অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
১২.
কিছু মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল রুদ্র। এখন মাথা একেবারেই ঠান্ডা রাখতে হবে। উদ্বিগ্ন হলে চলবেনা। এইসব মুহূর্তে এক্সিডেন্ট হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে উত্তেজিত হয়ে পড়া। উত্তেজনার বসে সঠিক পদক্ষেপ নিতে না পারার কারণেই বেশি বিপদ হয়। এরকম সমস্যা থেকে বেরোনোটা অসম্ভব কিছু না। নিজেকে স্হির রেখে কিছুটা বুদ্ধি খাটালেই সম্ভব। আস্তে করে অ্যাক্সেলেটার থেকে নিজের পা সরিয়ে নিল রুদ্র। ধীরে ধীরে গিয়ার কমাতে শুরু করলো। হঠাৎ গাড়ির গতি কমে যেতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে তাকাল উচ্ছ্বাস। রুদ্রর দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই এঁকেবেঁকে গাড়ি চালাতে শুরু করল রুদ্র। উচ্ছ্বাস সাথেসাথেই সিট ধরে নিজেকে সামলে নিল। রুদ্র কী করছে কিছু বুঝতে না পেরে বলল, ‘ কী করছিস কী? নেশা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই? সর আমি চালাচ্ছি।’
রুদ্র সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই শক্ত কন্ঠে বলল, ‘ জাম্প কর।’
‘ মানে? নেশাটা সত্যি বেশি হয়ে গেছে না-কি? দেখ ভাই আমি কিছুই করিনি। ঐ চার নম্বর বেঈমানটা মোটেও আমি নই। আমি কোন বেঈমানি করিনি। আমায় কেন যমের দুয়ারে পাঠাতে চাইছিস?’ হতভম্ব হয়ে বলল উচ্ছ্বাস। কারণ উচ্ছ্বাসের মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। কী বলছে কী রুদ্র? কেন বলছে? হুইস্কি বেশি খেয়ে ফেলল না-কি? মাঝেমাঝে তো এর থেকেও বেশি খায়। এর আগে তো এরকম হয়নি।
রুদ্র একই ভঙ্গিতে বলল, ‘চুপচাপ লাফিয়ে পর নয়তো আমি লাথি মেরে ফেলে দেব। তখন আরো বেশি লাগবে, মরেও যেতে পারিস। অপশন আমার, চয়েজ তোর।’
উচ্ছ্বাস এবার বুঝতে পারল ঘটনার গুরুত্ব। গুরুতর কিছু না হলে রুদ্র এমন আজব কথা মোটেও বলবে না। বিগড়ে গেছে নিশ্চয়ই কিন্তু পাগল না রুদ্র। উচ্ছ্বাস চিন্তিত কন্ঠে বলল, ‘সমস্যা কী ভাই? গাড়িতে কিছু হয়েছে? সেটা হলে আমি তোকে ফেলে নামছি না। বল কী হয়েছে?’
রুদ্র আগের চেয়েও বেশি এঁকেবেঁকে গাড়ি চালাচ্ছে। প্রায় ফাঁকা রাস্তা বলে তেমন সমস্যা হচ্ছেনা। উচ্ছ্বাসের কথাটা শুনে ও শক্ত কন্ঠে বলল, ‘ পাঁচ সেকেন্ড দিচ্ছি। এরমধ্যে না লাফালে আমি আর মুখে কিছু বলব না।’
‘ কিন্তু..’
‘ তিন সেকেন্ড!’
রুদ্রর কথার ধরণ শুনেই উচ্ছ্বাস খুব ভালোভাবে বুঝতে পারল যে সে যা বলেছে তা করে দেখাতে এক মুহূর্তও ভাববে না। অনায়াসেই করতে পারবে কাজটা। আর সেটা করতে গেলে রুদ্র নিজেও বিপদে পড়বে। সে জানে রুদ্র এতো সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার ছেলে না। নিশ্চয়ই কিছু ভেবে রেখেছে। ওর কথা মতো কাজ করাটাই এখন উচিৎ হবে। গাড়ির গতি একেবারে কম। উচ্ছ্বাস আর অপেক্ষা না করে যথাসম্ভব সঠিক পজিশন নিয়ে লাফিয়ে পড়ল গাড়ি থেকে। রাস্তায় পরে তিনবার গড়াগড়ি খেলো সে। উচ্ছ্বাস নামতেই রুদ্র গাড়িটা আরও বেশি এলোমেলোভাবে চালাতে আরম্ভ করল। আশেপাশে তাকিয়ে গাড়ি ভেড়ানোর জায়গা খুঁজছে সে এখন। ওর হাতে বেশি সময় নেই। এখনই নিরাপদ কিছুর সাথে গাড়িটা ভিড়িয়ে না দিলে ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। বেশিক্ষণ এভাবে গাড়িটা চালিয়ে নিতে পারবেনা। কিন্তু কিছু না পেয়ে গলা শুকিয়ে এলো রুদ্রর। এদিকে গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। একটা পিলারের সাথে ধাক্কা লাগতে লাগতে বেঁচে গেছে একটু আগেই। কিন্তু কতক্ষণ? তখনই রাস্তার পাশের মাঠের কোণে একটা ঝোপ দেখতে পেল উচ্ছ্বাস। এক মুহূর্তও আর দেরী করল না সে। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত মাঠের মধ্য দিয়ে চালিয়ে সোজা ঝোপের মধ্যে ভিড়িয়ে দিল গাড়িটা।
বেশ জোরেই লাগল ধাক্কাটা। গাড়ির স্টেয়ারিং এ গিয়ে লেগেছে রুদ্রর মাথা। প্রচন্ড ব্যথায় মাথাটা টনটন করে উঠলো। মাথা তুলতে পারল না কয়েক সেকেন্ড। স্টেয়ারিং এ মাথা ঠেকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে দিল ব্যথাটা। রুদ্র জোরে জোরে শ্বাস নিল কয়েকটা, কিন্তু মাথা তুলল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই দৌড়াতে দৌড়াতে এসে উপস্থিত হল উচ্ছ্বাস। রুদ্রকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে ভাবল মারাত্মক জখম হয়েছে রুদ্রর। জ্ঞান নেই নিশ্চয়ই। উচ্ছ্বাস উত্তেজিত হয়ে রুদ্রর কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, ‘ভাই? এই ভাই? ঠিক আছিস তুই? কথা বলছিস না কেন?’
রুদ্র মাথা না তুলেই বলল, ‘বেঁচে গেছি এ যাত্রায়। প্যানপ্যানানি বন্ধ কর।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল উচ্ছ্বাস। হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছিল ওর। রুদ্র আস্তে আস্তে মাথাটা তুলে সিটের সাথে হেলান দিয়ে চোখটা বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘ তুই ঠিক আছিস?’
রাগে গা জ্বলে উঠল উচ্ছ্বাসের। ওর কী হবে? ওকে তো বেশ নিরাপদের নামিয়ে দিয়েছে রুদ্র। সাথে নিজেও লাফিয়ে নামলে কী হতো? এতোটা রিস্ক নেয় কেউ? আরেকটু দেরী হলে ভয়ানক কিছু হয়ে যেতে পারতো। উচ্ছ্বাস দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আমি কেন ঠিক থাকতে যাব বল? আমার কী ঠিক থাকার কথা? ব্রেক ফেল গাড়িটা তো আমি চালিয়ে থামালাম তাইনা? কাজেই আমারই ক্ষতিটা হওয়ার কথা।’
রুদ্র চোখ বন্ধ রেখেই হাসল। আবছা অন্ধকারে রুদ্রকে হাসতে দেখে উচ্ছ্বাস বলল, ‘ খবরদার হাসবিনা। আমাকে নামতে বলতে পারলি নিজে লাফাতে পারলি না?’
রুদ্র ক্লান্ত কন্ঠে বলল, ‘ ভাবলাম মরবোই যখন একা কেন মরব? সাথে কিছু লোকজন নিয়েই মরি। কিন্তু সামনে কাউকে পেলাম না। ব্যাড লাক।’
উচ্ছ্বাস বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। সে জানে রুদ্র কেন নামেনি। কিন্তু রুদ্র সেই কারণটা নিজের মুখে কোনদিন স্বীকার করবেনা সেটাও খুব ভালোভাবে জানা আছে উচ্ছ্বাসের। আজকের ঘটনায় রুদ্রর মৃত্যুও হতে পারতো। কিন্তু তার উপস্থিত বুদ্ধি আর স্হিরতার জন্যেই আজ প্রাণে বেঁচে গেল। উচ্ছ্বাস পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলল, ‘ মাঝেমাঝে আমার ইচ্ছে হয় কী জানিস? তোকে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারি। নেহাতই এক বছরের বড় আর রাশেদ বাবার ছেলে বলে মারতে পারিনা।’
রুদ্রর হাসির রেখাটা বড় হল। উচ্ছ্বাস ছেলেটা এমনিতে ওকে কিছুটা ভয় পায় ঠিকই কিন্তু সঠিক সময়মতো রুদ্রর প্রতি ওর ভালোবাসাটাও বেরিয়ে আসে বিনা দ্বিধায়। তখন ভয়কে পাত্তা না দিয়ে শাসন করতেও জানে সে। উচ্ছ্বাস ফোনের টর্চটা জ্বালিয়ে বলল, ‘দেখি কী হয়েছে?’
রুদ্রের কপালে টর্চটা ধরে দেখল কপাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। ডান গাল ইতিমধ্যে লাল হয়ে গেছে রক্তে। উচ্ছ্বাস ক্ষতটা দেখতে দেখতে বলল, ‘ চমৎকার! হাসপাতালে যেতে হবে আপনাকে। কপাল খুব ভালোভাবেই কেটেছে।’
এতক্ষণে চোখ খুলে তাকাল রুদ্র। একটু ভালো লাগছে এখন। কিন্তু মাথার ব্যাথা কমেনি। বরং সময়ের সাথেসাথে বাড়ছে। ভারী হয়ে আসছে মাথা। সোজা হয়ে বসতে ইচ্ছে করছেনা। ক্লান্ত চোখে উচ্ছাসের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ তোর সব ঠিক আছে?’
‘ আমার কিছুই হয়নি। শরীরের ডান সাইডে কিছুটা ব্যথা পেয়েছি, আর ডান হাতের কুনুইটা ছিলে গেছে, এটুকুই।’ ফোনে কারো নাম্বারে কল করতে করতে বলল উচ্ছ্বাস।
রুদ্র স্বস্তির একটা শ্বাস ফেলে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। উচ্ছ্বাস ফোন করে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলে আবার গিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। রুমাল দিয়ে চেপে ধরল রুদ্রর ক্ষত স্হানটা। রুদ্র চোখ বন্ধ করে গা ছেড়ে বসে আছে। উচ্ছ্বাস রুমালটা মাথায় বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘কে করেছে কাজটা বুঝেছিস?’
রুদ্র নির্বিকারভাবে বলল, ‘ মোটামুটি।’
‘ কীকরে বুঝলি? কোন হারামির বাচ্চার কাজ এটা? মরার ভয় নেই?’
‘ ভয় আছে বলেই করেছে কাজটা। কিন্তু এটাই ওর কাল হল। নিজের মরণটা সপ্তাহখানেক এগিয়ে আনল। শু*রটাকে খুঁজতে সপ্তাহখানেক লেগে যেতো না হলে। পরে খুলে বলল সব। এখন চুপ থাক। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।’
উচ্ছ্বাস একটা লম্বা করে শ্বাস ফেলল। আর কিছু জিজ্ঞেস করলনা। এই সামান্য যন্ত্রণার ক্ষমতা নেই রুদ্র আমেরকে কাবু করার। হয়তো এই বিষয়ে কথা বলতে চাইছেনা এখন রুদ্র। এখন শুধু গাড়ি আসার অপেক্ষা। হাসপিটালে যেতে হবে ওদের।
*
ইউনাইটেড হসপিটালের ডক্টরের কেবিনের সাথে জয়েন্ট রুমটাতে একটা বেঞ্চে বসে আছে রুদ্র আর উচ্ছ্বাস। হাসপাতালে এসে সবার আগে ডাক্তার রতনের কেবিনে ঢুকেছে দুজন। ভোররাত, তাই বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউ নেই হাসপাতালে। ডাক্তার রতন হন্তদন্ত হয়ে উঠে এলেন রুদ্র এসেছে শুনে। বায়ান্ন বছর বয়স তার। চুলে পাক ধরেছে। প্রায় অর্ধেক চুলই সাদা। ছোট করে গোঁফ রেখে দিয়েছে তাতেও পাক ধরেছে কিছুটা। চোখদুটো হলদে ঘোলাটে। গোল ফ্রেমের চশমাটা চোখে কম নাকের মাঝে বেশি থাকে। রাতে সাধারণত হাসপাতালে বসেন না উনি। কিন্তু জরুরি কাজ পড়ায় রাত তিনটার দিকে এসেছিলেন কোয়াটার থেকে। রাশেদ আমেরকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে সে। আর রুদ্র নাম শুনলেও তো আত্মা কেঁপে ওঠে একপ্রকার। ওমন শান্ত-ধীর পিতার এমন উগ্র-বদমেজাজি পুত্র কীকরে হল বুঝে উঠতে পারেন না কিছুতেই। ডাক্তার আসতেই রুদ্র বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,
‘ যা করার তাড়াতাড়ি করুন চাচা। ঘুম পাচ্ছে আমার, বাড়ি যাব।’
রুদ্রর কথা শুনে বিন্দুমাত্র অবাক হলোনা ডাক্তার রতন। খুব ভালো করেই চেনে সে রুদ্রকে। বহুবার এর চেয়েও ভয়ানক জখম নিয়ে ওনার কাছে এসেছে রুদ্র। কোনবার-ই ব্যথা নিয়ে কোন হেলদোল ছিলোনা ছেলেটার। শুধু বাড়ি যাওয়ার তাড়া ছিল। ডাক্তার রুমালটা খুলে চশমাটা নাকের মাঝে রেখেই নিজের হলদে ঘোলাটে চোখদুটো দিয়ে পরীক্ষা করল রুদ্রর ক্ষতটা। কিছুক্ষণ দেখে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘ বেশ ভালো জখমই তো করেছো বাছা। কাটল কীসে?’
রুদ্র কিছু বলল না। বোঝাই যাচ্ছে চরম বিরক্ত সে। এসব তার কাছে নিছকই অযথা প্রলাপ বৈ কিছু নয়। উচ্ছ্বাস বলল, ‘ স্টেয়ারিং এ লেগেছে।’
ডাক্তার রতন আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। রুদ্রকে রুমাল দিয়ে কপালটা চেপে ধরে রাখতে বলে উঠে চলে গেল আসছে বলে। পাঁচ মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও কাউকে আসতে না দেখে রুদ্র রেগে গেল। উঠে দাঁড়াতেই নিচ্ছিল ঠিক তখনই এসে উপস্থিত হল নার্সের পোশাক পরা সুন্দরী এক মেয়ে। হাতে একটা প্লাস্টিকের বর বক্স। মেয়েটাকে দেখে উচ্ছ্বাস থমকে গেল। চট করে দাঁড়িয়ে গেল সে। মেয়েটা নাজিফা। আজ তাহলে সত্যিই নাইট ডিউটি পড়েছে ওর? নাজিফা রুদ্রের পাশে বসে বলল, ‘ দুঃখিত, আসতে কিছুটা দেরী হয়ে গেল।’
অনেকটা যন্ত্রের মতো করেই বলল নাজিফা। বোঝা যাচ্ছে এতোটা বিনয় দেখাতে সে ইচ্ছুক নয় কিন্তু দেখাতে হচ্ছে। রুদ্র কিছু না বলে ভ্রু কুঁচকে বসে রইল। মেয়ে মানুষের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতে তার ভালোলাগেনা। নাজিফা বেশ সময় নিয়েই সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে দিল। সেই যান্ত্রিক গলাতেই বলল, ‘ দুটো সেলাই লেগেছে। ব্যান্ডেজ ভেজাবেন না। আর_’
নাজিফার কথা শেষ হওয়ার আগেই রুদ্র বলল, ‘ওর কুনুই ছিলে গেছে, সেখানে ড্রেসিং করে দিয়ে তুমি তোমার কাজে যাও।’
ভ্রু কিঞ্চিৎ কুচকে ফেলল নাজিফা। কিন্তু মোটেও রাগ করল না। রাশেদ আমের নামক মানুষটার কাছে শুধু ও নয় ওর পুরো পরিবার কৃতজ্ঞ। ঐ দেবদূতসম মানুষটা না থাকলে ওদের পুরো পরিবারটা ভেসে যেতো। ওর রাশেদ বাবা ওর কাছে পিতৃতুল্য। সেই সুত্রে শুরু থেকেই রুদ্রকে বড় ভাইয়ের মতো মনে করে এসছে। যদিও সেটা মনেমনেই। সামনাসামনি কখনও কথা কিংবা দেখা কোনটাই হয়নি ওর রুদ্রর সাথে। চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ বসুন।’
উচ্ছ্বাস নাজিফার দিকে তাকিয়ে থেকেই রিমোট চাপা পুতুলের মতো বসে পড়ল। নাজিফাও বসল ওর পাশে। উচ্ছাস একদম মূর্তির মতো বসে আছে। নাজিফা ভ্রু কুঁচকে গলায় কিছুটা ঝাঁঝ মিশিয়ে বলল, ‘কোথায় ছিলেছে দেখাবেন তো?’
হালকা চমকে উঠল উচ্ছ্বাস। দ্রুত শার্টের হাতা গুটিয়ে দেখাল নিজের ছিলে যাওয়া অংশটা। তুলোয় করে ঔষধ লাগানোর সময় উচ্ছ্বাসের মনে হল নাজিফা নিজের রাগ মেটাচ্ছে ওর ক্ষতের ওপর। জ্বলে যাচ্ছিল জায়গাটা কিন্তু ‘টু’ শব্দও করল না উচ্ছ্বাস। ঠোঁট চেপে সহ্য করে নিল। নাজিফা বলল, ‘ছিললো কীকরে?’
উচ্ছ্বাস অবাক চোখে চাইল নাজিফার দিকে। নাজিফা মেয়েটা হয়তো একটু অপ্রস্তুত হল। ইতস্তত করে বলল, ‘কোন ইনফেকশন হবে কি-না জানার জন্যে জিজ্ঞেস করছি।’
‘ রাস্তায় ঘষা লেগে। চলন্ত গাড়ি থেকে লাফাতে গিয়ে_’
বাক্যটা শেষ করতে পারল না উচ্ছ্বাস। ক্ষতের ওপর তুলোর ঘষা জোরে পড়ায় জ্বালায় গাল কুঁচকে এলো ওর। আর নাজিফার চোখে-মুখে ফুটে উঠল দ্বিগুণ বিরক্তি। রুদ্র বেঞ্চে হেলান দিয়ে নিরুৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে দুজনের কান্ড। পুরোটা সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উচ্ছ্বাস নাজিফার দিকে। সাদা নার্সের পোশাকে অমায়িক লাগছে মেয়েটাকে। ফর্সা মুখটা হালকা ঘেমে আছে। ছোট কাটা চুলগুলো নিজের হাতে সরিয়ে দিতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল উচ্ছ্বাসের। কিন্তু ইচ্ছেটাকে নিজের ভেতরেই দমন করে ফেলল সে। নাজিফা চুপচাপ ড্রেসিং করে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। উচ্ছ্বাসও বেড়িয়ে এলো নিজের ঘোর থেকে। নাজিফার থেকে চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক করে নিল নিজেকে।
রুদ্র আর উচ্ছ্বাস উঠে বেড়িয়ে যাওয়ার সময় নাজিফা বলল, ‘রুদ্র ভাই, আপনার আঘাতটা কিন্তু সামান্য না। বেখেয়ালি হবেন না।’
কথাটা বলে চোখ ঘুরিয়ে উচ্ছ্বাসের দিকে একপলক তাকিয়ে চলে গেল। উচ্ছ্বাস একটা তপ্ত শ্বাস ফেলল কেবল।
*
আমের ভিলায় ফিরে কারো সাথে কোন কথা বলল না রুদ্র। সোজা নিজের রুমে চলে গেল। ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে টিশার্টটা খুলে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিল নিশ্চিন্তে। শরীর ক্লান্ত আর অসুস্থ ছিল বিধায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমে ঢলে পরল রুদ্র আমের।
এদিকে উচ্ছ্বাসও বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবছে। বারবার হাত বুলাচ্ছে সে নিজের হাতের কুনুইয়ে। আজ প্রথম নাজিফার স্পর্শ পেয়েছে ভাবলেই কেমন গা শিরশির করে উঠছে ওর। মেয়েটাকে দেখলেই কেমন চুপসে যায়। অন্য ব্যক্তিত্বের মানুষ হয়ে ওঠে তখন। নাজিফার বিরক্তিমিশ্রিত মুখখানা মনে পরতেই মুচকি হাসল উচ্ছ্বাস। ধীরে ধীরে ওর চোখেও ঘুম এসে ধরা দিল।
রুদ্রর ঘুম ভাঙল বেলা দেড়টার দিকে। এরমধ্যে কেউ আর ডাকেনি ওকে। ব্যান্ডেজ না ভিজিয়েই ঠান্ডা পানিতে গোসল সেড়ে নিল ও। জিন্স আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে নিচে নেমে এলো। ক্ষিদে পেয়েছে ভীষণ। ডায়নিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখল বাড়ির সবাই একসঙ্গে খেতে বসে গেছে। টেবিলের মাথায় রাখা চেয়ারে বসে আছে রাশেদ। কুহু, উচ্ছ্বাস, জাফর সবাই বসে পড়েছে। জ্যোতি এখনো বসেনি, দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রকে দেখে রাশেদ বলল, ‘ চলে এসেছো? তোমাকে ডাকতে পাঠাতাম এক্ষুনি।’
রাশেদের কথা শুনে জ্যোতি আর কুহু তাকাল রুদ্রর দিকে। কপালে ব্যান্ডেজ দেখে দুজনেই চমকে উঠল। যদিও উচ্ছ্বাসের মুখে এতক্ষণে শুনে নিয়েছে পুরো ঘটনাটা। তবুও রুদ্রর কপালের ক্ষতটা দুজনকেই কষ্ট দিচ্ছে। যদিও এরকম ক্ষত নিয়ে বাড়ি ফেরা আজ প্রথম নয়। কুহু উঠে দাঁড়িয়ে গেল চেয়ার ছেড়ে। কাঁদোকাঁদো মুখ করে তাকিয়ে রইল নিজের ভাইয়ের দিকে। রাশেদ আমের শক্ত কন্ঠে বলল, ‘ কুহু মা। এখন বসে পরো।’
কুহু মাথা নিচু করে বসে পড়ল। রুদ্র নিঃশব্দে গিয়ে রাশেদের পাশের চেয়ারটা টেনে বসল। জ্যোতি এতক্ষণ রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ছিল স্হির চোখে। রুদ্র বসতেই ওর প্লেটে ভাত দিল। সবার পাতে খাবার দিয়ে জ্যোতি নিজেও বসে পড়ল কুহুর পাশে। জাফর খেতে খেতে বলল, ‘ তুই এমনিতে ঠিক আছিস তো? আর কোন ক্ষতি হয়নি?’
‘ না কাকা, আ’ম ফিট নাও। শুধু মাথাতেই সামান্য লেগেছে।’
রাশেদ দৃঢ় গলায় বলল, ‘ কতটা সামান্য সেটা দেখতেই পাচ্ছি। খাওয়া শেষ করে আমার রুমে আসবে, কথা আছে।’
রুদ্র চুপ করে রইল। রাশেদের কন্ঠে চাপা ক্রোধের আভাস পাচ্ছে ও। এমনিতে সবসময় শান্ত থাকলেও ওনার সন্তানদের গায়ে আচড় লাগলে ওনার মধ্যকার ঘুমন্ত পশুটা জেগে ওঠে। রুদ্র নিজেও ভয় পায় সেই পশুকে। তাই একদম চুপ করে গেল। জাফরও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর একটা কথাও বলল না। রুদ্র আড়চোখে একবার তাকাল জাফরের দিকে। জাফর চোখ টিপে আশ্বস্ত করল সে সামলে নেবে। মুচকি হাসল রুদ্র। খাওয়ার টেবিলে কেউ আর কোন কথা বলল না।
*
রুদ্র দুই হাত সামনে একত্রিত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদ বরাবরের মতোই তার ইজি চেয়ারটাতে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। কিছুক্ষণের মৌনতার পর রাশেদ বলল, ‘কাজটা কে করেছে বুঝেছো?’
‘ মোটামুটি নিশ্চিত আমি বাবা। আজ রাতের মধ্যে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যাব। আর কালকের মধ্যে ওকে_’
রুদ্র কথাটা শেষ করার আগেই রাশেদ তাকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘ কীকরে বুঝেছো জানতে চাইবোনা। কে সেটাও জানতে চাইব না। সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু ওকে আমার হাতে তুলে দিতে পারবে? বাকি কাজটা আমি নিজেই করতে চাই। দেবে?’
‘ না বাবা।’ স্পষ্ট উত্তর দিল রুদ্র।
হেসে ফেলল রাশেদ। রুদ্র মাথা নিচু করেই রাখল। রাশেদ বলল, ‘ সব দ্বায় নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াতে ভালো লাগে তাইনা?’
রুদ্র জবাব দিলোনা। রাশেদও চুপ করেই রইল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রুদ্র চলে যেতে নিলেই রাশেদ ডেকে উঠল, ‘রুদ্র?’
রুদ্র দাঁড়িয়ে গেল। রাশেদ চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, ‘তোমাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন রুদ্র। অপচয় করোনা নিজেকে। আমার শক্তি, আমার মেরুদণ্ড সবই তুমি। সাবধানে থাকবে।’
রুদ্র চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। একবার তাকাল নিজের বাবার তেজে পূর্ণ সেই অসাধারণ চেহারাটার দিকে। সেই দৃষ্টিতে যেটা আছে সেটা বর্ণনার করার মতো নয়। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলো সে।
রুদ্র রাশেদের ঘর থেকে বেরিয়ে করিডর দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাওয়ার সময় দেখল কুহু দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রও দাঁড়িয়ে গেল ওকে দেখে। কুহুর দিকে তাকিয়ে একটু হাসতেই কুহু দ্রুত পায়ে এসে দু হাতে পরপর দুবার কিল মারল রুদ্রর বুকে। মুখে না করতে পারা অভিযোগগুলো যেন এমন ছেলেমানুষী দিয়েই প্রকাশ করল মেয়েটা। রুদ্র হেসে ফেলল। কুহু সাংকেতিক ভাষায় বলল, ‘ হাসবেনা একদম। আমি রাগ করেছি তোমার ওপর।’
রুদ্র এক হাতে কুহুর সুন্দর করে বেঁধে রাখা চুলগুলো সব এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘ তো আমি কী করব? আমি ওসব রাগ-টাগ ভাঙাতে যাচ্ছিনা। তুই গাল ফুলিয়ে বসে থাক।’
কুহু ঠোঁট ফুলিয়ে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে নিজের চুল ঠিক করল। এরপর রুদ্রকে ঠেলে সরিয়ে চলে গেল নিজের রুমের দিকে। রুদ্র সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। সামনে তাকিয়ে দেখল জ্যোতি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। এতক্ষণ চুপচাপ উপভোগ করছিল দুই ভাইবোনের খুনশুটি। রুদ্র সেদিকে আর না তাকিয়ে চলে যাচ্ছিল। জ্যোতি বলে উঠল, ‘তোমার কিছু লাগবে?’
রুদ্র দাঁড়াল। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ মাথাটা ভার লাগছে। শরীর ম্যাচম্যাচ করছে ভীষণ। কাঁধটা টিপে দিতে পারবি?’
‘ পারব।’
‘ আমার রুমে যা আমি আসছি।’
জ্যোতি নিঃশব্দে চলে গেল রুদ্রর কথামতো। রুদ্র ফোনটা হাতে নিয়ে ফোন করল একটা। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হতেই রুদ্র বলল, ‘ তপু আর আক্কাসকে বলবি কাল আমি বের হবো একটু। সঙ্গে ওদের দুজনের যেকোন একজনকে যেতে হবে। যে যেতে একটু বেশি আপত্তি করবে কিংবা যার মধ্যে যাওয়ার জন্যে তুলনামূলক অনিহা দেখবি তাকেই পাঠাবি। মনে থাকবে?’
ওপাশ থেকে কিছু বলল। উত্তরে রুদ্র বলল, ‘ কোনরকম ভুল হলে কিন্তু_’
কথাটা শেষ করার আগেই ওপাশ থেকে আবার কিছু বলল। রুদ্র বাঁকা হেসে বলল, ‘ ভেরী গুড।’
রুদ্র ফোনটা কেটে একটা রহস্যময় হাসি দিল। ঠোঁটে সেই হাসি ধরে রেখেই নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
রুদ্র বিছানায় আসাম করে বসে আছে চোখ বন্ধ করে।জ্যোতি খুব যত্ন নিয়ে ওর কাঁধ টিপে দিচ্ছে। বেশ অনেকক্ষণ হয়ে গেছে জ্যোতি রুদ্রর কাঁধ চাপছে। জ্যোতিরও এবার হাত ব্যথা হয়ে আসছে। এখন থামা প্রয়োজন। তাই পেছন থেকে আস্তে করে রুদ্রর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রেখে বলল, ‘ সবসময় এরকম রিস্ক না নিলে হয় না?’
রুদ্র চোখ খুলল না। এমনকি কিছু জ্যোতির ওপর রাগও করল না। যদিও কিছুটা বিরক্ত হয়েছে জ্যোতি জড়িয়ে ধরাতে, কিন্তু সবসময় মেয়েটার সাথে নিকৃষ্ট ব্যবহার করতে ভালো লাগেনা ওর। এ বাড়ির সকলের প্রিয় মেয়েটা। ওর প্রিয় না হলেও অপ্রিয় নয়। রুদ্রর কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে অবাক হল জ্যোতি। এতক্ষণে তো ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার কথা ছিল রুদ্রর। সবসময় তো তাই করেছে। আজও মনে মনে প্রস্তুত হয়ে ছিল জ্যোতি ধাক্কার জন্যে। নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটতে দেখে বেশ অবাকই হল ও। অবাক কন্ঠে বলল, ‘ আজ ধাক্কা দিলেনা যে?’
রুদ্র চোখ বন্ধ রেখেই বলল, ‘জানিস যখন ধাক্কা দেব তখন এসব করিস কেন?’
‘ ভালোবাসি তাই।’ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল জ্যোতি।
রুদ্র চোখ খুলে থমথমে গলায় বলল, ‘ আমাকে ভালোবেসে কোন লাভ নেই জ্যোতি। আমাকে ভালোবাসা যায়না।’
‘ ভুল বললে। তোমার প্রেমে হয়তো পড়া যায়না, কিন্তু তোমাকে ভালোবাসা যায়। আমি তোমার প্রেমে পড়িনি রুদ্র, তোমাকে ভালোবেসেছি।’
রুদ্র জ্যোতির হাতের ওপর হাত রেখে বলল, ‘আমার ভালোবাসা নেওয়ার ক্ষমতা তোর নেই জ্যোতি। আমি আগুনের চেয়েও ভয়ংকর। আমার ভালোবাসা পেতে হলে সেই প্রচন্ড উত্তাপ সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে তার মধ্যে। সেই ক্ষমতা তোর নেই। সেটা তুইও জানিস।’
একটা মলিন হাসি দিল জ্যোতি। বিষণ্ন গলায় বলল, ‘ হয়তো সত্যি বলছো। কিন্তু কী করব বলো? তোমার মতো নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন, বেপরোয়া মানুষটা যেদিন সত্যি সত্যি কাউকে ভালোবাসবে; সেই ভালোবাসার গভীরতা, পবিত্রতা, উন্মাদনা ঠিক কতটা হবে ভাবলেও যে শরীর শিউরে ওঠে। সেই অসম্ভব, অপার ভালোবাসা পাওয়ার লোভ সামলাই কীকরে বলো?
#চলবে…
[ লেখিকা কিন্তু আজ বিশাল বড় পর্ব দিয়েছে। অতএব গঠনমূলক সুন্দর সুন্দর মন্তব্য চায় সে ]