তো?’
প্রয়াস হয়তো আন্দাজ করতে পারলো।
“বলেছি তো। ছাড়ো এখন।”
এতক্ষণে হাসলো তিয়াসা। সেই কোমলতার ভরা স্নিগ্ধ বোবা হাসি।
প্রয়াসকে ছেড়ে চোখ মুছলো তিয়াসা। প্রয়াস নিজে থেকেই একটু সরে দাঁড়ালো। গম্ভীর চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “শুধু এটা বলো যে তোমার পিঠের দাগগুলো কীসের? মারের?”
চোখ মুছতে মুছতে প্রয়াসের দিকে তাকালো তিয়াসা।
চোখমুখ আবার কেমন হয়ে গেলো যেন। আতঙ্কগ্রস্ত, শঙ্কিত।(লেখিকা লাকি নোভা)
“কেউ মারতো তোমাকে?” সন্দিহান চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো প্রয়াস।
তিয়াসা ভীত চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নাড়লো একটু। তারপর কেমন হাঁসফাঁস করা শুরু করলো ও। বুক ওঠানামা করা শুরু করলো ঘনঘন।
প্রয়াস খেয়াল করলো তিয়াসা কাঁপছে থরথর করে।
অবাক হলো প্রয়াস। এগিয়ে গিয়ে আলতো করে ওর দুইবাহু ধরে বলল, “শান্ত হও। এমন করছো কেনো?”
তিয়াসা তাকালো চোখ তুলে। চোখে জল কানায় কানায় ভর্তি হয়ে আছে। ঠোঁট কাঁপছে।
“ভয় নেই৷ শান্ত হও।” স্বাভাবিক মুখে বলল প্রয়াস।
তিয়াসা শান্ত হলো আস্তে আস্তে।
প্রয়াস বিছানায় নিয়ে বসালো ওকে।
রেখা আজ শাড়ি পরাতে গিয়েই দাগগুলো দেখেছিলো। সন্ধ্যায় চলে যাওয়ার আগে সেবিষয়ে আলাদাভাবে বলে গেছে প্রয়াসকে। প্রয়াস ভেবেছিলো প্রশ্নটা সরাসরি তিয়াসার পরিবারের লোককেই করবে, যেদিন তারা খোঁজ পেয়ে আসবে।
কারণ তিয়াসার হাবভাবে মনে হচ্ছে ওর পরিবারের লোকেদের মধ্যেই ঘাপলা আছে। নাহলে তিয়াসা বাসায় যেতে চাইবে না কেনো।
অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরলেও আজ আর কথা বাড়ালো না প্রয়াস।
তিয়াসাকে বলল, “শুয়ে পড়ো এখন।”
কথাটা বলে প্রয়াস বের হয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তিয়াসাও রওনা হলো।
বুঝতে পেরে থামলো প্রয়াস। ঘুরে তাকালো তিয়াসার দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “আমার পিছু নিচ্ছো কেনো তুমি?”
তিয়াসার ঠোঁটের হাসিটা আরেকটু প্রশস্ত হলো। যার অর্থ বুঝতে দেরি হলো না প্রয়াসের।
“ভুলেও ভেবো না যে আমি তুমি আবার একসাথে ঘুমাবো। ভুলেও না।” তর্জনী তুলে হালকা হুমকি দিয়ে বলল প্রয়াস।
তিয়াসা শুনলো না। ও প্রয়াসের সাথেই ঘুমাবে। মানে আজ রাতের ঘুমটাও নষ্ট করতে চাইছে মেয়েটা।
প্রয়াস দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গমগমে গলায় বলল, “এই তোমার মাথায় কি সামান্য কমন সেন্সটুকুও নেই? বোকা তুমি? আমি একটা ছেলে আর তুমি একটা মেয়ে। আমাদের একসাথে ঘুমানো যাবে না। বুঝেছো?”
তিয়াসা ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে রইলো।
প্রয়াস বুঝলো যে এই মেয়ে বুঝেতেই পারেনি। এতে খানিক বিরক্ত হলো প্রয়াস। এই মেয়ের মানসিক চিকিৎসার দরকার।(লেখিকা লাকি নোভা)
“বোঝা না বোঝা তোমার ব্যাপার। আমি আলাদা ঘুমাবো।” বলেই অন্য রুমের দিকে যেতেই তিয়াসাও চলে এলো।
প্রয়াস কোমড়ে হাত রেখে সরু চাহনিতে চেয়ে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার কি ভয়ডর নেই?”
তিয়াসা চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে রইলো। হয়তো কীসের ভয়ডর লাগতে হবে সেটাই বুঝলো না।
প্রয়াস গম্ভীর চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীর পায়ে তিয়াসার কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বলতে লাগল, “রাতে যদি আমি কিছু করে ফেলি তোমার সাথে? তখন কী করবা?”
বলতে বলতে একদম কাছে এসে দাঁড়ালো প্রয়াস।
“যদি বাজেভাবে ছুঁই তোমাকে? তখন কী করবা? কথাও তো বলতে পারো না যে চিৎকার করবা। আর করলেও বা কে আসবে?
তিয়াসার হাসিটা মুখ থেকে সরে গিয়ে প্রশ্নসূচক হয়ে উঠলো চেহারাটা।
প্রয়াস স্থির শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তিয়াসার চোখের দিকে। ও চাচ্ছে তিয়াসা নিজে থেকেই অন্যরুমে চলে যাক। কিন্তু তার আর হলো কই!
মিনিট কয়েক ধরে তিয়াসা চোখ পিটপিটিয়েই যাচ্ছে। ওর মতিগতির কোনো পরিবর্তন না দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো প্রয়াসের। তাহলে কি এত কথা বলার ফলাফল দাঁড়ালো শূন্য?
“কী ভাবছো তুমি? বোঝো নি কি বললাম আমি? চুপচাপ অন্য রুমে যাও।”
তিয়াসা নাসূচক মাথা নাড়লো।
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো প্রয়াস। শক্ত মুখ করে বলল, “মাথার তার ছেড়া নাকি তোমার?”
তিয়াসা নড়লো না। অর্থাৎ বোঝাপড়া করে কিছুই লাভ হলো না। অতঃপর প্রয়াসকে তিয়াসার সাথে এক বিছানাতেই শুতে হলো।
কী যে অস্বস্তিতে পড়েছে প্রয়াস তা বোধহয় ওর মতো ঠেলার না পড়লে কেউ বুঝবে না।
উলটো পাশ ফিরে শুয়ে আছে প্রয়াস। ঘুম আসছে না। সাথে অস্বস্তিটাও কমছে না। এই মেয়ের পরিবার যদি আরো দেরি করে?
ভেবেই শিউরে উঠলো প্রয়াস। অনেক কষ্টে মাথা থেকে সব বাজে চিন্তা ঝেড়ে জোরপূর্বক চোখ বন্ধ করলো।
নাহ! কিছুতেই পারা যাচ্ছে না। কোন মেয়ে এত অবুঝ থাকে যে এসব বুঝবে না! নাকি মেয়েটা নাটক করছে?
প্রয়াস তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর ঘুরে তাকালো তিয়াসার দিকে। সে ওর দিকে ফিরেই চোখ মেলে ছিলো। ওকে ঘুরতে দেখে সেই মৃদুহাসিটা দিলো।
প্রয়াসের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা বাড়লো। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আস্তে করে নিজের বালিশ থেকে মাথা তুলে তিয়াসার দিকে হালকা ঝুঁকে এলো। সোজা কথায় ভয় দিতে চাইলো। কিন্তু তিয়াসা ভয় পেলো বলে মনে হলো না। হাসিটা বজায় রেখে স্নিগ্ধ চাহনিতে চেয়ে রইলো।
কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া না পেয়ে কান্ত এক নিঃশ্বাস ফেলে ধপ করে নিজের বালিশে শুয়ে পড়লো প্রয়াস। “বেচারা বেচারা” অনুভব হচ্ছে ওর। পাশে শুয়ে থাকা প্রাণীটা সত্যিই মেয়ে নাকি রোবট! হতাশ হয়ে আবার উলটোদিকে ফিরলো প্রয়াস।
সে উলটো দিকে ফিরতেই মুখটা বিরস হয়ে গেলো তিয়াসার।(লেখিকা লাকি নোভা)
ও চায় প্রয়াস ওর দিকে ফিরে থাকুক। ওর সাথে কথা বলুক। কিন্তু প্রয়াস তা করছে না।
আসলে প্রয়াস যা বলতে চাইছে সেটা যে তিয়াসা একদমই বোঝেনি তা নয়। বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তিয়াসা তো প্রয়াসকে সেরকম ভাবে না। বরং ও বিশ্বাস করে যে প্রয়াস কখনই ওসব বাজে লোকটার মতো ছোঁবে না। আর ওর কাকা কাকির মতো মারবেও না। একদমই মারবে না।
হঠাৎই প্রয়াসের কানে নাক টেনে কান্নার আওয়াজ আসতেই চট করে ঘাড় ঘুরালো ও। হালকা বিস্মিত হলো তিয়াসাকে কাঁদতে দেখে।
তিয়াসা ওকে দেখে একদমই কান্না লুকানোর চেষ্টা করলো না। আর না লজ্জা পেলো।
বাচ্চারা যেমন কাঁদোকাঁদো চোখে তাকিয়ে থাকে সেভাবে তাকিয়ে রইলো।
“কী?” বিস্ময় নিয়েই প্রশ্ন করলো প্রয়াস৷ পুরোপুরি ফিরলো তিয়াসা দিকে।
“কাঁদছো কীসের জন্য? ঘুমাতে তো দিয়েছি।”
তিয়াসা চোখ মুছলো।
“তুমি কি বাসায় যেতেই চাও না?”
তিয়াসা সায় দিলো। সে যেতেই চায় না।
অবাক হয়ে গেলো প্রয়াস। কটাক্ষ করে বলল, “তো কি সারাজীবন আমার সাথে থাকবা?”
তিয়াসা হাসিমুখে মাথা নাড়লো। চোখমুখ উজ্জ্বল, উজ্জীবিত হয়ে উঠলো। প্রয়াসের এই কথাটা বেশ পছন্দ হয়েছে তার।
প্রয়াসের মুখটা দেখার মতো হয়ে গেলো। হতবিহ্বল হয়ে পড়লো যেন।
একটু থেমে বলল, “বাসায় কী সমস্যা? সেটা বলো। আমি পুলিশকে বলে সব ঠিক করে দেবো। কেউ তোমাকে কিছু করবে না। কিন্তু এভাবে আমরা একসাথে থাকতে পারবো না। বিষয়টা ভালো দেখায় না।”
তিয়াসা ভ্রুদ্বয়ে ভাঁজ ফেলে তাকালো। অর্থাৎ ‘কেনো থাকা যাবে না?’
“কারণ তুমি মেয়ে, আমি ছেলে। তুমিও ছেলে বা আমি মেয়ে হলে আলাদা কথা ছিলো। যেহেতু না, তাই অসম্ভব আমাদের একসাথে থাকাটা।”
তিয়াসার মুখোভাব দেখে মনে হলো ওর এই কথাগুলো পছন্দ হয়নি।
“বাসায় না গেলে যেও না কিন্তু হোস্টেলে থাকতে হবে। বুঝেছো? আমি ভালো হোস্টেলে যোগাযোগ করবো।”
সাথে সাথে মাথা নেড়ে নাকচ করে দিলো তিয়াসা। উঠে বসে নিজের নোটপ্যাড নিয়ে লিখতে শুরু করলো কিছু।
তারপর সেটা ধরলো প্রয়াসের সামনে।
‘আমি কোথাও যাবো না’ লেখা সেটাতে।
প্রয়াস কড়া নজরে তিয়াসার দিকে তাকাতেই তিয়াসা আবার লিখলো কিছু।
‘আমি তোমার কাছে থাকবো।’
চোখ বড়োসড় হয়ে গেলো প্রয়াসের। বিষম খেলো সে। উঠে বসলো কাশতে কাশতে।
তিয়াসা বিচলিত হয়ে তাকালো। হাত বাড়িয়ে প্রয়াসকে ছুঁতে চাইতেই সরে গেলো প্রয়াস।
চোখ পাকিয়ে বললাল, “মাথা ঠিক আছে তোমার? আমার কাছে থাকবা মানে কী? আর আমি তোমার চেয়ে কতো বড় জানো? ‘তুমি’ করে কথা বলছো কোন আক্কেলে?”
তিয়াসা অবুঝ চাহনিতে ঘন পাপড়ি মেলে তাকিয়ে রইলো। তুমি বলবে না তো কী বলবে?
প্রয়াস মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।তারপর ধীরে সুস্থে তিয়াসার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করলো, “বাসায় কে কে আছে? মা বাবা?”(লেখিকা লাকি নোভা)
তিয়াসার মুখটা বিমর্ষ হয়ে গেলো। ‘নেই’ বুঝাতে আস্তে আস্তে বামে ডানে মাথা ঘুরালো।
প্রয়াস ধীর গলায় “ওহ, সরি” বলে চোখ নামালো। একটু থেমে বলল, “তাহলে কে আছে?”
তিয়াসার মুখটা খুব মলিন দেখা গেলো। বোঝা গেলো যে যারা আছে তারা ওকে খুব একটা কদর করে না। এরাই হয়তো উলটো মারে, বকে।
তিয়াসা ঝাপসা চোখে আস্তে আস্তে নোটপ্যাডে কিছু লিখে সেটা এগিয়ে দিলো প্রয়াসের দিকে।
‘কাকা কাকি আর রুমি। আমি ওদের কাছে যাবো না। ওরা পঁচা। শুধু মারে।’
প্রয়াস শেষ কথাটা পড়ে থামকালো খানিক। বুঝতে বাকি রইলো না কিছু। মানুষ দিন দিন কতটা অমানুষ হচ্ছে ভাবতেই অবাক লাগে প্রয়াসের। এত অমানবিক!
প্রয়াস তাকালো তিয়াসার দিকে। তিয়াসা স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে পলক ফেলছে। চোখ থেকে অশ্রু গড়াচ্ছে অনবরত। চোখমুখ বিষাদময়।
প্রয়াস সেই মুখের দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলে উঠলো, “যেতে হবে না।”
কথাটা কানে আসতেই তিয়াসার মুখটা আগের মতো খুশিতে ঝলমল করে উঠলো। কান্নারত মুখেজ হাসলো সে নিঃশব্দে। কি স্নিগ্ধ আর মায়াবী সেই হাসি। চোখ সরিয়ে নিতে চেয়েও পারলো না প্রয়াস।
কিছুক্ষণ কেটে গেলো ওই চোখের দিকে তাকিয়েই।
তারপর প্রয়াসই চোখ সরিয়ে পরের প্রশ্নটা করলো।
“পালিয়ে এসেছো নাকি বের করে দিয়েছে?”
তিয়াসা মুখটা আবার কেমন যেন হয়ে গেলো৷ খুব বিব্রতবোধ করতে লাগলো হঠাৎ।
“কী হয়েছে?”
কোলের উপর হাত মোড়ামুড়ি করতে লাগলো তিয়াসা।
ভ্রু কুচকে গেলো প্রয়াসের।
“বের করে দিয়েছিলো?”
তিয়াসা সরাসরি তাকালো না। কেমন অনিশ্চিত ভাবে মাথা হ্যাঁ বোধক নাড়লো।
“কী লুকাচ্ছো বলো তো?”
তিয়াসা লিখলো না কিছু। আর না চোখ তুলে তাকালো। বিচলিত হয়ে মুখ নুয়ে রাখলো।
“আমাকে বলো সব। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না আর। কথা দিচ্ছি।”
তিয়াসা বললই না। অস্বাভাবিক ব্যবহার করতেই থাকলো।
খুব অপ্রীতিকর কিছুই ঘটছিলো হয়তো। তারপর ওকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো বা ও নিজেই বেরিয়ে চলে এসেছে। সব জানা যাবে ওর পরিবারের লোকগুলোকে ধরলেই। তিয়াসার ব্যবহারও তো বাচ্চাদের মতো। এমন বাচ্চা মেয়েকে বাসা থেকে বের করে দেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে? যে কারো হাতে পড়তে পারতো ও।
তিয়াসার মোড়ামুড়ি দেখে প্রয়াস বলল, “আচ্ছা বলতে হবে না। শান্ত হও।”
তিয়াসা আড়চোখে একবার তাকালো প্রয়াসের দিকে।
“শুধু এটা বলো যে তোমার বাসাটা কোথায়?”
তিয়াসা ঘাবড়ানো চোখে তাকালো। প্রয়াস কী ওকে বাসায় পাঠাতে চায়?
প্রয়াস ভ্রু উঁচিয়ে বলল,”বলো?”
তিয়াসা কাঁদোকাঁদো চোখে তাকিয়ে নাসূচক মাথা নাড়লো। (লেখিকা লাকি নোভা)
প্রয়াস বুঝতে পেরে বলল,”তোমাকে পাঠাবো না।”
তিয়াসা ওর কথার মাঝখানেই শুয়ে পড়ে উলটো পাশ ঘুরলো। ঠোঁট ফুলিয়ে চুপ করে রইলো। মোটেও বাসার ঠিকানা বলবে না ও। বললেই যদি পাঠিয়ে দেয়?
ক্যান্ডেল চোখমুখ কুচকে দাঁড়িয়ে আছে ইভানের কেবিনের সামনে। এত অস্বস্তি হচ্ছে যে ভিতরে যেতেই ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে এখানেই ঠুস করে মরে যেতে। মাত্র চার বার সাক্ষাতে ইভানকে হাড়েহাড়ে চিনেছে ক্যান্ডেল। একটা বায়োডাটাও বানিয়ে ফেলেছে ও। কাপুরুষটার নাম ‘লুচ্চা দ্য গ্রেট’ দিলেও কম হয়ে যাবে।
ক্যান্ডেল চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যেই চোখ খুলছে অমনি সব সাহস ফুস করে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে।
ইভানের সামনে দাঁড়ানো সত্যিই অসম্ভব। কী করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না ক্যান্ডেল। গতকালের কথা বার বার মনে পড়ছে।
কী পরিমাণ অসভ্য!
ক্যান্ডেল দোটানায় পড়লো। আজ অনেক কাজ আছে। গতদিনের ফাইলগুলো পুনরায় চেক দেওয়াতে হবে। পুরো কাজ আবার করেছে ক্যান্ডেল। তারপর আজ সারাদিনই এই ফালতু লোকটার সাথে থাকতে হবে। কারণ আজ শো-রুমে প্রডাক্টগুলো এসেছে কিনা সেটা ইভানকে নিয়ে চেক করতে যেতে হবে। ভাবতেই তো গা ঘিনঘিন করছে ক্যান্ডেলের।
অত্যন্ত অস্বস্তিতে দাঁত কিড়মিড়ালো ক্যান্ডেল। দরজা খোলার জন্য হাত বাড়িয়েও পিছিয়ে নিলো। মানতে না চাইলেও এটা সত্যি যে ক্যান্ডেলের লজ্জায় গা কেমন যেন করে উঠছে।
ক্যান্ডেল চোখ কুচকে মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ বের করলো। ঠোঁট কামড়ে আবার হাত বাড়ালো দরজার নবে। এবার নবে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। তারপর চোখ বন্ধ করে নবটা ঘুরাতে না ঘুরাতেই অপর পাশ থেকে দরজার নব টেনে খুললো কেউ।(লেখিকা লাকি নোভা)
চমকে তাকালো ক্যান্ডেল। ইভানের সাথে চোখাচোখি হতেই চরম লজ্জায় মুষড়ে গেলো ভিতরটা। মুখটা রক্তিম আভায় ছেড়ে গেলো একদম। কয়েকবার কেঁপে উঠলো চোখের পাতা৷ শ্বাস আটকে চোখ ঘুরিয়ে বাদিকে তাকালো ক্যান্ডেল। ঠোঁট কয়েকবার নড়েও থেমে গেলো। কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না।
ক্যান্ডেলের অপ্রস্তুত, দ্বিধাজড়িত, বিব্রত মুখটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে গেলো ইভানের চোখে।
আসলে ক্যান্ডেলের বেশি কথা বলা বন্ধ করাটা জরুরি ছিলো। আর সেটার জন্য লজ্জা দেওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না। কারণ অধিকাংশ মেয়েরাই বেশি বুঝলে, বেশি চিল্লায়। আবার কম বুঝলেও বেশি চিল্লায়।
যেমন ক্যান্ডেল করতো।
সুক্ষ্মভাবে হাসলো ইভান। বলল, “Anything wrong Miss Candle? You look so tensed!”
ধক করে উঠলো ক্যান্ডেলের বুকের ভিতরটা। গায়ে কেউ সূচালো সুই ফুটিয়ে দিলো যেন।
(চলবে…)
লেখিকা লাকি নোভা
(গল্প কপি সম্পূর্ণ নিষেধ।)
(ভুল ধরিয়ে দিয়েন)