পরীক্ষার হলে আমার পাশের সিটে কখনো শাবানা বসেনি, সবসময় রিনা খান জুটেছে
……….
…………….
গণিত বই আসলে একটা থ্রিলার বই। এখানে শ্রমিক হুট করে কাজ ছেড়ে চলে যায়! মেসে হঠাৎ করেই নতুন ছাত্র আসে। চৌবাচ্চা ফু’টো হয়ে যায়! মাঝি স্রোতের বিপরীতেই নৌকা চালায়!
………………………
……………..
.
এসএসসিতে অংক পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছি। বাবা গেইটের বাইরে দাঁড়ানো। জিজ্ঞেস করলেন,” কেমন পরীক্ষা হয়েছে?’ আমি ভাব নিয়ে বললাম,”চমৎকার”। বাবা বেশ খুশি হয়ে আমাকে পনেরো টাকার ঝালমুড়ি কিনে দিলেন। পর মুহূর্তে কোত্থেকে পরীক্ষার হলে পাশে বসা আঁতেল বন্ধু দৌড়ে এসে চিৎকার করে জড়িয়ে ধরে বলল,”দোস্ত আমাদের তো ‘মনে হয়’ দুইটা অংক ভুল হয়েছে!”
দুটো অংক মানে দশ-দশ করে বিশ মার্ক। পিছনে বাবা দাঁড়ানো। কিচ্ছুক্ষনের জন্য আমার আর বাবার চোখাচোখি হলো। আমি দৃষ্টি নামিয়ে ফেললাম। পুরো রাস্তা বাবা রিকশায় কোনো কথা বললেন না। শখের ঝালমুড়ি আমার গলা দিয়ে নামলনা। বাসায় পৌঁছানোর পর বাকিটা ইতিহাস। বড়াই করছিনা,কিন্তু সেবার রেজাল্ট দেয়ার পর আমার অংকে নিরানব্বই মার্ক এসেছিল।
মানুষের এই “মনে হয়” আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। বেশির ভাগ সময় যখন পরীক্ষার হলে খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে কিছু একটা লিখতে গিয়েছি, আশেপাশে কোথা থেকে জানি কিভাবে কিভাবে “মনে হয় এটা হবে না” বলে কেউ না কেউ লাফিয়ে উঠেছে। সাথে সাথে বিচার বিশ্লেষণ শুরু হয়ে গিয়েছে আমার। পরে দিয়ে দেখা গিয়েছে , হয় উত্তর ভুল লিখে দিয়ে এসেছি,আমারটাই ঠিক ছিল নয়তো শুধু শুধুই সময় নষ্ট করেছি জানা জিনিসের পিছে।
“মনে হয় “কথাটা খুব ভয় পাই আমি । দাদির কাছে শুনেছি ,আমার জন্মের আগে নাকি বাবা মা একবার “মনে হয় ছেলে হবে বলে”,আরেকবার “মনে হয় মেয়ে হবে” বলে বিশাল ঝগড়া করেছিলেন। আর জন্মানোর পর থেকেই তারা “মনে হয়” মেয়ে হলে ভালো হতো বলে পচানি খাওয়াচ্ছেন আমাকে।
কলেজে উঠার পর একদিন মার পাশের বাসার ভাবি চুপি চুপি এসে মার কানে কানে বলে গেলেন, “ভাবি আপনার ছেলেকে তো মনে হয় সিগারেট টানতে দেখেছি বাইরে। চেহারাটা ওর মতোই ছিল ‘মনে হয়’।ছেলের উঠতি বয়স। খেয়াল রাখবেন।”
মা এরপর বহুদিন যাবৎ আমার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেননি এবং সিআইডির রূপ ধারণ করেছিলেন। আমি কিভাবে হাঁটছি কিভাবে ঘুমাচ্ছি সব দেখতেন। এমনকি আমি বাথরুমে বেশিক্ষন থাকলেও মা বাইরে থেকে “কি করছি” বলে ডাক দিতেন। আমি তখন উত্তর দিতাম- “বিরিয়ানি খাচ্ছি। তুমি খাবে?”
এই “মনে হয়” এর জোরে মানুষের মুখে মুখে আমার ক্ষুদ্র জীবনে চার পাঁচটা প্রেম হয়ে গেছে। কিন্তু সেসব প্রেম আমার করা হয়নি,সবসময় শুধু সব কাহিনী “মনে হয় অমুকের সাথে প্রেম করে” তেই সীমাবদ্ধ ছিল। কলেজ জীবনে একবার এক বোন সমতুল্য বান্ধবীর সাথে রিকশায় করে বাসা পর্যন্ত এসেছিলাম। সন্ধ্যা নাগাদ “মনে হয়” এর জোরে মা-বাবার কানে এসে সে খবর পৌঁছালো। বাবা-মা ভাবলেন ছেলে ‘মনে হয়’ বিগড়িয়ে গেছে। মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ভার্সিটিতে উঠার পর শহরের বাইরে চলে গেলাম।কিছুদিন শান্তিতে ছিলাম। তাও বাঙালি জীবনে মনে হয় এর জোরে কানাঘুষা হবেনা তা তো হয়না।অনেক রাজনৈতিক চক্রে পর্যন্ত পড়েছি আমি। শুধু পরিবারের চাপ ছিলোনা, এটাই সান্তনা। শান্তির জীবন ছেড়ে এরপর প্রথমবার যখন বাড়িতে আসলাম,তখন একদিন বিকালে শুনলাম পাশের বাসার সেই বিখ্যাত আন্টি আমার মাকে বলছেন,” ছেলের চুল দাড়ি এত লম্বা কেন। সাবধানে রাখবেন ভাবি। মনে হয় হাওয়া লেগেছে। ছেঁকা খেয়ে পড়ে কবি হবে আর নেশা করবে। একলা ছেলে বলা তো যায়না।”
ভদ্রমহিলা যাওয়ার পর আমার মা একঘন্টা যাবৎ আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।
গ্রেজুয়েশন এর পর অনেক খাটাখাটুনি করে একটা ভালো চাকরি যখন হলো তখন এলাকায় শোনা গেল, আলম সাহেবের ছেলে “মনে হয়” ঘুষ দিয়ে বেতন পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা,আলম সাহেবের একটি মাত্র পুত্রমশাই আমি।
এই “মনে হয়” দিয়েই অর্ধেক জীবন পাড় করে ফেলেছি।এখন আপাতত একটা সোফায় বসে বসে অপেক্ষা করছি আর এগুলো ভাবছি। সামনে টি টেবিলে নানারকমের নাস্তার সমাহার। আশেপাশে মুরব্বিরা আমার বিয়ের কথা বার্তা বলছেন। আমি কনে দেখার জন্য বসে আছি। যদিও মেয়েকে দেখার কিছু নেই। সবকিছু আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মেয়ে আমার পরিচিত। নীরা নাম তার। নীরাকে পছন্দ করেছি চাকরি সূত্রে । মেয়েটা বেশ ভদ্র,যোগ্য ও রুচিশীল। হালকা শ্যামলা বর্ণ, টানা টানা চোখ। বেশ পরিশ্রমী মেয়ে। সবকিছু বাদ দিয়ে কথাবার্তা শুনলেই মেয়েটির প্রেমে পড়া যায়। দুজনের মতেই বিয়ে ঠিক হচ্ছে।
.
সবকিছু যখন একদম ঠিক ঠিক তার আগে বাবা-মা একদিন আমাকে ডাকলেন। আস্তে ধীরে বললেন ,”নীরা মেয়েটার চরিত্রে মনে হয় সমস্যা আছে।তুই অন্যকাউকে পছন্দ কর।” আমি স্থির দৃষ্টিতে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করলাম,” মেয়েটার চরিত্র খারাপ প্রমান কি?” তারা আমাকে প্রমাণ দেখাতে পারলোনা। মেয়ের দোষ একটাই মেয়ে নাকি আড়ালে চলে।তাও এগুলো শোনা কথা। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা-মাকে বললাম,” মনে হয় দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায়না। আমি যেমন আমার সহধর্মিণীও তেমনই হবে। আর যাই হোক ,আমি শুধু “মনে হয়” দিয়ে একজন মানুষকে বিচার করতে পারবোনা,তার জীবন ধ্বংস ও করতে পারবোনা।বিয়ে করলে আমি নিরাকেই করবো।”
.
রাত বাড়ছে । একমাস পর আমার আর নীরার বিয়ে। অনেক অমত ঠেলে সব ঠিক হয়েছে। একটু আগে নীরার সাথে ফোনে কথা হয়েছে। আমার “মনে হয়” এর থিউরি আর জীবন বৃত্তান্ত শুনে মেয়েটা হাসতে হাসতে শেষ। তার হাসি থামেনা। হাসতে হাসতেই বিদায় দিয়ে ফোন রেখেছে। মেয়েটার গলার স্বর যতটুকু না সুন্দর,তার চেয়েও বেশি হাসিটা সুন্দর। মেয়েটার হাসি শুনে এখন বিষাদ লাগছে আমার। বাইরে চাঁদের আলো ঘরের ভিতর এসে পড়ছে। বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাতাস হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মেঘ জমছে। একটু পড়ে চাঁদটা ঢেকে যাবে। কি অদ্ভুত সুন্দর রাত। চাঁদের আলো,বাতাস সব একসাথে। একটু পরেই বৃষ্টি শুরু হলো।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, বিয়েটা ‘মনে হয়’ আরো আগে হলে ভালো হতো। এই রাতে এককাপ চা করে দেয়ার মানুষ থাকতো, হাসি দেয়ার মানুষ থাকতো,গল্প করার মানুষ থাকতো।হয়তো মনে হয় দিয়ে ঝগড়া করার মানুষ টাও থাকতো।
#কানে_কানে
#ফারিয়া_তমা
……………………….
তিনটা পরীক্ষা শেষ। কাল অংক পরীক্ষা। মোজাম্মেল স্যার খুব করে বলে দিয়েছেন কাল পরীক্ষার ফি না নিয়ে যেন স্কুলে না আসি। ভীষণ রাগী স্যার। স্যারের কথা না শুনলে গুণে গুণে মারেন। আমাদের ক্লাসের ঝন্টু, স্যারের টুপি চুরি করে পালিয়েছিল। পরেরদিন মোজাম্মেল স্যার ঝন্টুকে এমন মার দিয়েছিল যে ঝন্টুর তিনদিন জ্বরে ছিল। আমি প্রতিবার অংকে প্রথম হই কিন্তু এবার মনে হয় আমার পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। পরীক্ষার ফি এখনো জমা দিতে পারিনি।
দত্তপাড়া বাজার। বাজারের কাছেই বিশাল এক জাম গাছ। আমি আর আব্বা সেই গাছের নিচে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টির বেগ আস্তে আস্তে বাড়ছে। বিলের জমে থাকা পানিতে বৃষ্টির ফোটা পড়ার শব্দ শুনে মনে হচ্ছে আম্মা খৈ ভাজছেন। আশে পাশে কোন মানুষজনও দেখা যাচ্ছে না। মাত্র ভোর হয়েছে। এসময় কোন লোকজন থাকার কথাও না। বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে গেল। আমি আর আব্বা পুরো ভিজে গেছি। মাঝে মাঝে গাছ থেকে পাকা জাম আমার মাথায় দু একটা পরছে। অন্য সময় হলে আমি জাম কুড়িয়ে মুখে দিতাম কিন্তু আজ ইচ্ছে করছে না। আব্বার উপর আমার ভীষণ রাগ হচ্ছে। আমি আব্বার সাথে কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।
অংক পরীক্ষা আজ। ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমাদের নিজেদের জমিটায় বেশ কয়েক বছর হলো চাষ হয় না। আব্বা বলেন এ জমি মইর্যা গেছে। এখন আব্বা বর্গা জমি চাষ করেন। এবার ধানের জন্য সারের টাকাও পুরোটা জোগাড় করতে পারেনি। হাতে কোন টাকা পয়সা নেই। পরীক্ষার পঞ্চাশ টাকা ফির জন্য আমি রোজ রোজ কাঁদছি। গতকাল রাতে আব্বা বলে দিয়েছেন পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নাই। রাতে আব্বার কথা আমার বিশ্বাস হয়নি। আব্বা এমন করে শক্ত কথা কখনো বলেন না। আজ বললেন। ভোরে আব্বা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। তারপর আমাকে নিয়ে দত্তপাড়া বাজারের দিকে রওনা দিলেন। বাজারের দিকে রওনা দিতেই আমি বুঝে গেলাম আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে না।
বৃষ্টি থামেনি। আব্বা জামগাছের উত্তর পাশের জমিটাতে নামলেন। জমির কোণায় আইল কেটে পানি ছাড়লেন। পানি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে কৈ মাছ উঠা শুরু করলো। বড় বড় কৈ। আব্বা একটার পর একটা কৈ ধরছেন আর আমার হাতে থাকা মাছ রাখার খালইতে রাখছেন। ছোট খালই। খালই অনেকটা ভরে গেছে। আমি কাঁদছি। বৃষ্টির পানিতে আমার চোখের পানি দেখা যাচ্ছে না। আব্বাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। ভীষণ খুশি। আব্বা মাছ ধরেন খুব ভালো। আব্বার চোখে মাছ পড়লেই সেই মাছ আর রক্ষা নাই। ঐ যে, মুন্সী বাড়ির পুকুরে ডুব দিয়ে আস্ত শিং মাছ তুলে আনতে পারেন। একদিন দেখি ডুব দিয়ে শিং মাছের বদলে বিশাল এক কুইচ্যা ধরে নিয়ে আসলেন। সেই কুইচ্যা পাঠানো হলো মোবারক মামার কাছে। মোবারক মামার নাকি কি এক অসুখ আছে। কুইচ্যা রান্না করে খেলে অসুখ ভালো হয়।
আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলি রতন আজ কেমন বড় বড় কৈ ধরছি।
আমি আব্বার কথার কোন উত্তর দিলাম না। আমার একটুও ভালো লাগছে না। অন্য সময় হলে আমি নিজেই মাছ ধরতে নেমে পরতাম আব্বার সাথে। কিন্তু আজ আমার একটুও ইচ্ছে করছে না। আমার মন পরে আছে অংক পরীক্ষায়। রাতে সব ভাগ অংকগুলো আমি শেষ করে রেখেছি। মনিরের সাথে বাজি লেগেছি এবারও আমি অংকে বেশি নম্বর পাবো।
বৃষ্টি থেমে গেল। মাছ এখনো আসছে কিন্তু আব্বা হঠাৎ করে বলল, চল বাজান, আর মাছ ধরুম না।
আমি মাছের খালই নিয়ে আব্বার পেছন পেছন হাঁটছি। খালই থেকে একটা মাছ লাফিয়ে পরেছে মাটিতে। আমি মাছ না তুলে আব্বার পেছন পেছন এগুচ্ছি। আব্বা সামছু ব্যাপারির বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমার কাছ থেকে মাছের খালইটা নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে বলে ব্যাপারি বাড়ির ভেতর গেলেন। আমার একটুও ভালো লাগছে না। ইচ্ছে করছে দৌড়ে পালিয়ে যাই। পরীক্ষার সময় হয়ে আসছে। আমার বুঝি পরীক্ষা দেওয়া আর হলো না। এসব ভাবতে ভাবতে আমি বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
পেছন থেকে আব্বা আমাকে ডাকছেন, কিরে রতন তোরে না দাঁড়াইতে কইলাম।
আব্বার হাতের মাছের খালইটা খালি। আব্বা মুচকি হাসতে হাসতে বলল, ব্যাপারি সাবরে হগল মাছ দিয়া দিলাম রতন। ব্যাপারি সাবের ছোড পোলা আইছে শহর তে। মাছ পাইয়্যা খুব খুশি হইছে লোকটা।
আমাকে চুপচাপ দেখে আব্বা কাছে এসে মাথায় হাত দিয়ে বলল, পরীক্ষা দেওন লাগবো বাপ। পঞ্চাশ টাকায় সব মাছ দিয়ে দিছি। দামতো আরো বেশি। কিন্তু বাপজান আমার যে অহন পঞ্চাশ হইলেই হইবো।
আমি আব্বারে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। আমার কান্না দেখে আব্বা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, বাজান পরীক্ষার সময় হইতাছে। জলদি বাড়িত গিয়া জামা পাল্টায় স্কুলে রওনা দেও। আমি আর কয়েকটা মাছ পাওন যায় কিনা দেহি।
আমি পুরো রাস্তা কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে গেলাম। আমার কান্না কিছুতেই থামছে না। আমি সেদিন খুব বুঝে গেলাম আর যাই হোক পড়ালেখা আমার ছাড়া যাবে না। আমাকে পড়ে যেতে হবেই। আব্বার জন্য, আব্বার এই ভালোবাসার জন্য।
প্রায় সতের বছর পর। আমি আর আব্বা বসে আছি আমেরিকার মিশিগানের একটা পার্কে। আমি স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় আসি সাত বছর আগে। এখানে আসার পর আমার সব সময় একটা জিনিস মাথায় ঘুরতো কখন আব্বাকে আমেরিকা দেখাবো। এখানকার পার্কগুলোতে বিশাল বিশাল গাছ। আমার খুব ইচ্ছা করতো, এই বিশাল গাছের নিচে রাখা বেঞ্চগুলোর কোন একটাতে বসে আমরা বাপ ছেলে আড্ডা দিবো।
আমার সেই ইচ্ছা সফল হয়েছে। আব্বাকে তিন মাসের জন্য বেড়াতে আনলাম আমার কাছে। আমি আর আব্বা বসে আছি তেমন বিশাল এক গাছের নিচে। গাছটার নাম আমার ঠিক জানা নেই। আব্বার হাতে পেয়ারার জুস। এই জুসটা কেনজানি আব্বা ভীষণ পছন্দ করেছেন। আমেরিকায় আসার পর আব্বা রোজ দিনই এই জুস খাচ্ছেন।
হ্যাঁ, আমি আব্বাকে আমেরিকা দেখাতে পেরেছি। আমেরিকায় এসেও আব্বা খুব স্বাভাবিক। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি আর আব্বা দত্তপাড়ার বাজারের কাছে জামতলায় বসে আছি। আমি আব্বাকে বললাম, আব্বা আপনার কি সেদিনের কথা মনে আছে। ঐ যে, আপনি যেদিন কৈ মাছ বেচে আমার পরীক্ষার ফি দিয়েছিলেন।
আব্বা মুচকি হাসলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, আমাগো এসব মনে রাখতে হয় না বাজান।
আমি বললাম কেন?
আব্বা আবার চুপচাপ। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বাপ হয়ে আমার অনেক দায়িত্ব। তোমাগো ভালো রাখা, ভালো খাওন দাওন দেয়া, পড়ালেখা করানো এসব আমার দায়। আমি যদি সৎভাবে তোমাগো এসব দেওনের চেষ্টা করি তবে একদিন আল্লাহ আমারে ঠিক সুখে রাখবো। বিশ্বাস করো বাজান, আমি আমার সব দিয়ে তোমাগো মানুষ করার চেষ্টা করছি। কোন কিছু মনে রাখতে চাই নাই। আমার বিশ্বাস, আমি যদি ঠিকভাবে আমার কাজ করতে পারি তবে তোমরাই আমারে মনে রাখবা। আমার সেই বিশ্বাস ঠিক বাজান।
আমি জানিনা আমার কেন কান্না পাচ্ছে। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সামছু ব্যাপারীর বাড়ির সামনে পরীক্ষার ফির জন্য মাছ বিক্রির টাকা দিতে গিয়ে যেমন করে মাথায় হাত বুলিয়েছেন ঠিক তেমনি।
আমি কাঁদছি। আব্বার এত আদর আর ভালোবাসা পেয়ে কাঁদতে না পারাটা যে ভীষণ কঠিন।
—পরীক্ষার ফি
——রুহুল আমিন