মায়াবতী পর্ব ৪৩
তানিশা সুলতানা
তন্নির দাঁড়িয়েই থাকে। অর্ণব যে খুব রেগে আছে সেটা ভালোই বুঝতে পারছে। তার এগিয়ে যাওয়া উচিত কি না ভাবছে। হঠাৎ কেনো রেগে গেলো কেনো? কে কল করেছে? কি বলেছে সে অর্ণবকে?
তখনই আবার অর্ণব বলে ওঠে
“নিধি নেক্সট টাইম আমাকে কল করবা না তুমি। তোমার থেকে কোনো ইনফরমেশন নিতে চাই না আমি। তোমার প্রতি আমার কোনো ফিলিংস নেই। মায়াবতী আমাকে ভালোবাসা বুঝিয়েছে। তোমাকে আমি কখনো ভালোই বাসি নি। জাস্ট তোমার দুঃখের কথা শুনে মন গলেছিলো। তাই সঙ্গ দিয়েছি। এটাকে ভালোবাসা বলো না প্লিজ৷
অর্ণব কল কেটে দেয়। ফোন পকেটে পুরে লম্বা শ্বাস টানে। সে জেনে গেছে তার মায়ের করা তন্নিকে অপমানের কথা। জেনে গেছে তার মায়ের প্লান। লজ্জিত সে। কি করে এই মুখ দেখাবে তন্নিকে? কি করে যাবে তার সামনে? কি করবে সে? কি করে তার মায়াবতীর অপমান ঘুচাবে?
রাগে পুরো শরীর জ্বলছে অর্ণবের। রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে রেলিং এ কয়েকটা ঘুসি দেয়। হাত পুরো লাল হয়ে যায়।
তন্নি ভয় পেয়ে দৌড়ে আসে। অর্ণব আবারও ঘুষি দিতে যাবে তখনই তন্নি অর্ণবের হাত ধরে ফেলে। অর্ণব তাকায় না তন্নির দিকে। চোয়াল শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। তন্নির কষ্ট হয়। সে অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে
” এমন কেনো করছেন? কি হয়েছে?
অর্ণব তন্নির থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয়। তন্নির দিকে পেছন ফিরে তাকায়।
“তন্নি প্লিজ আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
তন্নি চমকে ওঠে। চোখে পানি টলমল করছে। এই প্রথমবার অর্ণবের মুখে তন্নি নামটা শুনলো। খারাপ লাগছে শুনতে। ওই মুখটাতে শুধুমাত্র ” অনির মাম্মা, মায়াবতী, অথৈয়ের তন্নি, এসব নামই মানায়। তন্নি নামটা মানায় না। বড্ড বেমানান লাগছে নামটা।
দুই গাল বেয়ে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে তন্নির। হাতের উল্টো পিঠে পানি টুকু মুছে নেয়।
শক্ত গলায় অর্ণবকে প্রশ্ন করে
“আমাকে বলুন না কি হয়েছে আপনার? আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে কেনো আছেন?
অর্ণব দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়। ভীষণ অসহায় লাগছে তার। ভালোবাসার অপমান মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তার মা যদি একবার মুখ ফুটে বলতো ” আব্বা তন্নিকে আমার পছন্দ না তুই ওকে ভুলে যা”
অর্ণব দ্বিতীয় বার তন্নিকে নিয়ে ভাবতো না। মাকে সে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু সেই মা কি করলো? তার তন্নিকে অপমান করলো? তন্নির বাবা মাকে ছোট করলো।
কি করে পারলো তার মা?
তন্নিকে কি বলবে সে? কি করে তন্নির সম্মান ফিরিয়ে দিবে?
তন্নি অর্ণবের পাশে বসে পড়ে। অর্ণবের হাতটা সরিয়ে বুকে মাথা ঠেকায়৷ অর্ণব কোনো রেসপন্স করে না। তন্নি অর্ণবের হার্টবিট শুনতে থাকে। এটাই পৃথিবীর সব থেকে শান্তির জায়গা। এখানেই তন্নি পৃথিবীর সব সুখ খুঁজে পায়।
বেশ অনেকখন দুজন চুপচাপ থাকে। একজন মুহুর্তটাকে উপভোগ করছে আরেকজন চিন্তায় বিভোর।
তন্নি জিজ্ঞেস করে
“কি হয়েছে আপনার? রেগে কেনো আছেন? আমি কিছু করেছি?
অর্ণব তন্নির মাথায় চুমু খায়। তন্নির মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে বলে
” কিছু হয় নি।
“তাহলে আমাকে তন্নি বলে কেনো ডাকছেন?
” তোমার নাম তন্নি তাই।
“কিন্তু আগে তো অথৈয়ের তন্নি বলে ডাকতেন।
” এখন তো অথৈয়ের সাগর আছে।
“অনির মাম্মা
” অনি তো এখনো পৃথিবীতে আসে নি।
“মায়াবতী
” সেই নামে ডাকতে ইচ্ছে করছে না।
“মায়া কবে গেলো? ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেললেন?
অর্ণব উঠে যায়। রেলিং ধরে দাঁরায়। তন্নি বসেই থাকে। তার অভিমান হয়েছে বড্ড।
“আমার মনটা ভালো নেই তন্নি। আর আমি আমার রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না।
” আপনার বউ হই আমি৷ আপনার মন ভালো করার দায়িত্ব আমার।
অর্ণবের ইচ্ছে করছিলো বলতে “আমিও তো তোমার বর হই কই আমি তো পারলাম না তোমার সম্মান বাঁচাতে? তোমাকে অপমান করা হলো শুধুমাত্র আমার জন্য”
কিন্তু এই কথা বলবে না অর্ণব। বউয়ের জন্য মাকে সে অপমান করবে না। আবার মায়ের জন্য বউকেও অপমান করবে না। তাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে তার মা ভুল বুঝতে পারে তন্নিকে আপন করে নেয় ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে তোলে। আর তখনই মিটবে তন্নির অপমান।
“বাসায় যাবে তো?
” নাহহ থাকবো আজকে।
“যাও মাম্মা পাপা অথৈ আর্থির কাছে বলে এসো। আমি তোমাকে ছেড়ে আসবো।
তন্নি ফুঁসে ওঠে
” বললাম না যাবো না।
“ঠিক আছে তাহলে আর্থির কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ো।
তন্নি ধুপধাপ পা ফেলে অর্ণবের বেডে বসে পড়ে। অর্ণবও আসে তন্নির পেছন পেছন
” যতখন না বললেন কি হয়েছে ততখন আমি এখান থেকে এক পা নরবো না।
অর্ণব আলমারি খুলে নিজের টিশার্ট আর টাউজার নিয়ে তন্নির দিকে তাকিয়ে বলে
“ইনডিরেক্টলি বাসর করার প্রপোজাল দিয়ো না। আমার মুড নাই।
তন্নি বালিশ ছুঁড়ে মারে অর্ণবের দিকে। অর্ণব সেটা ধরে ফেলে।
তন্নি জোর গলায় বলে
” বলুন কি হয়েছে?
অর্ণব তন্নির দিকে বালিশ ছুঁড়ে মারে। একদম তন্নির মুখে এসে লাগে। তন্নি ঠাসস করে শুয়ে পড়ে। অর্ণব হেসে ফেলে
“এইরকম তেলাপোকার শরীর নিয়ে আমার সাথে কটামি করতে আসো ভয় করে না? মাথা তুলে একটা আছাড় মারলেই ফুটে যাবা।
তন্নি গাল ফুলিয়ে উঠে বসে। অর্ণবের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে থাকে।
অর্ণব এবার নিজের জামাকাপড় তন্নির দিকে ছুঁড়ে মারে। মুখে এসে পড়ে ওগুলো।
” এখন আর হাতে কিছু নেই। ওইভাবে তাকালে এই অর্ণবটাকেই ছুঁড়ে মারবো বলে দিলাম।
তন্নি হতাশ হয়। দুই হাতে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে
__
সাগর হাত দিয়ে খাবার তুলে খেতে পারে না। বাজে ভাবে ভেঙেছে তার হাত। জামাকাপড়ও একা চেঞ্জ করতে পারে না।
সকাল থেকে একটা শার্ট পড়ে আছে। বিরক্ত লাগছে তার। এই গরমে এভাবে থাকা যায়? গোছল করার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ডাক্তার বারণ করেছে। শুধু কাপড় ভিজিয়ে শরীর মুছে নিতে বলেছে।
অথৈ কোথায় গেছে জানা নাই সাগরের। তার ঘুম ভেঙেছে একটু আগে। এখন সে বসে আছে। কয়েকবার শার্ট খোলার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি।
তখনই অথৈ রুমে ঢুকে হাতে খাবারের থালা নিয়ে।
সাগরকে বসে থাকতে দেখে হেসে বলে
“আপনি উঠে গেছেন?
সাগর জবাব দেয় না। অথৈ সাগরের পাশে খাবারের থালা রেখে বলে
” ফ্রেশ হবেন তো? শরীর মুছিয়ে দিবো? ভালো লাগবে কিন্তু।
সাগর হা করে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা বুঝলো কি করে খারাপ লাগছে?
“আরে বাবা তাকিয়ে কেনো আছেন? আসুন না। শার্ট খুলে দেই।
সাগর চোখ নামিয়ে নেয়।
” আমি পারবো।
অথৈ বোতামে হাত রাখে।
“পারলে এতখনে খুলে ফেলতেন। এতো লজ্জা কিসের। আমরা আমরাই তো৷
সাগর আর কিছু বলে না। অথৈ শার্ট খুলে দেয়। এই প্রথমবার সাগরকে খালি গায়ে দেখলো অথৈ। বেশ লজ্জা লাগছে। তবুও পাত্তা দেয় না। ও লজ্জা পেতে থাকলে সাগরও লজ্জা পাবে।
” এখানে পানি আনবো না কি
“হুমম
অথৈ কোমরে আঁচল গুঁজে পানি আনতে যেতে নেয়। তখন সাগর জিজ্ঞেস করে ওঠে
” তন্নি চলে গেছে?
থেমে যায় অথৈ। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে পেছন ঘুরে সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে
“নাহহ ভাইয়ার রুমে আছে। আমার ভাই কাল বাসর সাজিয়ে রেখেছে। যেতে দেবে না বোধহয় আজকে আর।
বলেই অথৈ চলে যায়। সাগর মুচকি হাসে। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে যেনে তন্নি সারাজীবন ভালো থাকে। আল্লাহ যেনে সাগরের সব সুখ তন্নিকে দিয়ে দেয়। দীর্ঘ দিন বাঁচিয়ে রাখে।
চলবে…………….