#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২৬.
রুদ্রকে এতো গভীর ভাবনায় মগ্ন দেখে একটু অবাক হলো প্রিয়তা। একবার তাকিয়ে দেখল রুদ্রর হাতে থাকা স্যান্ডউইচটার দিকে। সেইযে এক বাইট খেয়েছে এরপর আর মুখে তোলেনি। এতো কী ভাবছে? এই লোকটাও এমন গভীরভাবে ভাবতে পারে! এই তিনদিনে প্রিয়তা যতটুকু চিনেছে সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ গতিতে চলে রুদ্রর মস্তিষ্ক। তার আবার এতো ভাবতে হয় কীসে? প্রশ্নটাকে আর মনে চেপে রাখতে না পেরে প্রিয়তা বলল, ‘ কী ভাবছেন?’
প্রিয়তার হঠাৎ ডাকে চমকে উঠল রুদ্র। কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘কিছু না।’
‘ খাচ্ছেন না যে?’
রুদ্র জবাব দিলো না। আবার স্যান্ডউইচে কামড় বসাল। মুখ কালো করে প্রিয়তা নিজেও খাওয়ায় মনোযোগ দিল। তবে মনে মনে রুদ্রর গুষ্ঠি উদ্ধার করতে ভুলল না। কী ভয়ানক পানসে লোক! একটা মানুষ এতো মেপে মেপে কথা বলে কীকরে? দশটা প্রশ্ন করলে মোটে একটার উত্তর পাওয়া যায়।
‘ মনে মনে আমার মুণ্ডুপাত করলে আমার স্বভাব বদলে যাবেনা।’
রুদ্রর কথা শুনে গালায় খাবার আটকে গেল প্রিয়তার। কাশতে শুরু করল বেচারি। রুদ্র নির্বিকার ছন্দে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিল প্রিয়তার দিকে। যেন ও প্রস্তুত ছিলো ব্যপারটার জন্যে। প্রিয়তা দ্রুত পানি খেয়ে সামলে নিলো নিজেকে। লম্বা করে দুটো শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হল। এই লোকটা কী মাইন্ড রিডও করতে পারে নাকি! আর কত অদ্ভুত গুন আছে এই ছেলের? মুখে বলল, ‘তো কী করব? কাল থেকে এই ফ্লাটে একা একা পড়ে আছি। কথা বলার মতো একটা মানুষও নেই। আজ যাও আপনি এলেন, কথা বলাতো দূরে থাক ঠিক করে তাকাচ্ছেনও না আমার দিকে। এভাবে থাকা যায়?’
রুদ্র বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনলো মেয়েটার অভিমান মেশানো অভিযোগগুলো। হালকা হেসে বলল, ‘আর কয়েকটা দিন। এরপরতো আবার দিয়ে আসব তোমাকে। তখন সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
বলে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল রুদ্র। যেন কত সহজ স্বাভাবিক একটা কথা বলল। কিন্তু কথাটা যে রুদ্রর জন্যে মোটেও সহজ আর স্বাভাবিক ছিলোনা, সেটা শুধুমাত্র রুদ্রই জানে। প্রিয়তা গভীর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। আনমনেই বলল, ‘একটু বেশিই অদ্ভুত আপনি।’
‘তিনদিনেই চিনে ফেললে?’ কৌতুকের স্বরে প্রশ্ন করল রুদ্র।
প্রিয়তা মুচকি হাসল। রুদ্রর মুখের থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলল, ‘ কাউকে চেনার জন্যে অনন্ত সময়ের প্রয়োজন পড়েনা। কখনও কখনও তিনদিনেও কাউকে চিনে নেওয়া যায়, আবার ত্রিশ বছরের পরিচয়েও অনেক মানুষ অচেনাই থেকে যায়।’
রুদ্র খাওয়া থামিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘ ফিলোসফির স্টুডেন্ট না-কি?’
প্রিয়তা হেসে ফেলল। বলল, ‘ইকোনমিকস্। অনার্স শেষ করলাম। মাস্টার্স করার ইচ্ছে আছে কিন্তু আগে একটা চাকরি পাওয়া বেশি জরুরি।’
রুদ্র কিছু বলল না। ও বুঝতে পারছে মেয়েটা ওর সাথে সহজ হয়ে উঠছে। কিন্তু এরকম না হওয়াটাই বোধ হয় ভালো ছিল। ছাড়তে এবং ছেড়ে যেতে দুজনেরই সুবিধে হতো। রুদ্রর ভাবনার মাঝেই প্রিয়তা বলল, ‘আপনার পড়াশোনা কতদূর? আদোও করেছেন, নাকি ছোটবেলা থেকেই ওসব পি’স্ত’ল_’
রুদ্রর চাহনী দেখে থেমে গেল প্রিয়তা। কারণ রুদ্র ‘খেয়ে ফেলবো’ টাইপ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা অনেক কষ্টে কিছুটা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘আমিও একটা পাগল। সবকিছু কী একসঙ্গে হয় বলুন? এইযে এতো ভালো ব’ন্দু’ক চালান। কী দারুণ টার্গেট! তারপর ঠাস্ ঠাস্ করে মশার মতো মানুষ মারেন। এগুলো শেখা কী চারটে খানি কথা? এতোসব গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে ওসব ছোটখাটো পড়াশোনা করার সময় কই? ঠিকই আছে।’
কথাগুলো বলে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে দেখল রুদ্রর চাহনীর কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রিয়তা মিনমিনে গলায় বলল, ‘বললাম তো ঠিক আছে।’
রুদ্র ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। গ্লাসে জুস ঢালতে ঢালতে বলল, ‘এম.বি.এ করেছি আমি।’
প্রিয়তা চোখ বড় বড় তাকাল রুদ্রর দিকে। কথাটা হজম করতে যথেষ্ট কষ্ট করতে হলো বেচারিকে। এম.বি.এ করে কি-না শেষে গুন্ডাগিরি করছে? গুন্ডাগিরি-ই যখন করবি তখন এতো কষ্ট করে এম.বি.এ করার কী দরকার ছিল? প্রশ্নটা মনে এলেও সরাসরি রুদ্রকে জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারল না প্রিয়তা। কিন্তু স্বভাববশত চুপ থাকতেও পারলনা। বলল, ‘আচ্ছা আপনার প্রফেশনটা কী?’
চোখ ছোট ছোট করে তাকাল রুদ্র প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা একটু সোজা হয়ে বসল। গলা ঝেড়ে বলল, ‘না মানে ক্রিমিনালদেরও তো অনেক ধরণ থাকে। যেমন ধরুণ কেউ প্রফেশনাল কিলার হয়, কেউ চাঁদাবাজ হয়, কেউ স্মাগলার হয়, আরও কত কী হয়। আপনার কাজ কী? আপনি ঠিক কী করেন?’
রুদ্র জুসের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে শুনছিল প্রিয়তার কথা। প্রিয়তার কথা শেষ হতেই রুদ্র বলল, ‘ মা’র্ডা’র করি। উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে মেয়েদের নিয়ে আসি। এরপর নিরিবিলি একটা জায়গায় কয়েকদিন রেখে সুযোগ সুবিধা অনুযায়ী খু’ন করে ফেলি।’
রুদ্রর কথাগুলো শুনে প্রিয়তা একটুও ঘাবড়ালো না। হেসে দিয়ে বলল, ‘চোখের সামনে খু’ন, মারামারি দেখে দুদিন একটু ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই। তাই বলে আমি এতোটাও বোকা নই যে যা গেলাবেন তাই গিলবো ‘
রুদ্র বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, ‘মিস্ বুদ্ধিমতি! আমি কী করি সেটা জেনে আপনার বিশেষ কোন লাভ নেই। তবে তুমি যা যা বললে সেসব আমার কাজের কাছে কিছুই না। দ্যা সোলার সিস্টেম গ্রুপের সেকেন্ড ম্যান আমি।’
‘ অ্যাঁ! সৌরজগত?’ বোকার মতো প্রশ্ন করে বসল প্রিয়তা।
রুদ্র এবার সত্যি সত্যি হেসে ফেলল। এই হাসিতে কোন কৃত্রিমতা নেই। রুদ্রকে শব্দ করে হাসতে দেখে অবাক হয়ে গেল প্রিয়তা। কী সুন্দর হাসি! রুদ্র কেন হাসল জানেনা প্রিয়তা। কিন্তু এটুকু জানে যে এই হাসি দেখে ও অনন্ত সময় পাড় করে দিতে পারবে। প্রিয়তার অবাক আর মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে হুশ ফিরলো রুদ্রর। নিজের হাসির কথা ভেবে নিজেই অবাক হয়ে গেল। শেষ কবে এভাবে হেসেছিল জানা নেই ওর। কী হচ্ছে কী ওর সাথে এসব? এই মেয়েটা এসে ওর সবকিছু বদলে দিচ্ছে। ও কোনদিন কোন মেয়ের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় নি, কিন্তু প্রিয়তার দিকে তাকিয়েছে। কোনদিন রাশেদকে মিথ্যে বলেনি, কাল প্রথমবার প্রিয়তার জন্যে রাশেদকে মিথ্যে বলেছে। কোনদিন কাউকে নিয়ে এভাবে ভাবেনি যেভাবে প্রথম প্রিয়তাকে নিয়ে ভাবছে। আর আজ মেয়েটা ওকে মন খুলে হাসিয়েও ছাড়ল, যে হাসি ও বহু বছর হাসেনি। রুদ্রর কঠোর জীবনে প্রিয়তা নিজের কোমলতা ছড়াতে শুরু করে দিয়েছে। রুদ্র ফেঁসে যাচ্ছে। আটকে যাচ্ছে প্রিয়তা নামক প্রেমজালে। মুক্তির কোন পথ খুঁজে পাচ্ছেনা রুদ্র। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এই প্রথম রুদ্রর মস্তিষ্ক কাজ করছেনা। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। রুদ্র আর ওখানে না বসে প্লেট নিয়ে উঠে চলে গেল সিঙ্কের কাছে। মনে হলো যেনো পালিয়ে গেল কোন কিছু থেকে।
প্রিয়তা মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করল পুরো ব্যাপারটা। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছেলেটা। যেমন দুর্বোধ্য তেমনই আকর্ষণীয়। যেন সবকিছুর সংমিশ্রণে তৈরী করা হয়েছে একে। তবে এটাও সত্যি যে লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে। যেটা সেই প্রথম দিন থেকেই প্রিয়তাকে টানছে। প্রিয়তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে এই সুদর্শন যুবকের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে ও। এটা কী কেবল বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ নাকি অন্যকিছু সেটা এখনো বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতে পারছে যে এই অনুভূতি এবার ভয়ংকর রূপ নিতে চলেছে।
*
সাড়ে এগারোটা বাজে ক্লাস শেষ হল কুহুর। দুটোর দিকে আরও একটা ক্লাস এটেন করতে হবে। কুহু আর ওর বান্ধবী রীতি ক্লাস ক্যান্টিন থেকে খাবার কিনে সোজা লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে হাঁটা দিল। ওখানে বসে পড়তে পড়তে খেয়ে নেবে। থার্ড ফ্লোরের করিডরে পৌঁছতেই রীতির বয়ফ্রেন্ড ফোন করল। বলল সে নিচে আছে, দু মিনিট দেখা করে যেতে। রীতি ফোনটা রেখে কুহুকে বলল, ‘শোননা কুহু, ও না একটা নিচে যেতে বলছে। কী কথা আছে না-কি। তুই লাইব্রেরীতে গিয়ে বস, আমি দু মিনিটের মধ্যে আসছি।’
কুহু ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতে দিতেই রীতি প্রায় দৌড়ে চলে গেল লিফটের দিকে। কুহু একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে লাইব্রেরীর দিকে পা বাড়াল। লাইব্রেরীতে গিয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ল। খাবারের প্যাকেটটা সাইডে রেখে দিল। রীতি এলে একসঙ্গে খাবে। সময় কাটাতে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে বইয়ের পাতায় ডুবে গেল কুহু। কিছুক্ষণ পর ও খেয়াল করল ওর পাশে কেউ একজন চেয়ার টেনে বসেছে। কুহু ভাবল রীতি এসেছে। অলস ভঙ্গিতে পাশে তাকিয়ে চমকে উঠল ও। কারণ সেখানে নিরব বসে আছে। গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে। কুহু উঠে যেতে নিলেই নিরব শক্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘খবরদার আজ পালাবেনা। চুপচাপ বসো।’
নিরবের কন্ঠে কিছু একটা ছিল আজ। প্রতিটা শব্দে অদ্ভুত জাদুকরি আদেশ ছিল। আজ কুহু সেই শব্দগুলোকে অবজ্ঞা করতে পারল না। মাথা নিচু করে পুনরায় বসে পরল নিজের চেয়ারে। নিরব আবার গালে হাত দিয়ে তাকাল কুহুর দিকে। শিশুসুলভ নিষ্পাপ মুখটা দিকে তাকিয়ে রইল কিছু মুহূর্ত। রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে দেখলেই এভাবে পালানোর কী আছে? খেয়ে নেব তোমাকে?’
কুহু চোখ তুলে তাকাল নিরবের দিকে। লাইব্রেরীতে জোরে শব্দ করা যাবেনা। তাই নিরব খানিকটা এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, ‘কতদিন যাবত তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি। আর তুমি? দাঁড়াও-ই না। অনেক পরিশ্রম করে তোমার নাম্বার জোগাড় করে মেসেজ করলাম। রিপ্লেটাও করলে না। কী সমস্যা? এতো ভয় পাও কেন?’
কুহু জবাব দিলোনা। মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। ছেলেটা এমনভাবে কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি। অথচ সেদিন কীভাবে হেনস্তা করেছিল কুহুকে। সেদিন নিরব চলে যাওয়ায় কুহু ভেবেছিল সবটা মিটে গেছে। এ বিষয় নিয়ে ছেলেটা হয়তো আর কোন ঝামেলা করবেনা। বোধ হয় সে বুঝতে পেরেছে কুহু ইচ্ছে করে মডেলটা নষ্ট করেনি। কিন্তু তারপরের দিন এরকম কিছু হবে কুহু ভাবেনি। ওকে ছাদে ডেকে নিয়ে ভয়ানক র্যাগ দিয়েছিল সেদিন নিরব ও তার বন্ধুরা। তখনই কুহু জানতে পারে নিরব মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। ঐ মুহূর্তে বেচারি এতোটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে যা বলেছে তাই করেছে। শেষে কেঁদেই ফেলল মেয়েটা। আর তখনই বাকিরা বুঝতে পারল যে কুহু কথা বলতে পারেনা। ব্যপারটা বুঝতে পেরেই নিরব চমকে উঠল। কুহু কেন ‘সরি’ বলেনি আর কেন কোন জবাব দেয়নি জলের মতো পরিস্কার হয়ে উঠল ওর সামনে। সাথে সাথেই সবাইকে থেমে যেতে বলল। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। কুহু কাঁদতে কাঁদতে চলে গেছে সেখান থেকে। নিরবের মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। কিছু না জেনেই মেয়েটাকে এভাবে কাঁদানো একদমই ঠিক হয়নি। তারচেয়েও বড় কথা হলো সেদিন কান্নামিশ্রিত নিষ্পাপ ঐ মুখটা হয়তো ভয়ানকভাবে ঘায়েল করেছিল নিরবকে।এরপর নিরব অনেকবার কুহুর কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছিল। কিন্তু কুহু শুনতেই চায়নি। কেন শুনবে? শুধুশুধু তো আর সরি বলছেনা। কুহু কথা বলতে পারেনা বলে লোকটা সিমপ্যাথি দেখাচ্ছে। ও সেই সিমপ্যাথি নেবে কেন?
নিরব চেয়ার টেনে কুহুর দিকে আরও খানিকটা এগিয়ে আগের মতোই নিচু আওয়াজে বলল, ‘ কুহু, আ’ম সো সরি। আসলে ঐ প্রজেক্টটা আমার জন্যে খুব ইম্পর্টেন্ট ছিল। সারারাত জেগে তৈরী করেছিলাম জানো? ঐ ইন্সিডেন্স এর আধঘন্টা পরে জমা দেওয়ার ছিল। সেটাও আর হয়নি। আমার কয়েকদিনের পরিশ্রম টোটাল জলে চলে গেছিল। আর সবটার জন্যে দায়ি মনে হল তোমাকে। তারওপর এরকম একটা কাজ করেও একবার ‘সরি’ বলারও প্রয়োজন বোধ না করায় তোমার ওপর খুব রাগ হলো। আস্ত একটা বেয়াদব মনে হল তোমাকে। তাই_’
একটু থামল নিরব। আবার বলল, ‘ কিন্তু তবুও আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। তুমি কথা বলতে পারোনা বলে বলছিনা। কারো সাথেই এরকম ব্যবহার করা উচিত না। আমি সত্যিই খুব দুঃখিত।’
কুহু এবার ফিরে তাকাল নিরবের দিকে। নিরবের চোখে-মুখে অনুতাপবোধ স্পষ্ট। কুহুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিরব বুঝলো না কুহু কী ভাবছে। তাই অসহায় মুখ করে বলল, ‘ক্ষমা করোনি? সরি বলেছিতো। আসলেই আ’ম আ বর্ন ডাফার। কিছু না বুঝেই উল্টাপাল্টা কাজ করে ফেলি। আমাকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারা উচিত। মারবে?’
কুহু বোকা বনে গেল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নিরবের দিকে। এবারেও কুহুর কোন প্রতিক্রিয়া না পেয়ে নিরব বলল, ‘ মারবেনা? আচ্ছা, তাহলে? লাথি মারবে? না প্লিজ! প্রেসটিজ ইস্যু হয়ে যাবে। আচ্ছা কান ধরি? তাহলে হবে নিশ্চয়ই? এইযে কান ধরছি।’
কথাটা বলে সত্যি সত্যি নিজের দুই হাত ক্রস করে দুই কান ধরল নিরব। কোন ফাঁদে ফেঁসে যাওয়া অসহায় বাচ্চার মতো দেখাচ্ছে ওকে। কুহু হেসে ফেলল নিরবের কান্ডে। কুহুকে হাসতে দেখে নিরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাত নামাল। আশাবাদী কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘করেছো ক্ষমা? রাগ নেইতো আমার ওপরে আর?’
কুহু হাসি থামালো। মাথা নেড়ে বোঝালো আর রেগে নেই ও। সত্যিই রেগে নেই। বরং এই ছেলের অদ্ভুত এবং হাস্যকর কথাবার্তা শুনে মন ভালো হয়ে গেছে ওর। ফুরফুরে লাগছে।নিরব যেন আকাশের চাঁদ পেল। অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখটা মুহূর্তেই পূর্ণিমার চাঁদের মতো হাস্যজ্বল হয়ে উঠল। কী অদ্ভুত কথাবার্তাই না বলল মেয়েটার মন ভালো করার জন্যে। এগুলো এর আগে কখনও করেনি ও। নিরব নিজের হাত ঘরির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। আমি আজ আসি। আবার কথা হবে কিন্তু। হোয়াটস্অ্যাপে অ্যাড করে রেখেছি তোমাকে। মেসেজ করলে রিপ্লে করবে।’
কথাট বলে উঠে যেতে নিয়েও থেমে গেল নিরব। আবার কুহুর দিকে বেশ অনেকটা ঝুঁকে বলল, ‘ রিপ্লে না করলে কিন্তু ভালো হবেনা। আগেরবার ভুল করেছি তাই সরি বলেছি। এখন এগেইন আমি তোমার সিনিয়র, তুমি আমার জুনিয়র। বেয়াদবি সহ্য করব না কিন্তু।’
বলে কুহুর কাঁধে হাত রেখে উঠে চলে গেল নিরব। কুহু বোকার মতো তাকিয়ে রইল সেদিকে। এমন অদ্ভুত ছেলে এর আগে কোনদিন দেখেনি ও।
*
গোধূলি লগ্ন। সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ আগেই। রক্তিম আভায় নিজেকে চমৎকার ভাবে সাজিয়ে নিয়েছে সীমাহীন আকাশ। আমের ভিলার ছাদে বসে আছে উচ্ছ্বাস, কুহু আর জ্যোতি। ছাঁদের মাঝে একটা পাটি বিছিয়ে গোল হয়ে বসেছে তিনজন। অবসরের আড্ডা যাকে বলে। প্রচন্ড ঠান্ডা পড়েছে আজ। তিনজনই ভারি গরম কাপড় পড়েছে। চা আর গরম গরম সিঙ্গারার জন্যে অপেক্ষা করছে তিনজন। ওদের গল্পের মাঝেই চা আর সিঙ্গারা নিয়ে হাজির হল নার্গিস বেগম। বাড়ির নতুন কাজের লোক। দুদিন হল কাজে আসছে। বয়স পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ এর মতো হবে। খাবারগুলো ওদের সামনে রাখল। উচ্ছ্বাসের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে মুখটা বিকৃত করে বলল, ‘এইযো ছোট সাহেবের চ্যালা! ছোট সাহেব আসছে। তোমারে খুঁজবো মনে হয়। দেখো যাইয়া কী লাগব।’
জ্যোতি কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই উচ্ছ্বাস মুচকি হেসে বলল, ‘আমি রুদ্রর চ্যালা নই চাচি। ওর ভাই। ওর প্রয়োজন হলে ও নিজেই আসে আমার কাছে, নয়তো ডেকে নেয়। তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা।’
বিকৃত মুখটা আরও বিকৃত হয়ে উঠলো উচ্ছ্বাসের জবাবে। নার্গিস একরাশ তিক্ততা নিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, ‘ জানি, জানি। কত দেখলুম। মুখে মধু, অন্তরে বিষ। ভাই! হুহ! এক প্রাসাদে থাকলেই কী বাদশা আর গোলাম এক হয়?’
কথাটা বিড়বিড়ানোর মতো করে বলে গেলেও এমনভাবে বলল যেন উচ্ছ্বাসের কানে পৌঁছায়। উচ্ছ্বাস সেদিকে পাত্তা দিলোনা। জ্যোতি আর কুহু একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। উচ্ছ্বাস প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘চল শুরু কর, সিঙ্গারা ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
এরমধ্যেই রুদ্র এলো ছাদে। রুদ্রকে দেখে উচ্ছ্বাস বলল, ‘ কী ব্যপার গুরু? আজ সন্ধ্যাবেলাতেই বাড়িতে যে?’
রুদ্র জবাব দিলোনা। এগিয়ে এসে রেলিং হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ সন্ধ্যাবেলা সবগুলো ছাদে কী করিস?’
জ্যোতি বলল, ‘কিছুই না। চা-সিঙ্গারার আড্ডা হচ্ছে। তুমিও বসে পড়ো।’
‘আমি এখন এসব খাবোনা।’
কথাটা বলে রুদ্র সিগারেট বের করতে নিলেই কুহু উঠে এসে বাঁধা দিল। ইশারায় অনুরোধ করে বলল, ‘প্লিজ ভাইয়া, আজকে বসো না। কতদিন হল আমাদের সাথে বসোনা। তোমাকে কথা বলতে হবেনা। শুধু পাশে বসে থাকো। প্লিজ!’
ওদের ধারণা ছিল রুদ্র বসবেনা। কোন একটা বাহানা দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে রুদ্র রাজি হয়ে গেল। মৃদু হেসে হাত বুলালো কুহুর মাথায়। কুহু খুশি হয়ে হাত ধরে এনে নিজের পাশে এনে বসালো ভাইকে। ঠান্ডার মধ্যে গরম সিঙ্গারা আর চায়ের আড্ডাটা বেশ জমে উঠল এবার। জমজমাট এই আড্ডায় হঠাৎ রুদ্রর মন বলে উঠল যদি প্রিয়তাও থাকতো এখানে? তৎক্ষণাৎ মাথা ঝাকিয়ে সে চিন্তা দূর করে দিল মাথা থেকে। কীসব অদ্ভুত ভাবনা ভাবছে ও! কথার মাঝে কুহু হাতের ইশারায় উচ্ছ্বাসকে বলল, ‘ভাইয়া? তোমাকে না-কি নাজিফা আপু নাম্বার দিয়েছে?’
উচ্ছ্বাস হতাশ হয়ে তাকাল কুহুর দিকে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘উফ! আবার তোর ঐ ডান্সিং ল্যাঙ্গুয়েজ! জ্যোতি কী বলছেরে ও?’
জ্যোতি হেসে দিয়ে বলল, ‘নাজিফা তোমাকে নাম্বার দিয়েছে, সেটার কথাই জিজ্ঞেস করছে। প্রেম প্রেম হাওয়া বইতে শুরু করেছে না-কি?’
বলে ভ্রু নাচাল জ্যোতি। কুহুও মুখ চেপে হেসে ফেলল। উচ্ছ্বাস বাচ্চাদের মতো গাল ফুলিয়ে বলল, ‘পাগল আমি ঐ মেয়ের সাথে প্রেম করব? ঝাঁসির রাণী একটা। দু দিনের মধ্যে ওপারে পাঠিয়ে দেবে আমাকে। এগুলো মজা করে বলি। ওর সাথে ওসব প্রেম-টেম আমার দ্বারা হবেনা।’
উচ্ছ্বাসের কথা শুনে কুহুর সে কী হাসি। হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে মেয়েটা। সেটা দেখে জ্যোতি খোঁচা মেরে বলল, ‘ সব জায়গাতেই প্রেম প্রেম হাওয়া বইছে বুঝলে? অনেকের ফোনে আবার মাঝরাতে মেসেজ টোন বেজে ওঠে।’
কুহু চমকে উঠল। কান লাল হয়ে উঠল ওর। মাথা নেড়ে বোঝাতে চাইল এমন কিছু না। উচ্ছ্বাস আর জ্যোতি সশব্দে হেসে ফেলল সেটা দেখে। রুদ্র তাকিয়ে দেখছে ওদের। বেশ ভালোই লাগছে এই দুষ্টুমিষ্টি আলাপ। এরমধ্যেই রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে জ্যোতি বলল, ‘এইযে সাইলেন্ট ম্যান! আপনার নিষ্ঠুর মনে এই জন্মে প্রেমের হাওয়া লাগবে?’
রুদ্র ভ্রু কোঁচকালো। কোন জবাব না দিয়ে আরেক কাপ চা ঢালল নিজের জন্যে। উচ্ছ্বাস টিটকারি মেরে বলল, ‘আমার তো মনে হয় পড়ে গেছে। দেখছিস না কত পরিবর্তন। সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি চলে এলো। আমাদের সাথে আড্ডায় বসল। শুনেছি প্রেমে পড়লেই মানুষ এভাবে বদলে যায়।’
জ্যোতি তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিল। সত্যিই যদি রুদ্র অন্য কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে থাকে? অন্যকাউকে ভালোবাসে? মানতে পারবে ও? যে সৌভাগ্যের কামনা ও ছোটবেলা থেকে করে আসছে, অন্যকাউকে সেই সৌভাগ্যের অধিকারিনী হতে দেখলে সহ্য হবে ওর? মানতে পারবে যে এই কঠিন সত্য, যে রুদ্র নামক এই নিষ্ঠুর পুরুষের ওপর ওর কোন অধিকার নেই। সে অন্যকারো জন্যে তৈরী, অন্যকারো অস্তিত্ব, অন্যকারো ভালোবাসা। কী করবে তখন ও? হিংসে করবে? পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম অভিশাপ দেবে ঐ মেয়েকে? নাকি শুভকামনা জানাবে। ওদের দুজনের সুখী জীবনের কামনা করবে। কী করা উচিত হবে ওর?
#চলবে…