ইদানীং বউ ঘন ঘন বাপের বাড়ি যাচ্ছে। আমি বাদে বাড়ির কারোই ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না। আমার মা, বাবা, ভাই-বোনসহ আশেপাশের সকলের ধারণা আমার বউ পরকীয়া করছে। তবে আমি খুব খুশি। বউ বাড়ি থাকলে সারাক্ষণ খিটখিট করতে থাকে, অফিসের দেরী হয়ে গেলো, কত রাত হয়ে গেছে এখনও খেতে এলে না, কত কি!
মাঝে মধ্যে দুই-একজন এসে এটাও বলে তাঁরা নাকি আমার বউকে কোন ছেলের সাথে অন্তরঙ্গ হয়ে রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে দেখেছে। এইতো সেদিন পাশের বাড়ির শিউলি ভাবি দৌড়ে এসে আমাকে জানালো সে নাকি আমার বউকে কোন ছেলের সাথে দোকানে বসে চা খেতে দেখেছে। ছেলেটা বউয়ের চায়ের কাপে ফু দিয়ে দিচ্ছিলো। উনার কথায় আমি তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। এসব লোকের নিজের কোনো কাজ নেই, এদের কথায় কান দিতে নেই। শিউলি ভাবি নিজের মতো কিসব বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন।
আজও বউ বাপের বাড়ি যাবে। বুধবার বাড়ি ফিরেছে, আজ রবিবার। সকাল থেকে সে রান্নাঘরে ভিষণ ব্যস্ত। যে তিন-চার দিন বাপের বাড়ি থাকবে সব কয়দিনের তরকারি আজ রান্না করে ফ্রিজে রেখে যাবে। আমি সময় সময় গরম করে খেয়ে নিবো। দু-এক বেলার খাবার কম পড়লে উপবাস করতে হবে। আগে মা বাবা, ছোট বোন, ছোট ভাই,তাঁর বউ সবার সাথে এক সংসারের ছিলাম কিন্তু মিতার বাপের বাড়ি যাওয়ার সূত্র ধরে এখন আমাদের টোনাটুনির সংসার। বউ রোজ রোজ সংসার ফেলে বাপের বাড়ি গেলে সংসারের কাজ কে করবে? তাদের কেন এতো দায়! অথচ মিতা বাপের বাড়ি গেলে লোক বলতে আমি একা।
মিতা সব কাজ শেষ করে আমার কাছে এলো। আমি মোবাইল নিয়ে ফেজবুক রাজ্য জয় করতে ব্যস্ত। মিতা ভালো-মন্দ কিছুই বললো না, শুধু মানিব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে নিয়ে নিজের মতো চলে গেলো। দরজা দিয়ে বের হতে হতে বললো, ” সময় মতো খেয়ে নিও। “
আমি হু হা কিছুই বললাম না। মিনিট দুয়েক পরে ছোট বোন পুতুল এসে বললো, ” ভাইয়ার মানিব্যাগ তাঁর বউয়ের জন্য উন্মুক্ত হয়ে আছে। আর আমাদের বেলার কোন টাকা-পয়সা নেই। “
মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে বোনের দিকে তাকালাম। মুচকি হেসে বললাম, ” তোর জন্য কি আমার মানিব্যাগ উন্মুক্ত ছিলো না কখনো? “
পুতুল মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, ” সে তোমার বউ আসার আগে ছিলো। এখন তো তুমি বউ নিয়েই ব্যস্ত। বউকে নিয়ে আলাদা সংসার পেতেছো। “
প্রচন্ড বিরক্ত লাগলো পুতুলের কথায়, সবে মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে। কথা শুনে মনে হচ্ছে সামনে একটা কুচুটে বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
–” তোর প্রতি মাসের টিউশন ফ্রি তিন হাজার টাকা আমিই দিচ্ছি এখনো। আর আমার বউ-ই আমাকে বলছে তোকে একটু বেশি টাকা দিতে, কত সময় কত জিনিসের প্রয়োজন হয়, সব সময় কি টাকা চাইতে পারে নাকি! সে-ই সুবাদে তুই সাতশো টাকা হাতখরচ পাস আমার থেকে। “
পুতুল চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সময় তারপর নিজের মতো চলে গেলো। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা এখানে শেষ কিন্তু মিনিট পাঁচেক পর মা এসে বললেন, ” তুই তোর ও-ই বউয়ের জন্য আমাকে মেয়েকে কিছুই বলবি না। নিজের বউকে সামলাতে পারিস না আবার আমার মেয়েকে বাজে কথা বলিস!”
মা’য়ের সাথে ছোট ভাই সুর মিলিয়ে বললো, ” তোমার বউকে সামলে রাখো, আমাদের জ্ঞান দিতে হবে না। “
মুচকি হেসে বললাম, ” তোদের কাছে কি জ্ঞান চেয়েছি নাকি? আমি তোদের ঘরে যাইনি, তোরা সবাই এসেছিস। “
ছোট ভাইয়ের বউ উপহাস করে বলে উঠলো, ” ভাইয়া ভাবির পরকীয়া ধরা পড়লে যেন আপনাকে আফসোস করতে না দেখি।”
–” কি জানো তো শেফালি পরকীয়া করতে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না, ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে চুমু ছুঁড়েও পরকীয়া করা যায়।
শেফালি আমার কথা আৎকে উঠলো হয়তো। তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ছোট ভাই ব্যাঙ্গ করে বললো, ” নিজের বউয়ের পরকীয়া বন্ধ করতে পারে না, আবার অন্যের বউকে জ্ঞান দেয়। “
ভাইকে আর কিছুই বললাম না। মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, ” তোমার ছেলে মেয়ে যদি দ্বিতীয়বার আমার বউয়ের চরিত্র নিয়ে দোষ দেয় তাহলে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। তোমরা আমার একান্ত আপন বলে এতো কথার পরেও এখানে থাকি, তবে মিতাও আমার স্ত্রী। তার সম্মান বজায় রাখা আমার দায়িত্ব। “
মা চোখ গরম করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, সাথে বাকিরাও।
দু’দিন পর আর মিতা বাড়িতে এসেছে, বিকালে আসা থেকে কিসব রান্না করে চলেছে। আমি বারান্দায় বসে গল্পের বই পড়ছি। এমন সময় মিতা এক কাপ চা নিয়ে এসে আমাকে বললো, ” এখনও তুমি বাচ্চাদের গল্পের বই পড়ো। তুমি কি আর বড় হবে না”
–” যার বউ তাঁকে সময় দেয় না সে কি করবে আর বলো!”
মিতা আমার কথায় কিছুটা চুপসে গেলো। পাশে বসতে বসতে বললো, ” সবার মতো তুমিও কি বিশ্বাস করো আমি পরকীয়া করি?”
–” কখনোই না। আমি বিশ্বাস করি তোমায়। তাছাড়া আমি জানি আমার শশুর আব্বু প্যারালাইজড, কয়েকদিন ধরেই শাশুড়ি মা’য়ের টাইফয়েড দেখা দিয়েছে। বাড়িতে মানুষ বলতে শুধু মাত্র তাঁরা দু’জন। তুমি না গেলে উনাদের অনেক বেশি কষ্ট হয়ে যায়। “
মিতা আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আমি চুপচাপ ওর চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। মেয়েটা কত সুন্দর একসাথে দুইটা বাড়ি সামলাচ্ছে। আমার শশুর আব্বু দুই বছর ধরেই প্যারালাইজড, গত দুইমাস ধরে শাশুড়ি মা’য়ের জ্বর জ্বর থাকে। ডাক্তার জানিয়েছেন ওনার টাইফয়েড হয়েছে, কিছুদিন বিশ্রামে থাকতে হবে। উনাদের ও-ই একটাই মেয়ে মিতা।আর কোনো সন্তান নেই। মিতা না গেলে উনাদের অনেক বেশি কষ্ট হয়ে যায়। মিতার অজান্তেই আমি উনাদের একজন সহযোগী লোক রেখে দিয়েছি, কয়েকবার আমাদের বাড়িতে এসে থাকতে অনুরোধ করেছি কিন্তু উনারা কিছুতেই মেয়ের বাড়িতে এসে থাকবেন না৷ আমাকে অনুরোধ করতে নিষেধ করেছেন, শুধু এতটুকু দাবী মিতা যেন উনাদের একটু দেখে আসে। এজন্যই মিতা রোজ রোজ বাপের বাড়ি যায়। উনাদের সাথে সময় কাটিয়ে আসে। কিন্তু মিতার রোজ রোজ বাপের বাড়ি যাওয়াটা আমার বাড়ির লোকের পছন্দ নয়। আমার বাবা যখন অসুস্থ ছিলো, মা থাকার পরেও মিতা নিজের হাতে সব সেবা করেছে। খাইয়ে দেওয়া, হাত পা মালিশ করা, নক কেটে দেওয়া, পত্রিকা পড়ে শোনানো, এমন নানান কাজ। মিতা বাড়ির বড় বউ। সংসারের সব কাজ সামলেই বাবার সেবা করতে হয়েছে ওঁকে। মা তখন পুতুলকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। এতো কাজ করতে গিয়েও যে মেয়েটা কখনো অভিযোগ করেনি, আজ তার বাপের বাড়ি যাওয়া নিয়ে তাঁকে কিছু বলা মানায় না আমার। ও আমার পরিবারের জন্য অনেক কিছুই করছে। কিন্তু আমি তেমন কিছুই করতে পারিনি। তবুও সামান্য চেষ্টা করি, ওঁকে সাপোর্ট দিয়ে।
মিতার গালে পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বললাম, ” বউ শোনো, আমি বিশ্বাস করি তোমায়!”
উত্তরে মিতা কিছুই বললো না। শুধু আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। আমিও আর কিছু বললাম না, শুধু মুচকি হাসলাম।
সমাপ্ত
#আমি_বিশ্বাস_করি_তোমায়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল