এবং শেষ পর্ব
আজ তনুর কাউন্সিলিং নেয়ার শেষ দিন। এক, দুই দিন পর পরএ পর্যন্ত টোটাল পনেরোটা সেশন নেয়া হলো। সেশন টাইম পয়তাল্লিশ মিনিট নির্ধারিত। কিন্তু সানজিদা কেন যেন তনুর সাথে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই পনেরো দিনের মধ্যে একদিনও শেষ করতে পারেনি। প্রতিবার ঘন্টা পার হয়ে যায়। তারপরও যেন তনুর কথা শোনা তার শেষ হয় না। শেষ দশ মিনিট অবশ্য তনুকে চুপ থাকতে হয়। সানজিদা বলে যায়,
: তনু, আমরা একসাথে আছি কয়েকমাস হলো। আর স্পেশালি আমরা দুজন একসাথে আছি আজ একমাসের বেশি হবে। আমাদের একসাথে চলার জার্নিটা আজ হয়তো শেষ হয়ে যাবে। আমি আশা করবো আর কখনোই যেন আমার কাছে আপনাকে আসতে না হয়। তবে অবশ্যই বলে রাখি, মনের মাঝে সামান্যতম অস্বস্তি অনুভব করলে এক মিনিটও চিন্তা করবেন না। সরাসরি চেম্বারে চলে আসবেন। আমার সাথে দেখা করার জন্য আপনার কখনোই সিরিয়াল নেয়ার প্রয়োজন হবে না। কারণ, আপনি আমার মিরাকল কেস! আপনার জীবনের গল্প শুনতে শুনতে নিজেরটা মিলিয়ে নিয়েছি। আপনাকে কাউন্সিলিং করতে গিয়ে আমি নিজেকেও সংশোধন করেছি। আপনার জীবনের প্রত্যেকটা ঘটনা পৃথিবীর প্রতিটা মেয়ের সাথে কোন না কোন ভাবে মিলে যায়। অতএব আপনার কেসটা আমাদের বিশেষ করে মেয়েদের জন্য উদাহরণ স্বরূপও। আপনি যে অবস্থা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন, সেটা আসলেই অপ্রত্যাশিত। আপনার কাছ থেকে আমাদের সবার শেখার আছে।
এতোক্ষণ শান্ত হয়ে মনোযোগ দিয়ে তনু সানজিদার কথা শুনছিলো। কথাগুলি শুনছিলো সানজিদার সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে। তনুর সেই তাকানোর মধ্যে ছিলো স্বচ্ছতা। পিঠ সোজা, মেরুদন্ড টানটান করে বসা। তনুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজই বলে দিচ্ছিলো তার পরিবর্তন। তনুর বসার ভঙ্গিতেই ফিরে আসা আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট।
: আজ আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই।
সানজিদার চোখে সামান্য বিস্ময় মিশ্রিত প্রশ্ন,
: কোনটা যেন!?
এবার একটু মুচকি হেসে, আজ তনুর এই হাসির মধ্যে ছিলো আত্মবিশ্বাস। তার প্রতিটা নড়াচড়া বলে দিচ্ছিলো, যা বলছি তা আমি বিশ্বাস করি। জেনে বুঝেই বলছি। গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছে নিজের প্রতি প্রগাঢ় আস্হা। তার কথার প্রতিটা শব্দ সে উচ্চারণ করছিলো দৃঢ়তার সাথে।
: শাহেদের মৃত্যুটাকে আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই মেনে নিয়ে ছিলাম। বরং বেশ খুশি মনেই মেনে নিয়ে ছিলাম। সাত সাতটা বছর তার অমানুষিক অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ায় মনে মনে আমি খুব আনন্দিত হয়ে ছিলাম। কিন্তু বাসায় যখন আমাদের আত্মীয় স্বজনরা এলো। তারা আমার এই স্বাভাবিক আচরণকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের কাছে আমার আচরণ খুব অস্বাভাবিক মনে হওয়ায় একেকজন একেক রকমের মন্তব্য করছিলো। যারা কিনা বিগত সাত বছরে একবারের জন্যও আমার খোঁজ নেয়নি। আমি কেমন আছি? কিভাবে জীবন যাপন করছি? বেঁচে আছি? নাকি ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছি? তারাই নাকি ঐ এক মুহুর্তের আমাকে দেখায়, আমার ভুল ত্রুটির হিসাব নিকাশ করা শুরু করে দিলো!
সবাই আমাকে শাহেদের খুনি বানিয়ে ফেললো! যখন যার দিকে তাকাই তার দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিলো, “তুমি শাহেদের খুনি”। দূর থেকে কাউকে কথা বলতে দেখলেই আমার মনে হতো আমাকে নিয়ে কথা বলছে। নিজেকেও আমি শাহেদের খুনি ভাবতে শুরু করলাম। কখন, কিভাবে শাহেদকে খুন করেছি? সেটাও নিজের মনে মনে সাজিয়ে ফেললাম। এক সময়ে মনের কল্পনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলাম। কারণ অপরিচিত কাউকে দেখলেও মনে হতো, সেও আমার ভেতরের সব দেখতে পাচ্ছে। আমি খুনি। আমি শাহেদকে খুন করেছি। সাত বছরে শাহেদের অত্যাচারে আমি মানুষিক ভাবে যতটা না ভেঙ্গে পরেছিলাম, তারচাইতে বেশি ভেঙ্গে পরেছিলাম বাসায় আসা এই লোকজনদের একদিনের কথায়।
এই পর্যায়ে সানজিদা তনুর হাতের উপর হাত রেখে,
: এখনো কি আপনি তাই বিশ্বাস করেন?
তনু সানজিদার হাতের উপর নিজের আরেক হাত রাখে। ১০/১৫ সেকেন্ড এমনই ভাবে বসে থাকে। এর পর তার দুটো হাত সরিয়ে নিয়ে উঠে দাড়ায়। মুখে তার মুচকি হাসিটা তখনো লেগে রয়েছে,
: আপনি আমার হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাসটাকে ফিরে পেতে সাহায্য করেছেন। এই জন্য ধন্যবাদ।
বলে তনু নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডসেক করার জন্য। চেম্বার থেকে বের হয়ে তনু বড় আপার দিকে তাকিয়ে খুব উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
: আপা, আজ গাড়ি ছেড়ে দাও তো। চলো রিক্সায় ঘুরি।
আপা অবাক হয়ে তনুর দিকে তাকায়। তনু বেশ কিছু দিন ধরেই স্বাভাবিক আচরণ করছে। কিন্তু ঘরের বাইরে বের হতে চায় না। আজ তার কি এমন হলো যে নিজ থেকেই ঘুরতে চাচ্ছে! মনে মনে শাহেদা আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানায়।
: সেদিনের মতো করবি না তো আবার?
আপার এ কথা শুনে তনু একটু লজ্জা পেয়ে যায়। কারণ কয়েক দিন আগেই আপা তনুকে নিউমার্কেট নিয়ে গিয়েছিল কিছু কেনাকাটা করে দেয়ার জন্য। এই কয়েক মাসে তনুর ওজন কমে গেছে। পুরোনো জামা গুলো সব ঢলঢলে হয়ে গেছে। কাঁধ বেয়ে খুলে পরে যায় এমন অবস্থা। তাই নতুন কাপড়চোপড় কেনার জন্য একটা দোকানে ঢুকে ছিলো। তনু কোন কাপড় তো পছন্দ করতেই পারেনি। উল্টো টাকা হাতে নিয়ে দোকানের এককোনায় গিয়ে বসে ছিলো। ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছিলো সবার দিকে। সে কথা মনে হতেই এবার তনু একটু জোড়েই হেসে উঠে।
: আরে না না আপা কি যে বলো না! আজ অনেক কেনাকাটা করবো। দুজন মিলে এক্সট্রা ঝাল দিয়ে চটপটি খাবো। তারপর পার্লারে গিয়ে চোখে শশা লাগিয়ে দুজন একটু ঘুমিয়েও নেবো।
একথায় দুজনেই একসাথে হেসে উঠে। আপার খুব ভালো লাগতে থাকে তনুকে হাসতে দেখে। রাতেরবেলা তনু দেখে বড় আপা তার বালিশ নিয়ে তনুর রুমে হাজির। সেটা দেখে তনু একটু কপোট রাগ দেখিয়ে,
: আপা, সারাদিন তুমি আমার সাথে ছিলে। এখন আবার বালিশ নিয়ে হাজির হয়েছো? তোমার ঘটনাটা কি বলোতো? দুলাভাই এর সাথে আবারও ঝগড়া করেছো নাকি?
: আরে নাহ্। তোর সাথে ঘুমাতে ইচ্ছা করছে। তাই আসলাম।
তনু ঠিক আন্দাজ করতে পারে, আপা আজ নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন। কিন্তু জোড়াজুড়ি করে না। আজ তারা দুজনেই প্রচন্ড টায়ার্ড। তাই একপাশ হয়ে শুয়ে পরে। একটু পর আপা তনুর গায়ে একটা হাত রেখে,
: ঘুমিয়ে গেলি নাকি?
তনু পাশ না ফিরেই জবাব দেয়,
: না আপা।
: তোর বিয়ের আগেই আমি শাহেদের শারিরীক সমস্যাটা সম্পর্কে জানতাম। কিন্তু তার সমস্যা যে এতো বড় ছিলো? সেটা বুঝতে পারিনি রে বোন। চিকিৎসা করিয়েছিলাম। ও বলতো, সে ভালো হয়ে গেছে। আমি তার বড়বোন। আমার পক্ষে তো আর তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেক করে দেখা সম্ভব ছিলো না। যতটুকু সম্ভব আমি চেষ্টা করেছি। আমাকে মাফ করে দিস বোন।
তনু এবার চিত হয়ে শুয়ে তার পেটের উপর থাকা শাহেদার হাতের উপর নিজের হাতটা রেখে,
: কি বলছো এসব আপা!
শাহেদা তনুর আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে,
: বিয়ের পর তুই যেদিন আমাকে প্রথম জানালি শাহেদের ব্যাপারে? সেদিনই আমি শাহেদকে ডেকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলি। সেদিন শাহেদ আমার সাথে অনেক খারাপ ব্যাবহার করেছিলো। সে আমাকে কি বলেছিলো জানিস? তার বাসায় যেন কোনদিন না যাই। তোর সাথে যেন যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি। যদি করি তাহলে সে তোকে খুন করে সে নিজেও আত্মহত্যা করবে। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম রে বইন। শাহেদের এই ব্যাবহারে আমি এতো বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম তনু! আমার নিজের সন্তানের চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম তাকে। আর সেইই কিনা সেদিন আমার সাথে এমনটা করতে পারলো! নিজেকে কোন ভাবেই বুঝ দিতে পারিতেছিলাম না।
বলতে বলতে শাহেদার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরলো। তনু পাশ ফিরে শাহেদার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো। কিছু একটা বলতে যাবে, এমন সময় শাহেদা তনুর মুখে হাত দিয়ে,
: তনু, আমাকে থামাস না। বলতে দে। আমারও অনেক না বলা কথা আছে। কখনো কাউকে বলতে পারিনি। যেদিন প্রথম শাহেদের এই সমস্যা আমার কাছে ধরা পরলো সেদিন আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম। ভেবে ছিলাম আমার এই মা মরা ভাইটাকে না আবার হিজরারা এসে নিয়ে যায়! তাই গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসি। এরপর থেকে ভাইটা আমার কারো সাথে মিশতো না। আমিই ছিলাম তার একমাত্র আশ্রয়। সেই আমিও যদি তার সাথে অন্যায় আচরণ করি তাহলে সে কই গিয়ে দাড়াবে? কিন্তু সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত আমার অনেক বড় ভুল ছিলো। আমি যদি শাহেদের অন্যায় আবদারগুলো মেনে না নিতাম, সবার কাছ থেকে তাকে লুকিয়ে না রাখতাম। যদি তাকে বাস্তবতা শেখাতাম। তাহলে হয়তো তোর জীবনটা আজ অন্য রকম হতো। তোর সাথে যে অন্যায় আমি করেছি? তার কোন ক্ষমা নেই রে বোন। তার কোন ক্ষমা নেই।
: আপা, এসবই আমার কপালে ছিলো। আর এখন তো তোমরাই আমার জন্য যা করেছো, সেই ঋণ আমি কিভাবে শোধ করি বলো?
: তোর সাথে যে অন্যায় আমি করেছি। তার কাছে এটা কিছুই না রে। কিছুই না।
: অনেক কিছু আপা।
তনু এবার বেশ ধমকের সুরেই,
: আপা, কাল আমার কলেজের প্রথম ক্লাশ। তোমার এসব কথা আজ আর শুনবো না। অন্যদিন হবে না হয়। আজ ঘুমাতে দাও তো। তুমি প্লিজ দুলাভাইয়ের কাছে যাও। সারারাত কিছুক্ষণ পর পর তোমার এই ফ্যাচফ্যাচ করে কান্নার শব্দ আমি সহ্য করতে পারবো। আমি এখন ঘুমাবো। কালকের ক্লাশে আমি কিছুতেই দেরি করে যেতে চাই না। কালকের দিনটা আমার জন্য বিশেষ দিন আপা।
বলতে বলতে তনুর গলাও একসময় ধরে আসে। পরদিন সকালে তনু বড় দুলাভাই এর সাথে বের হয়। অফিস যাওয়ার পথে দুলাভাই তনুকে কলেজে ড্রপ করে দিয়ে যাবে। যাওয়ার আগে তনু বড় আপাকে সালাম করতে নিচু হয়। শাহেদা তনুকে দুহাতে টেনে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে,
: আজ তোকে দেখে খুব ভালো লাগছে। শান্তি লাগছে। আমার ভাইটা যে বেঁচে নেই, তার জন্য কোন আফসোস হচ্ছে না। শাহেদের মৃত্যুটা খুব প্রয়োজন ছিলো রে বোন। বোন হয়ে ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলতে হবে, জীবনেও ভাবিনি। কিন্তু কথাটা যে কতটুকু সত্য! এবং বোন হিসেবে বলতে পারাটা ততটাই কষ্টের।
বলতে বলতে শাহেদা চোখ মুছতে থাকে। তনু মুখে কিছু বলে না। নিরবে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। কলেজে নামার আগে দুলাভাই তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে,
: যা মা, মন দিয়ে লেখাপড়াটা আবার শুরু কর।
তনু এবারও কিছু বলে না। গাড়ি থেকে নেমে কলেজ গেটের দিকে পা বাড়ায়। তনু মাথা উঁচু করে ধীর পায়ে হেঁটে যায়।
আজ তনু নিজের বাসায় উঠবে। অনেক ঝামেলার পর আপা, দুলাভাইকে তনু রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে। প্রথমে তারা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না।
: কেন আপা, আজ আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে কি একা থাকা নিয়ে এতো জটিলতার সৃষ্টি হতো?
এরপর অবশ্য তারা আর আপত্তি করেনি। তাছাড়া কয়েকদিন পর পরই তারা দুজনেই তনুর সাথে তার বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করতে চায়। তনুর প্রচন্ড বাঁধার সামনে অবশ্য সেই আলোচনা বেশি দূর আগায় না। কিন্তু মাঝে মধ্যেই আপার বাসায় মুরুব্বি টাইপ কয়েকজন মেহেমান চলে আসে। তাদেরকে আবার বেড়ে খাওয়ানোর দায়িত্ব তনুর উপর পরে। আপা, দুলাভাই দুজনকেই তাদের সাথে গদগদ হয়ে আলাপ করতে দেখা যায়। আর তারা তনুকে একসময় জিগ্যেস করেন,
: লেখাপড়া শেষ করে তুমি কি করতে চাও মা?
অথবা আপা, তনু, দুলাভাই তিনজন মিলে হয়তো কোন রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে গেলো? সেখানে অবশ্যই একজন দুলাভাইয়ের পূর্ব পরিচিত লোকের সাথে হঠাৎই দেখা হয়ে যায়। যার সাথে তনুকে হেসে হেসে কথা বলতে হয়।
এসব যে তনু একেবারেই বুঝে না, তা নয়। তনু সবই বোঝে। কিন্তু তনু যে সব বুঝতে পারছে? সেটা আবার আপা, দুলাভাই বুঝতে পারে না। এমনই অনেক কারনেই তনু কিছুদিন একা থাকার জন্য নিজের বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। আপাদের অবশ্য তনু অন্য কথা বলে ম্যানেজ করে। তনু আসলে নতুন জীবন শুরু করার জন্য এই মুহুর্তে একদমই তৈরি নয়। জীবন নিয়ে আরেকজনের দেয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভুল একবার সে করেছে। সেই ভুলের খেসারত তাকে দিতে হয়েছে কড়ায়গণ্ডায়। তার জীবন থেকে সাত সাতটা বছরের চমৎকার সময় কেড়ে নিয়েছে ঐ একটা ভুলের কারণে। এবার সে চিন্তা ভাবনা করে, সময় নিয়ে তারপরই সিদ্ধান্ত নেবে। অবশ্যই সিদ্ধান্তটা হবে তার নিজের।
সেই যে বড় আপা তনুকে তার বাসা থেকে নিয়ে গিয়েছিলো। কতদিন? কত মাস? নাকি বছর হতে চললো? আজ আর তনু সময়ের হিসেব করতে যায় না। এর মধ্যে আপা লোক পাঠিয়ে ঘর পরিস্কার করার ব্যবস্হা করেছেন। আপা অবশ্য তনুর এই সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। তনুর যুক্তির কাছে অবশেষে হার মানতে হয়েছে। তনু বাসায় ঢুকে আলমিরাতে নিজের কাপড়গুলি গুছিয়ে রাখে। পাশেই শাহেদের শার্টগুলি হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। থাকের উপর আয়রন করা প্যান্টগুলি ভাজ করা। তনু কাপড়গুলির উপর আলতো করে হাত বুলায়।
বাথরুমে ঢুকে ব্রাশ রাখতে গিয়ে কোনার ছোট্ট লাল টুলটার দিকে চোখ যায়। শাহেদ মাঝে মধ্যেই তনু বাথরুমে ঢুকলে বাইরে থেকে ছিটকিনি আটকে দিতো। কতক্ষণ পর অবশ্য খুলেও দিতো। একদিন বাজার থেকে কিসের সাথে যেন এই টুলটা ফ্রী দিয়েছিলো। টুল পেয়ে তনু খুব খুশি হয়ে ছিলো। টুলটা বাথরুমে রেখে ছিলো। যেন দীর্ঘ সময় তাকে ফ্লোরে বসে থাকতে না হয়। তাছাড়া ভেজা ফ্লোরে বসে থেকে থেকে ঠান্ডাও লেগে যেতো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আঁচড়াতে গিয়ে আয়নার ভাঙ্গা কোনাটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। কতদিন যে কপালের ঐ কালশিটে দাগটাকে চুল দিয়ে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা সে করেছে। ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে তনু শাহেদের চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।
: শাহেদ, তুমি যখন বেঁচে ছিলে? তখন তুমিই আমার মৃত্যু কামনার একমাত্র কারণ ছিলে। আজ তুমি বেঁচে নেই। কিন্তু জানো? তুমিই আমার বেঁচে থাকার কারণ? হ্যা, তোমার মৃত্যু আজ আমার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ। তোমার বিবাহিত স্ত্রী হিসেবে নয় বরং তোমার বৈধব্য হিসেবে বাঁচতেই বেশি পছন্দ করবো আমি।
“বৈধব্য সবার জন্যই কষ্টের কারণ নয়।
অনেক সময়, কারো কারো জন্য
বড্ড কাংখিতও বটে।”
সমাপ্ত
আফরোজা খানম তন্দ্রা