আমার স্কুল জীবন ছিলো উইলস লিটল ফ্লাওয়ার হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল। এখন অবশ্য নাম হলো ‘উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজ’। তখনও কলেজ আসেনি। হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল হিসেবেই ছিলো।
স্কুলটা ছিলো কাকরাইলে।
ঢাকা শহরে কাকরাইলের মতো ব্যস্ত একটা জায়গায় বেশ বড় বাউন্ডারি দেওয়া এক টুকরো স্বপ্নের জায়গা। গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই বিশাল মাঠ। আরো সামনে এগিয়ে হাতের বাম পাশে এক তলা অফিস ঘর। মাঝে এক সাদা প্রাসাদসম বিল্ডিং। এর পেছনে বাগান ঘেরা এক পানির ফোয়ারা। তা পেরিয়ে বিরাট লাল দালান। সেখানেই ক্লাস হতো। আমি যখন মফস্বল শহর থেকে এসে এখানে ভর্তি হতে এলাম, তখন সাদা দালানটি ভাঙ্গার কাজ শুরু হয়েছিলো। আমি আগে কখনো বিল্ডিং ভাঙ্গতে দেখিনি। চোখের সামনে প্রাসাদ বিল্ডিং ভাঙ্গা হচ্ছে -অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম।
তবে এই অবাকের স্থায়িত্ব বেশিদিন ছিলো না। স্কুল শুরু হলো কঠিন বাস্তবতা দিয়ে। প্রথম দিনেই কানে ধরে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। কারণ আমি স্কুল ইউনিফর্ম পড়িনি। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বাসায় ফিরলাম। স্ট্রিক্টলি রুলস ফলো করতে হবে। নমনীয়তার ছিটাফোঁটা নেই। মফস্বলের কোনো নিয়ম কানুন এখানে চলে না। জীবন যন্ত্রণাময় হয়ে গেলো।
কোনো কোনো শিক্ষক আমাকে দেখতে পারছেন না কারণ আমি তাদের ব্যাচে পড়ছি না। কেউ বা আমার লাজুকতা এবং পড়া বুঝতে পারার অক্ষমতা নিয়ে বিরক্ত। আমাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছেন।
এরই মধ্যে এক শিক্ষিকার সাথে আমার পরিচয় হলো। উনার নাম নাজ মিস। সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষিকা। ছোট খাটো উচ্চতার একজন বৃদ্ধ মহিলা। প্রচন্ড কঠোর। মুখে হাজারো বলিরেখার ছাপ। কিন্তু চোখে মুখে একধরনের কাঠিন্য আছে যা বুকে ভয় ধরিয়ে দেয়। তার ব্যাপারে বেশ কিছু কথা প্রচলিত ছিলো, যেমনঃ তিনি তাঁর সততার জন্য আলাদা বেতন পান। কেউ তাঁর উপর কথা বলার সাহস রাখে না। তাঁকে কেউ কখনও হাসতে দেখেনি। কারো কারো ধারণা ছিলো তাঁর হাসি অনেক ভয়ানক। তিনি চোখ বন্ধ করেও সব দেখতে পারেন। বই বন্ধ থাকলেও পেইজের লেখা পড়তে পারেন…ইত্যাদি।
কয়েকটা জিনিস আসলেও সত্যি ছিলো। ম্যামের চমৎকার স্মৃতিশক্তির সাথে পরিচিত ছিলাম আমরা। পুরো বই মুখস্ত করে রেখেছিলেন। কোন পেইজের, কোন লাইনে, কোন শব্দ আছে -তা পর্যন্ত চোখ বন্ধ করে বলে ফেলতেন। ক্লাসে ঢুকেই নিজের চেয়ার ক্লাসরুমের বাইরে রেখে দিতেন। দাঁড়িয়ে ক্লাস নিতেন। পড়ানোর সময় পিন পতন নিরবতার সহিত থাকতে হতো। শব্দ হলেই ধরা! পড়াতেন বেশ ভালো। কিন্তু তার কঠোরতার কারণে ছাত্ররা তাকে তেমন পছন্দ করতো না।
ষান্মাসিক পরীক্ষায় আমার রেজাল্ট ভয়াবহ রকমের খারাপ হলো। হবারই কথা। আমি পড়াশোনার ধাঁচ বুঝতে পারছি না। পরীক্ষায় কি লিখবো? তিনি আমাকে টিচার্স রুমে ডেকে পাঠালেন। জানতে চাইলেন সমস্যা কি? ‘সমস্যা কি’ -তা বলার মতো সাহস আমার ছিলো না। চুপ করে মাথা নিচু করে রইলাম।
তিনি বুঝে গেলেন সমস্যা কই। এগিয়ে আসলেন। ‘পড়া’ যে শুধু পড়তে হয় না তিনিই জানালেন। দুর্বল ছাত্রদের জন্য সহজ পাঠের চেষ্টা করলেন। শুধু তার সাবজেক্ট নয়, অনান্য সাবজেক্টও কিভাবে সহজ ভাবে পড়া যায় বুঝানোর চেষ্টা করলেন। তবে আমার তেমন উন্নতি হলো না।
পরের পরীক্ষায় বসে আছি। পেছন থেকে চিরকুট আসার অপেক্ষা করছি। চিরকুট আসলেই লিখা শুরু করবো। এরমধ্যে নাজ ম্যাডাম দেখতে আসলেন। আমাকে বসে থাকতে দেখে উনি বুঝে ফেললেন। বললেন, আজকে যদি তুই নকল করিস আমি এক্সফেইল করবো না। তোর পাশ করার প্রয়োজন আছে। কিন্তু মনে রাখিস তুই তোর যোগ্যতায় পাশ হস নাই। নিজের কাছে ছোট হয়ে থাকবি।
একটু থেমে বললেন, ইতিহাসের ঘটনা তো জানিস। নিজের মতো লেখ। বইয়ের মত লাগবে না। সাল আর জায়গার নাম ঠিক রাখিস।
কথাগুলো বলে ম্যাম অন্যদিকে চলে গেলেও আড়চোখে দেখছিলেন আমাকে। খুব সম্ভবত পরীক্ষা করছিলেন আমি চিরকুট নেই কিনা। তবে তাঁর এই পরীক্ষায় আমি এক প্রকার বাধ্য হয়েই পাশ করলাম। লজ্জায় আমি পেছন থেকে চিরকুট নিতে পারলাম না।
খাতায় নিজের মতো লিখলাম। সেই পরীক্ষায় আহামরি নাম্বার না পেলেও ফেল হবার হাত থেকে বেঁচে গেলাম। তবে একটা জিনিস শিখলাম। নিজের উপর কনফিডেন্স আনা, আমি চাইলেই পারবো। হয়তো একটু দেরি হবে, তবে পারবো। একই সাথে আমার এক অক্ষমতা তৈরি হলো, আমি জীবনে আর নকল করতে পারিনি। ছোট চিরকুটে লেখা আমার চোখে ঝাপসা হয়ে আসে। এটার অবশ্যই একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাখ্যা আছে। সেই ব্যাখ্যা আমি জানতে আগ্রহী নই।
জেএসসি পরীক্ষার বেশ কিছুদিন আগে তাঁর সাথে আমার শেষ দেখা হয়। তিনি তখন খুব অসুস্থ। একদিন ক্লাসে আসলেন আমাদের দেখতে। বললেন, তোমরা যারা সমাজে A+ পাবা তার জন্য আমি একটা পুরস্কার ঘোষণা করবো। একটা সারপ্রাইজ। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে পাশ করতেই হবে। ফেইল করা যাবে না। ফেইল করলে তোকে আমি স্কুলেই রাখবো না।
আমি মন খারাপ করে ফেললাম। উনি আমাকে নিয়ে সন্দিহান- পুরষ্কার পাওয়া দূরে থাকুক আমি নূন্যতম পাশ করবো কিনা। মনের মধ্যে জেদ চেপে গেলো। উনাকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। রাত দিন খেটে পড়লাম। পরীক্ষা দিলাম। মিরাকেল ঘটলো। নূন্যতম রেজাল্টের জায়গায় বৃত্তি পেয়ে গেলাম। প্রচন্ড খুশিতে আমি আত্মহারা।
কিন্তু না। উনাকে আর জানাতে পারিনি আমার রেজাল্টের কথা। পরীক্ষা চলাকালীন সময়েই মৃত্যু বরণ করেছিলেন। সে খবর আমি পাই রেজাল্টের বহুপরে। আমার জীবনে অসংখ্য আফসোসের মধ্যে অন্যতম একটা আফসোস হলো, ম্যামকে রেজাল্ট বলার পর উনার চেহারার এক্সপ্রেশন কেমন হতো? উনি কি সারপ্রাইজ দিতেন? তা জানা হলো না। আর কখনো জানতেও পারবো না।
নাজ ম্যামের সাথে তেমন কোনো স্মৃতি নেই। কলিজা কাঁপানো ম্যাম থেকে অন্য সবার মতই বরাবর দূরে থাকতাম। কিন্তু তাঁর ছাত্রদের প্রতি তিনি যে মমতা দেখিয়েছিলেন তা আমার আমৃত্যু মনে থাকবে।
শিক্ষক দিবসে শুভেচ্ছা জানানোর মতো সাহস করলাম না।
লেখাঃ Nahid Ashraf Uday