#ফিজা_সিদ্দিকী
#পর্ব_৮(প্রণয়ালগ্ন)
বাইরে ঝোড়ো হাওয়া দিচ্ছে। পরিবেশে শীত শীত ভাব। রুমের লাইট অফ করে বিছানার একপাশে শুয়ে আছে নম্রমিতা। থেকে থেকে গাল বেয়ে গড়ানো জল বালিশ ছুঁয়েছে। রাফিদ রুমে ঢুকে খানিকটা অবাক হয়। অন্ধকারের মাঝে কিছু টের পাওয়া দায়। কিছুটা সময় হাতড়ানোর পর এক এক করে খুলে দেয় রুমের সব দরজা জানালা। দমকা বাতাসে চেয়ে যায় ঘর। বাইরের আলোতে আবছা দেখা যাচ্ছে নম্রমিতাকে। গলা পর্যন্ত কাঁথা টেনে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সে। রুমের ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে নম্রমিতার পাশে শুয়ে পড়ে রাফিদ।
“নম্র!”
কোনোরূপ প্রতিউত্তর আসেনা ওপাশ থেকে। অথচ রাফিদ বেশ টের পাচ্ছে নম্রমিতা জেগে আছে। মাঝের কোলবালিশটা একপাশে সরিয়ে রাফিদ খানিকটা এগিয়ে যায় নম্রমিতার দিকে। একহাতে গলা পর্যন্ত ঢেকে রাখা কাঁথা নামিয়ে দেয় কোমরের কাছে।
“এই নম্র! আমি সরি।”
“নম্র তাকাও এদিকে। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। বিশ্বাস করো ভুল করে..”
“হ্যা ভুল করেই তো। ভুল করে আমাকে বিয়ে করেছেন। ভুল করে আমাকে আপনার দয়ায় থাকতে দিয়েছেন। ভুল করেই আমাকে নিজের স্ত্রীর পরিচয় দিতে হচ্ছে। ভুল করে একটা বিধবা মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। সবই তো ভুল। আসল ভুলটা ঠিক কোথায় হয়েছিলো জানেন! সবচেয়ে বড়ো ভুল আপনার আর আমার পরিচয়। তার চেয়েও বড়ো ভুল আপনাকে ভালোবাসা। এটা না হলে জীবনটা কতো সহজ হতো। এই আপনি নামক মানুষটাকে না ভালোবাসলে আমার বাবা অপরাধবোধে শেষ হতেন না। আমি অনাথ হতাম না। আর না কখনও দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে হতো।”
থামে নম্রমিতা। দুই চোখের কার্নিশ বেয়ে উপচে পড়া জল মুছে ফেলে ঘুরে তাকায় রাফিদের দিকে। অতঃপর জোরে নিঃশ্বাস টেনে আবারো বলে ওঠে,
“ঠিকই বলেছো তুমি, এটা তো আর আমার নতুন বিয়ে নয়! এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। তাইতো বিয়েতে মেহেদী পরিনি। বাসরঘর নিয়ে মাতামাতি করিনি। এমনকি এতদিনে একবারের জন্যও রাস্তার ওপাশের ফুচকার দোকানেও যাইনি। অসহায় এক বিধবাকে কেউ বিয়ে করেছে এইতো ঢের। আমাদের আবার সখ থাকতে আছে নাকি! চিন্তা নেই, সখগুলোকে আমি নিজের হাতে গলা টিপে মেরে ফেলেছি। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো। আমার জন্য কোনো বাড়তি খরচ তোমার হবেনা।”
“আমি সরি নম্র। ওভাবে বলতে চাইনি তোমাকে। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার কথা তো আমি স্বপ্নেও ভাবিনা। তোহাকে না পাঠানোর বাহানা দিতে গিয়ে কখন যে তোমাকে আঘাত দিয়ে কথা বলে ফেলেছি, আমি সত্যিই ইচ্ছে করে বলিনি। প্লীজ কান্না করোনা।”
“কষ্ট দেওয়ার অজুহাতে যাকে ঘরে তুলে এনেছ, তাকে কষ্ট দিতে চাওনি! ব্যাপারটা হাস্যকর নয় কি!”
বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায়না রাফিদ। আজকের করা এত বড়ো একটা ভুলের জন্য নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবেনা সে। নম্রমিতা যে অনেকটা কষ্ট পেয়েছে তা বেশ বুঝতে পারছে রাফিদ। কিন্তু সে তো ইচ্ছে করে করেনি। তাছাড়া নম্রমিতার দেওয়া আঘাতের কাছে তো এ আঘাত যৎসামান্য। সে তো দুইটা বছর কষ্ট যন্ত্রণায় জর্জরিত হয়ে কাটিয়েছে। প্রতিটা মুহুর্তেই যখন মনে হতো তার নম্রমিতাকে অন্যকেউ ছুঁয়ে দিচ্ছে, দমবন্ধ হয়ে আসতো। পাগল পাগল লাগতো নিজেকে। বাইরে থেকে নিজেকে শক্ত রাখলেও ভেতরে ভেতরে প্রতিনিয়ত ভেঙেচুরে যেত। নম্রমিতা তো সে ব্যথার এক অংশও পায়নি। তবে আজ নাহয় কিছুটা ব্যথা সয়ে নিক। বুঝুক ঠিক কতটা কষ্টে কেটেছে তার দিনগুলো।
৯.
আজ অফিস থেকে বেশ খানিকটা লেট করেই বের হয়েছে রাফিদ। পেন্ডিং কাজ ছিল বেশ কিছু। যেহেতু আগামী সপ্তাহে সে থাকছেনা, তাই ওভারটাইম করতে হবে কয়েকদিন। অফিস থেকে বের হয়ে সামনে দাড়ানো আরুশিকে দেখে বেশ খানিকটা চমকায় রাফিদ। আরুশির এখানে আসার কোনরকম কারণ খুঁজে না পেয়েও ভদ্রতার খাতিরে এগিয়ে যায় সেদিকে।
“তুমি এখানে! কোনো কাজ ছিলো?”
“আসলে আপনার থেকে কিছুটা সময় চাই ভাইয়া। কিছু কথা বলার ছিল।”
খানিকটা অবাক হয় রাফিদ। আরুশির কি এমন কথা আছে, যা বাড়িতে বলা যাবেনা! ভেবে পায়না সে।
কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে দুজনে। আরুশি বেশ কিছুক্ষণ ধরে আনচান করছে হয়তো কিছু বলার জন্য। কিছুটা অপ্রস্তুত অনুভব করছে রাফিদও। আরুশির সাথে সেভাবে সখ্যতা কখনোই গড়ে ওঠেনি তার। তবে হুট করে কী বলতে চায় সে!
“আপুর বিয়ের কয়েকমাস পর থেকেই বাবা অসুস্থ হতে শুরু করেন। ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিলেন ভীষণভাবে। কোনো এক অপরাধবোধ যেনো কুরে কুরে খেয়ে ফেলছিলো তাকে। একদিকে আপু ভালো নেই, আদিল নামক জানোয়ারের আরো একটা রূপ ছিলো ভেতরে ভেতরে। বহু নারীতে আসক্ত ছিলো সে। মাঝে মাঝেই বেশ মারধর করতো আপুকে। প্রাথমিকভাবে আপু বাড়িতে না জানালেও কয়েকমাস পর জানাজানি হয়ে যায়। সেই থেকেই বাবার ভেঙে পড়ার সূচনা। সবার ধারণা ছিল আপুর চিন্তায় বাবার এ অবস্থা। অনেক ডাক্তার দেখানো হয়, কিন্তু বাবা আর সুস্থ হয়না।”
জোরে দম নেয় আরুশি। গলা ভেঙে আসছে। বাবার কথা মনে হলেই হু হু করে কেঁদে ওঠে বুক। রাফিদ পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় আরুশির দিকে। ঢক ঢক করে পুরো পানি শেষ শেষ করে নিজেকে শান্ত করে আরুশি। অতঃপর আবারো বলে উঠে,
“মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগে বাবা আমাকে ডেকে পাঠান নিজের রুমে। বহুদিন পর অনেক কষ্টে আদুরে হাত তুলে দেন মাথায়। ততদিনে বিচানাসজ্জায় তিনি। বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তার দিন ফুরিয়ে আসছে। তাইতো, হুট করেই ডেকে পাঠিয়ে গছিয়ে দেন এক বিশাল দায়িত্ত্ব। অনেকটা বড়ো এক দায়িত্ত্ব। ঠিক সেদিনই জানতে পেরেছিলাম আপনার কথা। আপুর ভালোবাসার কথা। আর আপনাদের বিচ্ছেদের কথা। বাবা আমাকে দ্বায়িত্ব দেন, কখনও যদি আপনার সাথে দেখা হয় তবে যেনো সব সত্যিটা জানিয়ে দিয়। এতে কিছুটা হলেও তার অপরাধ কমবে।”
একে একে সব ঘটনা শোনার পর থমকে যায় রাফিদ। বিস্ময়ে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরুশির দিকে। এ কোন অজানা অতীত জানলো সে! কেনো জানলো সে! নম্রমিতার প্রতি হওয়া অন্যায়ের অপরাধে সেও যে জর্জরিত হয়ে গেলো! এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকে সে নম্রমিতা। অথচ তাকেই এতগুলো দিন অবহেলা করে এসেছে সে! প্রতিনিয়ত লাগামহীন কথার মাধ্যমে অপমান করেছে। আরো বেশি করে কষ্ট দিয়েছে। তার তো প্রয়োজন ছিল নম্রমিতাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসার, আগলে রাখার।
আনমনে ড্রাইভ করছে রাফিদ। মাথায় ভর করে আছে হাজারো চিন্তা। অপরাধবোধে ভুগছে ভীষণভাবে। দূরে একটা ফুলের শপ দেখে গাড়ি দাঁড় করায়। কিছু জিনিস কিনে আবারো গাড়ি স্টার্ট দেয় রাফিদ। ঠোঁটের কোণে লেগে আছে তার ক্ষীণ হাসি।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে নম্রমিতা। পরনে কালো শাড়ি। আপনমনে চুলে চিরুনি চালাতে ব্যাস্ত সে। আচানাক কারো স্পর্শে কেঁপে ওঠে নম্রমিতা। নম্রমিতার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে রাফিদ। বাম হাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নম্রমিতার কোমর। আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিতে নম্রমিতা তাকায় আয়নার দিকে। রাফিদকে ভীষণ অন্যরকম লাগছে আজ। ভীষণ উস্কখুস্ক অথচ স্নিগ্ধ। নম্রমিতাকে ছেড়ে রাফিদ ব্যাগ থেকে কিছু একটা বের করে আবারও এসে দাঁড়ায় তার পিছনে। নম্রমিতা কিছু বলার চেষ্টা করলে তাকে থামিয়ে দেয় রাফিদ। চুলগুলো মুঠো করে হাতখোঁপা করে জড়িয়ে দেয় বেলি ফুলের মালা। হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে নম্রমিতা। চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে রাফিদের দিকে ঘুরতেই একে একে দুই হাতে পরিয়ে দেয় বেলি ফুলের মালা। একের পর ঘটনায় বিস্ময়ে হতবাক নম্রমিতা। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ইতিমধ্যে সাদা গোলাপ হাতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে রাফিদ। নতশিরে গোলাপটা এগিয়ে দেয় নম্রমিতার দিকে। অতঃপর মুগ্ধতার সুরে বলে ওঠে,
“হৃদপিঞ্জরে রেখে যেত চিঠি, মনের কবুতরে।
অবহেলার ভূমিতে ঝরঝরে মাটি;
দিয়েছে ঠেসে ঘুলিমলিন ডাকবাক্স।
মাঝদরিয়ায় ঝোড়ো উত্তালে না ডোবা নাবিকের, ডুবেছে নাই তোমার ওই অতল গভীর চোখের নেশায়।
চলো আজ হই মাতোয়ারা;
ঠোঁটে ঠোঁটে ডুবে, দিয়ে ফেলি সাড়া।”
#চলবে!