প্রিয়োসিনী পর্ব ১৭
#নীরা_আক্তার
ইসরাক নওরিনের হাত ছাড়িয়ে আমানের কাছে এগিয়ে যায়।আমান ইসরাককে জড়িয়ে ধরে,
ইসরাকও ভাইকে সযত্নে আলিঙ্গন করে নেয়,
-চিন্তা করো না দাভাই, ইশা ভালো আছে!অনেকটা ট্রভেল করাই একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো।এখন ঘুমিয়ে আছে।আমি তোমাকেই আগে ফোন করতাম তুমি তো আমার নাম্বারটা ব্লক করে রেখেছো তাই বাধ্য হয়ে বড় আব্বুকে জানালাম।
ইসরাক একটু স্বস্তি পায়
-ভাই তুই কেমন আছিস?
-বেঁচে আছি।মরে যাই নি!আল্লাহ্ হায়াত রাখলে কারো ক্ষমতা নেই মেরে ফেলার।
আমান কথাটা বলেই নওরিনের দিকে তাকায়।নওরিন পেছনে গুটি শুটি হয়ে দাড়িয়ে আছে।নওরিন আমানের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।আমান নওরিনের দিকে তাকাতেই চোখা চেখি হয়ে যায়। নওরিন চোখ সরিয়ে নেয়।দৃষ্টি মেঝেতে স্থির করে। সে এক হাত দিয়ে আরেক হাতের তালু দলায় মালায় করছে কখনো আঙ্গুল মটকাচ্ছে!আমানের সামনে থাকতে ভীষন অস্বস্তি হচ্ছে তার।।
ইসরাক আমানের কথাটা বুঝতে পারলেও কোনো রিয়াক্ট করে না।এখানে কথা বাড়ালে নওরিনেরই সন্মান যাবে।
ইসরাক জিনাত সিকদারকে নিয়ে ইশার কেবিনে চলে যায়।নোহা আর নওরিন পেছন পেছন যেতে থাকে। আমানের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আমান নোহাকে ডাকে,নোহা থেমে যায়।কিন্তু নওরিন থামে না সে নিজের হাটার গতি আরো বাড়িয়ে দেয় এক নিঃশ্বাসে ছুট লাগায় ইশার কেবিনের দিকে, যেন তাকে কোনো পাগলা ষাঢ় তাড়া করেছে।
নোহা পেছন ফিরে তাকায়,
কিন্তু কোনো কথা বলে না
-নোহা কথা বলবি না আমার সাথে?
-নো
-আমি না তোর বেস্ট ফ্রেন্ড।
-আগে ছিলে এখন নেই।
-জানতে চাইবি না কেমন আছি?
-তুমি জানতে চেয়েছো আমরা কেমন আছি?
-খুব অভিমান করে আছিস?
-তোমার সাথে কি আমার মান অভিমানের সম্পর্ক?
-তাহলে কিসের সম্পর্ক
-কিছু না!
নোহা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না।সেখান থেকে চলে যায়।আমান কেবিনের বাহিরেই দাড়িয়ে থাকে।এই পরিবারটা একসময় তার জীবনের সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা ছিলো।অথচ আজকে এই লোকগুলোর সামনে দাড়াতেই তার ভীষন অস্বস্তি হচ্ছে।পা দুটো কাপছে।শরীরে ঘাম দিচ্ছে।তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু তার দাভাই,তার সবচেয়ে কাছের মানুষ নোহা সবাই তাকে ইগনোর কারছে….!
কিন্তু কার জন্য?
আমান চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে।গাল বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পরে!উওরটা হলো,
“নওরিন”
আমান ভেতরে যায় না।দরজায় দাড়িয়ে থাকে।ইমতিয়াজ সিকদার আমানকে ডাকলেও সে ভেতরে যায় না।ইসরাক নিজেও চাইছে না আমান ভেতরে আসুক।কারন সেখানে নওরিনও ছিলো!
নওরিন আর আমানের মাঝে দুরত্ব বজায় রাখা প্রয়োজন!
কিছুক্ষন দাড়িয়ে থেকে আমান সবার থেকে বিদায় নেয়,
–আমি আসছি।তোমরা ভালো থেকে
ইমতিয়াজ সিকদার চেঁচিয়ে উঠে,
-আসছি মানে কি?কোথায় যাবি তুই?
-বড় আব্বু আমি চলে যাচ্ছি!
-কোথাও যাবি না তুই আমার সাথে নিজের বাড়িতে যাবি।সিকদার বাড়ির ছেলে তুই। কোথায় না কোথায় থাকিস কিছু জানি না আমি!বাবা এবার তো বাড়ি চল।অনেকতো হলো।
আমান মুচকি হেসে উওর দেয়,
-না। আমায় ক্ষমা করো বড়আব্বু
ইমতিয়াজ সিকদার অভিমানের সুরে বলে উঠে,
–আমি কে হয় তোর আমার কথা কেন শুনবি!
আমান মাথা নিচু করে মুচকি হাসে,
-দাভাই আমি কি চলে যাবো?
প্রশ্নটা সে ইসরাককে করেছে।ইসরাক নওরিনের দিকে তাকায়।নওরিন চোখ মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে তার দিকে,সে কি উওর দেবে সেটা ভেবে হয়তো দম আটকে রেখেছে।
ইসরাক মুখ কালো করে উওর দেয়,
-তোর ইচ্ছে…..
আমান হেসে দেয়,
-বুঝতে পেড়েছি।সমস্যা নেই আমি চলে যাচ্ছি।
আমান চলে যায়।ইমতিয়াজ সিকদারও আমানের পেছন পেছন বেড়িয়ে যায়।
ইশা এখনো ঘুমিয়ে আছে।মাথার কাছে জিনাত সিকদার বসা আর অপর পাশেই নোহা আর নওরিন বসা।
ইসরাক দূরে একটা সোফায় বসে আছে,
ইসরাক ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য বেরিয়ে যায়।একটু পরেই নার্স এসে ইমার্জেন্সি ঔষধের একটা প্রেসক্রিপসান ধরিয়ে দেয়।নওরিন প্রেসক্রিপশান হাতে বেরিয়ে পড়ে।উদ্দেশ্য ইসরাককে খুজে সেটা দেওয়া।
নওরিন হাসপাতালের করিডোরে ইসরাককে খুজতে থাকে।ইসরাকের চিহ্নও নেই কোথাও। নওরিন পিছু হাটা দেয়।ইসরাককে ফোন করলেই তো হয়!!
বোকার মতো নিজের মাথায় নিজেই চাটি মারে,
নওরিন রুমের দিকে ফিরছিলো হটাৎ করে কেউ একজন নওরিনের হাত ধরে টান দেয়।
নওরিন চিৎকার করতে চাইলেও পারে না। গলা দিয়ে কোনো শব্দ বার হচ্ছে না।সবগুলো শব্দ যেন গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে।তার সামনে আমান সিকদার দাড়ানো।যাকে সে জীবনে সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
নওরিন চোখ মুখ খিচে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।আমানকে সজোরে দাক্কা দেয়,কিন্তু আমান এক ইন্ঞ্চিও সরে না,হাতটা শক্ত করে মুঠো করে নেয়,
-দেখুন এটা একটা হাসপাতাল প্লিজ ঝামেলা করবেন না।আমি কিন্তু চিৎকার করবো।
-তাতে তোমারই জাত যাবে!যতোটুকু সন্মান তোমায় দা ভাই দিয়েছে সেটাও এখানেই বিসর্জন হয়ে যাবে।
-ওনি জানলে কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না।শেষ করে দেবে আপনাকে
-নাটক করছো?আমার সবটুকু শেষ করে এখন ড্রমা হচ্ছে?
-কিসের নাটক?
–আদর্শ বউ হওয়ার নাটক।কি করে পারো বলতো?আল্লাহ বোধয় নিজের হাতে তোমায় এই বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে।
-কিসের ক্ষমতা
-পুরুষ মানুষের মন ভুলানোর ক্ষমতা। ছলনাময়ী বেঈমান নারী।তুমি শুধু মুখের কথায় যেকোনো পুরুষকে বশ করতে পারো।আমাকেও করেছিলে এখন দাভাই কে করেছো।
–মুখ সামলে কথা বলুন!অসভ্য অভদ্র লোক।
-সামলেই তো রেখেছি নিজেকে,নয়তো কখন তোমাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিতাম!
-প্লিজ যেতে দিন!যা কথা বলার আপনার ভাইয়ের সামনে বলবেন!
আমান নওরিনের হাতটা নিজের বুকে রাখে,
-এই জায়গায় আঘাত করেছিলে তুমি।তোমার জন্য পাগল উন্মাদ এক প্রেমিকের হৃদয়কে ভেঙ্গে শত সহস্র টুকরো করে দিয়েছিলে তুমি।তুমি সেই নারী যাকে আমি হৃদয়ের এই জায়গায় লালন করেছিলাম। তুমি সেই বেঈমান নারী যে সেই হৃদয়কেই ভেঙ্গে দিয়েছিলে।তোমার কোনো যোগ্যতা নেই আমার দাভাইয়ের বউ হওয়ার।শুধু ভাই কেন…পৃথিবীর কোনো প্রেমিক পুরুষকেই তোমরা ডিসার্ব করো না।তুমি নিজে থেকে আমার দাভাইয়ের জীবন থেকে চলে যাবে না কি আমি তোমায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবো?
কথাগুলো বলতে বলতে আমান স্বজোড়ো দেয়ালে ঘুসি দেয়।নওরিন কেঁপে উঠে।আমানকে পাশ কাটিয়ে ছুট লাগায় কেবিনের দিকে।
কেবিনে এসে হাপাতে থাকে।নোহা এগিয়ে আসে
-কি হয়েছে নওরিন?
-আমা….
নওরিন বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায়।এদিকে সেদিকে চোখ বুলায়।জিনাত সিকদার কোথাও নেই।
-শ্বাশুড়ি মা কোথায়?
-বম্মা তো তোমার সাথে সাথেই বেরিয়ে গেলো।তুমি তো ফোন নিয়ে যাও নি। এতো বড় নার্সিং হোমে ফোন ছাড়া দাভাইকে কি করে খুঁজে পাবে শুনি?
নওরিন হাপাতে থাকে।ততোক্ষণে ইশারও জ্ঞান ফিরেছে।জ্ঞান ফিরেই ইশা আমানকে খুঁজতে থাকে,নোহা ভ্রু কুচকে তাকায় ইশার দিকে,
-এতো কিসের পিরিত?
–আমান ভাই কোই?
– জানো নওরিন আমার মনে হয় আমাদের সিকদার বাড়ির প্রত্যেকের রক্তে পাগলামো আছে।একাকজন একাক করকম পাগল প্রেমিক -প্রেমিকা।গিনেস বুকে নাম দেওয়া উচিত আমাদের চার ভাই বোনের।
নওরিন ভ্রু কুচকে তাকায়। ইশা কেঁদে দেয়,
–আমান ভাই আমাকে না বলেই চলে গেলো?
নোহা মুখ বাকিয়ে উওর দেয়,
-তোকে বলার প্রয়োজন মনে করে নি তাই বলে নি!তুই কে যে তোকে বলে আদর করে দিয়ে যাবে!
ইশা আরো জোরে কেঁদে উঠে,
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করে জিনাত সিকদার আর তার পেছন পেছন ইসরাকও আসে।
ইশাকে কাঁদতে দেখে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠেন,
-কাঁদিস কেন শরীর খুব বেশি খারাপ লাগছে? ডাক্তার ডাকবো?
ইশা মাথা নাড়ায়
–আম্মা আমান ভাই কোই?আমান ভাই-ই তো আমাকে নিয়ে আসলো।আমি কেমন আছে মা জেনেই চলে গেলো?আমাকে একবার বলেও গেলো না!
জিনাত সিকদার ইশার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়,
–আমান কোথাও যায় নি এখানেই আছে।তাই না নওরিন?
নওরিন চোখ মুখ কালো করে তাকায়,
-একটু আগেই তো তুমি আমানের সাথে কথা বললে।ও বোধহয় তোমার সাথে কথা বলার জন্যই বাহিরে অপেক্ষা করছিলো….সবার সামনে বলতে চাইছিলো না!
নওরিন অবাক চোখে তাকায় শ্বাশুড়ির দিকে।তিনি যে তাকে খারাপ ইঙ্গিত দিয়ে কথাগুলো বলছেন তা সে বেশ বুঝতে পারছে।
“ছিহ্”
মনে মনে নওরিন শ্বাশুড়ি মায়ের কথা বলার ভঙ্গীকে ধিক্কার জানায়।একজন নারী হয়ে একজন নারীর দূর্বলতাতে শব্দ দাড়া আঘান করছেন তিনি।
নওরিন শ্বাশুড়ি মায়ের চোখে চোখ রাখে,স্পষ্ট স্বরে বলে উঠে
–আমি নিজে থেকে ওনার সাথে কথা বলতে যাই নি।ওনি নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলতে এসেছেন।
জিনাত সিকদার তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠেন,
-হ্যা তুমি তো নিজে থেকে কিছুই করো না সব অন্যকেউ করে আর দোষ হয় তোমার।যেমন আগের কোনো কিছুই তুমি করো নি!এটাই বলবা তো?
কথাটা বলেই তিনি নওরিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইসরাকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন,
–আব্বা তুমি হা করে দাঁড়ায়ে আছো কেন?নওরিনের হাত থেকে প্রসক্রিপশানটা নাও আর বোনের জন্য ঔষধ নিয়া আসো।দেখো না তোমার ভাই-বোন কতো কষ্ট পাচ্ছে।তাদের আঘাতে তো তোমাকেই মলম লাগাতে হবে।তুমি মা বড়!
কথাগুলো অর্থ ইসরাক না বুঝলেও নওরিন বেশ বুঝতে পারছে।
ইসরাক বিষ্ময় কাটিয়ে নওরিনের দিকে এগিয়ে আসে।নওরিনের হাত থেকে ছো মেরে কাগজটা নিয়ে নেয়।
–আমানের থেকে দূরে থাকো।কথা বলোনা ওর সাথে।আমি কিন্তু সহ্য করবো না।
ইসরাক বেরিয়ে যায়।নওরিন অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে ইসরাকের যাওয়ার দিকে।
জিনাত সিকদার ইশার মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছে।এতো রাতে ইশাকে আর ছাড়বে না তারা।ইশাকে হাসপাতালেই থাকতে হবে।
জিনাত সিকদারের শরীর খারাপ লাগছে।ইমতিয়াজ সিকদার স্ত্রী কে নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।হাসপাতালে নওরিন আর নোহা থাকবে।ইসরাক নোহাকে বাবা মায়ের সাথে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দেয়,
-এখানে এতো লোকজন না থাকায় ভালো।চাইলে নওরিনও যেতে পারে।বোনের সাথে সে একাই থাকবে।
ইশাও তাতে সম্মতি জানায়।নওরিনকে চলে যেতে বলে।তার ধারনা নওরিন না থাকলে আমান হয়তো আসবে।অন্তত একবার আসবে।
কিন্তু নওরিন বাড়ি যায় না।ইশাকে একা ফেলে সে যাবে না। ইশার সাথে নওরিন আর ইসরাক থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নোহাও যেতে চায় না।সে মনে করছে এই মুহুর্তে তার এখানে থাকা প্রয়োজন কিন্তু ইসরাকও নাছর বান্দা জোর করে নোহাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
চলবে……