#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
২৭.
রাত বারোটা ছত্রিশ বাজে। কুহু নিজের টেবিলে বসে পড়ছে। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। জ্যোতি সোজা হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। ডান হাতটা কপালের ওপর রাখা। বিকেলে বলা উচ্ছ্বাসের কথাটা নিছকই মজা হিসেবে নিতে পারেনি ও। রুদ্রর আচরণে পরিবর্তন স্পষ্ট। হঠাৎই এক প্রচ্ছন্ন বদল দেখা দিয়েছে তার মধ্যে। সত্যিই কী রুদ্র প্রেমে পড়ল? অন্যকোন মেয়ের? কিন্তু এও সম্ভব? এতো বছর সবরকমভাবে চেষ্টা করেও যার মনে একবিন্দু জায়গা করতে পারেনি। তার মনে অন্যকোন রমনী এতো সহজেই জায়গা করে নিতে পারল? এতোই সহজ! আচ্ছা, এই বদলের কারণতো অন্যকিছুও হতে পারে। হয়তো কাজের ক্ষেত্রেই কোন সমস্যায় আছে। ও একটু বেশিই ভাবছে হয়তো। মাথা থেকে চিন্তাগুলো ঝেড়ে ফেলল, কুহুকে বেশি রাত জাগতে নিষেধ করে ঘুমিয়ে পড়ল জ্যোতি। উল্টোপাল্টা চিন্তা করে মাথা ব্যথা করতে চায়না এখন আর।
রাত তখন একটা বাজে। টেবিলে রাখা ফোনটায় হোয়াটস্ অ্যাপের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। কুহু হাতের কাজটা শেষ করে ফোনটা হাতে নিল। ভ্রু কুঁচকে ফোনের তাকিয়ে দেখল, অচেনা একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ইংরেজি বর্ণ দিয়ে লিখেছে, ‘হাই কুহু। কেমন আছো?’
কুহু চিনতে না পেরে ভাবল রিপ্লে দেবে কি-না। হঠাৎ ওর নিরবের কথা মনে পড়ল। নিরব নয়তো? বলেছিল তো মেসেজ করবে। সেদিন ফোনে যে মেসেজটা এসেছিল তার সাথে মিলিয়ে দেখল একই নাম্বার। বুঝতে আর বাকি রইল না মেসেজটা নিরবই করেছে। কুহু জবাবে লিখল, ‘ কে?’
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিপ্লে চলে এলো, ‘চিনতে পারলে না? আমি নিরব। নাম্বারটা সেভ করে রাখোনি কেন?’
‘ সেভ করব কেন?’
‘ কারণ এখন থেকে আমরা নিয়মিত কথা বলব। নাম্বার মুখস্হ করে রাখার চেয়ে সেভ করে রাখা বেশি সুবিধার। তাইনা?’
‘ নিয়মিত কথা কেনো বলব?’
‘ আমরা বন্ধু তাই।’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব এলো নিরবের।
নিরবের জবাবে অবাক হয়ে গেল কুহু। লিখল, ‘বন্ধু?’
‘ হ্যাঁ।’
‘ সেটা কবে হলাম?’
‘ এখন থেকে।’
‘ জবরদস্তি না-কি?’
‘ তাই মনে হচ্ছে বুঝি?’
কুহু হেসে ফেলল। রিপ্লে করল, ‘ আপনি এমন কেন?’
‘ কেমন?’
কুহু প্রায় আধ মিনিট ভাবার চেষ্টা করল কেমন। কিন্তু নিরব কেমন তা প্রকাশ করার মতো কোন শব্দ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হল। লিখল, ‘কেমন যেন।’
নিরব তিনটি লাফিং ইমুজি পাঠাল। এরপর প্রসঙ্গ বদলে লিখল, ‘ কী করছিলে?’
‘ পড়ছিলাম। আপনি?’
‘ তোমার কথা ভাবছিলাম।’
কুহু আবার হাসল। ইমুজিও পাঠিয়ে দিল অট্টোহাসির। নিরব উত্তরে লিখল, ‘ বিশ্বাস হচ্ছেনা? আ’ম সিরিয়াস কুহু।’
কুহু নিঃশব্দে হাসতে হাসতে লিখল, ‘ সিরিয়াস নন। পাগল আপনি।’
‘এবার সত্যি সত্যি হয়ে যাব বোধ হয়।’ প্রায় দু মিনিট পর জবাব এলো নিরবের।
কুহু ঠোঁট থেকে হাসি সরল না। লিখল, ‘ ঘুম পাচ্ছে আমার। কাল সকাল সকাল ক্লাস আছে। গুড নাইট।’
নিরবের উত্তরের অপেক্ষা করল না কুহু। ফোনটা রেখে দিল সাইডে। জ্যোতির দিকে তাকিয়ে দেখল ঘুমিয়ে পড়েছে। বইখাতা সব বন্ধ করে কুহুও চুপচাপ ঢুকে পড়ল ব্ল্যাঙ্কেটের নিচে। শুয়ে শুয়ে নিরবের মেসেজগুলোর কথা ভেবে হেসে উঠল আনমনেই।
*
এক সপ্তাহ কেটে গেল নিমেষেই। শীতের প্রকোপ হঠাৎ বেশ বেড়ে গেল। বিদায় নেওয়ার আগে মাঘ যেন তার শীতলতম রূপ দেখিয়ে যেতে চায়। নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। আপনমনে সিগারেট টানতে টানতে নিজেকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করছে হয়তো। বদলে যাচ্ছে জীবনের সমীকরণ। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে মনেরও পরিবর্তন ঘটছে। সেই বদল উপলব্ধি করতে পারছে রুদ্র নিজেও। অনাকাঙ্ক্ষিত এই বদল কিছুতেই মেনে নিতে চাইছেনা রুদ্রর মস্তিষ্ক। কিন্তু মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে মস্তিষ্ককে যথেষ্ট দুর্বল বলে মনে হচ্ছে আজ ওর।
রুদ্র ভেবেছিল যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলবে প্রিয়তাকে। নিজের ভেতরে জন্মানো অনুভূতিকে আর বাড়তে দেবেনা। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে কোথায়? প্রথম পাঁচদিন গুনে গুনে পাঁচবার গিয়েছিল প্রিয়তার কাছে। প্রতিদিনই সন্ধ্যায় একবার গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসতো প্রিয়তার। সারাদিনে আর যেতোনা। কিন্তু রাতে নিজের অবাধ্য মনকে মানাতে পারতো না। ফোন করে বসতো প্রিয়তাকে। কিন্তু সেখানেও বেশিক্ষণ কথা বলতো না। এমন একটা ভাব করতো যেন দায়ে পড়ে খোঁজ নিতে হচ্ছে ওকে। দেখা করতে গিয়েও সেভাবে এটেনশন দিতোনা প্রিয়তাকে। রুদ্রর এরকম গা ছাড়া আচরণে প্রিয়তার সুন্দর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যেতো। দুটো অতি প্রয়োজনীয় কথা সেরে নিয়েই যখন রুদ্র যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতো তখন অসহায় মুখ করে তাকিয়ে থাকতো মেয়েটা। হয়তো আরেকটু সময় চাইতো রুদ্রর কাছে, আরেকটু কথা বলতে চাইতো। সেসব রুদ্রর চোখ এড়াতো না। তবুও দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে চলতো সে। প্রিয়তার কথা জানে না রুদ্র। কিন্তু এই সামান্য কাজটুকু রুদ্রর কাছে কতটা কঠিন মনে হতো সেটা কেবল রুদ্রই জানে। গতপরশু রাতে এমনই এক সময় ঘুমানোর প্রস্ততি নিচ্ছিল রুদ্র। প্রিয়তাকে ফোন করবে কী করবেনা নামক দ্বিধায় ভুগছিল শুয়ে শুয়ে। কিন্তু ওর দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে প্রিয়তাই ফোন করল ওকে। একটু বিচলিত হল রুদ্র। খুব বেশি প্রয়োজন না পড়লে প্রিয়তা কখনও নিজে থেকে ফোন করেনা ওকে। সময় নষ্ট না করে দ্রুত ফোন রিসিভ করল ওর রুদ্র। প্রথম কথা ভেসে এলো ওপাশ থেকেই,
‘ হ্যালো?’
প্রিয়তার কন্ঠে স্পষ্ট মন খারাপের আভাস পেল রুদ্র। আপ্রাণ চেষ্টা করল ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়ার। হোক এই মেয়ের মন খারাপ। তাতে ওর কী? ওর কিছু এসে যায়না তাতে। কন্ঠস্বর যথেষ্ট গম্ভীর করে বলল, ‘কিছু লাগবে?’
‘ না।’
‘ তাহলে? কিছু বলবে?’
কোন উত্তর এলোনা ওপাশ থেকে। প্রায় এক মিনিটের নিরবতার পর একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। প্রিয়তা বিষণ্ন গলায় বলল, ‘আমার এখানে ভালো লাগছেনা। সারাদিন এখানে একা পড়ে থাকি। দ্বিতীয় একটা জন্তু অবধি নেই। মীরার সাথেও আপাতত ফোনে কথা বলা নিষেধ। কী করব আমি? নিজের নিঃশ্বাসটাও বিভৎস মনে হচ্ছে। ভালো লাগছেনা আমার। এভাবে থাকলে দম আটকে মরে যাব আমি।’
কথাটা বলতে বলতে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলেছে প্রিয়তা। রুদ্র চুপ করে রইল। প্র্যাকটিক্যালি ভেবে দেখল ব্যপারটা। সত্যিই তো, একটা মেয়ে সারাদিন একা পড়ে আছে ছোট্ট একটা বদ্ধ ফ্ল্যাটে। টানা সাতটা দিন এভাবে থাকলে যে কারো দম আটকে আসবে। নিজের কথা ভাবতে গিয়ে প্রিয়তার অবস্থাটা ঠিকভাবে ভেবেই দেখেনি ও। এতো দায়িত্বজ্ঞানহীনতা রুদ্র আমেরকে শোভা দেয়না। প্রিয়তার অসহায়ত্ত্বের কথা অনুমান করেই সব গুলিয়ে গেল রুদ্রর। প্রিয়তার কান্নার আভাস পেয়ে অস্হির হয়ে উঠল মন। এতো মানুষের গগন বিদারী মরণ চিৎকার, আর্তনাদ কোনদিন যে রুদ্র আমেরের মন গলাতে পারেনি, একটা মেয়ের সামান্য কান্না সেই রুদ্র আমেরকে এতোটা বিচলিত করতে পারে ভেবে নিজেই নিজের ওপর অবাক হল রুদ্র। আগে পরে কিছু না ভেবে বলল, ‘ কান্না থামাও। কাল সারাদিন আমি থাকছি তোমার সঙ্গে।’
‘ সত্যিই?’
হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল প্রিয়তার বিষণ্ন গলা। কন্ঠস্বরে ঝড়ে পড়া একঝাঁক আনন্দ লুকিয়ে রাখা গেলোনা। রুদ্র কল্পনা করল প্রিয়তার হাস্যজ্বল মুখ, সেই মিষ্টি হাসি।
পরেরদিন সকালবেলা যথাসময়ে বনানীর ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হল রুদ্র। রুদ্রকে দেখেই অমায়িক এক হাসি ফুটে উঠেছিল প্রিয়তার মুখে। রুদ্র মনোযোগ দিয়ে দেখেছিল সেই হাসি। গত পাঁচদিনের সব বিরক্তি, অস্বস্তি, টানাপোড়নের যন্ত্রণা যেন দূর অর্ধেক দূর হয়ে গেল প্রিয়তাকে দেখেই। প্রিয়তার মুখটা দেখার মতো ছিল। কঠোর মরুভূমির পথে তৃষ্ণার্ত কোন পথিক হঠাৎ একটু পানি পেলে যতটা খুশি হয়। ঠিক ততটাই খুশি হয়েছিল প্রিয়তা।
সকালের নাস্তা প্রিয়তা নিজের হাতে বানিয়েছে। এখন আর বাইরে থেকে খাবার আসেনা। শুধু বাজার আসে। রান্নাটা প্রিয়তা নিজেই করে। প্রস্তাবটা প্রিয়তাই রেখেছিল রুদ্রর কাছে, সময় কাটানোর ছোট্ট এক মাধ্যম হিসেবে। নাস্তা করে চা খেতে খেতে দুজনে সিনেমা দেখতে বসল। বায়নাটা প্রিয়তারই ছিল। রুদ্র বারণ করেনি। মেয়েটাকে হাসতে দেখতে দারুণ লাগছে ওর। ও চায়না হাসিটুকু মিলিয়ে যাক। রুদ্রর মতো কঠোর হৃদয়ের মানুষটাও মনে মনে বলে উঠল, আজকের দিনটা তোমার নামে লিখে দিলাম প্রেয়সী। কমেডি ফিল্ম হওয়াতে কিছুক্ষণ বাদেবাদেই অট্টোহাসিতে ফেটে পড়ছিল প্রিয়তা, রুদ্রকে ব্যখ্যা করছিল ঘটনাগুলো। কিন্তু সেদিকে কোন মনোযোগ ছিলোনা রুদ্রর। প্রিয়তাতেই আটকে ছিল ওর মন-মস্তিষ্ক। দুপুরের খাবারটা প্রিয়তাকে রান্না করতে দেয়নি রুদ্র। বাইরে থেকে অর্ডার করে আনিয়ে নিয়েছে। বিকেলের দিকে আরেকটা সিনেমা দেখতে বসল প্রিয়তা। টাইটানিক। তখন তেমন কথা হচ্ছিলো না ওদের মধ্যে। রুদ্র নিজের ফোনে ব্যস্ত ছিল আর প্রিয়তা টিভিতে। রোজ-জ্যাকের ঘনিষ্ঠ চুম্বনের এক মুহূর্ত আসতেই চোখ বড়বড় হয়ে গেল প্রিয়তার। ঝট করে রুদ্রর দিকে একপলক তাকিয়ে দ্রুত রিমোট চাপল চ্যানেল ঘোরানোর জন্যে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার রিমোটও চরম বেইমানি করে বসল প্রিয়তার সাথে। সাময়িকভাবে অকেজো করে দিল নিজেকে। বারবার রুদ্রর দিকে তাকিয়ে চ্যানেল বদলানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে গেল মেয়েটা। কিন্তু নিষ্ঠুর রিমোট কিছুতেই সাহায্য করল না প্রিয়তাকে। প্রিয়তার অস্হিরতা টের পেয়ে ভ্রু কুঁচকে ফোন থেকে চোখ তুলল রুদ্র। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে ওকে অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকতে দেখে টিভির দিকে তাকাল। দু সেকেন্ডের জন্যে চমকে গেল রুদ্র নিজেও। কিন্তু সামলে নিল সঙ্গেসঙ্গেই। লজ্জায় কুঁকড়ে বসে থাকা প্রিয়তার দিকে চাইল। কান, গাল, লাল হয়ে উঠেছে মেয়েটার। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কপালে চুলগুলো সরিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল একবার। মেয়েটা যে অস্বস্তির চরম সীমায় আছে সেটা না বোঝার কারণ নেই। চোখ সরিয়ে আবার টিভির স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে টানা দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎই অদ্ভুত এক ইচ্ছে খেলে গেল রুদ্রর মস্তিষ্কে। সবটা গুলিয়ে গেল। সম্মোহিত ব্যক্তির মতো খানিকটা এগিয়ে গেল প্রিয়তার দিকে। রুদ্রকে এগোতে দেখে চোখ তুলে তাকাল প্রিয়তা। চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুদ্রর দিকে। রুদ্র আরেকটু ঝুঁকতেই উত্তপ্ত নিঃশ্বাস এসে পড়ল প্রিয়তার চোখে-মুখে। চোখ বন্ধ করে নিল প্রিয়তা। মনে মনে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিল। আরও কাছে এগিয়ে আসছে রুদ্র। টের পাচ্ছে প্রিয়তা। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি একত্রিত করে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে হাত ওঠাতেই প্রিয়তা অনুভব করল রুদ্র সরে গেছে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল সোজা হয়ে বসে রিমোট হাতে চ্যানেল ঘোরাচ্ছে রুদ্র। প্রিয়তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রিমোট নিতে এগোচ্ছিল তাহলে। আর এদিকে রুদ্র নিজের চোখ-মুখ একদম নির্বিকার আর স্বাভাবিক রাখলেও ভেতরে ভেতরে নিজেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাগ্যিস শেষ মুহূর্তে হুশ এসেছিল। না হলে সেদিন এক অঘটন ঘটিয়ে বসতো।
সারাটা বেলা বেশ ভালোই কাটল। সন্ধ্যায় বারান্দায় বসল দুজন কফি নিয়ে। রুদ্র একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেট ধরানোটা মোটেও পছন্দ হলোনা প্রিয়তার। এতোদিন সাহসে না কুলালেও সেদিন সাহস করে বলেই ফেলল, ‘এটা খেয়ে কী শান্তি পান? খালি কতখানি ধোঁয়া, তাও কী বাজে গন্ধ!’
রুদ্র ঠোঁটের মাঝ থেকে সিগারেটটা নামিয়ে প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ট্রায় করে দেখো?’
প্রিয়তার মুখ বিকৃত হয়ে উঠল। নাক কুঁচকে বলল, ‘ছিহ্। আপনিই খান এসব জঘন্য জিনিস।’
রুদ্র মৃদু হেসে আবার সিগারেট টানায় মনোযোগ দিল। ফাঁকে ফাঁকে চুমুক দিচ্ছে গরম কফির মগে। প্রিয়তাও মুখ কালো করে কফির মগে ফুঁ দিতে লাগল। চারপাশের অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। বাইরের বিল্ডিং, দোকানপাট আর রাস্তার যানবাহনের হেডলাইটের আলোয় অদ্ভুত সুন্দরভাবে সেজে উঠেছে শহরটা। ঠান্ডা বাড়ছে আস্তে আস্তে। কিছুক্ষণ পর প্রিয়তা রুদ্রকে বলল, ‘এক সপ্তাহ হল বাহিরে বের হয়ে দেখিনি। একটু ঘুরতে নিয়ে যাবেন?’
রুদ্র জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। প্রায় দু মিনিটের গভীর ভাবনার পর বলল, ‘দিনের বেলা যাওয়া যাবেনা। আমি চাইনা এখনই তোমার ব্যপারে আমার দলের কেউ কিছু জানুক। সন্ধ্যার পরে গুলশান লেক পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবো একদিন। রাতের বেলায় খুব সুন্দর দেখায়।’
‘ আজই চলুন না। বসেই তো আছি। আবার কখনও সময় দিতে পারবেন কি-না কে জানে?’
রুদ্র তাকাল প্রিয়তার মুখের দিকে। একবুক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা ওর দিকে। মেয়েটার আশা ভাঙতে মন শায় দিলোনা রুদ্রর। কিছুক্ষণ আকুতি নিয়ে তাকিয়ে থাকা অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রইল নিঃশব্দে। মৃদু হেসে বলল, ‘কফিটা শেষ করে রেডি হয়ে নাও।’
হেসে উঠল প্রিয়তা। যেন পূর্ণিমার চাঁদ ছড়িয়ে পড়ল গোটা ব্যালকনি জুড়ে। রুদ্র সেদিকে তাকাল না। বাইরে তাকিয়ে সিগারেট টানল একমনে।
দিনের চেয়েও অতিরিক্ত সুন্দর কাটলো রাতটা। প্রিয়তাকে এই সন্ধ্যায় নতুনভাবে আবিষ্কার করল রুদ্র। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি হওয়ার সাথেসাথে ভীষণ পজেটিভ ও। সবকিছুর মধ্যে নিজের মতো করে ভালোটা খুঁজে নেয়। যদিও সেরকমটা না হলে রুদ্রর মতো একটা মানুষের সাথে এতো সহজ, স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারতো না। রুদ্র খেয়াল করল বিগত পাঁচ দিনের অস্বস্তি, বিরক্তি, খারাপ লাগা সব কেটে গেছে এই মেয়েটার সান্নিধ্যে এসে। সবটাই অদ্ভুত মনে হল ওর।
লেক পার্ক দিয়ে হাঁটার সময় রুদ্র খেয়াল করল এখানেও ফলো করা হচ্ছে ওকে। যদিও অনুসরণকারী বেশ সতর্কতার সাথে নিজের কাজ করছে কিন্তু রুদ্রর অভিজ্ঞ দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। রুদ্র নির্বিকার রইল। অনুসরণে কোনরকম বাঁধা দিলোনা লোকটাকে। ওপর দিয়ে স্বাভাবিক থাকলেও মস্তিষ্কে দ্রুত চিন্তা চলল রুদ্রর। সেদিন উচ্ছ্বাসও বলেছিল তাকে ফলো করছিল কেউ। কারা এরা? কোন গ্রুপের লোক? এভাবে নজর রাখার আসল কারণ কী? হাঁটতে হাঁটতে স্বাভাবিক ফোন স্ক্রোল করার ভঙ্গিতে কাউকে মেসেজ পাঠিয়ে দিল রুদ্র। আপাতত এটুকুই যথেষ্ট।
প্রায় ঘন্টা দুই হাঁটাহাঁটি করার পর দুজন ব্রিজের ওপর চলে এলো। ব্রিজ থেকেও দেখা যাচ্ছে লেক পার্কটা। সেখান থেকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে লেকটা। ব্রিজের ওপর পাশাপাশি বসল রুদ্র আর প্রিয়তা। রুদ্র আবার একটা সিগারেট বের করল। খোলা মুক্ত আকাশ, চারপাশে জ্বলে ওঠা উজ্জ্বল আলো, ব্যস্ত যানবাহন শব্দ। শো শো করে ঠান্ডা বাতাস বইছে, শরীর শিরশির করে উঠছে হিমশীতল বায়ুর স্পর্শে। প্রায় পাঁচ মিনিট নিঃশব্দে কাটল। নিরবতা কাটিয়ে প্রিয়তা বলল, ‘ আচ্ছা, চট্টগ্রামে তো দু’দিনেই আপনার ওপর এতোগুলো অ্যাটাক হল। অথচ গুলশানে এতো রিল্যাক্সে ঘুরছেন কীকরে? এখানে আপনাদের ওপর আক্রমণ হয় না?’
রুদ্র মৃদু হাসল। একমনে সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে বলল, ‘ গুলশানে ঢুকে আমার ওপর অ্যাটাক করা আর আ’ত্ম’হ’ত্যা করার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই।’
প্রিয়তা বুঝতে পারল ব্যপারটা। বহু দূরের লেকের পানিতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করল, ‘ আমায় আর কতদিন থাকতে হচ্ছে এখানে?’
‘ কেনো? চলে যাওয়ার খুব তাড়া বুঝি?’ এক বুক ধোঁয়া ছেড়ে জিজ্ঞেস করল রুদ্র।
প্রিয়তা জবাব দিলোনা। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল লেকের জ্বলজ্বলে পানিতে। রুদ্র বলল, ‘এখন আর তোমার তেমন কোন বিপদ নেই। এই এক সপ্তাহে তোমার ব্যপারে সবরকম খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে ওদের। ওরা এখন জানে তোমার সঙ্গে সোলার সিস্টেম গ্রুপের কোন সম্পর্ক নেই। তবুও সাবধানতার জন্যে আরও এক সপ্তাহ থাকতে হবে তোমাকে এখানে।’
প্রিয়তা যান্ত্রিক গলায় বলল, ‘তারপর?’
‘ ফিরিয়ে দিয়ে আসব তোমাকে।’
কথাটা বলে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে সিগারেটে পরপর দুটো টান দিল রুদ্র। প্রিয়তা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আরও দু মিনিট অস্বস্তিকর নিরবতায় কেটে গেল দুজনের। এবারের নিরবতা কাটানোর দায়িত্বটাও প্রিয়তা নিজেই নিল। বলল, ‘জানেন, এই একটা সপ্তাহ আপনাকে নিয়েই ভেবেছি আমি। সারাদিন আপনার কথা ভেবেই কেটে যেতো আমার।’ রুদ্র ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা বলে চলল, ‘ আমি আপনাকে নিয়ে ভাবতে চাইনি। যেদিন আপনি আমাকে নিয়ে এলেন মনে মনে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল আপনার ওপর। আপনার জন্যেই এরকম একটা বিপদে ফেঁসে গেলাম। কিন্তু একটা জিনিস ভেবে ভীষণ অবাকও হয়েছিলাম যে, শুধুমাত্র আমাকে বাঁচানোর জন্যে আপনি নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আবার ফিরে এসেছেন চট্টগ্রাম। প্রথমে আমার মনে হচ্ছিল আপনার নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে। আমাকে বাঁচানোটাই আপনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলোনা। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে দিলেন আপনি।’
রুদ্র সিগারেটের মাথায় জমা ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে বলল, ‘এখন কী ধারণা তোমার?’
এবার প্রিয়তাও তাকাল রুদ্রর দিকে। কয়েক সেকেন্ডের নিরবতার পর শীতল কন্ঠে বলল, ‘আমি আপনাকে বুঝতে পারছিনা, রুদ্র। আজকের কথাই ভাবুন। আমার দেখা গত নয়দিনের আপনি আর আজকের আপনি কত আলাদা। আজ যেন আলাদা এক মানুষ হয়ে উঠেছেন আপনি। আমি জানি কাল আবার আগের মতো হয়ে যাবেন আপনি। সেই বেপরোয়া, নিষ্ঠুর সত্ত্বায় ফিরে যাবেন। অদ্ভুত মানুষ আপনি। দুর্বোধ্য। হঠাৎই এই দুর্বোধ্য মানুষটাকে বুঝতে ইচ্ছে করছে আমার। কেনো বলতে পারেন?’
আঙুলে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা লাগতেই চমকে সিগারেটটা ছেড়ে দিল রুদ্র। ফিরে এলো গতকালের সেই মধুর স্মৃতি থেকে। গতকাল রাতে বলা প্রিয়তার কথাগুলো এখনো বাজছে রুদ্রর কানে। প্রিয়তার ‘কেনো’ এর উত্তর দিয়ে আসতে পারেনি ও। রুদ্র বাস্তববাদী মানুষ। ওর মনে হয়েছিল দীর্ঘ সময় প্রিয়তার সঙ্গে ছিল তারওপর মেয়েটা যথেষ্ট সুন্দরী, শারীরিক গঠনও চমৎকার। যেকোন পুরুষের নজরে পড়ার মতো এই মেয়ে। সেকারণেই হয়তো রুদ্রও আকর্ষণবোধ করেছে। কিছুদিন দূরত্ব বজায় রাখলে আপনাআপনি সব আকর্ষণ কেটে যাবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি। রুদ্রর ধারণা যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। জৈবিক চাহিদার কারণে হলেও অসংখ্য মেয়ের সঙ্গে রাত্রিযাপন করেছে ও। দৈহিক আকর্ষণ চিনতে ভুল হবেনা ওর। আর টিনেজারদের মতো চোখে রঙিন চশমা পড়ে, ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় ভেসে বেড়ানোর মতো প্রেমের বয়সটাও ওর নেই। তাহলে প্রিয়তার প্রতি জন্মানো ওর অনুভূতির নাম কী? ভালোবাসা! ভেতরে ভেতরে অস্হির হয়ে উঠল রুদ্র। স্হির হয়ে দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে গেল ওর জন্যে। দ্রুত হেঁটে রুমে চলে এলো। গায়ে একটা জ্যাকেট জড়িয়ে, জিপের চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বারের উদ্দেশ্যে। এখন কয়েক গ্লাস হুইস্কিই পারে ওকে এই অস্হিরতা থেকে মুক্তি দিতে। শান্তি দিতে।
*
রাত প্রায় দুটো বাজে। প্রিয়তা এখনো জেগে আছে। ঘুম আসছিল না তাই টিভি দেখে দেখেই সময় কাটাচ্ছিল। ঘরের লাইট অফ করে দিয়েছে। টিভির আলোয় যথেষ্ট আলোকিত হয়ে আছে রুমটা। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল প্রিয়তার। শরীর জমে গেল। চকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটা পুরুষালি অবয়ব দেখতে পেয়ে কেঁপে উঠল ভেতরটা। চিৎকার করার আগেই টিভির আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল আগন্তুকের মুখ। রুদ্র! প্রিয়তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সাথে অবাকও হলো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি এতো রাতে_’
বাক্যটা সম্পূর্ণ করার অবকাশ পেলোনা প্রিয়তা। তার আগেই পড়ে যেতে নিল রুদ্র। প্রিয়তা দ্রুত ধরে ফেলল। সোজা করে দাঁড় করাতে গিয়ে নাকে মদের বিশ্রী গন্ধ আসতেই বুঝতে পারল রুদ্র ড্রাংক। ও হতবাক হয়ে বলল, ‘আপনি নেশা করে এসেছেন এখানে?’
রুদ্র তাকিয়ে রইল প্রিয়তার মুখের দিকে। নিয়মিত নেশা করার অভ্যাস আছে রুদ্রর। সহজে নেশায় কাবু করতে পারেনা ওকে। কিন্তু আজ সত্যিই মাথাটা গুলিয়ে গেছে ওর। অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর অতিরিক্ত ড্রিংক করার ফলেই হয়তো এমনটা হয়েছে আজ। রুদ্র প্রিয়তার দুই বাহু ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল, ‘ কী আছে তোমার মধ্যে? তুমি জানো তুমি কী করেছো? রুদ্রকে, রুদ্র আমেরকে বদলে দিচ্ছো তুমি। তাও মাত্র, মাত্র দশদিনেই। তোমাকে ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছিনা আমি। যেটা আমি কোনদিন চাইনি সেটাই হচ্ছে আমার সাথে। এই প্রথম নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে আমি ব্যর্থ হচ্ছি। নিজের ওপর থেকে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি আমি। সবটা শুধুমাত্র তোমার জন্যে হচ্ছে। জাস্ট বিকজ অফ ইউ।’
কথাটা বলে প্রিয়তাকে ঠেলে সোফায় ফেলে দিল রুদ্র। প্রিয়তা হতভম্ব, বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে রুদ্রের দিকে। রুদ্রর প্রতিটা শব্দ স্তব্ধ করে দিচ্ছে ওকে। নড়ার শক্তিটুকুও নেই ওর মধ্যে। মূর্তির মতো ওভাবে পড়ে থেকেই তাকিয়ে আছে রুদ্রর দিকে। দু চোখ ভর্তি বিস্ময়। রুদ্র এসে বসল প্রিয়তার পাশে। প্রিয়তার ওপর দিয়ে এক হাত রেখে ঝুঁকে গেল ওর দিকে। মদের গন্ধ নাকে লাগতেই মুখ ঘুরিয়ে নিল প্রিয়তা। রুদ্র একহাতে ওর গাল ধরে নিজের দিকে ফেরাল। প্রিয়তা তাকাল রুদ্রর চোখে। অদ্ভুত সম্মোহনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুদ্র ওর চোখের দিকে। টিভির পর্দা থেকে আসা কম্পমান রঙিন আলোয় অদ্ভুত আকর্ষণীয় লাগছে সেই চাহনী। সেই দৃষ্টি থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার রইল না প্রিয়তার। হতবাক চোখে তাকিয়ে রইল রুদ্রর চোখে। রুদ্র বলল, ‘তোমার এই চোখ দুটোই আমাকে ধ্বংস করে দিয়েছে প্রিয়। তুমি জানো তোমার চোখের গভীরতায় কতবার হারিয়েছি আমি? কতবার হাবুডুবু খেয়েছি? নিজ চেষ্টায় কতবার উঠে এসেছি কোন হিসেবে আছে তোমার? তোমাকে হাসতে দেখলে মনে হয় আমার গোটা জগত হেসে উঠেছে। তোমার বিষণ্ন মুখ দেখলে অস্হির হয়ে উঠেছি আমি। আমার সবটা জুড়ে একটা, একটাই নাম বিচরণ করছে। প্রিয়তা! মাত্র দশদিনে কারো অস্তিত্ব হয়ে ওঠা যায় প্রিয়? সম্মোহিত করে ফেলছো তুমি আমাকে। আমাকে নিজের অধীনস্হ করে ফেলছো। আমি মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি, বাঁচার জন্যে ছটফট করছি কিন্তু পারছিনা। এই প্রথম কোন বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছিনা আমি, এই প্রথম আমার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। এই প্রথমবার আমি হেরে যাচ্ছি প্রিয়। হেরে যাচ্ছি তোমার কাছে।’
প্রিয়তার চোখ টলমল করছে। ঠোঁট ভেঙ্গে আসছে। হঠাৎই বুক ফাঁটা কান্না আসছে ওর। রুদ্র আরও ঝুঁকে এলো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা সেঁটে গেল সোফার সাথে। কিছুটা কাত হয়ে গেল বাঁ দিকে। কিন্তু চোখ সরালোনা রুদ্রের চোখের থেকে। রুদ্র প্রিয়তার মুখে পড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে নেশাক্ত কন্ঠে বলল, ‘কোনকাজে মন বসাতে পারছিনা। বারবার, বারবার মনে হচ্ছে আমার শুধু তোমাকে চাই। তোমাকে পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার সকল অস্হিরতা, সকল অস্বস্তি, সকল সমস্যার কারণ শুধুমাত্র তোমার অনুপস্থিতি। কিন্তু আমি চাইনা তোমার উপস্থিতি। চাইনা আমি তোমাকে আমার জীবনে। রুদ্র হৃদয়হীন, বাঁধনহীন, পিছুটানহীন, বেপরোয়া, নিষ্ঠুর হয়েই থাকতে চায়। কিন্তু তুমি উপলব্ধি করাচ্ছো যে আমারও হৃদয় আছে, বেঁধে ফেলছো আমাকে, দুর্বল করে দিচ্ছো আমাকে। কেনো? কেনো করছো এরকম?’
প্রিয়তার চোখের কার্নিশ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু চোখের পলক ফেলল না। তাকিয়ে রইল রুদ্রের তীক্ষ্ম, গভীর চোখের দিকে। হুইস্কির চেয়েও বহুগুণ ভয়ানক নেশা গ্রাস করে ফেলেছে প্রিয়তাকেও। রুদ্রর মুখনিঃসৃত একেকটা শব্দ প্রিয়তার শরীরের একেকটা নার্ভকে যেন অকেজো করে দিয়েছে। মন চিৎকার করে বলছে এই পুরুষের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ বিলিয়ে দেওয়া যায়। নির্দ্বিধায়। রুদ্র আরও এগিয়ে এলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল প্রিয়তার। রুদ্র ফিসফিসে আওয়াজে বলল, ‘আমার এতো প্রিয় হয়ে ওঠার কী খুব প্রয়োজন ছিল প্রিয়? ঠিক করোনি তুমি এটা।’
প্রিয়তার পৃথিবী দুলে উঠল। জগত অচেনা হয়ে উঠল। মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেল। সব ভুলে গেল রুদ্র নিজেও। প্রিয়তার চোখের গহীনতায় হারিয়ে ফেলল নিজেকে। অচেনা হয়ে উঠল সবকিছু। ভুলে গেল রুদ্র আমের কে, রাশেদ আমের কে, ভুলে গেল অন্ধকার সেই জগতকে। সমস্ত জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিল নিজেকে। নামিয়ে আনল নিজের ঠোঁটজোড়া প্রিয়তার অধরোষ্ঠে। বাঁধা দেওয়ার কোন লক্ষণ দেখা গেল না প্রিয়তার মধ্যে। সে ক্ষমতা কিছুক্ষণ আগেই হারিয়ে ফেলেছে সে। আবেশে বন্ধ করে ফেলল চোখজোড়া। মেনে নিল জীবনের প্রথম চুম্বনকে। অবশেষে ঘটেই গেল সেই অঘটন!
#চলবে…
[ পর্বটা বড়ই দিয়েছি। মন্তব্যগুলোও গঠনমূলক হওয়া চাই।]