রাত প্রায় ১২টা বাজে। শাহেদা টেবিলের সব খাবার ফ্রিজে তুলে ঘরের টুকটাক কাজ শেষ করে তনুর রুমে গেলো তাকে দেখার জন্য। নাহ্, মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। কয়েকদিন হলো তনুকে একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে অসুধ খাওয়ানোর পর তনু এখন দিনের বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের রুমে এসে ঢুকলো শাহেদা। রাতে ঘুমানোর আগে সে আর জলিল দুজনে একসাথে পান খেতে খেতে সারাদিনের কার্যকলাপ গুটুর গুটুর করে আলোচনা করে। শাহেদা আসলে জলিলের উপর ভিষণ ভাবে কৃতজ্ঞ। তার সব কিছুতেই শুরু থেকে তার স্বামীর প্রচন্ড সাপোর্ট ছিলো। জলিলের মতো এতো ভালো মানসিকতার মানুষ তার জীবনে খুব কমই দেখেছে। এখনো শাহেদা পরম কৃতজ্ঞতার চোখে জলিলের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তনুর ব্যাপারেও এই লোকটার কোন অভিযোগ নেই! বরং সেই বলেছে,
: মেয়েটিকে আমাদের কাছে এনে কয়েকদিন রাখা উচিৎ। যে অবস্থা সেদিন দেখে এলাম, এমনটা আর কয়েকদিন থাকলে মেয়েটাকেও হারাতে হবে হয়তো।
শাহেদা তনুর মা-বাবার সাথে যোগাযোগ করে তার শারীরিক অবস্থার কথা জানিয়েছে। কিন্তু সেদিন তনুর মার কথা শুনে শাহেদা নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলো! একজন মা তার সন্তান সম্পর্কে এমন ভাবে চিন্তা করতে পারে! তার ধারণাতেও ছিলো না! শাহেদা ফোনের এপাশ থেকে চুপচাপ তার কথা শুনছিলো,
: আপনি তো জানেনই তনুর বাবার এখন কোন ইনকাম নেই। আমরা দুজনেই কিছুদিন ছেলে আবার কিছুদিন ছোট মেয়ের বাসায় থাকি। এই অবস্থায় আমাদের পক্ষে তনুকে এনে ওদের বাসায় রাখা সম্ভব না। চিকিৎসা করা তো দূরের কথা। শাহেদের বিষয় সম্পত্তি তনুর নামে আপনারা এখনো লিখে দিতে পারেন নি। লিখে দিলে তখন না হয় ওর ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। তার আগেই যদি ওকে আমরা নিয়ে আসি, বলা তো যায় না তারপর যদি আমার মেয়েকে পাগল সাব্যস্ত করে ওকে ওর সমস্ত সম্পত্তি থেকে আপনারা বঞ্চিত করেন? তখন এই পাগল মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় গিয়ে দাড়াবো?
তনুর মা আর শাহেদা দুজনের বয়স কাছাকাছি। হিসেব করলে দেখা যাবে তনুর মা’ই হয়তো শাহেদার চাইতে বয়সে ছোট হবেন। তাই সম্পর্কে বড় হওয়ার পরও তনুর মা শাহেদাকে আপনি বলে সম্বোধন করেন। তনুর মা’র মুখে এমন কথা শুনে শাহেদার আর তার সাথে কোন রকম আলোচনা করার ইচ্ছা হয়নি। জলিলকে সব খুলে বলার পর,
: থাক তাদের সাথে আর এসব বিষয়ে তোমার কথা বলার দরকার নাই। শাহেদকে তো তুমিই বিয়ে করিয়েছিলে। তনুকে পছন্দ করে তুমিই এ বাড়ির বৌ করে এনেছিলে। অতএব তনুর দায়িত্ব তো তোমার উপরও বর্তায়। তাছাড়া এখন আমরা শুধু দুজন এ বাসায় থাকি। আমাদের ছেলে মেয়েদেরও আলাদা সংসার হয়েছে। তনুর শারীরিক অবস্থাও ভালো না। থাকুক আমাদের কাছে। যতদিন পারো মেয়েটার দেখভাল করো। পরেরটা পরে দেখা যাবে। জীবনে তো কম জনকে মানুষ করোনি। শেষ বয়সে না হয় আরেকজনের দায়িত্ব নিলা।
সেদিন শাহেদার মাথা কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে গিয়েছিলো। সাথে সাথে জায়নামাজ বিছিয়ে দু’রাকাত নফল নামাজ পরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছিলেন, জলিলের মতো এতো ভালো মানসিকতার একজন মানুষ তার স্বামী হিসেবে পাওয়ার জন্য। অথচ এদিকে শাহেদের মৃত্যুর দিন তনুকে অসম্ভব স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো শাহেদার কাছে। মনে হচ্ছিলো মৃত্যুটা বুঝি তনুর জন্য খুব জরুরী ছিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মেয়েটার কি চরম অস্বাভাবিকতাই না তৈরি হচ্ছিলো। তনুর ভেতরের এই ভাঙ্গাচুরটা ঘুনাক্ষরেও সে টের পায়নি।
শাহেদা যত্ন করে একটা পান বানিয়ে জলিলের দিকে এগিয়ে দিলো। জলিল হাত বাড়িয়ে পানটা নিয়ে নিজের মুখে দিতে দিতে,
: তনুকে অসুধ গুলো ঠিক মতো খাওয়াচ্ছো তো শাহেদা?
: হ্যা, প্রেসক্রিপশন দেখে নিয়মিত খাওয়াচ্ছি।
: কোন ইম্প্রুভ হচ্ছে কি? ওকে তো সারাদিনই ঘুমাতে দেখি। কথা বলতে শুনি না।
: ডাক্তার বলেছে অসুধ এ্যাডজাস্ট হতে সপ্তাহ দশদিন সময় লাগতে পারে। এর মধ্যে অতিরিক্ত এ্যাবনর্মাল কোন আচরণ করলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে বলেছেন। অসুধ খাওয়াচ্ছি মাত্র তো তিনদিন হলো।
তাদের কথার এই পর্যায়ে হঠাৎ তনু দরজা খুলে তাদের ঘরে ঢুকলো। ভাগ্যিস ঘরে ছোট লাইটটা জ্বালানো ছিলো। কারণ, তনুর গায়ে কোন কাপড় নেই!
: আপা, আমাকে গোসল করায়ে দিবা না? শরীর জ্বলতেছে। আমার গায়ে অনেক ময়লা। পোকা হাঁটতেছে। ঘিন্না লাগতেছে। সাবান দিয়ে ডলে গোসল করায়ে দাও। আপা আমাকে গোসল করায়ে দাও। শাহেদ ঘরে ঢুকছিলো। আমাকে গোসল করায়ে দাও।
তনু একই কথা বার বার বলতে থাকে।
হতভম্ব জলিল এই পরিস্থিতিতে কি করবে? বুঝে উঠতে পারে না। শাহেদা দৌড়ে গিয়ে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে তনুর শরীর ঢেকে দেয়। সে একটু উঁচু গলায় ধমক দিয়ে,
: তনু, তুই কাপড় খুলেছিস কেন!!
তনু আবারও বলে উঠে,
: আমাকে গোসল করায়ে দাও আপা। গোসল করায়ে দাও।
এর কয়েকদিন পরের কথা। সেদিন শুক্রবার ছিলো। কার কাছ থেকে যেন শাহেদা শহর থেকে একটু দূরে এক মাজারের খোঁজ পায়। সে শুনেছে সেখানে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করলে নাকি মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এমন অনেকেরই নাকি পূর্ণ হয়েছে। সবচাইতে বড় কথা তনুর মতো এমন মানসিক রুগী নাকি এর আগে ভালোও হয়েছে। জলিলের আবার এসব মাজার, মসজিদের উপর বিশ্বাস কম। তাই বলে সে নাস্তিক নয়। তার কথা আল্লাহর কাছে চাইতে হলে এসব মসজিদ, মাজারে যেতে হবে কেন? ঘরে বসে নামাজ পড়ে খাস দিলে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেই তো হয়। আল্লাহ্ সব জায়গায়ই রয়েছেন। শাহেদা জলিলকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজি করেছে। আসলে তনুর কথা চিন্তা করেই জলিল রাজি হয়। কি জানি হয়তো এসবে কোন ভালো কিছু হলেও হতে পারে। তাছাড়া শাহেদার কথার বিরোধিতা সে সাধারণত করে না।
অনেক বছর আগে শাহেদা এই মসজিদে শাহেদকেও নিয়ে গিয়েছিলো। সে অবশ্য এসব কথা জলিলের কাছে গোপন রেখেছে। মাজারটি যে তার এখন নয় অনেক আগে থেকেই জানা, সেটা সে জলিলের কাছে চেপে যায়। শাহেদ তখন ক্লাস এইটে পড়ে। কয়েকমাস হলো শাহেদা গ্রাম ছেড়ে শহরে থিতু হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। শহরের পরিবেশ তার একদম পছন্দ নয়। কিন্তু ঐ গ্রামে ফিরে যাওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। শাহেদের জন্য সে যে কোন কষ্ট স্বীকার করতে রাজি আছে। সে নিজেও প্রচন্ড অবাক হয় ভেবে, শাহেদের জন্য তার এতো কেন ভালোবাসা! কিন্তু কখনোই তেমন কোন সদুত্তর পায় না। শাহেদের কোন রকম কষ্ট তার সহ্য হয় না। বাসায় মিথ্যে বলে গিয়েছিলো সেদিন। শাহেদ অবশ্য প্রথমে যেতে চায়নি। অবশেষে শাহেদার কান্নাকাটির কাছে তাকে নতিস্বীকার করতে হয়েছে। মাজার থেকে সেবার পানি, তেল, মাটি, গাছের ছাল, শিকড় এমন প্রায় বিশ ধরনের জিনিস পড়া এনেছিলো। সব কিছুর জন্য সেই তখনই পীরবাবাকে ৩০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। নিয়ম করে সেগুলো খাওয়ানোর পরই তো শাহেদ আল্লাহর রহমে বেশ ভালো হয়ে গিয়েছিলো। গাছন্ত শেষ হয়ে গেলে পরে আরেকবার অবশ্য মাজারে শাহেদকে নিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু শাহেদ বলেছিলো সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে। আর যেতে হবে না। শাহেদা তার কথায় আশ্বস্ত হয়ে আর মাজারে যায়নি।
এতো বছর পর শাহেদা আবার সেই মাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। তার বিশ্বাস শাহেদের এতো বড় শারীরিক সমস্যা যেহেতু সমাধান করতে পেরেছেন, তনুর এই সামান্য মানসিক সমস্যাও নিশ্চয়ই নিরাময় হবে। সকাল সকাল তারা সবাই রেডি হয়ে বের হয়ে যায়। গাড়িতে উঠে শেষ বারের জন্য জলিল শাহেদাকে জিগ্যেস করে,
: শাহেদা, তুমি নিশ্চিত যা করছো সেটা তনুর ভালোর জন্যই করছো?
: হ্যা, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। তুমি আর মন্দ বলো না গো। আল্লাহর নাম নিয়ে চলো এবার রওনা দেই।
মাজারের ভেতর শুধু শাহেদা তনুকে নিয়ে ঢুকেছে। জলিল বাইরে একটু দূরে গিয়ে একটা গাছের ছায়ায় দাড়িয়ে আছে। পাশেই টিউবওয়েল। টিউবওয়েলের হাতল ধরে একহাতে চেপে আরেকহাত টিউবওয়েলের মুখে ধরে জলিল ছোটবেলার মতো মুখ লাগিয়ে একটু পানি খেলো। এভাবে সে একটা সময় পানি খেতো। তাই টিউবওয়েল দেখে তার ছোটবেলার কথা মনে পরে যায়। কিন্তু পানিটা সেই সময়ের মতো স্বাদ লাগে না। কেমন যেন পানিতে একটু কাদাকাদা গন্ধ লাগে জলিলের কাছে। পানির ঐ গন্ধ পাওয়ার পর থেকে তার শরীরটা গুলাতে থাকে। একটু পান খেলে বুঝি ভালো লাগতো। কিন্তু পানের বাট্টা গাড়িতে। ড্রাইভারকেও আশেপাশে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। জলিল শরীরে ঐ অস্বস্তি নিয়ে গাছের নিচে দাড়িয়ে রইলো।
একটু পর একটালোক মাজারের ভেতর থেকে দৌড়ে বের হয়ে এলো। হাতে তার বালতি। দ্রুত কল চাপছে বালতিটা ভরার জন্য। আর জোরে জোরে বলতেছে,
: এইসব কাম মাইনসে করে? কি অলুক্ষুইনা কাম! জোয়ান মাইয়া মাজারে পীরবাবার কব্বরের সামনে মুইতা দিছে! নাউজুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ্! গজব পরবো এই মাইয়ার উপর। পীরবাবার লানত লাগবো। ছারখার হইয়া যাবো ওর জীবন। কি অলুক্ষুইন্যা মাইয়া। গলায় রক্ত উঠবো। রক্ত বমি হইয়া মরবো।
চলবে……
আফরোজা খানম তন্দ্রা