নয়নে লাগিল নেশা পর্ব ৬
#WriterঃMousumi_Akter.
রজনী বিরক্ত হয়ে রান্নাঘরে গিয়ে তার মায়ের পাশে বসল। আয়েশা বেগম কড়াইতে আটটা মুরগির ডিম সিদ্ধ করতে দিয়েছেন। রজনী একটা পিড়ি টেনে বসে বলল, “আম্মু, সকালে কি এনার প্রশংসা করল বাবা?”
“হ, মা।”
“এত প্রশংসার কারণ কী?”
“মা এই পোলা বহুত ভালা। তুমি জানো না তাই। আমাগো গেরামেরই পোলা।”
“আমাদের গ্রামের? কই আগে তো দেখিনি!”
“গেরামে তো আহে না। তাই কেউ চিনে না।অনেক ভালা একখান পোলা।”
“কিন্তু দেখে তো চরিত্রহীন লাগছে।”
“ছি! মা, এসব কইয়ো না। শুইনা ফ্যালব।এমন ভালা পোলাডারে এসব কইয়ো না।”
রজনী বেশ অবাক হলো তার মা-বাবার এহেন সরলতা দেখে। মানুষের উপর দেখে ভেতর না চেনা মা-বাবাকে দেখে মনে মনে ভীষণ আফসোস করল। এই চরিত্রহীন লোকটা যে তার মেয়ের ক্ষতি করতেই তাদের সাথে ভালো ভালো কথা বলছে তারা সেটা বুঝতেই পারছে না। মুনসুর আলী দলিল বের করে নিয়ে এলো। প্রান্তিক পায়ের উপর পা তুলে দলিল দেখছে। রজনী খেয়াল করছে– প্রান্তিক সেই তখন থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দলিল দেখা যেন একটা বাহানা মাত্র। আসলেই তো বাহানা। হুদাই দলিল দেখার নাটক করছে। রজনী বেশ বিরক্ত হয়েই রুমে চলে গেল।
আধাঘণ্টা পর আয়েশা বেগম ডিম সিদ্ধ, সেমাই, মুড়ি মাখা, ঘরে তৈরি মোয়া দিলেন নাস্তার জন্য। মুনসুর আলী বললেন, “বাজান, এইগুলান ওহন খাও, দুপুরে একবারে ভাত খাইয়া তয় যাইবা।”
শ্রাবণ আর প্রান্তিক দুজনেই বলল, “না না চাচা, আমাদের অনেক কাজ। হঠাৎ মনে হলো আপনার দলিলটা দেখতে হবে তাই চলে এলাম।”
মুনসুর আলী বললেন, বাজান, জমিনখান কি পাইব?”
প্রান্তিক বলল, “এটা আজ থেকে আপনার ।কেউ শালিসে ডাকবে না আপনাকে নিয়ে। এই জমিতে গেলেও কেউ ঝামেলা করবে না।”
মুনসুর আলী খুশি হয়েই বললেন, হাচা কইতাছ বাজান?”
“জি চাচা।”
প্রান্তিকের এখন উঠতে হবে কিন্তু যাওয়ার আগে রজনীর মুখটা তাকে দেখতেই হবে ।আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল, “চাচি, হাত মুছব।”
আয়েশা বেগম রজনীকে ডেকে বললেন, “রজনী মা, একটা গামছা নিয়া আইসো।”
রজনী গামছা নিয়ে আসতেই প্রান্তিক রজনীর সামনে পা এগিয়ে দিল। সাথে সাথে বেঁধে পড়ে গেল প্রান্তিকের বুকের উপর।প্রান্তিক রজনীর কোমর শক্তভাবে হাত দিয়ে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, “এ তো, মেঘ না চাইতেই জল। আমি তো এটাই চাইছিলাম। এটা এক প্রকার স্বপ্নের মতো আমার কাছে। আমি চাইছি না যে, তুমি আর ওঠো। আজীবন আমার বুকেই থাকো।”
রজনী চোখ রাঙিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। মুনসুর আলী বললেন, “মা, পইড়া গেলা কেমনে?”
প্রান্তিক বলল, “গায়ে বল নেই। এই সিদ্ধ ডিমগুলো খাইয়ে দিন চাচা আপনার মেয়েকে।”
রজনী আবারও রাগী চোখে তাকাল। প্রান্তিক আর শ্রাবণ বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। মুনসুর আলী আজ ভীষণ খুশি সাথে আয়েশা বেগমও।
রজনী ঘরে গিয়ে জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে; প্রান্তিকের শার্টটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ– রজনী জানে প্রান্তিক এদিক দিয়েই যাবে আর জানালার দিকে তাকাবেই। সত্যি তাই হলো। যাওয়ার সময় জানালায় রজনীকে দেখে প্রান্তিক বাইক থামাল। বাইক থামিয়ে বলল,
“কী ব্যাপার রজনীগন্ধা, আমি চলে যাচ্ছি বলে খারাপ লাগছে? ইউ মিস মি?”
রজনী আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিল কেউ আছে কি না। কাউকে না দেখতে পেয়েই প্রান্তিকের কথার উত্তর দিল, “জি না, আপনার শার্টটা ফিরিয়ে দেব বলে দাঁড়িয়ে আছি।”
“বুঝি বুঝি শার্ট ফিরিয়ে দেওয়া বাহানা মাত্র।”
“আপনার যা ইচ্ছা বুঝুন। ধরুন আপনার শার্ট।”
“দূর থেকে দিতে পারবে? তোমার গায়ে তো বল নেই।”
“আমার গায়ে বল নেই আপনাকে বলেছি?”
“তাহলে পড়ে গেলে কেন? ইচ্ছা করেই, মানে– তোমারও আমার বুকে পড়তে ইচ্ছা করছিল?”
রজনী শার্টটা ছুড়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দিল। কিছুক্ষণ পরে জানালা খুলে দেখল– প্রান্তিক নেই। তবে গাছে খোদাই করে লিখে রেখে গিয়েছে তোমাকে এত সুন্দর হওয়ার অধিকার কে দিয়েছে রজনীগন্ধা? আই সয়ার, আমি কখন হয়তো হার্টফেইল করব তোমাকে দেখতে দেখতে।”
____________________
তিনদিন কেটে গিয়েছে। প্রিয়তা কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। প্রান্তিক বিজি থাকে বলে শ্রাবণই তাকে কলেজে পৌঁছিয়ে দেয়। শ্রাবণ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।প্রিয়তা গিয়ে বাইকের পেছনে উঠল। শ্রাবণ বাইক চালাচ্ছে আর আয়নায় প্রিয়তাকে দেখছে। প্রিয়তা শ্রাবণের পিঠে ছোট্ট একটা কি* ল দিয়ে বলল, “রাস্তা দেখে গাড়ি চালাও শ্রাবণ।”
“দেখার মতো জিনিস পেছনে থাকলে রাস্তা দেখব কীভাবে?”
“বিলাই একটা। যত প্রেম উনার আড়ালে এলেই! ভাইয়ার সামনে মিনমিন করে।”
“সম্বন্ধীকে সম্মান করি।”
“ভ*য় পাও না তাই বলছ?”
”না পাই না।”
“আচ্ছা, তাই?”
“ভ*য় পাই না তার প্রুভ দিব?”
“হুম দাও।”
শ্রাবণ বাইক থামাল। তাতে জোরালো একটা ধাক্কা লাগল। প্রিয়তার মুখ শ্রাবণের পিঠে ঠেকল। শ্রাবণ দুষ্টুমি করে বলে উঠল, “চুমু দিয়ে দিলে তুমি?”
প্রিয়তা এবার সত্যি চুমু দিয়ে বলল, “হ্যাঁ দিলাম।”
শ্রাবণ গাল এগিয়ে দিয়ে বলল, “উফফ! এইবার দাও; তাও ঠোঁটে দাও। প্লিজ জা*ন দাও।”
প্রিয়তা শ্রাবণের গালে একটা থা’প্প’ড় মে’রে বলল, “ এই যে দিলাম।”
“মা**ইর দেওয়ার পরে কিন্তু আদর দেওয়া উচিত।”
“আদর নেওয়ার এত শখ তাহলে বিয়ে করছ না কেন?”
“আর একটু বড়ো হও। এখনো বাচ্চা তুমি।বউ বউ ফিলিংস আসুক তোমাকে দেখে; তখন বিয়ে করব?”
“আমাকে দেখে এখন তোমার কেমন ফিলিংস আসে শ্রাবণ?”
“প্রেমিকা প্রেমিকা।”
“লুই**চ্চা কোথাকার। প্রেম করে আদর নিতে চাও, বিয়ে করতে চাও না।”
“বিয়ে তো করেই ফেলেছি কবে।”
“তোমার মতো ভীতু টাইপ ছেলের ওই মনে মনেই বিয়ে করতে হবে।” – বলেই প্রিয়তা একটা গাছের নিচে বসল। এদিকে সাধারণত কেউ আসে না। শ্রাবণ এদিক দিয়েই রোজ প্রিয়তাকে কলেজে এগিয়ে দিয়ে আসে। যাওয়ার সময় এই ফাঁকা জায়গাটায় বসে কিছুক্ষণ। একটা বড়ো কৃষ্ণচূড়া গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে একান্তে কিছু সময় কাটায়।
শ্রাবণ বাইকটা রেখে প্রিয়তাকে বলল, “একটু উঠে দাঁড়াবে জা’ন?”
প্রিয়তা উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বলল, “কী হলো?”
শ্রাবণ হাঁটু গেড়ে বসে প্রিয়তার সামনে একটা গোলাপ ফুল ধরে বলল, “তোমার ভাইয়ের গাছের ফুল চু*রি করা যা-তা ব্যাপার নয়।তোমার ভাই-এর বোনকে তোমার ভাই-এর বাগানের ফুল দিয়ে প্রপোজ করছি। আমি চাইলে অন্য জায়গা থেকে ফুল আনতে পারতাম; কিন্তু আনিনি। কারণ– আমি দুঃসাহসী ছেলে। তাই সাহসী প্রেমিকের মতো কাজ করেছি। আই লাভ ইউ জা’ন।আই লাভ ইউ সো মাচ।”
প্রিয়তা ফুলটা হাত বাড়িয়ে নিল। তখন শ্রাবণ প্রিয়তার হাতের তালুতে চুমু দিয়ে বলল, “এই হাত দু’টো এত সুন্দর কেন জা’ন? এই সুন্দর কোমল হাত দুটোর মালিকানা শুধু আমার।”
প্রিয়তা ফুলটা নিয়ে বলল, “আচ্ছা, আমি কী বলব বলো তো? খুশি হয়েছি আমি প্রচুর। কিন্তু হাসিও পাচ্ছে, ট্রাস্ট মি। জীবনে কেউ এইভাবে প্রপোজ করে কখনো? তুমি যে ডায়লগগুলা বলে প্রপোজ করলে!”
শ্রাবণ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি আনকমন পার্সন জা’ন। বুঝতে হবে।”
প্রিয়তা খিলখিল করে হাসছে। হেসেই যাচ্ছে। সত্যি কী অদ্ভুতভাবে শ্রাবণ প্রপোজ করল। শ্রাবণ মুগ্ধ হয়ে প্রিয়তার হাসি দেখছে। প্রিয়তার এই হাসির জন্য শ্রাবণ জা’নও দিতে পারে। প্রেমিকার হাসি পৃথিবীর সব কিছুর থেকে বেশি সুন্দর। প্রেমিকার হাসি পুরুষের মানসিক শান্তির কারণ।প্রেমিকার হাসি প্রেমিকের মন ভালো হওয়ার কারণ।
শ্রাবণ আর প্রিয়তা কিছুক্ষণ গল্প করে উঠল। কলেজ গেইটে প্রিয়তাকে নামিয়ে দেওয়ার সময় বলল, ‘আচ্ছা শোনো, রজনী নামে কাউকে চেনো?”
প্রিয়তা চোখ কপালে তুলে বলল, “চিনি, কেন?”
“মেয়েটাকে পছন্দ হয় তোমার?”
“কী ব্যাপার বলো তো?”
“ব্যাপার আছে।”
“এই তুমি ইদানীং প্রায়শ কলেজের আশপাশ দিয়ে ঘুর ঘুর করো। কাহিনি কী?”
“কাহিনি ইজ– আমার বউ এই কলেজে পড়ে।”
“সত্যি কথা বলো, রজনীকে ভালো লেগেছে তোমার? আমার সতিন বানাতে চাইছ?”
“কেন, বানালে তোমার আপত্তি নেই?”
“শ্রাবণের বাচ্চা! তোরে আমি খাই**য়া ফেলাব দেখিস। আমার ভাইকে দিয়ে তোর তেরোটা বাজাব।”
“এজন্য মাফিয়াদের বোনকে ভালোবাসতে নেই। জীবনটা হাতের উপর থাকে। নিজের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি জা’ন।”
চলবে….