সম্পূর্ণ সত্য ঘটনা অবলম্বনে পর্ব ৫
গল্পঃ কুল-বড়ই (পর্ব : ৫)
লোকমানের বাড়ির বাগানের একপাশেই তার চাচা আয়নাল হকের পরিবার থাকে।একদিন আয়নাক হক চাচাও কথায় কথায় জিজ্ঞেস করল,লোকমান তোমরা কি রাতে বাথরুমে মোমবাতি নিয়ে যাও?তোমার না টর্চ আছে?ওটা নিয়ে যাবে,মোমবাতি নিয়ে বাথরুমে যাওয়া ঠিক না।লোকমান ভ্রু কুচকে বলল,কই না তো চাচা।আমরা মোমবাতি ব্যবহার করি না।কুপি বা লন্ঠন জ্বালাই।আর বাথরুমে গেলে টর্চ নিয়ে যাই।
তাহলে আমি যে দেখি কে এমন মিটমিটে আলো নিয়ে ঐ দিকটায় যায় আবার আসে তোমাদের বাগানে!
লোকমান আগ্রহ নিয়ে বলে একটু খুলে বলেন তো চাচা।
তুমি তো জানো গরমে ঘুম আসেনা আমার।বাহিরে প্রবল বাতাস থাকে।তাই ঘরের দরজার সামনে বসে মাঝে মধ্যে বিড়ি ফুঁকি।তোমার চাচিকেও কয়দিন বললাম,তোমরা রাতবিরেত বাথরুমে যাও মোমবাতি নিয়ে এটা তো উচিত না।তোমার চাচি বলে, ঘরে হয়তো কেরোসিন নাই কুপি জ্বালানোর তাই হয়তো মোমবাতি নিয়ে যাও।বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করছে।আমাদের আদরের লামিয়া দাদুমনিটা নেই।রাত হলে বাড়িটা ভার ভার লাগে।গা ছমছম করে।প্রস্রাব পায়খানা করতে যেতে পারিনা,ভয় হয়।আহ! আল্লাহ্ এটা কি করলেন?হেসে খেলে বেড়ানো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখার একমাত্র কলিজার টুকরাটাকে নিয়ে গেলেন। দাদুমনিটার জন্য বড় কষ্ট হয়।আপনি এভাবে মাঝরাতে বাহিরে থাকবেন নাতো।আমার ডর লাগে।বাড়িতে শিশু মরা ভালো না।এসব বলে তোমার চাচি আমাকে নিষেধ করে রাতে ঘর থেকে বের হতে না।
তবে জানো কি লোকমান,মাইয়াডার প্রতি তোমাদের আরও একটু খেয়াল রাখা উচিত ছিল।বাচ্চা মানুষ খেলতে খেলতে কখন কই যায় না যায় তার কি কোনো ঠিক আছে।একটু সতর্ক থাকলে দাদুমনিটাকে আমাদের হারাতে হতো না।
আমি মাঝে মাঝে গভীর রাতে দেখি মোমের আলোর মত একটা আলো তোমার মেয়ের কবরের কাছ থেকে তোমাদের ঘরের দিকে চলে যায়।কিন্তু একটা জিনিস খটকা লাগে আমার বাহিরে ফুরফুরে বাতাস থাকা সত্বেও আলোটাকে কখনো বাতাসে দোলতে দেখিনি।
হয়তো ভুল দেখেছেন আপনি।এ বলে লোকমান চলে যায়।কিন্তু রয়ে যাত ভিতরে এক অজানা ভয় আর কষ্ট।একটা চক্রাকার ভাবনা তার ভিতর ঘুরপাক খেতে লাগলো।আমি,আমার বউ,ছোট ভাই লামিয়ার হাঁটার দৌড়ানোর শব্দ পাই।কোমরের ঘুঙুরের ঝুনুরঝুনুর শব্দ পাই।বাকি ছিল শুধু আয়নাল চাচা আর চাচি।আজ চাচা যে কথা বললেন তাতেও মনে হয় লামিয়ার অস্তিত্বের কথাই বললেন।তাহলে কি আজ রাতে ঘরের বাহিরে এসে দেখবো কোন মোমের আলো মেয়েটার কবরের কাছ থেকে আমাদের ঘরের কাছে আসে?
ভাবনা মত লোকমান মধ্যরাতে ঘরের সামনে এসে বসে।ঘাড় অন্ধকারের ভিতর ঝোপঝাড়ের মধ্য থেকে ডাহুক পাখির ডাকডাক শব্দ ভেসে আসছে।বাঁশঝাড়ের ভিতর ভুতুম প্যাঁচা অনবরত ডেকে যাচ্ছে।বাতাসে গাছের ডগাগুলো যেন মাথা দুলিয়ে মানা করছে|চারিদিকটার পরিবেশ কেমন গুমোট ধরে আছে|লোকমান যদিও অনেক সাহসী তবুও আজ এক অজানা ভয়ে গায়ের লোমগুলো দাড়িয়ে আছে!মনে মনে সাহস যোগাচ্ছে এই বলে যে,লামিয়া তো আমারই মেয়ে আমার আবার ভয় কিসের!? আমাকে ভয় পেলে চলবেনা|দেখি কোথা থেকে আলোটা আসে আবার কোথায় মিশে যায়?!
কিন্তু অনেকটা সময় ধরে বসে থেকেও লোকমান কোনো আলোই তো দেখতে পায়না!শুধু পুকুর পাড়ে ছোট ছোট ঝোপের উপর জোনাকি পোকাগুলো মিটমিট আলো জেলে খাবার খোঁজছে!পুকুরের বড় মাছগুলো হঠাৎ হঠাৎ ঝাপটা মেরে জলের উপর উঠতে চায়! বাগানের ঝরা শুকনো পাতাগুলো মচমচে উঠে! হয়তো ইঁদুর কিংবা চিকা দৌড়ানোর শব্দ! বাড়ির সামনে ধপাস ধপাস শব্দ হচ্ছে!সম্ভবত বাড়ির সামনের বড় তালগাছটি থেকে পাকা তাল ঝরে পড়ছে! বাঁশ বাগানে ঠাসঠাস শব্দ, পাকা বাঁশ ফাটলে যেমনটি শব্দ হয়! ঘরের টিনের চালায় সরসর শব্দে লোকমানের গা শিউরে ওঠে! চালের উপর নারিকেল পাতার দোলানির শব্দ নয়তো?! দূরে কোথাও থেকে দলবেদে শিয়ালের হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়ার মাতম ধ্বনি ভেসে আসছে!
লোকমানের নাকে তীব্র একটা ঘ্রাণ লাগে! খুব পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছে ঘ্রাণটা!ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ফুলের সুবাস! কিন্তু কি ফুলের সুবাষ?! এ বাড়িতে তো তেমন কোনো ফুল গাছ নেই! ওও মনে পড়েছে হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ! লামিয়াকে কবর দেয়ার পর তার ছোট ভাই নিজ হাতে হাসনাহেনা ফুলের গাছটি রোপন করে বলেছিল, আমার চাচ্চুটা ফুলের সুবাস নিতে নিতে ঘুমাক!লামিয়ার কবর থেকেই নিস্তব্ধ রাতে হাসনাহেনার সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে! হঠাৎ একটা হিমশীতল বাতাস লোকমানের শিরদাঁড়া বেয়ে প্রবাহিত হয়ে গেল পুরো বাড়ির উপর দিয়ে! সবকিছু মিলে চারিদিকটায় কেমন একটা অশুভ সংকেত পাচ্ছে লোকমান! তার ভিতরটা এখন আড়ষ্ট হয়ে আসছে! তার ভয় হচ্ছে একা একা বসে থাকতে! তাই সিদ্ধান্ত নিল ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে!
বিচানায় লামিয়ার মায়ের গা ঘেঁষে শুয়ে ভাবছে মেয়েটা কেন এমন করছে?! দূর থেকে এমন না করে আমাদের কাছে এসে বলুক সে কি চায়?! আমি যে আর সহ্য করতে পারছিনা।
দুচোখ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল লোকমানের এমন সময় হঠাৎ দরজা ধাক্কানোর শব্দে স্বামী স্ত্রী দুজনে জেগে চমকে উঠে!! লোকমান ভাঙাভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করে কে!? দরজা ধাক্কা দেয় কে!?
ওপাশ থেকে কান্না কান্না কন্ঠে বলছে, আব্বু আমি লামিয়া। দরজা খোলো। তোমরা আমাকে বাহিরে রেখেছো কেনো? আমার খুব কষ্ট হয়। আমার দোলনা খুলেছো কেনো? আমি তোমাদের মাঝখানে ঘুমাতে চাই!
চলবে….
#Imran_Khan_Ratan
#কুল_বড়ই