এক সমুদ্র প্রেম পর্ব ৫০
কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৫০)
সমুদ্রের কোল ঘেঁষে সূর্য ডু*বেছে। এইত,কিছুক্ষণ হলো। প্রকৃতির এই অদ্বিতীয় সৌন্দর্য ব্যগ্র লোঁচনে উপভোগ করেছে ওরা। পিউয়ের নেত্রপল্লবই পড়ছিল না। প্রথম দিকে সূর্য ডুবছেনা কেন,সেই নিয়ে বিরক্ত হলেও,ধীরে ধীরে নিজেই তলিয়ে গেল মনোহারিতায়। সে চুপ রইলেও পুষ্প মুগ্ধ হয়ে আওড়াল, ‘ ওয়াও,কী সুন্দর!’
এরপর চারিধার ঘিরে অন্ধকার নামল। বীচেও যেন হুরহুর করে বাড়ছিল লোক। বাড়তে থাকল অসংখ্য ভ্যানের ভীর। ধূসর আর কিছুতেই ওদের রাখবেনা ওখানে। বলল,
‘ ঘুরেছি অনেক,চল এবার।’
পুষ্প আরো থাকতে চেয়েছিল। সমুদ্রেও নামা হলো না আজ। আসতে আসতে বিকেল হওয়ায় ইকবাল নামতে দেয়নি, ঠান্ডা লাগবে বলে। কিন্তু
কড়া কণ্ঠের কাছে তার আবদার যে আর টিকবেনা সে জানে। ঠোঁট উলটে চুপ করে থাকল। চারজন গাড়িতে উঠল। ধূসর সবাইকে শুধাল,
‘ খেয়ে যাবি? না খাবার নিয়ে যাব?’
ইকবাল বলল, ‘ খেয়ে যাই।’
পুষ্প ও স্বায় দিলো। ধূসর আড়চোখে তাকাতেই পিউ অবিলম্বে মাথা নীচু করে ফেলল। পুষ্প বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল,
‘ কী রে? এখানে খাবি? না হোটেলে যাবি?’
সে সময় নিয়ে জানাল,’ সবাই যা বলবে।’
ধূসর বাইরের দিকে ফিরল। কক্সবাজারে আগেও এসেছে সে। পার্লামেন্ট থেকে প্রতি বছর আয়োজিত বনভোজনের তাগিদে একবার ঘুরেছিল এখানে। ইকবালের ও তাই। ওইজন্যে কোনাকানি মোটামুটি পরিচিত ওদের।
জায়গার বলে দেওয়া নাম অনুযায়ী চালক গাড়ি থামালেন। একটা তকতকে, শোধিত রেস্তোরাঁয় ঢুকল ওরা। অথচ এখানেও ভীর। টেবিল খালিই নেই বলতে গেলে। একজন ওয়েটার এগিয়ে এলেন ওদের দেখে। বসার জায়গা দিতে না পেরে বিনম্র গলায় বললেন,’ স্যার একটু অপেক্ষা করুন,টেবিল এক্ষুনি খালি হবে।’
ধূসর মাথা নাড়ল। ওদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। পিউ কাঁচের দেয়ালের পাশে লাগানো টেবিল গুলোর দিক চকচকে নয়নে চেয়ে আছে। ভীষণ চাইছে, ওগুলো একটা খালি হোক! তবে ওখানে বসে সমুদ্র দেখবে আর খাবে। এর মাঝে এক বয়স্ক লোক হাতে ধুঁয়ে ফেরত এলেন। ওদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে ধা*ক্কা দিলেন পিউকে। রোগা শোকা,বেখেয়ালে থাকা মেয়েটা সেই ধা*ক্কায় পুষ্পর ওপর হেলে পরল । রা না করে ঠোঁট উলটে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল। এত জায়গা থাকতে ওর গা ঘেঁষেই যেতে হলো?
অথচ ধূসর ক্ষি*প্ত বাঘের ন্যায় ফিরল তার দিকে। ভীষণ ক্ষো*ভে চোখ দুটো জ্ব*লে উঠেছে। চেঁচিয়ে ডাকল,
‘ এই দাঁড়া।’
চিৎকারে কেঁ*পে ওঠে পিউ-পুষ্প। কিন্তু লোকটা শোনেনি। হেলেদুলে হেঁটে নিজের টেবিলের কাছে গিয়েছে সে। ইকবালের মেজাজ ও তেঁতেছে। দুবোন ভীত চোখে একে অন্যকে দেখল। ধূসরের হাবভাব নিয়ে ভ*য় হচ্ছে। কিন্তু ইকবাল শান্ত, পরিস্থিতি বোঝে। ধূসরকেও চেনে। ওকে থামাতে বলতে গেল,
‘ ধূসর এখানে এখন….
সে শুনলে তো! হনহন করে গিয়েই লোকটার কলার ধরে নিজের দিক ফেরাল। টেবিল থেকে টিস্যু তুলে হাত মুছছিলেন তিনি। বয়সে আজমলের ধারেকাছে হবেন। আকষ্মিক ঘটনায় ভ্যাবাচেকা খেলেন। টেবিলে বসা আরও দুজন ভদ্রলোক অবাক চোখে তাকালেন। লোকটা নিজের কলার ধরা ওর হাতের দিক চাইল একবার। ধূসর সোজাসাপটা শুধাল,
‘ তুই ওকে ধা*ক্কা দিলি কেন?’
সেই শীতল স্বরের প্রশ্ন রেস্তোরাঁর সব কানায় পৌঁছায়। সবার মনোযোগ নিক্ষেপ হয় এদিকে। খাওয়া রেখে উৎসুক নজরে তাকিয়ে থাকল সকলে। ইকবাল গিয়ে ধূসরের পাশে দাঁড়ায়।
লোকটি না জানার ভাণ করে বলল, ‘ ককাকে?’
ধূসরের মেজাজ খারাপ হলো আরও। লাল চোখে চেয়ে বলল, ‘ নাটক করছিস? মেয়ে দেখলেই ধা*ক্কা মা*রতে মন চায়? ‘
‘ মানে কী আশ্চর্য! রাস্তায় চলতে গেলে একটু আধটু এমন ধা*ক্কা লাগতে পারেনা? হয়ত তাই…। আর আপনি তুই তোকারি করছেন কেন? এটা কেমন ভদ্রতা?
গলার স্বর উঁচু করলেন তিনি।
ধূসরের মেজাজ আরো চটে গেল। পাল্টা চেঁচিয়ে বলল,
‘ বেশ করছি। তুই ওকে ধা*ক্কা মারলি কোন সাহসে? কোনটা ইচ্ছে অনিচ্ছের আমি বুঝিনা?’
অচেনা জায়গায় এমন ধৃষ্টতায় ঘাবড়ে গেলেন উনি। ধরেই নিলেন এ স্থানীয় ছেলে। নাহলে বেড়াতে এসে ছেলেপেলে এমন ঝামেলায় জড়ায় না। সাথে দু দুটো বলিষ্ঠ যুবককে খেয়াল করে ভীত হলেন। ছোট করে বললেন,
‘ আমি দেখিনি।’
ধূসর তাও কলার ছাড়ল না ৷ রেস্তোরাঁর কর্তৃপক্ষ লোকজন এসে কাছে দাঁড়িয়েছে। পিউকে আঙুল দিয়ে দেখাল ধূসর। ভ*য়ে মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। ঢোক গি*লছে বারবার। ধূসর লোকটাকে আদেশ দিলো,
‘ সরি বল ওকে!’
ভীষণ অপমানিত বোধ করলেন উনি। এরকম হবে জানলে ভুলেও এমন করতেন না। পাশই মা*রাতেন না। ওনার সাথে আসা অফিস কলিগরা হা করে চেয়ে আছেন। পুরো রেস্তোরাঁ দেখছে তাকে। মান ইজ্জ্বতের এরুপ ধ্বং*সলীলা অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রত্যাশিত। চোখ নামাতেই ধূসর অধৈর্য হাতে কলার ঝাঁকাল ৷ হু*ঙ্কার দিলো,
‘ সরি বল!’
লোকটা সময় নিলো,তবে আস্তে করে বলল, ‘ সরি!’
তখন হাত হঁটাল ধূসর। দম ফেলল। তারপর গটগট করে চলে এলো পিউদের কাছে।
‘ খাব না এখানে, চল।’
বলল, সাথে পিউয়ের হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলো। তখন পুষ্পকে দেখে কাঁধ থেকে হাত সরিয়েছিল,অথচ এখন এত এত মানুষের মধ্যেই ওকে নিজের সাথে পেঁচিয়ে হাঁটা ধরেছে। মেয়েটা দুচোখ ছাপানো বিস্ময় সমেত তার শক্ত চিবুকটা একযোগে দেখে যায় । বাকরুদ্ধ সে,হতবিহ্বল।
পেছনে হাঁটতে হাঁটতে ইকবাল, পুষ্পকে হা হুতাশ ভঙিতে বলল,
‘ সাহস দেখেছো? ব্যাটা আস্ত একটা জল্লা*দ! ভয়ড*র নেই।’
পুষ্প চাপা কণ্ঠে বলল, ‘ তুমিত একটা ভীতু! ভেড়ার মত ভাইয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলে।’
ইকবাল বলল,’ কই পেছনে? আমি আমার বন্ধুর পাশে ছিলাম। একটা ঝামেলা হলে প্রস্তুত ও ছিলাম, একশন নেওয়ার। ফোন ও বের করে রেখেছিলাম বুঝলে!’
পুষ্প তাও মুক বাঁকাল। তারপর নিমিষেই হেসে বলল,
‘ ভাইয়া কত পসেসিভ দেখেছো? সামান্য একটু ধা*ক্কায় কী রিয়্যাক্ট করল বাবাহ! কত্ত ভালোবাসেন আমার বোনটাকে।’
‘ ধা*ক্কাটা সামান্য হলেও লোকটা ইচ্ছে করে দেওয়ায় ক্ষেপেছে বেশি৷ ওইটুকু মেয়ে,মধ্যবয়সী একটা লোক তাও অসভ্যতা করলো? ওর মেয়েইত পিউয়ের বয়সী হবে। এদের কী বিবেক-জ্ঞান নেই?’
‘ পৃথিবীতে সবাই কি এক হয়? যেমন ওদের মত পুরুষ আছে, তেমন আমার বাবা,চাচ্চু আর তোমার,আর ধূসর ভাইয়ের মতোও আছে। আর আমি হচ্ছি সবচাইতে লাকি। কারণ সব ভালো মানুষ গুলোকে আল্লাহ আমার ঝুলিতে ফেলেছেন।’
ইকবালের ঠোঁট দুদিকে আমুদে ভঙিতে সরে গেল৷
এর মধ্যে ম্যানেজার লোকটি অনুনয় শুরু করলেন ধূসরকে। ‘ স্যার স্যার ‘বলে কয়েকবার ডাকলেন। ও ফিরেও দেখল না। পিউকে সাথে জড়িয়েই লম্বা পায়ে বেরিয়ে গেল। মেয়েটা হিমশীম খেল সেই কদমে তাল মেলাতে। তাতে কী? ধূসর ভাইয়ের গায়ে মিশে থাকাই সবচাইতে জরুরি এখন।
রেস্তোরাঁর মানুষ গুলো গোলগোল চোখে দেখে গেল শুধু। কানা ঘুষাও বাদ রইল না। অত কিছু কে পেছনে রেখেই ধূসরদের গাড়ি হাওয়া হয়।
_____
মারিয়া আজ সাদিফকে ছাড়ল না৷ জোর করে, ইনিয়ে-বিনিয়ে বাড়িতে নিয়েছে। বিশেষ করে ইমোশোনাল কথাবার্তায় গলে গিয়েছে সাদিফ। প্রথমে সে কিছুতেই বাড়ির ভেতর যাবে না। কিন্তু যখন মারিয়া মন খারাপ করে বলল,
‘ আমরা গরীব বলে যেতে চাইছেন না তাইনা?’
প্রকান্ড অস্বস্তি হলো তার। সেতো এরকম কিছু ভাবেইনি। সঙ্গে সঙ্গে বাইক থেকে নেমে এসে বলল,
‘ চলুন।’
কলিংবেলের শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেলেন রোজিনা খাতুন। দরজা খুলে মেয়ের সাথে একটা অপরিচিত মুখ দেখে অপ্রস্তুত হলেন। উত্তর খুঁজতে মেয়ের দিক চাইলেন। মারিয়া প্রফুল্ল কণ্ঠে বলল,
‘ মা,উনি আমার বস সাদিফ। ওনার আরো একটা পরিচয় আছে,উনি ধূসর ভাইয়ের ভাই।’
সাদাফ সালাম দিলো। রোজিনা উত্তর নিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললেন,
‘ আসুন, আসুন,ভেতরে আসুন।’
সে ভেতরে এসে বলল,
‘ আন্টি আমাকে তুমি করে বলবেন,আমি আপনার ছেলের মত। ‘
রোজিনা তার সদাচরণে বিমুগ্ধ হলেন। মেয়ের দিক চাইতেই মারিয়া হাসল। তারপর নিজেও হেসে বললেন,
‘ ঠিক আছে। বসো বাবা,বসো।’
সাদিফ বসল। তাকে ভীষণ অপ্রতিভ লাগছে। কখনও এরকম মেয়েদের বাসায় যায়নি। কোনও মেয়ে ক্লাশমেটদের বাড়িতেও না। মারিয়াই প্রথম। সে দাঁড়িয়ে আছে দেখে, রোজিনা বললেন,
‘ তুই গিয়ে ফ্রেস হ। আমি ওকে চা দিচ্ছি।’
মারিয়া তড়িঘড়ি করে কাধ ব্যাগ নামিয়ে বলল,
‘ না না মা,আমি দিচ্ছি।’
তারপর রান্নাঘরে ছুটে গেল। রোজিনাও পেছনে গেলেন। সাদিফ বসে বসে আশেপাশে তাকাল। তিন কামড়ার ফ্ল্যাট,তবে খুব একটা বড় নয়। ছোটখাটো ফ্রিজ,টেলিভিশন সবই আছে,কিন্তু পুরোনো, বেশ আগের। তবে গোছালো,পরিপাটি খুব। তারপর চোখ পড়ল দেয়ালে। মারিয়াদের ফ্যামিলি ফটো ঝোলানো সেখানে। রওনাক,তার বাবা,রোজিনা আর সে। রওনাক কে দেখে অবাক হয় সাদিফ। ওকে সে চেনে। ধূসরের সাথে অনেকবার দেখেছিল। উনিতো মা*রা গিয়েছেন। তবে,উনিই মারিয়ার ভাই? সেজন্যেই মেয়েটা এই বয়সে চাকরি করছে?
সাদিফ উঠে এলো। এগিয়ে গেল দেয়ালের কাছে। বহু আগের মারিয়া এখানে। বোঝাই যাচ্ছে তার শৈশবের ছবি এটি। পড়নে ফ্রক,দুপাশে দুটো ঝুটি। কী শুকনো! হাসির মধ্য থেকে উঁকি দিচ্ছে পোঁকে খাওয়া দাঁত। সাদিফ হেসে ফেলল। এই অর্ধেক সাদা -কালো দাঁতের মারিয়াকে দেখতে দারূণ লাগল তার। সে চটপট পকেট থেকে ফোন বের করে ক্যামেরা অন করল। শুধু মারিয়াকে জুম করে টুক করে ছবিটা তুলে নিলো ফ্রেমে। এর মাঝে ট্রেতে নাস্তা নিয়ে হাজির হলো মারিয়া। ওকে ছবির কাছে দেখে বলল,
‘ কী দেখছেন?’
সাদিফ নড়েচড়ে তাকায়। ফোন পকেটে ভরে। দুষ্টুমি করে জানায়,
‘ আপনার পোঁকা আক্রান্ত দাত কপাটি দেখছিলাম।’
মারিয়ার হাসিটা কমে ঠোঁট চলে এলো উঁচুতে। ভীষণ দুঃখ নিয়ে বলল,
‘ আর বলবেন না,বাবার সাথে আমার ওই একটা ছবিই আছে। তাই জন্যে ভাইয়া ওটাই বাধিয়েছিল।নাহলে এই দাঁত আমি কাউকে দেখাতাম না।’
বলতে বলতে সে এসে ট্রে টেবিলে রাখল। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখল সাদিফ কাছে এসে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ এত কাছে দেখায় বক্ষ হেলেদুলে উঠল তার। এমন করে কী দেখছেন উনি?
তখনি সাদিফ বলল,
‘ এখন হা করুন তো, আপনার পোঁকা খাওয়া দাঁত গুলো দেখা যায় কী না একবার চেক করি!’
মারিয়া ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেল। কিছু বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। পালটা হাসল সাদিফও। সে বলল,
‘ প্লিজ বসুন,চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। ‘
সাদিফ ঘুরে এসে বসল। চায়ের কাপ হাতে তুলে চুমুক দিয়েই বলল,
‘ বাহ,আপনার চায়ের হাত তো বেশ ভালো।’
প্রসংশা শুনে মারিয়া মাথা নামিয়ে স্বলজ্জিত হাসে। চা শেষ করেই সাদিফ উঠে দাঁড়ায়। হাতঘড়ি দেখে বলে,
‘ আজ আসি।’
রোজিনা বেরিয়ে এলেন শুনে। বললেন,
‘ সে কী বাবা! নাস্তাতো কিছুই খেলে না। সব পরে আছে। আর এখন যাবে কেন,রাতে খেয়ে যেও।’
‘ না না আন্টি,আজ নয়,অন্যদিন। আজ তাড়া আছে।’
‘ ঠিক আছে,আবার এসো কিন্তু। ‘
‘ জি।’
সে দরজা অবধি যেতেই মারিয়া মিনমিন করে বলল,
‘ চলুন,এগিয়ে দেই।’
সাদিফ মানা করেনি। সে সামনে এগোতেই মারিয়া পিছু নিলো। নিশ্চুপ ভাবে দুজন গেটের কাছে আসে। মারিয়া গেটের লোহা আগলে দাঁড়ায়। তার দৃষ্টি কাতর। সাদিফ কয়েক পা গিয়ে থামল,ঘুরে তাকাল। মিলন হলো এক জোড়া আকুল আর এক জোড়া দ্বিধাযুক্ত চক্ষুর। মারিয়া মৃদূ হাসলে,হাসি বিনিময় করে সেও। তারপর উঠে বসে বাইকে। বলে, ‘ আসি।’
মারিয়া বলল, ‘ সাবধানে যাবেন।’
সাদিফ চলে গেলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘরে ঢুকল খুশিমনে। রোজিনা এঁটো বাসন গুছিয়ে রান্নাঘরে যাচ্ছিলেন,ওকে দেখে থামলেন। মারিয়া এসে কাঠের সোফায় বসল। তিনি বললেন,
‘ ছেলেটা কী ভদ্র! নম্র! তাইনা?’
‘হ্যাঁ। ‘
‘ ধূসরের সাথে চেহারার একদমই মিল নেই। কত ফর্সা! আমিতো বিদেশী ভেবেছিলাম।’
মারিয়া টি টেবিলে পা দুটো তুলে মাথা এলিয়ে দিলো পেছনে। চোখ বুজে বলল,
‘ ধূসর ভাইয়ের যা পার্সোনালিটি! সেখানে ওমন দশটা ফর্সা ছেলে মা*র খাবে বুঝলে!’
রোজিনা ঘাড় দোলালেন,
‘ তা ঠিক। ওরা না থাকলে আমাদের যে কী হোতো!’
শেষে এসে কণ্ঠ ভারি হলো তার।
মারিয়া প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,
‘ এসব এখন ছাড়ো। আমাকে একটু চা এনে দাওনা মা! মাথাটা ধরেছে।’
তিনি কপাল কুঁচকে বললেন,
‘ ওমা,এইনা বসের জন্য নাঁচতে নাঁচতে চা বানালি? এখন আমাকে বলছিস কেন? তখন টায়ার্ড লাগেনি?’
মারিয়া চোখ বুজে রেখেই হাসল,বলল,
‘ ওসব বুঝবেনা তুমি।’
আচমকা হাসি গায়েব হলো আবার। সাদিফের মনে অন্য কারো বাস,ভাবতেই ভারী হয়ে উঠল অন্তঃপাড়। চোখ খুলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলো। মাকে বলল,
‘ যাওনা, এনে দাওনা।”
‘ আনছি,আনছি।’
সাদিফ পুরো মনোযোগ দিয়ে বাইক চালাচ্ছে। এগারটা পেরিয়ে যাওয়ায় রাস্তাঘাট শূনশান হচ্ছে ধীরে ধীরে। শো শো শব্দের বাতাস এসে লাগছে গায়ে। হাল্কা ফেঁপে উঠছে তার পড়নের পাতলা শার্ট। এর মধ্যে হঠাৎ মারিয়ার কথাখানা বেজে ওঠে কানে।
‘ ওই তিনটাকে মা*রলে আমি আপনাকে তিনশ টাকা দেব।’
বলার সময়ে তার মুখভঙ্গি মনে করে হেসে উঠল সাদিফ। সেই হাসি দীর্ঘসময় লেগে থাকল ওষ্ঠপুটে। সহসা সচকিতে খেয়াল করল,তার এখন একটুও মন খারাপ নেই। পিউ চলে যাওয়ায় যতটা ছিল,তার ছিটেফোঁটা ও হাতিয়ে পেলো না। এর কারণ কী? মারিয়া? বাহ,জাদু জানে তো মেয়েটা!
______
পিউ রুমে এলো। তাদের ঘুরতে ঘুরতে রাত নেমেছে। খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকেছে বহু আগে।
সে কক্ষে এসেই হাসল। সেই পরিচিত লজ্জায় রক্তিম হয়ে ওঠা ঝলমলে মুচকি হাসিটুকুন। দুদিকের নরম গাল ফুলে ওঠল ওপরে। একটা মানুষের তাকে ধা*ক্কা দেওয়ায় রে*গে যাওয়া ধূসর ভাইয়ের চেহারা ভেবে হৃদয়পুর ছেঁয়ে এলো ভালো লাগায়,ভালো বাসায়। তারপর ওর বলা কথাটা’
রোমান্টিক হলে সুস্থ থাকবি? বারবার মনে পড়ছিল। এই যে এখনও যেন স্পষ্ট শুনছে কানে। নিরন্তর বাজছে কর্ণ পৃষ্ঠের আশেপাশে৷ পিউ মিনমিন করে বলল,
‘ একবার রোমান্টিক হয়ে না হয় আমাকে অসুস্থই বানালেন ধূসর ভাই। আপনার প্রেমে পড়ে আমার হৃদপিন্ডের চারটে প্রকোষ্ঠ এমনিতেই সুস্থ নেই।
তারপর ফোন নিয়ে বারান্দায় এলো। হোমস্ক্রিনে ধূসর আর তার যূগল ছবিটি সেভ করা। পিউ সেই ছবিতে তুখোড় যত্নে হাত বোলায়। লক খুলে গ্যালারিতে গিয়ে ধূসরের একার ছবি বের করে। তৃষ্ণা মেটাতে চেয়ে রইল কিয়ৎক্ষণ। আচমকা অধর নাড়িয়ে গেয়ে উঠল,
‘ এই তুমি যতক্ষণ থাকবে কাছে,
এই দেহে ততক্ষন প্রাণটা আছে, আমার প্রাণটা আছে। ‘
পিউ রেলিং ধরে মুক্ত, তারাভরা আকাশ পানে চায়। নক্ষত্রের ঝলসে ওঠা রুপ দেখে মন আরো ফুরফুরে হয়।
ফের দুপাশে দুলতে দুলতে গান ধরে,
‘ আমি যে তোমারই প্রেমেতে পড়েছি।
আমি যে প্রেমেরই মরণে মরেছি।
তোমারই ভাবনায় একাকি ভেসেছি।
তোমারই কাছে তো এসেছি।
জেনে নাও,ও প্রিয়,বুঝে নাও আমিও,
তোমাকেই মনে প্রাণে ভালোবেসেছিইই….
গানের মধ্যেই কোনও পুরুষালি অবয়ব পেছনে এসে দাঁড়াল। সেই ছাঁয়া ভেসে উঠল বারান্দার দেয়ালে। পরপর দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে মাঝে রেখে দুপাশ থেকে আকড়ে ধরল হঠাৎ। আকষ্মিক স্পর্শ, চেনা সুবাস নাকে যেতেই পিউয়ের বক্ষঃস্থল থমকায়। কণ্ঠস্বর কেঁ*পে ওঠে,গান থামে সহসা। স্ফুর্ত অধরে ভূমি*কম্প নামে। একবার ফিরে চাওয়ার প্রয়াস চালায়।
পিউয়ের হাঁটু টলে ওঠে। শরীরের ঝাঁকুনি প্রবল। ধূসরের অত্যুষ্ণ শ্বাস বৈশাখের তাণ্ড*বের ন্যায় প্রক্ষেপ হয় গালে। ঠান্ডা থুত্নী লেগে আসে কাঁধে। পিউয়ের ভেতর তোলপা*ড় শুরু হলো।
ধূসর ভাই কি এবার সত্যিই রোমান্টিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামলেন?
তার গতরের ঘূর্নিঝ*ড়ে, ধূসরের কপালে ভাঁজ পড়ল। গাঢ় ভাবে সরল রেখার ন্যায় স্পষ্ট ফুটে উঠল তারা। সেই ভাঁজ নিয়েই পিউয়ের দিক ঘাড় বেকে দেখল একবার।
তারপর বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ আর একটু কাঁ*পলে, এখান থেকে ঠে*লে ফেলে দেব।’
হুমকি শুনে পিউ ভ*য় পায়। অথচ কম্পন থামে না। ওরা কী তার মত বাধ্য?ধূসর সেকেন্ড খানেক দেখে গেল। শেষে বিদ্বিষ্ট, ব্যর্থ হয়ে ছেড়ে দিলো। সরে এলো দুরুত্বে। গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ ঘুমিয়ে পড়।’
তারপর বেরিয়ে যায়৷ পিউ আহত নজরে চেয়ে রইল সেই যাওয়ার দিকে।
________________________
পিউয়ের কিছু ভালো লাগছে না! নিজের ওপর তিঁতিবিরক্ত খুব। ধূসর ওইভাবে ছেড়ে যাওয়ায়,খারাপ লাগছে। ক*ষ্টও হচ্ছে। একবার গিয়ে সরি বললে হতোনা? সাথে বলবে,
‘আপনি এখন থেকে কাছে এলেও কাঁপ*ব না ধূসর ভাই। বিশ্বাস না হলে ধরে দেখুন। ‘
তারপর নিজেই জ্বিভ কা*টল। বিষয়টা কেমন দেখায় না? বেশরমের মত হয়ে যাবে কাজটা। কিন্তু উনি যে রা*গ করলেন!
এতক্ষনের হৈহৈ মেজাজ-খানা অনিমেষ হারিয়ে ফেলল পিউ। মুখ ভাড় করে বসে রইল বিছানায়। কতক্ষণ পাঁয়চারি করল কামড়া জুড়ে। নাহ,কিছুতেই মন ভালো হবে না আজ।
সে চটপটে কদমে পুষ্পদের ঘরের দিক রওনা করল।
ওদের দরজা খোলা, শুধু চাপানো। পিউ তাও কড়া নাড়ল। জানতে চাইল, ‘ আসব আপু?’
ভেতর থেকে জবাব এলো তৎক্ষনাৎ, ‘ আরে পিউপিউ এসো,ঘরতো তোমারই।’
পিউ হেসে ঢুকল। পুষ্প পা ভাঁজ করে বসে সোফায়। ইকবাল তার পাশেই। গা ঘেঁষে বসাছিল দুজনে। পিউয়ের গলা পেয়ে দুরুত্ব বাড়িয়েছে। সে ঢুকতেই পুষ্প নিজের পাশ দেখিয়ে বলল,
‘ আয় বোস।’
পিউ বসেনি। সে ওদের রুম থেকে বারান্দার দিক চাইল। ধূসর ভাইয়ের ঘরটা এদের পাশেই। বারান্দাও একইসাথে নিশ্চয়ই! ওনাকে কী দেখা যাবে? পিউ ত্রস্ত এগোলো সেদিকে। ইকবাল শুধাল,
‘ কই যাচ্ছো?’
‘ আপনাদের ঘরটা একটু দেখি!’
যেতে যেতে উত্তর দিলো। ইকবাল হাসল,বুঝেছে সে। পিউ বারান্দার এসে একদম কোনায় গিয়ে দাঁড়ায়। ডান পাশের ঘরটা ধূসরের। আলো জ্বলছে ভেতরে। পিউ কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে। যদি সে আসে এখানে! কিন্তু এলো না। উলটে বন্ধ হলো বাতি। পিউয়ের অপেক্ষার উত্তেজনা নিভে গেল। মন খারাপ করে রুমে আসতেই দেখল পুষ্প- ইকবাল ফিসফিস করে কথা বলছে। ওকে দেখতেই সহসা থামল সে আলাপ। দুজনেই গাল ভরে মেকি হাসল। পিউ এতে সন্দেহী চোখে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘ কী বলছিলে তোমরা?’
ইকবাল আমতা-আমতা শুরু করে। পুষ্প ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’ তোকে বলব কেন? ‘
‘ বললে কী হয়?’
পুষ্প দুষ্টুমি করে বলল,
‘ এসব হলো নবদম্পতির কথা। এগুলো ছোটদের শুনতে নেই।’
পিউ মুখ বাঁকায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ‘থাক,শুনলাম না।’
তারপর আরেকবার বারান্দা পানে চায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে’ আচ্ছা থাকো তোমরা,আমি আসি।’
ইকবাল বলল,
‘ সে কী! এলেইত এখন। বোসো না, গল্প করি!’
পিউ মুখ কালো রেখেই বলল,
‘ ঘুম পাচ্ছে খুব ভাইয়া। গল্প কাল করব কেমন? ‘
তারপর গুটিগুটি পায়ে ঘর ছাড়ল। ইকবাল শুধাল,
‘ ও কী রাগ করল মাই লাভ? ‘
পুষ্প নিশ্চিন্ত কণ্ঠে জানাল,
‘ আরে না! আমার বোনের ওমন ঢিলে রাগ নেই।’
সাদিফ ফ্রেশ হয়ে বের হলো কেবল। জবা বেগম এর মধ্যেই খাবার রেখে গিয়েছেন ঘরে। সে আসার সময়েই বলে এসেছিল দিয়ে যেতে।
সাদিফ মাথা মুছে এসি কমাল,ফ্যান ছাড়ল। কাউচে বসে টি টেবিল থেকে খাবার নিয়ে খেতে বসল। ভাত মেখে মুখে দিতে গিয়ে মনে পড়ল পিউয়ের কথা। আজ সারাদিন ওকে দ্যাখেনি। খেয়েছে ও? বাড়িতে এসে শুনেছে ওরা বিকেলেই পৌঁছেছিল। পিউ কেমন আছে কয়েক ঘন্টায়? একটুও মনে পড়ছে ওকে? ওর স্নিগ্ধ আনন চোখে ভাসতেই
সাদিফ খাবার রেখে উঠে যায়। ফোন এনে জায়গায় বসে কল দিলো পিউকে।
পিউ পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ঠোঁট উলটে কোলবালিশের ফিঁতে টানছে৷ ফোন সাইলেন্ট করা। সাদিফের কলে স্ক্রিন জ্বলে উঠল শুধু। তবে সেই আলো,তার মন খারাপের কাছে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। বেজে বেজে কে*টে গেল,সাদিফ আবার দিলো। ধরল না পিউ। সাদিফ বেশ কয়েকবার টানা কল দিয়ে থামল। এতবার তো কল দিতে হয়না ওকে। সব ঠিকঠাক আছে তো?
সে গুরুতর ভঙিতে অনক কিছু ভাবে। তারপর ব্যস্ত হাতে ফোন করে পুষ্পকে।
‘ ইকবাল,ফোন বাজছে আমার। সরো। ‘
ইকবাল সরল না। বরং কাধে ঘনিষ্ঠভাবে মুখ গুঁজে বলল,
‘ উম ঘুমাও,ধরতে হবে না।’
‘ জরুরি ফোন হলে?’
‘ তাও না।’
পুষ্প বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
‘ তোমার মত একটা হাতি আমার গায়ে হাত পা তুলে দিলে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি ইকবাল? একটুত মায়া করো।’
ইকবাল চোখ বুজে রেখেই বলল,
‘ এত কষ্টর ফল তুমি মাই লাভ! আমার যদি আরো চারটে হাত- পা থাকতো আমি তো সেটা দিয়েও তোমায় অজগরের মত পেচিয়ে রাখতাম ।’
‘ হ্যা,তারপর গি*লে খেতে নিশ্চয়ই? ‘
‘ ছি! ছি! মেয়েটা কী সব বাজে কথা বলে। ‘
পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এদিকে রিংটোনের লাগাতার স্বরে তার মাথা ধরেছে। সাদিফ ওর সাড়া না পেয়ে চিন্তায় পড়েছে আরও। যতক্ষণ না ধরবে থামবে না হয়ত। পুষ্প ভাবুক কণ্ঠে বলল,
‘ এতবার ফোন দিচ্ছে কে? বাড়িতে কিছু হয়নিতো? এই পিউতো একা ঘুমিয়েছে, ও ঠিক আছে? ‘
ইকবাল সচেতন হয়। ওমনি সরে যায়। পুষ্প চটপট উঠে ফোন হাতে নিতেই দ্যাখে সাদিফের নম্বর। তাও অবিলম্বে রিসিভ করে বলল,
‘ হ্যালো ভাইয়া,বাডিতে সব ঠিক আছে?’
সাদিফ গলা ঝেড়ে বলল,
‘ হু? হ্যাঁ। হ্যাঁ সব ঠিক আছে। তোরা, তোরা ঠিক আছিস?’
‘ আমরা তো ঠিক আছি। ‘
‘ ঘুমিয়ে পড়েছিলি? ‘
‘ না না জেগে ছিলাম। খেয়েছো তুমি? বাড়ির সবাই কী করছে?’
‘ খেয়েছি। শুয়ে পরেছে সবাই। তোরা খেয়েছিস?’ ‘ ‘হ্যাঁ। ‘
সাদিফ একটু থামল। শুধাল,
‘ পিউ কোথায়?’
কণ্ঠ অপ্রস্তুত শোনাল তার। পুষ্প সহজ গলায় বলল,
‘ ওতো রুমেই। ঘুমোচ্ছে হয়ত। বলে গেল ঘুম পেয়েছে খুব।’
সাদিফ মনে মনে বলল, ‘ ও,এইজন্যেই মহারানী ফোন ধরছেন না।’
মুখে বলল,’ ওহ।’ এঞ্জয় করছিস কেমন?’
‘ দারূন! তুমি এলে আরো মজা হতো।’
ইকবাল ফিসফিস করে বলল,
‘ মোটেইনা। তখন ধূসর-পিউ প্রেম করতে পারতো না এরকম।
পুষ্প চোখ রাঙিয়ে থামতে বোঝাল। সাদিফ শোনেনি, হাসল সে। তার চিন্তা শেষ । বলল,
‘ আচ্ছা,তাহলে ঘুমিয়ে পড়। শুভ রাত্রী। ‘
‘ শুভ রাত্রী। ‘
পুষ্প লাইন কাট*তেই ইকবাল বলল,
‘ সাদিফকে একটা বিয়ে করিয়ে দেয়া দরকার। বেচারা সিঙ্গেল বলে রাত বিরেতে কাপল দের ফোন করে।’
পুষ্প কপাল কুঁচকে বলল, ‘ তাতে তোমার সমস্যা কী?’
‘ আমার সমস্যা কী মানে? ইটস টাইম ফর রোমান্স মাই লাভ। আর রোমান্সে কেউ ডিস্টার্ব করলে সমস্যা হবে না?’
‘ কীসের রোমান্স?ঘুমাও। সকালে সূর্যদয় দেখতে যাব।’
ইকবাল লাইট নেভালো দুরন্ত হাতে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,’ হানিমুনে এসে কেউ ঘুমায়না মাই লাভ। ‘
তারপর চট করে পুষ্পকে শুয়ে দিয়ে আধশোয়া হলো ওর ওপর। পুষ্প ভড়কেছে প্রথমে,তারপর হেসে ফেলল। ইকবালের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,’ পাগল!’
সে নির্দ্বিধায় জানাল,’ তোমার জন্য!’
____
পিউ এপাশ- ওপাশ করছে। সারাদিন ম*রার মত ঘুমিয়ে এখন আর ঘুম আসছেনা।
আবার ধূসর ভাইয়ের শোকে মনটাও পু*ড়ছে। কী সুন্দর মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি এসে ধরা দিয়েছিল হাতে। মনের মধ্যে থাকা অস্তমিত সূর্যটা লাফিয়ে উঠেছিল অম্বরে। প্রথম বার ধূসর ভাই নিজে থেকে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আর সে? পিউ রাগে- দুঃ*খে কেঁ*দে ফেলল না শুধু। তবে আফসোসে বুক জ্ব*লছে এখন। নিজেকে কষে কিছু চ*ড়-থাপ্প*ড় মা*রতে পারলে শান্তি পেত।
চারদিক তখন শূনশান। গভীর রাত। সাগরের অল্প স্বল্প গর্জন আসছে কানে। এর মধ্যেই বাইরে থেকে দলীয় কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ এলো। পরপরই এলো দূর থেকে শিয়ালের ডাক। দুই তারস্বরের মিশ্রণ শুনতেই পিউ চোখ প্রকট করল। কক্সবাজারে কী শিয়াল ও ঘুরতে এসেছে? দিনের বেলায় কোথায় ছিল ওরা? ঝাউবনে?
শব্দ ক্রমে ক্রমে বাড়ছে। নিস্তব্ধ রাত,আর নীরব কামড়ায় ওমন ডাক ভূতুড়ে সিনেমার কথা মনে করাল তাকে। ঠিক যেন ভূতের গোঙানীর মত লাগছে এসব। পিউ ভ*য়ে ভ*য়ে থাই গ্লাস দিয়ে বাইরে তাকাল৷ বিদ্যুৎ বেগে আবার দৃষ্টি ফেরাল। মনে হচ্ছে, কাঁচ ফেটে উড়ে আসবে ওরা। তাকে ছিড়ে-খুঁ*ড়ে কলিজাটা বের করে খাবে।
পিউয়ের ঘাম ছুটল। অনুভব হয়,অশরীরী হাঁটছে ঘরে। সে তড়াক করে উঠে বসে, ত্রস্ত হাতে আলো জ্বালাল। পরিপাটি রুমটাকে আবিষ্কার করল শিয়ালের গর্তরূপে। যেন পাল ধরে ওয়াশরুম ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ওরা।
বাড়িতে তো একাই শোয়। একটুও ভ*য় লাগে না। এখন এত ভ*য় পাচ্ছে কেন তবে ? অবশ্য ওই ঘর, ওই বাড়ি তো জন্ম থেকে দেখছে। আর সেখানে এই জায়গায় সম্পূর্ন নতুন।
শিয়ালের ডাক একটু পরপর থামলেও, কুকুর গুলোর বিশ্রাম নেই। যেন ভীষণ চটেছে কারোর ওপর। নিরন্তর উচ্চশব্দে ঘেউঘেউ করছে। কোনওটা আবার সুর দিয়ে ডাকছে।
পিউয়ের আত*ঙ্কে হাত পা জমে আসছে। না,এই ঘরে একা থাকা সম্ভব না ওর। সে ছটফটে পায়ে দরজা খুলল শব্দ করে। তারপর ধুপধাপ করে দৌড়ে বের হলো। সোজাসুজি পুষ্পর দরজায় এসে ধা*ক্কা দিতে গিয়েও থমকাল।
মাথায় এলো,পূষ্প তো একা নেই, ইকবাল ও সাথে। এই মাঝরাতে ওদেরকে বিরক্ত করা ঠিক হবে? পুষ্প তার নিজের বোন হলেও, ইকবাল ভাই বিরক্ত হতেই পারেন! নতুন বিয়ে হয়েছে, সেখানে কিছু প্রাইভেসি দেয়া উচিত।
পিউ অসহায় হয়ে পড়ল। দুপাশে সাড়ি সাড়ি রুমের, মাঝের সরু রাস্তাটায় অবলার মত দাঁড়িয়ে থাকল। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝের দিক চেয়ে রইল। ভীষণ কা*ন্না পাচ্ছে! মায়ের কথা মনে পড়ছে। আচ্ছা, ধূসর ভাইয়ের কাছে যাবে একবার?
তার মস্তিষ্কের ভাবনা মস্তিষ্কে থাকল। হ্যাঁ – না উত্তর বের হওয়ার আগেই কারো দরজা খট করে খুলল। হঠাৎ শব্দে পিউ চমকে তাকায়। সেকেন্ডে পেটানো শরীরের অধিকারী ধূসর বেরিয়ে আসে। তার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। পিউয়ের দরজা খোলার শব্দ,পায়ের আওয়াজ কর্নকুহর হতেই এই আগমন। ওকে বাইরে দেখে দরজায় থমকাল।
কন্ঠ শান্ত রেখে বলল’ এখানে কী করছিস?’
পিউ কথা বলল না। চুপচাপ চেয়ে রইল।
ধূসরের মুখবিবর অশান্ত,উদগ্রীব। এই নিশ্চুপতায় মাত্রা ছাড়াল যা।
অস্থির লোঁচনে এক পল দেখে এগিয়ে এলো। শুধাল,’ শরীর খারাপ লাগছে?’
পিউ চোখ নামিয়ে মাথা নাড়ল দুপাশে।
‘ তাহলে কী?’
পিউ ঢোক গি*লে ছোট কণ্ঠে জানাল,’ ভ*য় লাগছে! ধূসর ভ্রু বাঁকায় ‘ কীসের ভ*য়?
পিউ থেমে থেমে বলল,’ ভূত,ভূতের ভ*য়।’
তারপর তাকাল। ধূসরের ক্ষুদ্র শৈলপ্রান্ত বাঁকা দেখে উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ কী জোরে জোরে শিয়াল ডাকছে! আবার কুকুর গুলো জুটেছে সঙ্গী। আমার মনে হচ্ছে ভূত আমার রুমের মধ্যে ঘুরছে। হাঁটছে। আমি ওখানে কিছুতেই শুতে পারব না। দেখা গেল ঘুমিয়েছি, সকালে আর নিজেকে খুঁজে পেলাম না। ‘
বলতে না বলতে ফের ডাক শোনা যায়। পিউ ভয়া*র্ত গলায় বলল, ‘ ওই দেখুন, এখনও ডাকে।’
ধূসরের চেহারা অপরিবর্তিত। সে বিরক্ত কী না চোরা নেত্রে চেয়ে বোঝার প্রচেষ্টা করল পিউ। কিছুই না বুঝে আবার নীচে তাকাল।হাত কচলাল।
ধূসর ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,,
‘ আমি সাথে যাচ্ছি,চল। ‘
‘ ঘুমিয়ে পড়লে চলে আসবেন?’
‘ পাহাড়া দিতে বলছিস?’
পিউ জোরে জোরে মাথা নাড়ল
‘ না না। ‘
তারপর মিনমিন করে বলল,
‘ আপনি চলে আসার পর যদি মাঝরাতে ঘুম ভা*ঙে? আবার ভ*য় লাগে,তখন? আমি ভ*য়ে মরে যাবনা? ‘
এ যাত্রায় ধূসরের অভিব্যক্তি বদলাল। মেঝের দিকে ভাবুক নজরে চেয়ে রইল। যেন সিধান্ত নিচ্ছে কত কিছুর। একটু চুপ থেকে বলল,
‘ আয়।’
বলে নিজের রুমে ঢুকল। পিউ নীচের ঠোঁট চে*পে ধরে চেয়ে রয়। ধূসর ভাই কি ওনার ঘরে যেতে বললেন? ভেবে ভেবে পা বাড়াল।
ভেতরে ঢুকতেই ধূসর বিছানা দেখিয়ে বলল,
‘ ঘুমিয়ে পড়।’
পিউ অবাক হয়ে বলল,’ এখানে?’
‘ খাটের নীচে। ‘
পিউ থতমত খেয়ে বলল, ‘ না মানে,তবে আপনি কোথায় শোবেন?’
ধূসর চোখ কুঁচকে তাকাল,
‘ এত কথা কীসের? ঘুমাতে হলে ঘুমা।’
পিউয়ের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। ধূসর ভাই তাহলে সত্যিই রেগে আছেন? একবার হা করে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। উলটে রে*গে গেলে!
ধূসর ভাই কোথায় শোবেন, অনুচিন্তনে মাথা খা*রাপ হয়ে গেল পিউয়ের। ধম*ক খেয়ে কথা বাড়াল না। মনঃদ্বিধা নিয়ে বিছানায় উঠল। বালিশে মাথা রেখে ওপাশ ফিরে শুলো। টের পেলো ধূসর দরজা খুলছে। সে ত্রস্ত এপাশ ফিরে বলল,’ কোথায় যাচ্ছেন?’
‘ আসছি।’
পিউয়ের ঘরের দরজা হা করে খোলা ছিল। ধূসর লক লাগিয়ে ফিরে এলো। পিউ উঠে বসে পরেছে এর মধ্যে। ধূসর বলল
‘ ভয় নেই,ঘুমা।’
বলতে বলতে নিজে টানটান হয়ে শুলো ডিভানে। মাথার নীচে দুহাত রেখে চোখ বুজল। পিউ আস্তে ধীরে শোয়। বেশ কিছুক্ষণ পর ধূসরের দিক ফিরে তাকায়। বালিশে দুহাত লাগিয়ে গাল ছোঁয়ায় সেখানে। ধূসরের চোখ বন্ধ। ঘুমিয়ে পরেছে। পিউ সেই সুযোগ লুফে নিলো। মনের সম্পূর্ন যোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করল তাকে। দুই ঠোঁট ভরে এলো হাস্য জোয়ারে । ধূসরের ভ্রু,গভীর নেত্র,পাতলা ঠোঁট, গাল,গলা, অভঙ্গুর চিবুক,তার ফেঁপে ওঠা দুই পেশি একনিবিষ্টে অবলোকন করল৷ কত সুন্দর তার ধূসর ভাই! আর এই সুন্দর মানুষটা শুধুই ওর।
সে যখন মুগ্ধতায় বিভোর,বিমোহিত,ভুলে গিয়েছে সব, ধূসর আচমকা গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ এভাবে তাকিয়ে থাকবিনা। ‘
পিউ ভ্যাবাচেকা খেয়ে নড়ে উঠল। ধূসর চোখ খোলেনি৷ মুখভঙ্গিও স্বাভাবিক। তবু পিউ ঘাবড়ে গেল৷ গরমের মধ্যেও তড়িঘড়ি করে কম্বলে মুখ ঢেকে ওপাশ ফিরে ভাণ ধরল ঘুমানোর।
চলবে।
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/somudro/
আগামী পর্বে আপনারা একটু দ্বিধায় পরবেন,মানে খুশি হবেন না কষ্ট পাবেন সে নিয়ে। আর যদি তা না হয়,তাহলে তো ভালোই