অন্তর্হিত কালকূট
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২৪.
শুক্রবারের সকাল। ইউনাইটেড হসপিটালের সামনে আজ বেশ ভীড়। চাকুরিজীবী ও কর্মজীবী মানুষদের জন্যে ছুটির এই দিনটাই ডাক্তার দেখানোর উপযুক্ত দিন। তাই রোজকার তুলনায় আজ ভীড় অনেকটাই বেশি পড়েছে। কিন্তু এই ভীড় মোটেও পছন্দ হচ্ছেনা উচ্ছ্বাসের। প্রায় দু ঘন্টা যাবত হসপিটালের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ও। আদোও নাজিফা এই সময় হাসপাতালে আসবে নাকি ভেতরেই আছে সেটা জানা নেই। একমুহূর্তের জন্যেও গেইট থেকে চোখ সরায় নি। যদি সেই ফাঁকে নাজিফা ভেতরে ঢুকে যায় কিংবা বেরিয়ে যায় তাহলে? তারওপর এই ভীড়! গেইটের কাছে এতো মানুষের আনাগোনা থাকায় নজর রাখাটা বেশ মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের মাঝে নিল উচ্ছ্বাস।
গেইটের দিকে সতর্ক দৃষ্টি বজায় রেখেই লাইটার দিয়ে সিগারেটে আগুন জ্বালালো। এতক্ষণ অপেক্ষা করেও নাজিফার দেখা না পেয়ে ভেতরে ভেতরে অস্হির হয়ে পড়েছে উচ্ছ্বাস। এতদিন অবস্থাটা ভিন্ন ছিল। কিন্তু কাল নাজিফার নিজে থেকে কথা বলতে আসাটা ওর সবটা এলোমেলো করে দিয়েছে। হঠাৎ কী বলতে এসেছিল নাজিফা? ওদের তো সরাসরি কোন চেনাজানা বা আলাপ নেই তাহলে? কী প্রয়োজন ছিল? এই প্রশ্নগুলো সারারাত ঘুমোতে দেয়নি ওকে। এর উত্তর না পাওয়া অবধি স্বস্তি পাবে বলেও মনে হচ্ছেনা উচ্ছ্বাসের। অনেকক্ষণ হলো দাঁড়িয়ে আছে। নাজিফা তো এলোনা? এখন কী তাহলে আসবেনা? মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে হতাশ ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিল উচ্ছ্বাস। কয়েক সেকেন্ড পর আবার চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে চমকে উঠল। হৃদপস্পন্দন যেন থেমে গেল আধ সেকেন্ডের জন্যে।
হতভম্ব চোখে তাকিয়ে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নাজিফাকে। নাফিজা হাত ভাঁজ করে মুখে একরাশ গাম্ভীর্য নিয়ে তাকিয়ে আছে উচ্ছ্বাসের দিকে। উচ্ছ্বাস বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, মস্তিষ্ক পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেল। অথচ কাল থেকে নাজিফার সাথে দেখা করার জন্যেই ছটফট করছিল ছেলেটা। আর এখন নাজিফা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথচ উচ্ছ্বাস নড়তেও পারছেনা। হাতে থাকা সিগারেটের কথা মাথায় আসতেই উচ্ছ্বাস থতমত খেয়ে গেল। একপলক নাজিফার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত নিচে ফেলে দিল আধপোড়া সিগারেটটা। নেভানোর জন্যে পা দিয়ে পিষতে আড়ম্ভ করল। এমনভাবে পিষছে যেন পারলে সিগারেটটা মাটির নিচে পাঠিয়ে দিতো। নাজিফা হাত ভাঁজ করে রেখেই মনোযোগ দিয়ে দেখল উচ্ছ্বাসের ক্রিয়াকলাপ। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, ‘এভাবে পিষলে ওটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবেনা।’
উচ্ছ্বাসের পা থেমে গেল। চোখ তুলে তাকাল নাজিফার দিকে। কেমন অদ্ভুতরকম অসহায় দেখালো সে দৃষ্টি। যেন বিশাল রকম কোন ফাঁদে আটকে গেছে বেচারা। এই চেহারা দেখে কে বলবে এই ছেলে একজন গ্যাংস্টার? নাজিফা ভারি কন্ঠে বলল, ‘আপনি জানেন আমার কবে কখন ডিউটি পড়ে? কোনদিন কখন হসপিটালে আসি?’
উচ্ছ্বাস বোকার মতো তাকিয়ে রইল নাজিফার মুখে দিকে। নাজিফা ভ্রু নাচিয়ে বোঝাল তার উত্তর চাই। উচ্ছ্বাস দ্রুত না বোধক মাথা নাড়ল। নাজিফা হতাশ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘ তাহলে আন্দাজে যখন-তখন দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী? এটা কী সিনেমা পেয়েছেন? হিরো হিরোইনকে একপলক দেখার জন্যে সারাদিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, শীতে কেঁপে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে, আর হিরোয়িন সেসবে ফিদা হয়ে একদিন বলে দেবে আই লাভ ইউ টু। এতো সোজা?’
উচ্ছ্বাস ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। নাজিফার কথাগুলো শুনে বোকা বনে গেলেও স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘আমি সেরকম কোন আশা রাখিনি।’
নাজিফা দু’পা এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘তো? কী আশা করেছিলেন? এসব করে লাভ টা কী?’
উচ্ছ্বাস চোখ নামিয়ে ফেলল। নরম গলায় বলল, ‘ তুমি ডিস্টার্ব ফিল করলে আমি আর আসবোনা।’
নাজিফা কিছুক্ষণ উচ্ছ্বাসের মুখের দিকে তাকেই থেকে থমথমে গলায় বলল, ‘আমি আপনাকে বলেছি আর না আসতে? আসবেন নিজের ইচ্ছেতে আবার যাবেনও নিজের খুশিমতো? আমাকে কী মনে হয়? চিড়িয়াখানার পশুপাখি?’
উচ্ছ্বাস চমকে তাকাল নাজিফার দিকে। নাজিফার মুখ ভাবলেশহীন। বিস্ময়ে বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে উচ্ছ্বাস। একটু আগে যেটা শুনলো সেটা ঠিক শুনেছে কি-না বুঝে উঠতে পারছেনা। এই মেয়েটা ঠিক চাইছেটা কী? নিজে থেকে আজ কথা বলতে এলো, আর কীসব অদ্ভুত কথা বলছে! না, ওকে জানতে হবে আসল ব্যপারটা। বিস্ময়ভাবটা কাটিয়ে হালকা গলা ঝেড়ে উচ্ছ্বাস বলল, ‘গতকাল কী কিছু বলতে চেয়েছিলে? আমি ব্যস্ত ছিলাম তাই দাঁড়াতে পারিনি।’
নাজিফা ঠোঁটে বাঁকিয়ে চোখ তুলে নিজের তাচ্ছিল্য ভাবটা প্রকাশ করল। ব্যঙ্গ করে বলল, ‘ আপনি আবার ব্যস্ত। যাই হোক, হাতটা দিন তো?’
‘ হ্যাঁ?’ ভ্যাব্যাচ্যাকা খেয়ে এল উচ্ছ্বাস।
‘ বাংলাতেই বলেছি।’
উচ্ছ্বাস অবুঝ দৃষ্টিতে নাজিফার দিকে তাকিয়ে থেকেই হাতটা বাড়িয়ে দিল। নাজিফা ততক্ষণে নিজের ব্যাগ থেকে কলম বের করে ফেলেছে। উচ্ছ্বাসের ডান হাতটা নিজের বাঁ হাতের মাঝে নিয়ে উচ্ছ্বাসের হাতের তালুতে কিছু একটা লিখল। নাজিফা ছাড়তেই উচ্ছ্বাস নিজের হাতটা মুখের সামনে ধরে দেখল একটা ফোন নাম্বার লেখা আছে। নাজিফা কলমের ক্যাপ লাগাতে লাগাতে বলল, ‘এরপর থেকে দাঁড়ানোর আগে একটা ফোন করে জেনে নেবেন যে কখন কখন আমার ডিউটি থাকে। অযথা দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।’
কথাটা বলে চলে যাওয়ার জন্যে তিন কদম এগিয়েও থেমে গেল নাজিফা। পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘আর হ্যাঁ। সবসময়ই সঙ্গে আপনার সেই ভয়ানক বন্ধুকে সাথে আনার কোন দরকার নেই। বড় ভাইয়ের চোখে দেখি ওনাকে, ভয়ও পাই। বুঝেছেন?’
উচ্ছ্বাস দ্রুত হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল কিন্তু আসলে ও কিছুই বোঝেনি। নাজিফা আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে চলে গেল হসপিটালের ভেতর। আর উচ্ছ্বাস বিমূঢ় হয়ে একবার নাজিফার চলে যাওয়া দেখছে আরেকবার নিজের হাত দেখছে। কিন্তু যখন ওর মস্তিষ্ক পুরোপুরিভাবে বুঝতে পারল যে নাজিফা ওকে নিজের নাম্বার দিয়েছে তখন খুশিতে রাস্তার মাঝেই নাচতে ইচ্ছে হল ওর। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল। হাতের তালুতে লেখা নাম্বারটার ওপর চুমু খেলো একটা। কিন্তু হঠাৎই উচ্ছ্বাসের চোখ পড়ল রাস্তার দক্ষিণে থাকা একটা চায়ের দোকানে। বাদামি শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়া শ্যামবর্ণের একজন লোক দোকানে বসে চা খাচ্ছে। তার দৃষ্টি এতক্ষণ উচ্ছ্বাসের ওপরেই ছিল। কিন্তু উচ্ছ্বাস তাকতেই দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছে। উচ্ছ্বাসের দৃষ্টি এড়ালোনা ব্যপারটা। ও কিছুই বুঝতে পারেনি এমন একটা ভাব করে উঠে বসল গাড়িতে। গাড়ি স্টার্ট করে রিয়ার মিররে চোখ রেখে দেখল লোকটাও উঠে দাঁড়িয়েছে। উচ্ছ্বাস হাসল। স্বাভাবিক গতিতে চালিয়ে নিয়ে গেল গাড়িটা। পেছনে বাইকে করে উচ্ছ্বাসের গাড়িটা ফলো করছে লোকটা। উচ্ছ্বাস পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করল। কল রিসিভ হতেই উচ্ছ্বাস বলল, ‘ কালো রঙের একটা বাইকে করে আমার গাড়িটা ফলো করছে একজন। বাদামি শার্ট গায়ে, শ্যামবর্ণ। আমি বাড়িতে ঢোকার পর লোকটা কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব ইনফরমেশন কালেক্ট করবি। হ্যাঁ, আমি রোড ৫০ এই আছি এখন। মিস হয়না যেন।’
কলটা কেটে আবার মিররে তাকিয়ে বাইকের অবস্থানটা দেখে নিল উচ্ছ্বাস। ওকে বুঝতে দিলে চলবেনা যে উচ্ছ্বাস কিছু বুঝেছে। আপাতত শুধু গাড়ি চালিয়ে যেতে হবে।
*
তিন রুমের ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ই মনে হলো প্রিয়তার। একটা হল রুম, একটা বেড রুম আর কিচেনসহ একটা ডাইনিং রুম। বেডরুমের সাথে এটাচড বিশাল বারান্দাও আছে। ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায় হওয়াতে বারান্দা থেকে চমৎকার লাগছে বাইরের দৃশ্য দেখতে। ফ্লাটের ভেতরটাও বেশ সুন্দর। রুদ্র একটু নিচে গিয়েছিল কিছু কেনাকাটা করতে। ফিরে এসে দেখে প্রিয়তা পুরো ফ্লাটটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। রুদ্র প্রিয়তাকে দেখতে দেখতে ব্যাগগুলো সোফায় রেখে বলল, ‘ কী ম্যাডাম? পছন্দ হয়েছে?’
প্রিয়তা চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে আলতো হেসে বলল, ‘পছন্দ না হলে কী তাজমহল বানিয়ে দেবেন না-কি?’
রুদ্র কিছু বলল না। নিজে একবার সবকিছু চেক করে দেখল ঠিক আছে কি-না। সকাল আটটায় নাস্তা করে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয় রুদ্র আর প্রিয়তা। রওনা হয়েই ওর লোককে বলে দিয়েছিল ফ্লাটটা পরিস্কার করে বসত যোগ্য করে রাখতে। বনানী পৌঁছে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে প্রিয়তাকে নিয়ে সোজা চলে আসে এই ফ্লাটে। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই প্রিয়তা থমকে গেল। কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠে রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনি এখানে একা থাকেন?’
রুদ্র স্পষ্ট বুঝতে পারল প্রিয়তার মনবৃত্তি। রুদ্রর উপস্থিতিতে ভয় পাচ্ছে মেয়েটা! দুটো রাত যে ছেলেটার পাশে ঘুমিয়ে পাড় করল তাকে নিয়েও এতো ভয়? চমৎকার! রুদ্র খানিকটা কৌতুকের ছলে বলল, ‘ হ্যাঁ! তাইতো তোমাকে নিয়ে এলাম। একা একা আর কতদিন থাকা যায় বল? কম্পানি দেওয়ার মতো কাউকে তো প্রয়োজন না-কি?’
প্রিয়তা কেমন বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। মেয়েটা হয়তো উল্টোপাল্টা কিছু বলার সাহস পাচ্ছেনা। সেই মারাত্মক রকমের দুটো থাপ্পড় এতো তাড়াতাড়ি ভোলার কথা না। প্রিয়তাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুদ্র ভ্রু নাচাল। প্রিয়তা কিছু বলতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিল। তবে ওর ভেতরের অস্বস্তিটা চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠছে। রুদ্র এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ ভাবনার সাগরে ডুবে যাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি এখানে থাকিনা। তবে ফ্লাটটা আমারই। বাবা দিয়েছে।’
‘ হ্যাঁ সেই, বাপের টাকায় ফুটানি!’ বিড়বিড় করে বলল প্রিয়তা।
রুদ্র প্রিয়তার কথাটা শুনতে পেলোনা। তবে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেছে সেটা বুঝেছে। কিন্তু সেসবে পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘ শোন, আমি গুলশান যাচ্ছি। আমার বাড়িতে। তুমি আপাতত এখানেই থাকবে। আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাইরে আমার লোক আছে। ওরা সবসময় নজর রাখছে। ইউ আর টোটালি সেফ হেয়ার। আর কিছু প্রয়োজন হলে আমায় কল করো। নাম্বার সেভ করে দিয়েছি তোমার ফোনে। একা থাকতে পারবে তো?’
প্রিয়তা ঘাড় কাত করে বোঝাল হ্যাঁ ও পারবে। রুদ্র হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিয়ে সোফায় রাখা প্যাকেটগুলো দেখিয়ে বলল, ‘এখানে চা, কফি, মিল্ক পাউডার আর কয়েকরকমের স্নাকস রাখা আছে। আর রাতের খাবারটা এখন ফ্রিজে রেখে দাও। রাতে গরম করে খেয়ে নিও। আর তোমার জামাকাপড়গুলো কাবার্ডে রাখতে পারো, ফাঁকাই আছে। আর কিছু লাগবে?’
‘ না।’
‘ তাহলে আসছি এখন আমি।’
রুদ্র চলে যেতে নিলেই প্রিয়তা ডেকে উঠল, ‘শুনুন?’
রুদ্র দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘আবার কখন আসবেন?’
‘ কাল সকালে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব। তুমি দরজা লাগিয়ে দাও’
কথাটা বলে রুদ্র আর দাঁড়াল না। রুদ্র বেরিয়ে যেতেই প্রিয়তা দরজা লক করে দিল। রুদ্র পেছন ফিরে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে লিফটের দিকে পা বাড়াল।
*
আমের ভিলায় ফিরে রুদ্র দেখল রাশেদ, জাফর কেউ বাড়িতে নেই। আমের ফাউন্ডেশনে গেছে হয়তো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রুদ্র। শান্তিতে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাবে। এসেই যে কৈফিয়তের গোডাউন খুলে বসতে হচ্ছেনা এই ঢের। কুহুর সাথে দেখা করে সোজা নিজের ঘরে চলে এলো রুদ্র। উচ্ছ্বাস ঘুমোচ্ছে। ওরও আরেকটু বিশ্রাম প্রয়োজন। জ্বরটা সেড়ে গেলেও শরীর কিছুটা দুর্বল। হাতের ব্যান্ডেজটা না ভিজিয়ে গোসল সেড়ে নিল রুদ্র। শীতের মধ্যেও ঠান্ডা পানিতে গোসল করে শরীর জুড়িয়ে গেল একদম। নব্বই ভাগ ক্লান্তি কেটে গেল গোসলের পরেই। বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার জন্যে প্রস্তুতি নিতেই যাচ্ছিল এমন সময় জ্যোতি এসে ঢুকলো রুদ্রর ঘরে। বরাবরের মতো এবারও দরজায় নক না করেই ঢুকে পরেছে। রুদ্র বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। কারণ আগেও বলেছে কোন লাভ হয়নি। জ্যোতি এগিয়ে এসে রুদ্রর ব্যান্ডেজের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ কখন এলে? ডাকলে না তো? হাতে না-কি গু’লি লেগেছিল? খুব বেশি লেগেছে?’
রুদ্র নিজেও একবার জায়গাটা দেখে নিয়ে বলল, ‘ না, গু’লিটা ছুয়ে বেরিয়ে গেছে। গুরুত্বর কিছু না।’
জ্যোতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রুদ্র গ্লাসে পানি ঢালছে জগ থেকে। জ্যোতি এবার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে পেছন থেকে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এরকম নিষ্ঠুর কেন তুমি? তিনদিন পর এলে। নিজে থেকেতো দেখা করলেই না, আমি নিজে থেকে এলাম। তাও একবার জিজ্ঞেস করলে না আমি কেমন আছি?’
রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিল। আজ রাগ বা বিরক্তির চেয়ে বিতৃষ্ণা বেশি কাজ করছে ওর। ওর মনে হচ্ছে ওকে ছোঁয়ার অধিকার কারো নেই। জ্যোতি অনিধিকারচর্চা করছে। নিজের ক্রোধ সংবরণ করে জ্যোতিকে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ও নিজের থেকে। পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল জ্যোতির ঠোঁটে এখনো হাসি ঝুলে আছে। রুদ্র শক্ত কন্ঠে বলল, ‘দেখ, তুই কিন্তু এখনো বাচ্চা না, যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এবং তুই যথেষ্ট ভদ্র এবং ভালো মেয়ে। কোনটা উচিত আর কোনটা অনুচিত সেটা বোঝার মতো বয়স তোর হয়েছে। ভালোবাসলেই গায়ে পড়তে হবে তার কোন মানে নেই। আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়াকে ভালোবাসা বলেনা। যে নিজেকে ভালোবাসে সে কখনও নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়না। আর যে নিজেকে ভালোবাসতে পারেনা সে পৃথিবীর কাউকেই ভালোবাসতে পারেনা। আই হোপ এরপর থেকে কথাগুলো তোর মাথায় থাকবে।’
জ্যোতি এতক্ষণ তাকিয়ে ছিল রুদ্রর দিকে। রুদ্রর কথাগুলোতে যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও অপমানজনক মনে হল জ্যোতির। কিন্তু বরাবরের মতই সেই অপমান হজম করে নিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ খাবেনা?’
‘ খেয়ে এসছি। আমি এখন ঘুমাবো। দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে যা।’
কথাটা বলতে বলতেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে রুদ্র। জ্যোতি কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল রুদ্রকে। চাপা এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। ওখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে ধীর পায়ে রুদ্রর কক্ষ ত্যাগ করল জ্যোতি।
#চলবে…