#তানিশা সুলতানা
দুই মাস দশ দিন হলো তন্নির হাসপাতাল জীবনের। আয়নার সামনে দাঁড়ানো হয় না অনেক দিন। নিজেকে দেখা হয় না। বাইরের আলো বাতাসে মন প্রাণ জুড়ানো হয় না। কলেজে যাওয়া হয় না। এইচএসসি পরীক্ষা চলছে৷ তন্নি পরিক্ষা দিতে পারলো না। অথৈও পরিক্ষা দিলো না।
তন্নি বার বার বলেছিলো অথৈকে। কিন্তু তার এক কথা “আমি পরিক্ষা দিবো না”
অথৈকে সাপোর্ট করেছে সাগর। সে বলেছে “ঠিক আছে দিতে হবে না”
এই দুই মাসে পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক কিছু। লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের অর্ণব আর আগের মতো সুন্দর নেই। সারাক্ষণ পরিপাটি হয়ে থাকা ছেলেটা অগোছালো হয়ে গেছে। সেলুনে যায় না অনেক দিন। দাঁড়ি বড়বড় হয়ে গেছে। চুল গুলে ঘাড় ছাড়িয়ে পড়ছে। ফর্সা চেহারা কালো হয়ে গেছে। তাছাড়াও অথৈ তারেক আর্থি সাগর এবং ডাক্তার রিজুয়ানের চেহারায়ও অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। কাউকে হাসতে দেখে না তন্নি। কেউ হাসে না। তারা কি হাসতে ভুলে গেছে?
এক আকাশ সমান পরিমাণ আফসোস তন্নির। জীবনটা এমন না হলেও পারতো।
তামিম প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল বিকাল বসে থাকে তন্নির পাশে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে চুমু খায়। তন্নি শান্তি পায় না। তবুও ভাইকে বুকে জড়িয়ে নেয়। তন্নির নানু বাড়ির সবাই রোজ এসে দেখে যায়।
তাচ্ছিল্য হাসে তন্নি।
এতোদিন কেউ ছিলো না। কিন্তু এই শেষ সময়ে সবাই ছুটে এসেছে। ভালোবাসা দিচ্ছে। লোভ জাগাচ্ছে। বাঁচার ইচ্ছে বাড়িয়ে তুলছে। এটা কি তারা ঠিক করছে?
তন্নি শুনেছে তার যে রোগ হয়েছে এই রোগে মানুষ বাঁচে না। মরণব্যাধি হয়েছে তার। সে বাঁচবে না। শুধু শুধু লোভ বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।।
দুই চোখ ভরে আসে তন্নির। দুই হাতে মাথা ধরে উঠে বসে। চুলে হাত দিতেই এক গুচ্ছ চুল হাতের সাথে চলে আসে।
তন্নি চুলের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে ওঠে
“আমার সময় বুঝি ঘনিয়ে এসেছে?”
তখনই কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে ডাক্তার রিজুয়ান। সে যখনই তন্নির কেবিনে ঢোকে মুখে মিথ্যে হাসি ঝুলিয়ে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বেশিখন থাকে না তার হাসি।
“তোমাকে না বলেছি পাকনামি করবা না। উঠেছো কেনো?
চোখ পাকিয়ে বলে রিজুয়ান। তন্নি মুচকি হাসে
” ভাইয়া আমার এখানে আর ভালো লাগছে না। একটু বাইরে নিয়ে যাবেন আমায় প্লিজ?
রিজুয়ান কিছু একটা ভাবে। তারপর বলে
“শিওর যেতে চাও?
তন্নি মাথা নারায়।
” জাস্ট ফাইভ মিনিট
আমি হুইল চেয়ার আনছি।
রিজুয়ান যেতে নেয় তন্নি বলে ওঠে
“অর্ণব কোথায়?
রিজুয়ান দাঁড়িয়ে যায়। পেছন ঘুরে তাকায় তন্নির দিকে। বুঝে যায় তন্নি অর্ণবের সাথে বেরতে চাইছে।
” চলে আসবে
বলেই চলে যায়। তন্নি দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। কখন আসবে? কতোখন লাগবে? সেই সকালে দেখেছিলো। এমন তো করে না সে। তাহলে আজকে কেনো করছে? সে কি বিরক্ত হয়ে উঠেছে তন্নির প্রতি? তন্নিকে ভালো লাগছে না?
চোখ দুটো টলমল করে ওঠে তন্নির। নিশ্বাস আটকে যেতে থাকে। অর্ণবের বিরক্তির কারণ সে কখনোই হতে চায় না।
রিজুয়ান চলে আসে। তন্নির হাত ধরে তাকে চেয়ারে বসায়। হাত পা শুকিয়ে গেছে তন্নির। একা একা হাঁটার শক্তি নেই।
তখনই সাগর ঢোকে। হাতে তার টিফিন বক্স। তন্নির জন্য খাবার এনেছে সে।
তন্নি নাক মুখ কুঁচকে ফেলে। এখন আবার খেতে হবে?
তন্নির এই খারাপ লাগা বুঝতে পেরে রিজুয়ান বলে ওঠে
“পরে খাবে। আগে ঘুরে আসুক।
সাগর কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে তন্নির দিকে। বলতে দ্বিধা নেই এই মেয়েটাকে সাগর এখনো প্রচন্ড পরিমাণ ভালোবাসে৷ তন্নির অসুস্থতা যত বাড়ছে সাগরের ভালোবাসাও ততবাড়ছে। এই ভালোবাসাতে চাওয়া পাওয়ার হিসেব নেই। নেই কোনো চাহিদা। আছে শুধু সীমাহীন মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা।
ইদানীং অসহায় লাগে খুব। অথৈয়ের সামনে যেতে পারে না। অথৈও শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা নেই সাগরের।
এসব কবে ঠিক হবে? কবে সবটা আগের মতো হয়ে যাবে? আবার কবে সবাই হাসবে? কবে সবাই মজা করবে?
হাসপাতালের সামনে বিশাল বড় মাঠ। তন্নি বুক ভরে শ্বাস নেয়। আহহহা কতোদিন পরে আলো বাতাস খাচ্ছে।
তন্নির চুল গুলে এলোমেলো হয়ে আছে৷ রিজুয়ান একটু সাহস নিয়ে চুলে হাত দেয়। হাত জোড়া কাঁপছে তার।
তবুও সে কাঁপা কাঁপা হাতে খোঁপা করে দেয়।
তন্নি তাচ্ছিল্য হেসে বলে
” আমাকে আপনিও খুব ভালোবাসেন তাই না?
রিজুয়ান চমকে ওঠে। তন্নির সামনে ঘাসের ওপর বসে।
“আমি জানি। বুঝতে পারি। এতো বড় একজন ডাক্তার আপনি। সব পেশেন্ট ফেলে আমার পেছনেই পড়ে থাকেন। আমার শরীরে সুচ ফুটাতে গিয়ে হাত কাঁপে আপনার।
রিজুয়ান মাথা নিচু করে ফেলে।
” আমার সময় যত ঘনিয়ে আসছে মানুষ আমাকে তত ভালোবাসছে। কেনো বলুন তো? মায়া বাড়াচ্ছেন কেনো?
একটা সময় ছিলো যখন আমার এই দুনিয়াতে আপন বলতে কেউ ছিলো না। এই যে আমি অসুস্থ। মায়ের হাতে মাইর খেতে খেতে।
জীবনে অনেক কষ্ট করেছি আমি। কেউ এগিয়ে আসে নি। কেউ ভালোবেসে বুকে জড়িয়ে নেয় নি। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নি।
কিন্তু আজকে
রিজুয়ান বলে
“মানুষের মৃত্যুর কথা কেউ বলতে পারে না। এতোটাও সিরিয়াস কেনে রোগ হয় নি তোমার। সারাক্ষণ এসব ভাবো বলেই চুল পড়ে যাচ্ছে তোমার। কনফিডেন্স রাখো।
তন্নি আর কিছু বলে না। চুপ করে যায়।
অর্ণব অফিসে গেছে। কালকে তন্নির অপারেশন। অনেক অনেক টাকা লাগবে। বিদেশ থেকে ডাক্তার আসছে দুটে। অর্ণব তাদের দিয়ে তন্নির সার্জারী করাবে। বাংকে অর্ণবের নামে যত টাকা ছিলে সব তোলা হয়ে গেছে।
এখন অফিসের সবার থেকে দোয়া চাইতে এসেছে। পথ শিশুদের খাবার খাইয়েছে। যত গুলো মাজার ছিলে সব মাজারে গিয়েছে৷ প্রত্যেকটা মসজিদে পাঁচটা করে কুরআন শরীফ কিনে দিয়েছে।
রাস্তায় হুজুর টাইপের যত মুরব্বি ছিলো সবার কাছে দোয়া চেয়েছে।
তার তন্নিকে বাঁচাতে হবে। ভালো করে তুলতে হবে।
অবশেষে সব কাজ সেরে অর্ণব হাসপাতালে আসে। গাড়ি থেকে নামতেই দেখতে পায় তন্নি মাঠে। তার সাথে রিজুয়ান। অর্ণব দুই হাতে কপালের ঘাম মুছে তন্নির দিকে এগিয়ে যায়।
” মায়াবতী
তন্নি ফট করে মাথা তোলে। অর্ণবকে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। খুশিতে চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে। তন্নি হাত বাড়িয়ে দেয় অর্ণবের দিকে
“কোথায় ছিলেন আপনি? সকাল থেকে একবারও আমার কাছে আসলেন না যে? কতো মিস করেছি আমি।
অর্নব তন্নির হাত ধরে বসে৷ রিজুয়ান উঠে যায়। ওদের স্পেস দেওয়া দরকার।
অর্ণব তন্নির হাতে চুমু খেয়ে বলে
” একটু কাজ ছিলো। এখানে এসেছো যে?
“রিজুয়ান ভাইয়াকে বললাম। আর উনি নিয়ে আসলো।
অর্ণব তন্নির চোখের দিকে তাকায়।
” আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি তন্নি। খুব ভালোবাসি তোমায়।
তন্নি অর্ণবের ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। নিজের মুখটা এগিয়ে এনে চুমু খায় অর্ণবের কপালে।
তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে
“আমিও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি অর্নব। আপনাকে ছেড়ে যেতে চাই না। আমাকে আগলে রাখুন না প্লিজ। কোথায় যেতে নিয়েন না। বাঁচিয়ে দিন আমায়।
” ইনশাআল্লাহ
আমরা আলাদা হবো না। আল্লাহ আমাদের নিরাশ করবেন না।
চলবে
……………….