অন্তর্হিত কালকূট পর্ব ১৭
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
১৭.
আকাশে গোল থালার মতো রুপালি চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। গভীর ঘন জঙ্গলের চারপাশে নিস্তব্ধ। কিন্তু মাঝেমাঝে কিছু পোকামাকড়, পাখি আর অন্যান্য জন্তুর বিচিত্র আওয়াজ আসছে আশপাশ থেকে। হঠাৎই গা ছমছম করে ওঠে সেই আওয়াজে। জঙ্গলের সেই গা ছমছমে পথ দিয়ে স্বাভাবিক গতিতে এগোচ্ছে রুদ্র। ওর হাতে পিস্তল, আঙুল ট্রিগারের ওপরেই রাখা। ওর ঠিক এক হাত পেছনেই প্রিয়তা আসছে। সৌভাগ্যবশত আজ পূর্ণিমার রাত। নয়তো এই ঘন জঙ্গলের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে হারিয়ে যেতো ওরা দুজন। প্রিয়তা রুদ্রর জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে দু হাত গুটিয়ে ছোট ছোট কদমে এগোচ্ছে। সামনে থাকা ব্যক্তির দিকে ওর ভয়ার্ত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। তবে পা চলছে সমানে।
এদিকে আসা করিম তাজওয়ারের লোকগুলোকে রুদ্র গু’লি করে মে/রে ফেলে। তারপর এগিয়ে গিয়ে ওদের কাছ থেকে একটা পি’স্ত’ল আর দুটো এক্সট্রা ম্যাগাজিন নিয়ে নেয় নিজের জন্যে। প্রিয়তা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে দেখছিল রুদ্রর কর্মকাণ্ড। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিস্মিত কন্ঠে বলেছিল,
‘আপনি এগুলো দিয়ে কী করবেন? আবার কাউকে_’
রুদ্র কোন জবাব দেয়নি। ম্যাগাজিন দুটো পকেটে রেখে ওদের মৃ/তদেহ থেকেই একটা রুমাল নিয়ে নিল। একহাতে যতোটা সম্ভব শক্ত করে বেঁধে নিল গু’লি ছুঁয়ে বেরিয়ে যাওয়া হাতটা। কাজ সেরে পি’স্ত’ল টা হাতে রাখতে রাখতেই প্রিয়তাকে যে তিনটে ছেলে তুলে এনেছিল তারা এসে হাজির হয় ওকে খুঁজতে খুঁজতে। রুদ্র বিনা কোন দ্বিধায় তিনটে বু/লে/টে তিনজনকেই শেষ করে দিয়েছে। বিস্ফোরিত, স্তব্ধ চোখে নিজের সামনে ঘটে যাওয়া এতোগুলো হ/ত্যা দেখে শক্ত পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গেল প্রিয়তা। দম বন্ধ হয়ে এলো একপ্রকার। কিন্তু রুদ্র একবারও প্রিয়তার দিকে না তাকিয়ে চারপাশে একবার দৃষ্টিতে বুলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। প্রিয়তা কয়েকসেকেন্ড স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। যখন মনে পড়ল যে ও এখানে সম্পূর্ণ একা আছে সঙ্গে সঙ্গে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো। দৌড়ে এগিয়ে চলে গেল রুদ্রর পেছন পেছন। রুদ্র কোন প্রতিক্রিয়া করল না। ও নিজের মতো হাঁটছে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে। প্রিয়তার যেন হঠাৎ করেই মনে পড়ল, একটা খু/নির সঙ্গে যাচ্ছে ও। একটা শুকনো ঢোক গিলে দাঁড়িয়ে গেল প্রিয়তা। চিৎকার করে বলল, ‘আমি যাবোনা আপনার সাথে। আপনি একজন খু/নি।’
রুদ্র থামল। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। কিছুক্ষণের জন্যে স্থির হয়ে গেল চোখদুটো। গাছের আড়ালের অন্ধকারে সেভাবে দেখতে পায়নি প্রিয়তার মুখটা। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় মুখটা এখন স্পষ্ট। কোমর ছোঁয়া খোলা এলোমেলো চুল, মৃদু হলদেটে গায়ের রং, মায়া মাখানো এক মিষ্টি মুখ। কিন্তু এগুলো রুদ্রর নজর কাড়তে না পারলেও প্রিয়তার চোখদুটোতেই আটকে গেছে ওর চোখ। এতো সুন্দর চোখ জীবনে খুব কম দেখেছে রুদ্র। তবে মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিল। প্রিয়তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক ভ্রু ওপরে তুলে বলল, ‘আমি তোমাকে বলেছি আমার সাথে আসতে?’
প্রিয়তা থমকালো। তাইতো! লোকটাতো ওকে বলেনি নিজের সাথে যেত। ও নিজেই যাচ্ছে। কিন্তু তবুও কিছুতেই পরাজয় মানতে রাজি হলোনা প্রিয়তার জেদি মন। সে আরেকটু চেঁচিয়ে বলল, ‘মানে কী হ্যাঁ? খু’নি হওয়ার সাথে সাথে আপনি একটা পাষাণও। যদিও পাষাণ না হলে কী আর খু’ন করতেন? এভাবে জঙ্গলে একটা অসহায় মেয়েকে একা ফেলে চলে যাবেন?’
রুদ্র গুনে গুনে প্রায় পাঁচসেকেন্ড তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। এরপর খুব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে আমার সাথে আসতে বারণ করেছি বলেও আমার মনে পড়ছে না। তোমার ইচ্ছে হলে এসো, ইচ্ছে না হলে থেকে যাও। জীব-জন্তুর সাথে আড্ডা দাও। ইটস্ টোটালি আপ টু ইউ।’
প্রিয়তা ভাষাহীন চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। এ কেমন মানুষ! ওর প্রতি এরকম গা ছাড়া ব্যবহারে মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেল প্রিয়তার। রুদ্র শান্ত গলায় কথা বলাতে অনেকটা সাহসও সঞ্চার করে ফেলেছে। রুদ্র ঘুরে যেতে নিলেই প্রিয়তা ওর হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে আরও উঁচু আওয়াজে বলল, ‘আপনি! আপনিতো দেখছি শুধুমাত্র খু’নি আর পাষাণই নন একটা কাপুরুষও। ভদ্রভাবে কথাও বলতে জানেন না। কীরকম গা ছাড়_’
বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে পারল না প্রিয়তা। তার আগেই ভয়ানক এক থাপ্পড় পড়ল ওর বাম গালে। থাপ্পড়ের ধাক্কায় পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছে ও। কয়েক সেকেন্ড গালটা অবশ মনে হল, কানে পর্দা যেন ফেটে যাওয়ার মতো অনুভূতি হল প্রিয়তার। এরপরেই গালের সেই অসহ্য জ্বলুনি। গালে হাত রেখে হতবাক দৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে তাকাল প্রিয়তা। রুদ্রর চোখ-মুখ একদম স্বাভাবিক, নির্বিকার। এইমাত্র যে একটা মেয়েকে ঠাটিয়ে চড় মেরে দিয়েছে সেটা ওকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। এ মানুষ! ঠোঁট ভেঙ্গে এলো প্রিয়তার। ছলছল চোখে তাকিয়ে থেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেই ধমকে উঠল রুদ্র। ধমকের সুরে বলল, ‘একদম কাঁদবে না। একটু আওয়াজ এলে কষিয়ে আরও দুটো চড় মারব। চুপ!’
প্রিয়তা সঙ্গেসঙ্গে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল। রুদ্রর হুমকিতে কান্না আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু গাল থেকে হাত নামায়নি। ভীষণ জ্বলছে। রুদ্র প্রিয়তার ডান হাতের বাহু ধরে কিছুটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, ‘যদি আমার সাথে আসতে চাও, এসো। কিন্তু ভদ্র মেয়ের মতো একদম চুপচাপ থাকবে। যতক্ষণ আমার সাথে আছো আমি যা বলব তাই করতে হবে তোমাকে। একটু এদিক-ওদিক হলে_’
হাতের পি’স্ত’লটা প্রিয়তার কপালের ওপর তাক করে চোখের ইশারা করল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বুঝেছো?’
প্রিয়তা নিজের গালে হাত রাখা অবস্থাতেই ঘাড় কাত ধরে সম্মতি দিল। দেখে বোঝা গেল, ভয় পেয়ে গেছে মেয়েটা। মাঝরাতে এমন নির্জন জঙ্গলে কেউ কপালে ব/ন্দু/ক ধরে এমন হুমকি দিলে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। রুদ্র প্রিয়তাকে ছেড়ে দিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলল, ‘এখান থেকে বের হওয়ার কোন রাস্তা জানো তুমি? আমি জাস্ট একটা পথই চিনি। কিন্তু সেদিক দিয়ে যাওয়া যাবেনা। তাজওয়ারের লোক আছে। মেইনরোডে পৌঁছানোর আর কোন পথ আছে?’
প্রিয়তা হাত দিয়ে গাল ঘষতে ঘষতে বলল, ‘মশার মতো করে মানুষ মা’রতে পারেন অথচ পথ চেনেন না?’
রুদ্র শক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা ঘাবড়ে গেল। এই বুঝি আরও একটা চড় পড়ল গালে। কিন্তু তেমন কিছুই হলোনা। রুদ্র থমথমে গলায় বলল, ‘আমি স্থানিও নই। বেশি কথা না বলে পথ জানা থাকলে বলো নয়তো আমায় অন্যকিছু ভাবতে হবে।’
প্রিয়তা আঙ্গুলের ইশারায় পূর্ব দিক দেখিয়ে বলল, ‘এদিক দিয়ে বের হওয়াটা সবচেয়ে সহজ হবে।’
রুদ্র সেদিকটা একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘শিওর?’
‘হুঁ।’ অস্ফুট স্বরে বলল প্রিয়তা।
রুদ্র আর কথা না বাড়িয়ে পি’স্ত’লটা ঠিকভাবে ধরে পূর্ব দিকে পা বাড়ালো। প্রিয়তাও মনে অনেকরকম সংশয় নিয়ে যাচ্ছে রুদ্রর পেছন পেছন। লোকটাকে ভয় পাচ্ছে ও। তবুও যেতে হচ্ছে তার সাথে। আর কোন উপায়ই নেই। থাকলে ভুলক্রমেও এই ভয়ংকর স’ন্ত্রা’সী লোকটার সাথে যেতোনা ও। কী অসহ্য এই ছেলে।রুদ্রকে ভয়ানক কঠিন কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে প্রিয়তার। কিন্তু সেটা করার কথা চিন্তা করলেই হাত নিজে থেকেই বাঁ গালটায় চলে যাচ্ছে। কী জোরে মেরেছে!
জঙ্গলের গাছপালা, ঝোপ, কাদা সব পেরিয়ে প্রায় একঘন্টার মতো হাঁটার পর অবশেষে ওরা দুজন একটা রাস্তায় উঠে এলে। প্রিয়তা হাঁফিয়ে গেছে। এতোটা এর আগে কোনদিন হাঁটেনি ও। তাও আবার এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। অথচ রুদ্র! একটা মেয়ে ওর সাথে আছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। প্রিয়তা যেন নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় এবং জোর করে ঘাড়ে চেপে বসা একটা বস্তু। নিজেকে এতোটা অবহেলিত মনে হতেই রুদ্রর ওপর অজানা এক অভিমান হলো প্রিয়তার। ছেলেমানুষী অভিমান।
কিন্তু রাস্তায় উঠে রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকাল চারপাশে। এটাতো হাইওয়ে নয়। একটা কাঁচা রাস্তা। এটা শহুরে এলাকা অবশ্যই না। আশেপাশে বাড়িঘরও নেই। প্রিয়তাও বোকার মতো তাকিয়ে দেখছে চারদিক। রুদ্র বিরক্তি নিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘এই তোমার হাইওয়ে?’
প্রিয়তা আরেকবার চারপাশে সরল দৃষ্টি বুলিয়ে অসহায় কন্ঠে বলল, ‘আমিতো জানতাম দক্ষিণ দিকেই হাইওয়ে।’
রুদ্র চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস ফেলল। বলছে দক্ষিণ অথচ তখন ইশারা করেছিল পূর্ব দিকে। এই মেয়েটার কথা শুনে এদিকে আসার মতো বোকামি কীকরে করল ও? নিজেই নিজেকে ভয়ানক কয়েকটা গালি দিয়েও শান্তি পেলোনা রুদ্র।
#চলবে…
[ রি-চেইক করিনি। আর বেশ ছোট একটা পর্ব দিয়েছি। কারণ লিখতে ইচ্ছে করছিল না। বড় করতে গেলে হিবিজিবি হয়ে যেতো।]