#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
#বিড়াল_ছানার_অপমৃত্যু_অতঃপর…
একটি বিড়াল ছানার দুর্ঘটনায় আমার এবং আমার বন্ধুর জীবন ও আমাদের দুই পরিবার পুরোপুরি তছনছ হয়ে যায়।
আমি এজাজ। একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। আমার পরিবারে মা বাবা, স্ত্রী ও দুই কন্যা ছিল। আমার বড় মেয়ের নাম ছিল আফিয়া আর ছোট মেয়ের নাম সাফিয়া।
খুব সুন্দর ছিল আমার এই ছোট্ট পরিবার। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। আর তাই বাবা-মা, স্ত্রী-কন্যা নিয়ে আমার পরিবার ছিল লাখে একটি।
একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল আমার জীবনকে একেবারে তছনছ করে দিয়ে গেছে।
আর আমার এই সুন্দর পরিবারকে কেড়ে নিয়েছে আমার জীবন থেকে।
ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় তের বছর আগের। আমি রোজ অফিস করি। অফিস শেষ হলে বাসায় ফিরে আসি। এভাবেই আমার জীবন দিব্বি চলে যাচ্ছিল।
আমার এক বন্ধু ছিল যে পেশায় ট্যাক্সি চালক। ওর বাবা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক ও আল্লাহ ভীরু মানুষ। এক কথায় আল্লাহর খাস বান্দা যাকে বলে।
নাদিম। আমার বন্ধু। তাদের পরিবার খুব একটা সচ্ছল ছিল না তা বলবনা। তার বাবা একটা ছাপাখানায় কাজ করতেন। তাদের বাপ বেটার উপার্জনে কোন রকমে সংসার চলে যেতো।
কিন্তু কয়েক বছর আগে জীবনে চাকরি নামক অধ্যায়ের অবসান ঘটে।
নাদিমের পরিবার বলতে তার স্ত্রী এক ছেলেসহ আরও এক ভাই ও বোন ছিল। যারা বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট ছিল।
পরিবারে হাল ধরার জন্য নাদিম ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করে।
আমিও মাঝেমধ্যে ওকে কল করে বাসায় পৌঁছে দিতে বলতাম।
যেদিন আমার অফিস থেকে বের হতে হতে বেশ রাত হয়ে যেত।
সেসময় রাস্তায় গাড়ি পেতে বেশ সমস্যা হতো। রাত দশটা বাজতেই কেমন জানি সব ফাঁকা হয়ে যেত। তাই গাড়ি না পেলে নাদিমকে ফোন দিয়ে বলতাম আমাকে বাসায় পৌঁছে দেয়ার জন্য।
এভাবেই আমার আর নাদিমের জীবন খুব সুন্দর ভাবেই চলছিল। কিন্তু আমার আর নাদিমের এই শান্তির ধারা যে বেশি দিন স্থায়ী নয় তা আমরা কেউই ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি।
একদিন আমার অফিসে বিদেশ থেকে ক্লায়েন্ট আসায় সেদিন আমার অফিস থেকে বের হতে হতে রাত দশটা চল্লিশ বাজে। গাড়ি পাবনা আগেই জানতাম। তাই নাদিমকে ফোন দিয়ে চলে আসতে বলি। বেচারা আমার জন্য প্রায় ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করেছিল।
বের হয়ে গাড়িতে উঠে সরি বলতে সে হেসে বলে কিসের সরি? পকেট থেকে পাঁচশো টাকা ছাড় বিরানি খাব। এটাই তোর শাস্তি। আমি হাসতে হাসতে তার দিকে একশো টাকার তিনটি নোট বের করে দিতেই সে না নেয়ার জন্য জেদ করতে থাকে। আমিও জানি সে মজা করেই আমাকে এ কথা বলেছে কিন্তু আমি তাকে টাকাটা নিতে খুব জোর করেছিলাম। কারণ ওর পরিবারের কথাতো আমার অজানা নয়।
এভাবে আমাদের হাসি ঠাট্টা চলে। আর এই হাসি ঠাট্টাই আমাদের জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। চলমান হাসি ঠাট্টায় অসাবধানতা বশত নাদিমের গাড়ির সাথে কিছু একটার ধাক্কা লাগে।
আমি আর নাদিম দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যাই। নেমে দেখি সেখানে একটি সাদা ধবধবে বিড়ালের বাচ্চা মরে পড়ে আছে।
বিড়াল ছানাটি ছিল অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর ও তার চেহারা এতো বেশি মায়া ছিল যে দেখে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।
আমি আর নাদিম তা দেখে আফসোস করতে থাকি এই সুন্দর একটা প্রাণীর জীবন কেড়ে নেবার জন্য।
নিজেদের খুব অপরাধী বলে মনে হতে লাগলো কেননা আমরা যদি ঠাট্টা না করতাম তাহলে এমনটি নাও হতে পারতো।
বিড়াল ছানাটিকে রাস্তার একপাশে রেখে চলে আসার সময় দেখি আরও একটি সাদা বিড়াল সেই মৃত বিড়াল ছানাটির পাশে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির হেডলাইটের আলোতে স্পষ্ট দেখলাম বড় বিড়ালটির চোখ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পানি পড়ছে।
আমাদের দিকে সে যেন প্রচন্ড ঘৃনা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আর মনে মনে যেন হাজারটা অভিশাপ দিচ্ছে।
বি:দ্র: এটি ১ম পর্ব। ২য় পর্ব আসবে
২৯ই জুলাই,২০২২
#Imran_Khan_Ratan_ACMA
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
#বিড়াল_ছানার_অপমৃত্যু_অতঃপর…
পর্ব: ২
বিনা দোষে বিড়াল ছানাটি মারা যাওয়াতে আমার প্রচন্ড রকমের খারাপ লাগছিল। কিন্তু যা হবার তাতো হয়েই গেছে আর কিছু তো করার নেই।
বাকি পথ আমি আর নাদিম কোন কথা বলিনি। আমি নাদিমকে ওর টাকা বুঝিয়ে দিতে সে চলে যায়।
আমিও বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুম আসছিল না।
বার বার সেই বিড়ালের মায়াবী মুখ আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।
আফসোস করতে করতে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন সকালে আমি অফিসে যাই এবং নিয়মিত অফিস করতে থাকি।
কিছু দিন পর আবারও বের হতে দেরী হওয়ায় নাদিমকে ফোন দেই।
নাদিম আমাকে নিতে আসে। কিন্তু ওকে কিছুটা বিষন্ন দেখাচ্ছে।
তার কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু সে কিছু বলতে চাচ্ছিল না।
আমি ভেবেছিলাম হয়তো টাকার সমস্যা। তাই পাঁচশো টাকার একটা নোট তাকে দিতে চাইলে সে কিছুতেই নিবেনা।
আমিও আর জোর করিনি। গাড়ি চলছে আর আমি বাহিরের দিকে তাকিয়ে জনমানবহীন শান্ত পরিবেশটা উপভোগ করছি।
এমন সময় নাদিম বলল, ওর বাবা খুব অসুস্থ।
কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই সে গাড়ি থামিয়ে কেঁদে উঠে।
তার বাবা হুট করে আজ সকাল থেকে রক্ত বমি করতে শুরু করে।
ওনাকে হসপিটালে নিলে ডাক্তার নানান টেস্ট দেন। টেস্টে ধরা পড়ে ওনার লিভার একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে।
ডাক্তারও অবাক । এই অবস্থায় ওনি কিভাবে বেঁচে ছিলেন তা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছিল না।
বাবার ঔষধ কেনার টাকা নেই। মুমূর্ষু বাবাকে সে এভাবেই ফেলে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে যেন ঔষধ কেনার টাকাটা অন্তত জোগাড় হয়।
তার কথা শুনে আমি বলি, আমি কি মরে গেছি? আমাকে আগে বলিসনি কেন? তুই আমাকে বন্ধু মনে করিস না।
চল তোর বাবাকে দেখে আসি। আমাকে হসপিটালে নিয়ে চল।
যাওয়ার পথে ঔষধ কিনে নিবি।
আমার কথা শুনে সে পুনরায় গাড়ি চালাতে থাকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
আমি তার বাবার জন্য প্রয়োজনীয় ঔষধ কিনে হসপিটালে দেখতে যাই।
নাদিমের বাবার অবস্থা দেখে আমি মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।
তার বাবার বিছানার সাদা চাদর রক্তে ভেজা। তিনি ক্রমাগত কেশেই চলেছেন।
আর ওনার মুখ থেকে প্রচুর পরিমানে রক্ত ঝরছে।
কাশির সাথে কালো রক্ত জমাট বাঁধা কি যেন বেরিয়ে আসছে।
আমি তখন জলদি আমার স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে তাকে বিশ হাজার টাকা দেই।
নাদিম টাকা নিতে না চাইলেও আমি বকাঝকা করে টাকা দিয়ে আসি।
পরদিন সকালে আমি ব্যাংকে গিয়ে একাউন্ট থেকে টাকা তুলে আমার স্ত্রীর গয়না ছাড়িয়ে নাদিমকে ফোন দেই।
সে ফোন রিসিভ না করায় মনের ভেতরটা খচখচ করছিল।
তাই আমি তখন চলে যাই হসপিটালে। বসকে ফোন দিয়ে ছুটি নেই তিন দিনের।
হসপিটালে গিয়ে দেখি তার বাবার নীথর দেহের পাশে বসে বসে সে কাঁদছে।
আমাকে দেখে সে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
তার কষ্ট দেখে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিল।
নাদিমের এই অবস্থা দেখে আমি স্বার্থপরের মত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলছিলাম হে আল্লাহ আমার পরিবারের কাউকে আমার কাছ থেকে এভাবে কেড়ে নিও না।
আমি সইতে পারব না। আমি মরে গেলেও আমার দুঃখ নেই। কিন্তু আমার পরিবারের কাউকে তুমি আমার কাছ থেকে আলাদা করে নিও না।
আসলে আমি খুব স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম সে সময়।
কেননা আমার বন্ধুর মৃত বাবা যেন জান্নাতবাসী হন সে দোয়া না করে আমি নিজে যাতে কোন রকম ক্ষতিগ্রস্ত না হই সেটা চেয়ে আল্লাহর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছিলাম। এবং সেটা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
নাদিমের বাবা মারা যাওয়ার পর আমি নাদিমকে কিছুটা সময় দিতে লাগলাম।
কারণ সদ্য বাবা হারানো ছেলেটার বন্ধু বলতে তো একমাত্র আমিই ছিলাম।
আস্তে আস্তে দুই মাসের মত সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। আর সময়ের স্রোতে সব স্বাভাবিক হতে থাকে।
কিছু দিন পর নাদিম আমাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য ফোন দেয়।
আমার অফিস বৃহস্পতিবার হাফ থাকায় আমি সেদিন তার বাড়িতে যাই।
নাদিম আমাকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে কিছু কথা বলে । যেগুলো এরকম –
ভাই তোকে কিছু কথা বলবো। যদি তুই আমাকে অবিশ্বাস না করিস।
যেদিন রাস্তায় ঐ বিড়ালের মৃত্যু হয় সেদিন থেকে আমি প্রতি রাতে সেই মৃত বিড়ালের পাশে দাড়ানো সাদা বিড়ালটিকে দেখতে পাই।
তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আর সে ঘৃনা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
তার কষ্ট আমি অনুভব করতে পারি। আর আমার বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আরও বেশি অনুভব করছি।
আমি ঘুমুতে পারিনা। খেতে পারিনা। গাড়ি চালাতে পারিনা।
আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?!!
আমার সাথে কিসব ঘটে চলেছে ভাই?!!
এসব বাবাকে জানিয়েছিলাম কিন্তু বাবা তো আর আমাকে শান্তনা দেবার জন্য বেঁচে নেই।
এমন কেউ নেই যার সাথে শেয়ার করবো।
প্রথমে মা কে বলেছি। কিন্তু মা এসবকে মনের ভুল বলে ভুলে যেতে বলেন।
তাই তোকে ডেকে বললাম। তুই বল আমি এখন কি করব?!
নাদিমের কথা শুনে আমার চোখের সামনে হঠাৎ করে সেই বিড়ালের চেহারা ভেসে উঠে।
আমি যেন অন্য এক জগতে চলে যাই। যেখানে সবকিছু সাদাটে দেখাচ্ছিল।
আর ঘন কুয়াশার চাদরে আমি এক ফুটফুটে বিড়ালের বাচ্চা দেখতে পাই।
যার সাথে অন্য একটি বয়স্ক বিড়াল খেলা করছে।
বাচ্চা বিড়ালটি বারবার বয়স্ক বিড়ালটির উপর উঠে যাচ্ছিল।
আর বয়স্ক বিড়ালটি তাকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
যেন বাবা তার সন্তানকে কাঁদে নিয়ে হেঁটে চলেছে।
বি: দ্র: ৩য় পর্ব আসবে ৩১ই জুলাই, ২০২২।
#Imran_Khan_Ratan_ACMA
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
#বিড়াল_ছানার_অপমৃত্যু_অতঃপর…
পর্ব : ৩
এই অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমি যেন আমার মেয়েদের ছেলেবেলা দেখতে পাচ্ছিলাম।
হঠাৎ নাদিমের ধাক্কায় আমি চেতনা ফিরে পাই।
এতক্ষণ আমি তোকে যা বলেছিলাম তাকে আমি নাকি কিছু জানাইনি।
আর তার সমস্যার সমাধানও দিতে পারিনি।
কারন আমি তো আর বিজ্ঞ আলেম কিংবা স্বপ্নের ব্যাখ্যা দাতা নই।
আমিও তাকে মনের ভুল বলে সবকিছু স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে বলি।
রাতে তার বাসায় খেয়ে আমি রিকশা নেই। রিকশায় চেপে আমি বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। আর বারবার সেই দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে আসছিল।
যা আমি নিদিমের বাসায় দেখেছিলাম মানে অনুভব করেছিলাম।
বাসায় এসে দেখি আমার বাবা মা রাতের খাবার খাচ্ছেন। আর আমার স্ত্রীর সাথে গল্প করছেন।
আমি ডাইনিং টেবিলে বসে এক গ্লাস পানি পান করে তাদের কাছে সব কথা শেয়ার করি।
আমার মা আমাকে বলেন আমি ছোটবেলা থেকে বিড়াল পছন্দ করি বলে হয়তো এমনটা অনুভব করছি।
আমিও তাই ভাবলাম। কারণ সেই মুহূর্তে এটা ছাড়া আমি আর কিইবা ভাবতে পারতাম।
আমি ফ্রেশ হয়ে আমার মেয়েদের রুমে গিয়ে দেখি তারা খেলা করছে।
আমি তাদের ঘুমিয়ে পড়তে বলি কিন্তু তারা আমার কাছে গল্প শোনার জন্য বায়না ধরে।
আমি বারবার তাদের ঘুমিয়ে যেতে বলি কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা।
আমি তাদের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গল্প শুরু করতে যাবো ঠিক তখনি আবার আগের মতো আমার চোখের সামনে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে সেই বিড়াল দুটিকে হেঁটে যেতে দেখতে পাই।
বয়স্ক বিড়ালটি তার বিড়াল ছানাটিকে নিয়ে হেঁটে চলেছে।
কিছুক্ষণ পর পর তারা দাঁড়াচ্ছে আর বাচ্চাটি তার বাবার লেজ ধরে খেলা করছে।
এসময় ছোট বিড়ালটি দৌড় দিয়ে সামনে যেতেই আমি দেখি একটা গাড়ি বাচ্চাটিকে চাপা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
এরপরই বাবা তার সন্তানের নীথর দেহের পাশে বসে কান্না করতে শুরু করে।
এতক্ষণে সে আমার দিকে একটি বারের জন্য তাকায়নি।
কিন্তু এইবার সে আমার দিকে তার অশ্রুসিক্ত চোখ তাঁক করে দেখছিল।
বিড়ালটি আমার দিকে তাকানোর সাথে সাথেই আমার কেন জানি খুব কষ্ট হচ্ছিল।
আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার মেয়ে মারা গেছে। আর আমি আমার মেয়ের পাশে বসে কাঁদছি।
আমার মনেই হচ্ছিল আমার কলিজার টুকরা আমার চোখের মণি আমার মেয়ে আমাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে।
আমি প্রচন্ড কষ্ট পাই। প্রচন্ড জোরে কেঁদে উঠি। আমার কান্নার আওয়াজ শুনে আমার মা আমার স্ত্রী রুমে এসে ধাক্কা দেয় আর আমার চেতনা ফিরে আসে।
আমি দেখি আমার মেয়ে দুটি কাঁদছে।
আমি তাদের জড়িয়ে ধরে তাদের কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করতেই তারা বলে, আমি নাকি বিড়াল মারা যাওয়ার কথা বলে চুপ করে বসেছিলাম।
আর হঠাৎ আমি নাকি কেঁদে উঠি।
আমি আমার মেয়েদের দেখে যেন প্রান ফিরে পাই।
তাদের জড়িয়ে ধরে আবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকি আমার মেয়েদের যেন তিনি রক্ষা করেন।
সেই রাতে আমি আমার মেয়েদের রুমেই থেকে যাই।
আর সারারাত তাদের দিকে তাকিয়ে থাকি।
এবং সেই মৃত বিড়ালটির কথা ভেবে চোখের পানি ফেলতে থাকি।
এরপর কয়েকদিন পার হয়ে যায়। আমি আর কোনো কিছুই অনুভব করছিলাম না।
কিন্তু একটা বেপার লক্ষ্য করতে থাকি আর তা হলো নাদিমকে ফোন দিলেও সে আর আমাকে নিতে আসেনা।
কয়েকদিন এমন চলায় আমি বাসায় একদিন হাজির হই।
বাসায় গিয়ে দেখি তার বাসায় তালা দেওয়া।
আমি তাকে ফোন দিলে সে বলে তার মায়েরও নাকি তার বাবার মতো লিভার নষ্ট হয়ে গেছে।
তা শুনে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে যাই।
হসপিটালে গিয়ে দেখি তার মায়ের মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে।
তিনি কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না।
ঠিক নাদিমের বাবার মতই।
তিনি এতো কষ্ট সহ্য করেও ছেলেকে কাছে টেনে বারবার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।
কিছুক্ষণ পর দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে তিনিও পরপাড়ে চলে গেলেন।
আমার মধ্যে আর এসব সহ্য করার শক্তি ছিল না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি আমার বাসায়।
আমার স্ত্রী কান্না কন্ঠে বলছে আমার বাবা মা দুজনেই নাকি খুব রক্ত বমি করছে।
আমার স্ত্রীর কথা শুনে আমার আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না যে, আমার বাবা মাকে হয়তো আমি হারাতে যাচ্ছি।
আমি দ্রুত অ্যাম্বোলেন্স কল করে তাদের নিয়ে হসপিটালে যাওয়ার পথেই তারা আমার সঙ্গ ছেড়ে আল্লাহর দরবারের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান।
আমি আমার বন্ধু নাদিম আমরা আমাদের বাবা মা’কে হারিয়ে ফেলি চিরদিনের জন্য।
আমি সেদিন চুপ করে সব দেখেই যাচ্ছিলাম।
কথায় আছে না অতি শোকে পাথর।
মনে হয় আমারও তাই হয়েছিল।
#Imran_Khan_Ratan_ACMA
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
#বিড়াল_ছানার_অপমৃত্যু_অতঃপর…
পর্ব : ৪র্থ
বাবা মাকে দাফন করে আমি চলে আসি বাসায়। বাসায় এসে প্রচুর কেঁদেছি।
বাবা মা মারা যাওয়ার পর আমি খুব ভেঙ্গে পড়ি।
খুব ভয় হচ্ছিল ভাবছিলাম স্বপ্নের কথা জানানোর জন্য হয়তো আমার আর নাদিমের বাবা মা মারা গেছেন।
কেননা নাদিম স্বপ্ন দেখেছিল অনেক আগে।
আর আমি যে দৃশ্য দেখছিলাম তা নাদিম তার স্বপ্নের কথা বলার পর থেকেই।
আমি আমার স্ত্রী সন্তানের কাছেও বলেছি এই স্বপ্নের কথা।
তাহলে কি ওদেরও কিছু হবে!!?
ভেবে আমি আতংকিত হই। একপ্রকার পাগল প্রায় হয়ে যাই।
আমি আমার ছোট দুই মেয়ের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করি।
দেখতে দেখতে বাবা মা মারা যাওয়ার একবছর পূর্ণ হয়।
আমিও কিছুটা নিশ্চিন্ত হই কেননা আর কিছু এর মধ্যে ঘটেনি।
একদিন আমি আমার বাসায় মিলাদের আয়োজন করি।
নাদিমকেও আসতে বলি। নাদিম তার স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে আমার বাসার উদ্দেশে রওনা দেয়।
আমার বাসায় আসার পর মিলাদ পড়ানো হয়।
সব কাজ শেষ করতে করতে রাত আটটার বেশি বেজে যায়।
নাদিমকে রাতে খেয়ে যেতে বলি।
আমার বাসার বারান্দায় আমার মেয়েরা খেলছিল নাদিমের ছেলের সাথে।
হঠাৎ অনুভব করতে শুরু করি আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল।
কষ্টটা ঠিক যেমনটা আমি বিড়াল মারা যাওয়ার দৃশ্য দেখে অনুভব করেছিলাম।
এবার আমি দেখি আমি আমার মেয়েদের পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু পাচ্ছিনা।
তখন আবার আমি সেই কুয়াশা ঘেরা জায়গাটা দেখি। যেখানে সেই বিড়ালটি নাদিমের ছেলের সাথে খেলা করতে দেখি।
নাদিমের ছেলে বিড়ালটিকে কোলে তুলে নেয়।
আর বিড়ালটি পরম আদরে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
আবার আমার স্ত্রীর ধাক্কায় আমার চেতনা ফিরে আসে।
আমি ভয়ে নাদিমের ছেলেকে ডাকি কেননা আমি তাকে বিড়ালের সাথে দেখেছি।
যদি তার কিছু হয় এসব ভেবে আমি এক দৌড় দিয়ে বারেন্দায় যেতে যেতে তাকে ডাক দেই।
কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস বারেন্দায় গিয়ে দেখি নাদিমের ছেলে রক্ত বমি করে পড়ে আছে।
আর আমার মেয়ে দুটি সেখানে নেই।
আমি বারেন্দার গ্রীলের ফাঁক দিয়ে দেখি আমার মেয়ে দুটি রাস্তায় হাঁটছে।
কিন্তু তারা বাহিরে কি করে গেল আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না।
আমি আর আমার স্ত্রী ছুটে যাই তাদের বাঁচানোর জন্য।
কিন্তু রাস্তায় গিয়ে দেখি আমার মেয়ে দুটির বুকের উপর দিয়ে একটি ট্রাক চলে গেছে।
আমি এবং আমার স্ত্রী একেবারে নীরব নির্বাক হয়ে যাই এ দৃশ্য দেখে।
আমি বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে আমার কলিজার টুকরো দুটির লাশ নিয়ে আসি স্ত্রীকে সাথে করে।
বাসায় এসে দেখি নাদিমের স্ত্রীও আমার স্ত্রীর মতো পাথর হয়ে বসে আছে।
আমি আর নাদিম এই মহাবিশ্বের চেয়ে ভারি বেশি কষ্ট নিয়ে সন্তানের লাশ দাফন করার মতো কঠিন কাজটি করি।
আর কবরের পাশে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি।
ভোর হলে নাদিম তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যায়।
আমি তাদেরকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরে এলে আমার স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।
আমাদের কান্না শুনে সেদিন আমাদের প্রতিবেশীরা অনেকেই কেঁদেছিল।
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে
#বিড়াল_ছানার_অপমৃত্যু_অতঃপর…
পর্ব : ৫ (শেষ পর্ব)
আমার জীবন সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি বেচেও মরে গেছি।
সেদিন থেকে এখনো প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমার হৃদয় ছিড়ে যাচ্ছে।
মেয়েরা মারা যাওয়ার পর আমার সাথে আর নাদিমের কোন যোগাযোগ হয়নি।
আমার স্ত্রী একেবারেই খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। খুব জলদি সেও অসুস্থ হয়ে পড়ে।
আমিও আর চাকরিতে ফিরে যাইনি।
ব্যাংকে যা জমানো টাকা ছিল তাই দিয়ে চলছিলাম।
চাকরি করে আর হতইবা কি? জীবন তো শেষ হয়ে গিয়েছে আমাদের।
আমার স্ত্রী আস্তে আস্তে অনেক বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
সারাদিন মেয়েদের ছবি কোলে নিয়ে বসে থাকতো।
আমার শশুর বাড়ীর লোকজন তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও সে যেতে চায়নি।
অবশেষে সেই রক্ত বমি তাকেও পেয়ে বসে।
আমাকে ছেড়ে সেও চলে যায় আমার বাবা মা আর দুই মেয়ের কাছে।
আমি আমার জীবনে তখন সেই বয়সে যা দেখেছি আমার মনে হয় না আমার থেকে বেশি আর কেউ এমন কিছু দেখেছে।
আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি একদম চুপচাপ থাকতে শুরু করি।
বাসার সব লাইট খুলে ফেলে দেই। যার জীবনে কোন আলো আর অবশিষ্ট নেই এই কৃত্রিম আলো দিয়ে সে কি করবে?!!
একদিন রাতে শুয়ে আছি আর নিজের জীবন নিয়ে ভাবছি।
এমন সময় আমার রুমে হালকা আলোর উপস্থিতি টের পাই।
দেখি বিড়ালটি দাঁড়িয়ে আছে যে মৃত বিড়ালটির পাশে বসে কান্না করেছিল।
আজ তার চোখে পানি নেই।
সে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা মানুষের আকৃতি ধারণ করে। এবং আমার সাথে যেন কথা বলতে শুরু করল।
সে মানুষটি আমাকে বলছিল, কেমন আছেন আপনি? আমি জানি আপনি ভালো নেই। থাকবেন-ই-বা কি করে। নিজের সবকিছুই যখন হারিয়ে যায় তখন সে কিভাবে ভালো থাকে?!
এবং সে বলছিল, আমার নাম আনাস। আপনার মতো আমারও কেউ নেই।
কারণ আপনি এবং আপনার বন্ধু আপনারা দুজন মিলে আমার মেয়েকে মেরে ফেলেছেন।
আমাকে একা করে দিয়েছেন। আমার মেয়ের জন্মের পর আমার স্ত্রী আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যায়।
আমার জীবনে আমার মেয়েই ছিল সবকিছু।
আপনারা আমার বুক খালি করে দিয়েছেন।
আমার মেয়ের সব আবদার আমি পূরণ করতাম যে করে হোক।
আমার মেয়ে মানুষের দুনিয়া ঘুরে দেখার বায়না ধরেছিল।
তাই আমি তাকে নিয়ে বের হই। কিন্তু আপনারা কি সর্বনাশ-ই না করলেন।
জিনটি যখন কথাগুলো বলছিল তখন তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরছিল।
আমি তখন তাকে বললাম, মারলে আমায় মারতেন। আমার বাবা মা স্ত্রী সন্তানরা কি দোষ করেছে?! তাদের কেন মারলেন?!
তখন সে বলল, আপনাকে মেরে ফেললে তো আর আপনি কষ্ট কি যন্ত্রনা কি সেটা বুঝতেন না।
সে জন্যেই এ কাজটি করেছি।
এ বলে সে চলে যায়।
এরপর থেকে শুক্রবার বাদে বাকি প্রত্যেকদিন স্বপ্নের ভিতর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এসব কিছু পুনরাবৃত্তি দেখি।
আনাস তার কথা রেখেছে। সে আমাকে তার প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনা ভুলতে দেয়নি।
অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে শেষ করে দিতে কিন্তু আনাস তা করতে দেয়নি।
আমার জীবন চক্রে আমি বন্দি হয়ে গেছি।
যা কেবল মৃত্যুই আমাকে বাঁচাতে পারে।
আনাস তাকে আমার কাছে আসতে দেয়না।
আমার জন্য দোয়া করবেন যেন মৃত্যু আনাসের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমার কাছে আসে। তাহলে আমি বেঁচে যাই।
আমার জীবন আমি এখন আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে দিচ্ছি।
যদি পাপ কিছুটা হলেও কমাতে পারি।
আমি যা কামিয়েছি আনাসের মেয়ের মৃত্যুর কারণে তাহলে শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর সামনে হয়তো দাঁড়াতে পারব।
কিছুক্ষণ পরেই এশার আযানের উচ্চ ধ্বনি মসজিদের উঁচু মিনার থেকে ভেসে আসে,
আল্লাহু আকবার
আশহাদু-আল্লাহ্- ইলাহা ইল্লাল্লাহ্
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্….
( সত্য ঘটনার সমাপ্তি )
#Imran_Khan_Ratan_ACMA