লাশ নিয়ে চলে যাওয়ার পর মহিলারা তনুকে ধরাধরি করে বাসার ভেতরে নিয়ে আসলো। তনু অবাক হয়ে লক্ষ করলো তাকে বাথরুমের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! সবাই বলাবলি করছে,
: ওকে গোসল করানোর ব্যবস্হা করো। মেয়েটা তো কান্না করার শক্তিটাও হারায়ে ফেলছে। শরীর প্রচন্ড দূর্বল মনে হয়। তার উপর বমি করছে। বমিতে সারা গা মাখামাখি করে ফেলছে। সকাল থেকে কিছুই মুখে দেয়নি মনে হয়। আহারে ঠিক মতো দাড়াতেও পারছে না। ওকে কিছু খাওয়ানো দরকার। বাসায় তো মনে হয় কিছুই রান্না নাই। কেউ কি খাবার দেবে এই বেলায়? রাতেরটা না হয় আমি দেবো।
তনু মোটেও দূর্বল না। কিছু কিছু মানুষ নিজের মনের মতো করে ঘটনার বিশ্লেষণ করে থাকে। ভাগ্যিস মনগড়া ব্যাখ্যা দাড় করায়! তা না হলে তনুর নিজেকেই হয়তো এইসব অভিনয় করে প্রমাণ করতে হতো। সবাই ধরেই নিয়েছে যেহেতু তনুর স্বামী মারা গেছে তাই তার এইসব সমস্যা হচ্ছে। আমরা আসলে সচরাচর যে সব ঘটনা দেখে বা শুনে অভ্যস্ত, সে সবের বাইরে অন্য কিছুই চিন্তা করতে পারি না। তনুর এমন প্রায়ই না খেয়ে থাকতে হয়। বিশেষ করে সকালের নাস্তা, বেশ কয়েক বছর ধরেই সে খাওয়া বাদ দিয়েছে। যার কারণে পেটে প্রায়ই গ্যাস হয়। আজকের বমি হওয়াটাও সেই একই কারণ। তনুর বমির কারণে সবাই কেমন একটু কানাকানি করছে। এতো দুঃখের মাঝেও অনেকের চেহারায় হালকা একটা প্রশান্তি খেলা করছে।
: যাক মেয়েটা অন্তত স্বামীর একটা স্মৃতি নিয়ে বাকিটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
আবার অনেকের ভ্রু কুচকে আসছে ঠিক বিপরীত ভাবনায়,
: তনু যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে থাকে তাহলে তো এই মেয়েকে আরেকটা বিয়ে দেয়া মুশকিল হয়ে যাবে! বয়স তো বেশি না। একা একা কতদিন থাকবে? তখন কি ঐ স্বামী এই বাচ্চাকে মেনে নিবে?
তনুর বাবার বাড়ির মুরুব্বিদের মধ্যে নিচু গলায় ফিসফাস,
: এই ফ্ল্যাট কার নামে? গ্রামে কি জমিজমা কিছু আছে? জামাই আসলে কি করতো? তনুর নামে কি কিছুই লিখে দেয় নাই? ব্যাংকে কি পরিমাণ লিকুইড আছে? শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাদের মেয়ের উপর কোন আবার অন্যায় না করে বসে? দেবে তো সব বুঝায়ে?
তনু একেক জনের চেহারার দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাবনাটা ধরার চেষ্টা করছে। শাহেদের সাথে দীর্ঘ সাতটা বছর কাটানোর এটা একটা ভালো দিক। চুপচাপ থেকে চারপাশের পরিবেশ বোঝা এবং সামনের জন মনে মনে কি ভাবছে? সেটা ধারণা করা। তাদের দুজনের মধ্যে ২/৩ বছর ধরে কথা খুবই কম হতো। তনুর প্রধান কাজই ছিলো শাহেদের মাথায় কি ঘুরছে? সেটা ধরতে পারার প্রাণান্তকর চেষ্টা। কিন্তু এই মুহুর্তে তার আসেপাশের লোকগুলি কি চিন্তা করছে? সেটা কষ্ট করে বোঝার কোন দরকার নেই। কারণ এরা মনে মনে যা চিন্তা করছে, সেটা বেশি সময় মনের মধ্যে চেপে রাখতে পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা সেটা তনুর করা বমির মতই পেট থেকে আরেকজনের কাছে উগলে দিচ্ছে। তনুর থেকে সামান্য একটু দুরে সরে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। তারা আসলে ঠিক অতটা দুরে যেতেও পারছে না। কারণ তাদের সেই আলোচনার টুকরো অংশ তনুর কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে।
তনুর এখন একটাই চিন্তা কত দ্রুত সময়ের মধ্যে বাথরুমে ঢুকে পরা যায়। শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাড়াতে পারলে একটু শান্তি পেতো সে। সকালের ফরজ গোসলটাই যে এখনো করা হয়ে উঠেনি! কিন্তু এদের নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে না তনুকে এরা একা গোসল করতে দেবে। এমন সময় তনুর সাথে সাথে চার পাঁচ জন মহিলা বাথরুমে ঢুকে গেলো। এদের সামনেই তনুকে কি গোসল করতে হবে! এই জীবনে সে কারোর সামনে কখনো গোসল করেনি। ব্যপারটা তনুর কাছে ভিষণ অস্বস্তিকর। যে কারণে সে কোনদিন বৃষ্টিতে গোসল করেনি। লোকজন তার ভেজা শরীর দেখবে! ভাবতেই তো কেমন জানি বিচ্ছিরি লাগে। আর আজ নাকি সেই তাকেই এই চোদ্দগুষ্টির সামনে গোসল করতে হবে! আচ্ছা এদের সামনেই কি তাকে কাপড়ও পাল্টাতে হবে নাকি! সর্বনাশের চুড়ান্ত!
তনু মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। ভোরে উঠেই গোসলটা করে ফেলা উচিৎ ছিলো। প্রতিদিন তাইই করে। কিন্তু আজ কেন যেন একটু আলসেমিতে ধরে ছিলো। সকালের গোসলটা তনু একটু সময় নিয়েই করে। তনুর সারা গায়ে শাহেদের দেয়া রাতের ভালোবাসার দাগগুলি ডলে ডলে মুছে ফেলতে তার যে অনেক সময় লেগে যায়। তারপরও পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারে না। স্বামীর নখ আর দাঁতের সোহাগের দাগগুলি তনুর গায়ে পরনের জামার আড়ালে লুকিয়ে থাকা শরীরে স্হায়ী জায়গা করে নেয়। কে বলেছে মনের দাগের চাইতে শরীরের দাগ হালকা হয়? শরীরের দাগ এক সময় না এক সময় চলে যায়? কিন্তু মনের দাগ রয়ে যায়? তাহলে তনুর শরীরের দাগ দিনকে দিন এতো গাঢ় হয় কি করে? কাল রাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অথচ কে জানতো! আজ থেকেই তনু এই প্রতিদিনের ভয়ংকর অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছে!!
আজ সকালের ভেজালটা তো ছুটা বুয়াই বাজালো। প্রতিদিন ভোর ছয়টায় বুয়ার কলিং বেলের আওয়াজে তনুর ঘুম ভাঙ্গে। রুটি, ভাজি বানায়ে টেবিলে দিয়ে সে ঘর ঝাড়ু দিতে যায়। ঐ সময়ে শাহেদও ঘুম থেকে উঠে পরে। কিন্তু আজ বুয়া বেডরুমে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই চিৎকার দিয়ে তনুকে ডাকতে থাকে।
: মামি গো…..
তনু দৌড়ে রুমে ঢুকে দেখে শাহেদ বিছানায় অস্বাভাবিক ভাবে শুয়ে আছে। হাত-পা বাঁকানো। মুখ একদিকে কাত করা এবং হা করা। মুখটা কি সামান্য বেঁকে আছে? তনু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। আর হা করা মুখ থেকে চিকন হয়ে অল্প রক্ত গড়িয়ে সাদা বালিশের উপর পরে শুকিয়ে আছে। তনু ঐ সময়টায় কেন যেন নড়াচড়া করতে ভুলে যায়। মনে হয় পায়ে শিকল পরিয়ে দিয়েছে কেউ। সেই শিকলের সাথে আবার কয়েক মণ ওজনের পাথর বাঁধা। তনু এক দৃষ্টিতে বালিশের উপর ঐ রক্তের দাগের দিকে চেয়ে ছিলো। বুয়ার ঝাঁকুনিতে তনু বাস্তবে ফিরে আসে। এরপর আর তনুকে কিছুই করতে হয়নি। যা করার ঐ বুয়াই করেছে। আশে পাশে বাসার সবাইকে জানানো। তারাই আবার শাহেদের ভাইবোনদের জানিয়েছেন। তনুকে তারা কিছুই করতে দেননি। এমন কি হাসপাতালেও যেতে হয়নি তার। শাহেদের বড় দুলাভাই একাই সব কিছু সামাল দিয়েছেন। তবে তনু নিজের কোন কাজও করতে পারেনি তার আগেই বাসায় লোকজন চলে এসেছে।
প্রচন্ড বিরক্তি চেপে তনু নিজের গোসল করানোটা সহ্য করলো। এরা কিভাবে কিভাবে যেন সাদা কাপড়ও জোগাড় করে ফেলেছে! তনুকে জায়নামাজ বিছিয়ে দিলো কেউ একজন। অনেক সময় নিয়ে তনু জোহরের নামাজটা শেষ করলো। তার অসম্ভব ক্ষুধা পেয়েছে। ক্ষুধার জন্য রীতিমতো তার শরীর কাঁপছে। বাথরুম থেকে এই রুমে আসার সময় সে ঠিকই খেয়াল করেছে ডাইনিং টেবিলের উপর গামলা ভর্তি অনেক খাবার! কেউ হয়তো দিয়েছে। সবাই যার যার মতো প্লেটে খাবার নিয়ে খাচ্ছে। পাশের বাসার ভাবি আবার খুব দক্ষতার সাথে এসব তদারকি করছেন। শাহেদের ভাইবোনদের খুঁজে বের করে তাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। এই আরেক আজব ঘটনা, খাবারের বেলায় না জানলে বিয়ে বাড়ি আর মৃত বাড়ির মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য বোঝার উপায় থাকে না। একদিক দিয়ে লাশ বের হয় আরেক দিক দিয়ে মৃত বাড়িতে আসা কিছু লোকজন খাবারের উপর হামলিয়ে পরে।
এই মুহুর্তে অবশ্য তনু আর এসব চিন্তা করতে পারছে না। সে ভাবছে যেভাবে টেবিলের চার পাশে লোকজনকে খেতে দেখলো, শেষ পর্যন্ত তার নিজের খাওয়ার জন্য কিছু অবশিষ্ট থাকবে তো? পর মুহুর্তেই সে লজ্জা পেয়ে যায়। আজ তার স্বামী মারা গেছে। আর সে কিনা তার খাওয়ার চিন্তা করছে! ছিহ্!!
চলবে…….
আফরোজা খানম তন্দ্রা