দুঃখ দুর্দশা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। তিন বছর বয়সে বাবা-মায়ের ডিভোর্স দেখেছেন। বাবার ভালোবাসা পাননি। ডিসেলেক্সিয়া নামের এক জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। কিছু মনে রাখতে পারতেন না।তাই ছেড়ে দিতে হলো পড়াশোনা। প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছিলেন। প্রেমিকা ও মেয়ের মৃত্যুর পরে আত্মহত্যা করে নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। অথচ কিয়ানু রিভস নামের সেই মানুষটা এখন হলিউডের সবচেয়ে বড় সেলিব্রেটিদের একজন।সবচেয়ে বড় একশন স্টার।
একেকটি সিনেমার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক হাঁকান। যা ইনকাম করেন তার বেশির ভাগই বিলিয়ে দেন গরীব মানুষের জন্য। ছোট্র একটা ফ্লাটে থাকেন,পাব্লিক বাস বা মেট্রোতে চড়েন। কোটি কোটি ফ্যান ফলোয়ার তার।তবুও মনের ভিতর একবিন্দু অহংকার নেই মানুষটার। জীবনের কাছে হার না মানা এই অদম্য যোদ্ধাকে অনেকেই ডাকেন ট্র জেন্টলম্যান নামে।
প্রিয় পাঠক,
আমাদের আজকের আলোচনা ম্যাট্রিক্স বা জন উইক সিনেমা দিয়ে দুনিয়া কাপানো সেই কিয়ানু রিভার্স কে নিয়ে।চলুন আপনাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসি মহান হৃদয়ের অধিকারী এই তারকার জীবনের অন্দরমহল থেকে। যে গল্প নিষ্ঠূর মনকেও কাঁদাবে।
হাওয়াই দ্বিপপুঞ্জের ভাষায় কিয়ানু শব্দের অর্থ
পাহার থেকে বয়ে আসা হাড় কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস।
যে বাতাসের শব্দ শুনে মনে হবে এ যেন পাহাড়ের দির্ঘশ্বাস। নামের সাথেই যেন মিলে গেলো তারা পুরো জীবনের উপন্যাস। পৃথিবীতে যতোটুকু যন্ত্রনা পাওয়া সম্ভব তার প্রায় সবটুকুই পেয়েছেন জনপ্রিয় এই অভিনেতা। তবুও থেমে যাননি তিনি।প্রতিদিন একটু একটু করে এগিয়ে গিয়েছেন জীবনের পথে।
বাবার মদ ও জুয়ার নেশা টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল তাদের পরিবার।ডিভোর্স হয় বাবা-মায়ের।তখন তিন বছর বয়সি কিয়ানুকে নিয়ে মা চলে যান বাবার ছত্র ছায়া থেকে বহুদূরে। এরপর কিয়ানুর মা বিয়ে করেন আরো তিনটি। সেসব পরিবারে সন্তানও হয়েছে। কিন্তু সুস্থ স্বাভাবিক পরিবার পাওয়া হয়নি কোনদিনই। ছোট বেলা থেকেই তিনি ইনটোভার্ট।পড়ালেখা ভালোই লাগতো কিন্তু তার ধরা পড়লো বিড়ল এক রোগ ডিসলেক্সিয়া।এই রোগের মানুষেরা ঠিক ঠাক মতো পড়তে পারেনা।পড়া বুঝতে পারেনা, মনেও রাখতে পারেন না ঠিক মতো।
বিধাতা যখন যাকে বিপদ দেন হয়তো এভাবেই চারপাশ থেকে দেন। আগের সব সমস্যা থেকে তাও উত্তরণ হয়েছিল কিয়ানুর । কিন্তু এই রোগের কারণে তাকে ছেড়ে দিতে হলো পড়ালেখা।আরেক বার তাকে হার মানতে হলো জীবন যুদ্ধে।
স্কুলে থাকা অবস্থায় থেকেই থিয়েটারে কিয়ানু ছিলেন নিয়মিত মুখ। ঘটনা চক্রে টিভিতেও অভিনয়ের সুযোগ পান।কোকাকোলার বিজ্ঞাপন,শর্ট ফিল্ম,মঞ্চ অভিনয় সব মিলিয়ে কিয়ানু তখন জনপ্রিয় কিশোর অভিনেতা।এরপর কানাডার একটি সিনেমাতে অভিনয় করেন তিনি এবং সিদ্ধান্ত নেন বাকি জীবন সিনেমা করেই কাটাবেন তিনি।পাড়ি জমালেন লসএঞ্জেলসে, উদ্দেশ্য হলিউডের সিনেমায় সুযোগ পেতে হবে তাকে।
হলিউডের ভালো ভালো কিছু সিনেমায় অভিনয় করলেন তিনি,বেশ নাম ও পেলেন। এর মধ্য ‘’Bill & Ted’s Excellent Adventure’’(1989) সিনেমাটি হয়ে যায় ব্লক বাস্টার। মানুষ জন খুব পছন্দ করে সিনেমাটিকে।রাতারাতি টিনেজ হিরোর তকমা লেগে যায় তার সাথে।
হলিউডে কাজের সুবাদে অনেকের সাথেই ভালো সম্পর্ক তৈরি হয় এই তরুন অভিনেতার। কাজ সূত্রে রিভার ফিনিক্স নামের আরেক কিশোর অভিনেতার সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।কিয়ানুর একাকিত্বের সঙ্গী ছিলেন রিভার, অভিনয় ও করেছিলেন এক সিনেমায়।সিনেমাটির নাম ছিল
‘’I Love You To death” .
এই সিনেমার তিন বছর পরেই অতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়ার ফলে মারা গেলেন রিভার।কিয়ানু আবার একলা হয়ে গেল।
ততোদিনে তিনি ম্যাটিক্স সিনেমাতে অভিনয় করেছেন, সুপারস্টারে পরিণত হয়েছেন।এরপরই কিয়ানুর দেখা হয় জেনিফার সাইনুর সাথে। প্রথম দেখাতেই দুজন দুজনার প্রেমে পড়ে যান।চলতে থাকে উথাল-পাতাল প্রেম। কিয়ানু ভাবলেন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এবার।উপরওয়ালা তো আর কাউকে সাড়া জীবন কষ্ট দিতে পারেন না। সাইনুর সাথে ঘর সাজিয়ে বসলেন তিনি। পেলেন বাবা হবার সুখবর। কিন্তু তার কন্যা সন্তান পৃথিবীতে এলোনা। মাতৃগর্ভেই মৃত্যু হলো।
কিয়ানুর ভাগ্যটাই আসলো খারাপ। যখন যাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে ভাগ্য তখন তার কাছ থেকে সেই অবলম্বনই ছিনিয়ে নিয়েছে।
বন্ধু মারা গেল,সন্তান মারা গেল। যে বান্ধবীকে প্রচন্ড ভালবাসতেন তার সাথেও ছাড়াছাড়ি হলো। বান্ধবীকে ফিরে পাবার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছিলো কিয়ানু। কিন্তু সে আর ফিরে এলো না।এক রোড এক্সিডেন্টে সেও পারি জমালো ওপারে।
বাঁচার ইচ্ছাটা শেষ হয়ে গেল কিয়ানুর্। বহুবার শেষ করে দিতে চেয়েছেন নিজেকে। লাইসেন্স করা পিস্তল নিয়ে বসে থেকেছেন নিজের রুমে। কিন্তু সাহসের অভাবে ট্রিগারে চাপদিতে পারেনি।তাইতো আমরা পেয়েছি আজকের জন উইককে।
২০১৪ সালে জন উইকস মুক্তি পাবার সাথে সাথেই বক্স অফিস মেতে উঠেছিল কিয়ানু বন্দনায়।বক্স অফিসে সাফল্য আর কৃতিত্বের ভূয়সি প্রশংসা পেয়ে কিয়ানুর জীবনে আবারো জোয়ার এসেছিল।
কিয়ানু মানুষটা আসলেই অদ্ভত, বলিউডের আর দশটা অভিনেতার সাথে তাকে মেলানো যাবেনা কোনভাবেই। সিনেমায় কম পারিশ্রমিক নেন। যা পারিশ্রমিক নেন তার বেশিরভাগই দিয়ে দেন টেকনিশিয়ান ও অন্যান্যদের মাঝে। ম্যাট্রিক্স সিনেমায় আশি মিলিয়ন ডলার দিয়েছিলেন টেকনিশিয়নদের নিজের পকেট থেকে। যেন তারা মনোযোগ দিয়ে কাজটা করে।
যখনি দেখা গিয়েছে বড় কোন তারকাকে আনতে গিয়ে বাজেটের ঘার্তি দেখা দিয়েছে। কিয়ানু তখন নিজের পারিশ্রমিক কমিয়ে দিয়েছেন।কখনো আবার বিনা পারিশ্রমিকেই কাজ করেছেন। প্রতিবছরই নিজের আয়ের প্রায় ৮০ভাগ টাকায় দান করে দিয়েছেন বিভিন্ন চ্যারিটিতে।
তিনি থাকেন দুই রুমের ছোট্র একটা ফ্লাটে।কমদামি একটা গাড়ি আছে কিন্তু বেশীর ভাগ সময় পাব্লিক ট্রান্সপোর্টে দেখা যায় তাকে। তার কথা হচ্ছে তিনকুলে আমার কেউ নেই।কার জন্য এতো টাকা জমাবো।
আগেই বলেছি কিয়ানু শব্দের অর্থ পাহাড় থেকে বয়ে আসা ঠান্ডা বাতাস। কিয়ানুতো বলিউডের চাকচিক্যের মধ্য মন ভাল করে দেয়া ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায়। যার একাকিত্বের গল্প শুনে মনটা বিষাদে ভারী হয়ে ওঠে।