লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
শহুরে রাস্তায় হেঁটে বেড়ালে বাড়ির তোরণে তোরণে নানা রকম মনোহর নামফলক চোখে পড়ে। গীতাঞ্জলি, কুঞ্জবন, অপেক্ষা আরও কতশত নামের বাহার। আমাদের বাড়ির অবশ্য নাম নেই। থাকলে ; নিশ্চয় তার নাম হতো, ‘হৈ-চৈ’। চরপাড়ার এই কোলাহলে ঢাকা মহল্লায় সর্বপেক্ষা হৈ-চৈ বোধহয় হয় আমাদের বাড়িতেই।৬৩৭৮ কিলোমিটার নিরক্ষীয় ব্যাসার্ধের পৃথিবীতে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলেই তার প্রভাব সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে আমাদের বাড়ির দোরগোড়ায়। আমার গোষ্ঠী সেই ঢেউয়ে চঞ্চলা তটিনীটির মতো কলকলিয়ে উঠে। আত্মীয়-স্বজনের বোঁচকা বুঁচকিতে ভরে যায় শ্যাওলা পড়া দু’তলা বাড়ি। চুলোর আঁচ অক্ষুণ্ণ থাকে অষ্টপ্রহর। ভোররাতে চাপানো ডেচকি অবসন্ন হয় মধ্যরাতে। হৈ-চৈ কোলাহলে বাড়ির ভেন্টিলেটরে বাসা বাঁধা চড়ুই পাখিটা পর্যন্ত নিরুদ্দেশ যাত্রা করে। পরবর্তী এক হপ্তা তার টিকিটির সন্ধান পাওয়া যায় না। দেশান্তর হয় ফটকের কাছে অহর্নিশ ঝিমোতে থাকা বুড়ো কুকুরটাও। চরপাড়া মোড়ের ওই চুলে জট, খারাপ কথা বলা পাগলটাও সপ্তাহখানেকের জন্য পথ পাল্টে ফেলে; এই পথে আসে না।
এমন উন্মাদ গোষ্ঠীকে ঘাড়ের উপর বর্তমান রেখে কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ প্রসন্নচিত্তে ঘুমের কথা চিন্তা করতে পারে না। চিন্তা করলে বেকায়দায় পড়তে হয়। আমি পড়েছি বেকায়দায়। সেই কোন ভোর বেলায়; পুব আকাশে আলো ফোটার বহু আগে থেকে হৈ-হৈ তান্ডব চলছে বাড়িতে। চুলোয় চায়ের হাঁড়ি চেপেছে। খাবার টেবিলে বসেছে পিঠা বানানোর আসর। এই ভোর ভোর লগ্নেও টেলিভিশন ছেড়েছে কোনো এক আহাম্মক। মেজ চাচীর সাথে তার ছোটবোন মিলা ও তার মেয়ে নিধি এসেছে। মিলা আন্টির পীর-ফকিরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। তিনি সুযোগ পেলেই পীরের গুণগান করেন। গুণগানের ফাঁকে ফাঁকে উঁচুস্বরে গজল ধরেন। এই মুহূর্ত তিনি আতঙ্ক সীমার বাইরে গিয়ে গজল গাইছেন। পাশের ঘর থেকে তারস্বরে চিৎকার করছে মিথি আপুর মেয়ে মিষ্টু। ছাদের উপর লম্ফঝম্প করছেন ছোট চাচী। ডাক্তার ছোট চাচীকে অতি শীঘ্রই ওজন কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। ছোট চাচী যদিও প্রতিদিন হাঁড়ি হাঁড়ি ভাত খাচ্ছেন তবু ডাক্তারের পরামর্শ মেনে খুব ভোরে ছাদে উঠে লম্ফঝম্প করে আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছেন নিয়ম করে। আমি ভারী বালিশে কান চাপা দিয়ে কেবল একটাই প্রার্থনা করছি, ‘এই উন্মাদ গোষ্ঠীকে আপাতত আধ ঘন্টার জন্য মূক করে দাও বিধাতা। আমি গুণে গুণে ত্রিশটা মিনিট শান্তিতে ঘুমোতে চাই। ঘুম থেকে উঠেই দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ে ফেলবো। প্লিজ প্লিইইইজ!’
বিধাতা আমার প্রার্থনা শুনলেন না। শোনার কথাও না। খুব মন খারাপ হওয়ার মতো ব্যাপার, তিনি বেশিরভাগ সময়ই আমার প্রার্থনা গ্রাহ্য করেন না। তিনি বোধহয় কোনো কারণে আমার প্রতি ক্ষিপ্ত। ভেবে দেখলাম, দুই রাকাআত নামাজ পড়ার কথা বলা উচিত হয়নি। তিনি মহান ; তাঁকে কী এই রকম ঘুষের কথা বলা যায়? আমি ছোট চাচীর লম্ফঝম্পের তালে তালে তওবার বন্যা বইয়ে দিলাম। তওবা কতোটুকু কবুল হলো জানি না তবে বিছানার কাছে মূর্তিমান আজাব এসে উপস্থিত হলো। ছোট ফুপি তার ভারী শরীর নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকলেন,
‘ এই রোদ? রোদ। উঠ্ তো। উঠ্।’
আমি একবার ভাবলাম, ঘুমের অভিনয় করে শুয়ে থাকি। ডাকলেই চট করে উঠে বসতে হবে এমন নিয়ম তো কোনো মহাপুরুষ তৈরি করে রেখে যাননি। কিন্তু ফুপির ডাকাডাকির আতিশয্যে উঠে বসতে হলো। আম্মু ডাকলে বিরক্তিতে মুখ কালো করতাম; ফুপির সাথে বিরক্তি দেখানোর নিয়ম নেই বলে মুখটা রাখতে হলো হাসিহাসি। আমি হাসিহাসি মুখে শুধালাম,
‘ কী হয়েছে ফুপি?’
ফুপি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না বরং তাড়াহুড়ো কণ্ঠে বললেন,
‘ যা তো, যা। এক্ষুণি গিয়ে শুভ্রকে একবার ডেকে নিয়ে আয়।’
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। এই বাড়িতে এতো মানুষ! তাদের রেখে শুভ্র ভাইকে ডাকতে যেতে হবে আমাকে? তাও আবার ঘুম ভেঙে? কেন বাপ? কী এমন মহান কাজ সম্পাদন করবেন তিনি এই ভোর বেলায়? বাবার লক্ষ্মী মেয়ে হওয়ার সুবাধে ফুপির মুখের উপর এ-কথা ছোড়ার অধিকার আমার নেই। তাদের সাথে আমাদের হাসার অধিকার আছে, আহ্লাদ করার অধিকার আছে ; কিন্তু রাগ করার অধিকার? কদাপি নহে। অতএব, আমি হাসিমুখে শুধালাম,
‘ শুভ্র ভাইকে কেন ফুপি?’
‘ পলাশের খবর নিবো। শুভ্রই সবথেকে ভালো খবর দিতে পারবে। তুই জলদি করে বেরিয়ে যা। চুপিচুপি ডেকে আনবি। বলবি, ছোট ফুপি ডেকেছে।’
ছোট ফুপি বাতাসের বেগে অনর্গল কথা বলে গেলেন। আমি বেকুবের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে সেসকল কথা শুনলাম। কিন্তু তার বিন্দু বিসর্গও ধরতে পারলাম না। পলাশ? এই পলাশটা আবার কে? কোন পার্টির লোক? আশ্চর্য! আমি চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে মায়ের কাছে গেলাম। আম্মু তখন ভীষণ ব্যস্ত। এক হাতে পিঠা ভাজছেন। অন্য হাতে রুটি বেলছেন। কথা বলার জন্য বিশেষ এপয়েন্টমেন্ট দরকার। আমি এপয়েন্টমেন্টের জন্য অপেক্ষা করলাম। রান্নাঘরটা একটু ফাঁকা হতেই ঘ্যানঘ্যান করে বললাম,
‘ আম্মু! এই বাসায় কী শান্তিতে একটু ঘুমোনোও যাবে না? সব জায়গায় সবটা সময় শুধু আমার খোঁজ!’
আম্মু অবাক হয়ে বললেন,
‘ তোর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালো কে? তুই তো মহারাণী ভিক্টোরিয়া, তোর ঘুম ভাঙানো যাবে না। যা জলদি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। তুই ঘুমাবি দুপুর দুইটা পর্যন্ত।’
আমি আহত চোখে চাইলাম। বিপদের সময় অপমান গায়ে মাখতে নেই বলে কথাটা না শোনার ভান করে বললাম,
‘ ছোট ফুপি যে আমাকে ডেকে উঠালো? শুভ্র ভাইকে ডেকে আনতে বলছেন। এই ভোরে কেউ কারো বাসায় যায়? আর এই পলাশ কে? শুভ্র ভাই কী ডিটেক্টিভ? তিনি পলাশের খোঁজ কী করে দিবেন?’
আম্মু হতাশ চোখে চাইলেন। তার থেকেও হতাশ কণ্ঠে বললেন,
‘ এখন ভোর? বলদের বংশধর! ঘড়ি দেখ, দশটা বাজে। মাগনা বান্দী পেয়েছিস বলে এতো চোট। শ্বশুরবাড়ি গেলে এই জমিদারী ছুটে যাবে। সবার আগে এই ঘুমের একটা বিহিত হবে।’
আমি শ্বশুরবাড়ি নিয়ে তেমন একটা সমস্যা দেখালাম না। শুধালাম,
‘ পলাশ কে?’
আম্মু চোখ রাঙিয়ে বললেন,
‘ আস্তে কথা বল। বসার ঘরে মেহমান বসে আছেন। রাফিয়াকে দেখতে এসেছে। পলাশ পাত্রের নাম।’
অত্যাধিক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। সম্বিত ফিরতেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বললাম,
‘ রাফিয়াকে দেখতে এসেছে মানে কী? আমি কিছু জানি না কেন? ছেলে কী করে?’
আম্মু ভর্ৎসনা করে বললেন,
‘ সারাদিন মহিষের মতো ঘুমালে জানবি কী করে? ছেলে সচিবালয়ে চাকরি করে। নবম গ্রেডের চাকরি। তোর মামানির চাচাতো বোন; নাহিদের বড়ো খালার ছেলে। ওরা নাকি অনেকদিন ধরে মেয়ের খোঁজ করছিলো তখন ভাবী কথায় কথায় রাফিয়ার কথা বলেছে। ছেলের বয়স একটু বেশি। মাথায় চুল কম। তবু তোর ছোট ফুপি লাফাচ্ছে। চাকরি ভালো; পুরুষ মানুষের আবার রূপ কী?’
আমার আগ্রহী মনের আগ্রহ তৃপ্ত হওয়ার আগেই কোথা থেকে উড়ে এলেন ছোট ফুপি। চাপাস্বরে; বসার ঘরে বসেও যে স্বর নির্দ্বিধায় শুনে ফেলা যাবে এমন চাপাস্বরে তিনি বললেন,
‘ তুই এখনও যাসনি রোদ? জলদি করে যা।’
আমার পরিবর্তে উত্তর দিলেন আম্মু। মৃদু ধমক দিয়ে বললেন,
‘ তুমি কথায় কথায় এতো উত্তেজিত হয়ে যাও কেন শাহানা? ছেলের মা দেখতে এসেছেন, দেখে যাবে। আজই তো আর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না৷ ওরা চলে গেলে আস্তেধীরে যার যার থেকে খোঁজ নেওয়ার, নিবে। ওদের বসিয়ে রেখেই শুভ্রকে ডেকে জিজ্ঞেসাবাদ করতে হবে কেন? একটা কথা মনে হলেই অস্থির হয়ে যাবে না।’
ফুপির উৎসাহোজ্জ্বল মুখ অন্ধকারে ঢেকে গেলো। ছোট ফুপি ভয়ঙ্কর মহিলা; এতো সহজে হেরে যাওয়ার পাত্রী নন। আমার হৃদয় আশায় আশায় ভরে উঠলো। আমি মনে মনে এই দুই রমণীর মধ্যে একটা ঠান্ডা বাককলহ আশা করে ফেললাম। এখানে একটা ঝামেলা বাঁধলেই আমি নির্ঝঞ্জাটে বিছানায় ফিরে যেতে পারি। আমার মাথা দপদপ করছে। এই মুহূর্তে চমৎকার একটা ঘুম প্রয়োজন। আম্মু অবশ্য আমার কল্পনার রেলগাড়ী বেশিদূর এগোতে দিলেন না; চরপাড়ার সীমা পেরুনোর আগেই শিলনোড়া দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করলেন। ভ্রু বাঁকিয়ে তীব্র ভর্ৎসনার কণ্ঠে বললেন,
‘ তুই এখানে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে রইলি কেন? মহারাণী ভিক্টোরিয়া সেজেছিস? খাবার মুখে তুলে দিতে হবে? নাকি সকালের নাস্তাটা গ্রহণের জন্য আমাদের সকলকে আপনার পা ধরে বসে থাকতে হবে?
আমি অপ্রস্তুত হাসার চেষ্টা করলাম। বুঝাতে চেষ্টা করলাম, ঘুম থেকে উঠেই খেতে বসলে কেমন বিশ্রী লাগে স্বাদ। তারপর আরও কত অসুবিধা। কিন্তু আম্মু তার আগেই কঠিন এক ধমক দিলেন। চরমপত্রের থেকেও ভয়াবহ আল্টিমেটাম দিয়ে বললেন,
‘ আবার যদি তোকে বিছানার আশেপাশে দেখি তো তোর খবর আছে। হাত-মুখ ধুয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সকালের নাস্তা শেষ করবি। পাঁচ মিনিট এপাড়-ওপাড় হলে জমিদারগিরি একেবারে ছুটিয়ে ফেলবো।’
আমার মুখ ভার হলো। বাংলা বর্ষপুঞ্জিতে ‘১৪২৮ বঙ্গাব্দ’ যেমন ক্লান্তিতে নুইয়ে পড়েছে সমাপ্তির দোরগোড়ায়; আমার অবস্থাও কিঞ্চিৎ সেরকম। ঘুমের ভারে অদৃশ্য দেখছি ত্রিভুবন। মাথা দপদপ করছে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি মাত্র নেই। অথচ মা জননী বাড়ির আনাচে কানাচে ঢঙ্কা পিটিয়ে আদেশ জারি করলেন, বিছানায় গা ছোঁয়ানো নিষিদ্ধ। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বলি, এ কেমন স্বৈরাচার? এই স্বৈরাচারের কী কোনো বিচার ব্যবস্থা নেই?
গোটা বাড়ি চিরুনিতল্লাসি করে একটা নীরব জায়গায় এসে বসেছি আমি৷ জায়গাটা বাড়ির টানা বারান্দা। নিচে সবজি মামাদের হাঁক ছাড়া তেমন কোনো উচ্চ আওয়াজ নেই। আমার সামনে ছোট্ট টেবিলে ধূমায়িত চায়ের কাপ রাখা হয়েছে। সঙ্গে একটা সিদ্ধ ডিম। জিনিস দুটো টেবিলে সাজিয়ে রেখে বাধ্য সেনাপতির মতো দুইপাশে দাঁড়িয়ে আছে জারিফ-আদিবা। তাদের প্রধান দায়িত্ব, আমার ঘুম সম্পর্কে আম্মুর কাছে খবরাখবর পাঠানো। আম্মু হঠাৎ জানতে পেরেছেন, অতিরিক্ত ঘুম মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। খাঁটি বাংলা ভাষায় বেআক্কল বানিয়ে দেয়। আম্মুর ধারণা, তার ছোট মেয়ে এমনিতেই যথেষ্ট বেআক্কল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আরও বেআক্কল হয়ে গেলে সমস্যা আছে। তিনি বেআক্কল জনিত সমস্যা নিয়ে চিন্তিত৷ এই বেআক্কল জনিত তথ্যগুলো আম্মু পেয়েছেন মহামতী শুভ্র ভাই থেকে। আমাকে বিপদে ফেলার মতো সহস্র তথ্য নিয়ে তিনি ঘোরাফেরা করেন। তার মাথায় তথ্যের শেষ নেই। তিনি যে কতটা ফাজিল, অত্যাচারী, নরাধম তা তার বিচিত্র তথ্য ভাণ্ডার দেখেই আন্দাজ করে ফেলা যায়। তারপরও আমার ভাই-বোন আর আম্মুর কাছে সে নম্র-ভদ্র, মহামতী লেভেলের ভালো মানুষ। মানে হয়? আমি ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে পিটপিট করে আশেপাশে চাইলাম৷ আদিবা হাসিহাসিমুখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আর একটু পর পর ‘ বড়ো মামী, রোদাপু ঘুমিয়ে পড়ে যাচ্ছে’ বলে চিৎকার দিচ্ছে। আমি বিরক্তবোধ করলাম৷ এই পুচকুটাও শুভ্র ভাইয়ের ভক্ত; দিনদিন তার মতোই ফাজিল হচ্ছে। শাসন করা দরকার। আমি হাত বাড়িয়ে শক্ত একটা চাপট মারলাম তার গালে। বললাম,
‘ চিৎকার করলে আবার মারবো।’
আদিবা চিৎকারের ধারেকাছেও গেলো না৷ কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে হতভম্ব চোখে চেয়ে থেকেই মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলো; মূর্ছা যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি পানসে মুখে বসে রইলাম। ফুপি ছুটে আসার আগেই এটাকে তুলে বারান্দার বাইরে ফেলে দিবো কি-না চিন্তাভাবনা করা দরকার।
আমার চিন্তাভাবনার আগেই কোথায় যেন কী একটা ঘটে গেলো। ভেতরের ঘরে বিরাট হৈ-হুল্লোড় চলছে। আমার এক সেনাপতি কেঁদেকেটে বেহুঁশ হয়ে গেলেও অন্য সেনাপতি সচল আছে। আমি সচল সেনাপতিকে শুধালাম,
‘ ব্যাপার কী?’
জারিফ ভেতরের ঘর ঘুরে এসে গম্ভীর মুখে ব্যাপার জানালো,
‘ মিষ্টু নামক এক দুষ্ট শিশু ব্রডব্যান্ডের রাউটারের উপর হিসু করে দিয়েছে। ব্রডব্যান্ডের লাইন কাজ করছে না।’
খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। যদিও এই দুঃখ আমাকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারলো না৷ আমি চিন্তাই করতে পারছি না, এতো জায়গা থাকতে মিষ্টুর কেন সেখানেই হিসু করতে হবে? আর কোনো জায়গা ছিলো না? আমি জারিফকে নিয়ে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করতে গেলাম। ঘরের ভেতর তখন মিলাদ ভাইয়ের বক্তব্য চলছে। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ রাউটার ছিলো রাহাতের ঘরে, টেবিলের তলায়। মিষ্টু সারা বাড়ি রেখে খুঁজে খুঁজে রাহাতের টেবিলের তলাতেই গেলো কী করে? ও কী হাঁটতে পারে? ওকে সেখানে নিয়ে গেলো কে?’
রাতুল ভাই বললেন,
‘ আলিফ। মিষ্টু ওর কোলেই ছিলো। হিসু করার সম্ভবনা দেখেই ও মিষ্টুকে রাউটারের উপর বসিয়ে দিয়েছে।’
মিথি আপু চটে গিয়ে বললো,
‘ কোন আক্কলে তুই আমার মেয়েকে রাউটারের উপর বসিয়ে দিলি আলিফ? আমার মেয়ে তোর কোলে হিসু করলে কী তোর জাত যেতো?’
আলিফ ভাই চোখ-মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে বললেন,
‘ পাপী রাতুল মিথ্যে বলছে। কোনো হিসু টিসু না। রাউটারের উপর পানি ফেলেছে রাতুল। এখন গা বাঁচাতে আমার আর আমার নিষ্পাপ ভাগ্নীকে দোষারোপ করা হচ্ছে। ব্যাড, ভেরি ব্যাড!’
আমরা সকলে এবার রাতুল ভাইয়ের দিকে চাইলাম। রাতুল ভাই প্রতিবাদ করে বললেন,
‘ মিথ্যা কথা। আলিফ পৃথিবীর সবথেকে বড়ো মিথ্যাবাদী।’
আলিফ ভাই বললেন,
‘ আমি মিথ্যা কথা কেন বলবো? জন্মের পর থেকে আমি কখনো কোনো মিথ্যা কথা বলেছি?’
আলিফ ভাইয়ের মন্তব্যে কেঁশে উঠলো সবাই। আলিফ ভাই উদাহরণে বাড়াবাড়ি বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। মুখখানা গম্ভীর করে বললেন,
‘ বেশ, দোষ যখন আমার ঘাড়ে চেপেছে। এই রাউটার রহস্যের সত্যতা বের করার দায়িত্বও আমার। প্রয়োজনে এই রাউটারকে ফরেন্সিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে। এর ভেতরে ইউরিন আছে নাকি ওয়াটার সেই রিপোর্ট খবরের কাগজে ছাপানো হবে। এই জারিফ? যা, এক্ষুনি গিয়ে রাউটারটা নিয়ে আয়।’
জারিফ রাউটার আনতে গেলেও ফিরে এলো খালি হাতে। আলিফ ভাই শুধালো,
‘ রাউটার কই?’
জারিফ হতাশ কণ্ঠে বললো,
‘ মিষ্টু হিসু করেছে শুনে রাউটার সাবান দিয়ে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিয়েছে মেজো মামী। রাউটার এখন ছাদে রোদ পোহাচ্ছে।’
ভয়াবহ কাণ্ড! ঘরের ভেতর পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। আমরা সকলেই হতাশ হয়ে একে অপরের দিকে চাইলাম। আলিফ ভাই মর্মাহত কণ্ঠে বললেন,
‘ সাবান দিয়ে ধোওয়া রাউটারটাই নিয়ে আয়, যা। সাবান দিয়ে ধোওয়া রাউটার নিয়ে আমরা এখন যাবো শুভ্র ভাইয়ের বাসায়। শুভ্র ভাই নিশ্চয় এই রহস্য সমাধানের কোনো না কোনো পদ্ধতি বের করে ফেলবেন। আমাদের এই বিশাল কাজে একজন মহৎ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের মতামত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভেরি ইম্পোর্টেন্ট।’
আমি আলিফ ভাইয়ের ‘ভেরি ইম্পোর্টেন্ট’ কাজে অংশগ্রহণের আগ্রহ পেলাম না। উদাসমুখে বারান্দায় ফিরে এলাম। ততক্ষণে আদিবার কান্নাকাটি কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। সে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। আমাকে দেখামাত্র তার কান্না নতুন উদ্যম খুঁজে পেলো। নতুন উৎসাহে সে উচ্ছ্বসিত। মেয়ের কান্না শুনে ছোট ফুপির এতোক্ষণে মৌমাছির মতো ছুটে আসার কথা ছিলো। আজ আসছে না। রাফিয়ার বিয়ের ব্যাপারটা তার মাথায় ভালোভাবেই ঢুকে গিয়েছে। এই সচিবালয়ওয়ালাকে ভাতিজির আঁচলে না বাঁধা পর্যন্ত অন্যকোনো বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করবেন বলে মনে হচ্ছে না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বারান্দার প্রাচীরে চিবুক ঠেকিয়ে উদাসমুখে চেয়ে রইলাম আকাশে। মাঘের আকাশে সচারাচর মেঘ থাকে না। আকাশ থাকে ঝকঝকে নীল। অথচ আজকের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। থেকে থেকে বৃষ্টি গুঁড়ার জলে ভিজে যাচ্ছে কুয়াশাচ্ছন্ন পৃথিবী। সকাল-দুপুর-বিকেল আলাদা করা যাচ্ছে না। সবই দেখাচ্ছে ভোরের মতো। এই শান্ত স্নিগ্ধ ভোর ভোর দুপুরে শীতল এক হাত এসে থামলো আমার মাথায়। আমি মাথা তুলে ঘাড় ফিরাতেই দেখতে পেলাম এক টুকরো স্নেহময়ী হাসি। আমি একটুও অপেক্ষা না করে স্নেহময়ীর কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজলাম তার উষ্ণ বুকে। মামানি বললেন,
‘ এই ফাজিল মেয়ে, তুই নাকি এখনও নাস্তা করিসনি? আয় তোকে খাইয়ে দিই।’
আমি মামানির বুকে চিবুক ঠেকিয়ে তার মুখের দিকে চাইলাম। হেসে বললাম,
‘ তুমি কখন এলে?’
‘ অনেকক্ষণ। সাঈদা আপা আমাকে ছাড়া কিছুতেই আসবে না। আর তোর মা-ও সেই সকালে ফোন দিয়ে বলে রেখেছে এখানে এসে নাস্তা করতে হবে। সপরিবারে দাওয়াত। কথায় কথায় দাওয়াত দেওয়া তোর মায়ের স্বভাব হয়ে গিয়েছে। এমনিতেই এতো মেহমান তার মধ্যে আমাদের দাওয়াত দিয়ে কাজ বাড়ানোর কোনো মানে হয়?’
আমি আহ্লাদী কণ্ঠে বললাম,
‘ মামানি, তুমি এতো ভালো কেনো? এতো মা মা গন্ধ তোমার গায়ে! আমি অনেকক্ষণ তোমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো। তুমি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে, প্লিজ।’
মামানি পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরে রাখলেন আমায়। ঠিক তখনই আমার সকল শান্তি বিনষ্ট করতে শুভ্র ভাইয়ের উদয় হলো। চির ঘুমন্ত ফোন হঠাৎ বাজখাঁই শব্দে বেজে উঠলো। আমি চমকে বুকে থুতু ছিটিয়ে রিসিভার তুলতেই ওপাশ থেকে ধমকে উঠলেন শুভ্র ভাই,
‘ ফোন তুলতে এতোক্ষণ লাগে? বড়দের প্রতি কোনো রেসপেক্ট নাই? আমি তোর থেকে কত বছরের বড়ো সে হিসেব রাখিস? হিসেব শুনলে তো দাঁত খুলে পড়ে যাবে। তারপরও বলি, আমি তোর থেকে পাঁচ বছর দুই মাস আটাশ দিনের বড়ো। আর সেই আমাকে তুই সুদীর্ঘ ত্রিশ সেকেন্ড ওয়েটিং এ রাখিস? অতি শীঘ্রই তোর নাম পাল্টে বেয়াদব খান রাখা উচিত। ইয়াহিয়া খানের কন্যা বেয়াদব খান, সুন্দর মিলেছে।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
‘ আমি ফোন দিলে তো আপনি এক সপ্তাহেও রিসিভ করেন না। তাহলে আপনার নাম কী দেওয়া উচিত, শুভ্র ভাই?’
‘ আমার নাম নিয়ে তোর মতো বেয়াদব খানের সাথে আলোচনা আমি করবো না। তোর সাথে কথা বললে আমার সাদা মন কালো হয়ে যাবে। তুই আম্মুকে ফোনটা দে। আম্মু কোথায়?’
আমি বিরক্ত কণ্ঠে বললাম,
‘ আপনার আম্মুকে আমি কোলে নিয়ে বসে আছি? আমি জানি না মামানি কোথায়। আপনি মামানির ফোনে ফোন দিন।’
শুভ্র ভাই অধৈর্য কণ্ঠে বললেন,
‘ আম্মু বাসায় ফোন ফেলে গিয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না, একজন মা এতোটা নিষ্ঠুর কী করে হতে পারে!’
আমি বিনাবাক্য ব্যয়ে লাইন কেটে মামানির দিকে চাইলাম। অতিষ্ঠ কণ্ঠে বললাম,
‘ আমাকে জ্বালানোই যে তোমার ছেলের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য — কথাটা তুমি বিশ্বাস করো মামানি? আমার ধারণা, আমি যদি আফ্রিকার গহীন জঙ্গলেও জন্মাতাম সেখানেও তিনি ঠিক উপস্থিত হতেন। ভয়ানক বিরক্ত হয়ে ধমকা-ধমকি জুড়ে দিতেন। বলতেন,
এক থাপ্পড় দিয়ে তোর দাঁত ফেলে দেওয়া উচিত বেয়াদব। কোন অ-জায়গায়, কু-জায়গায় জন্মেছিস দেখ্। পৃথিবীতে জায়গা কম পড়েছিলো? তোর কেন আফ্রিকার জঙ্গলে এসেই জন্মাতে হবে? এখন কী আমরা লতা-পাতা পরে নাচানাচি করবো? তোর মতো গর্দভ প্রজাতির অবশ্য পছন্দজ্ঞান থাকে না। আচ্ছা যা, তোর গর্দভ মস্তিষ্কের কথা চিন্তা করে তোকে ক্ষমা করে দেওয়া হলো। আমি সহৃদয়বান মানুষ, আমার মন অনেক বড়ো। সেজন্যই এসব পোকামাকড় খেয়েও তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি। অন্য কেউ হলে এই অনাচারের জন্য কোনোদিন ক্ষমা পেতি না; সেকেন্ডে সেকেন্ড থাপ্পড় পেতি। প্রতি সেকেন্ডে এক কেজি করে থাপ্পড়। অথচ – ‘
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই চঞ্চলা কিশোরীর মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন মামানি। আমি মুখ ভার করে বসে রইলাম। মামানির হাসির মাঝেই ঝড়ের বেগে ফোন নিয়ে এলো জারিফ। মামানির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ শুভ্র ভাইয়া কথা বলবে।’
মামানি তখনও হাসি থামাতে পারেননি। কণ্ঠে হাসির আদ্র ছাপ নিয়েই বললেন,
‘ হ্যাঁ, বল।’
অযথা বসে আছি বলেই মামানির কানের কাছে কান পাতলাম আমি। শুভ্র ভাই ভয়ানক রাগ দেখিয়ে বললেন,
‘ বল, মানে? এমন ইনসাফ ছাড়া কাজটা তুমি কী করে করলে আম্মু? তুমি জানো না, আমি নাস্তা করিনি? রান্নাবান্না না করে গিয়ে বসে আছো ননদের বাসায়। আম্মু আমার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তুমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাসায় আসবে। নয়তো ঘরের একটা জিনিসও আস্ত থাকবে না ; সব আমি ভেঙে ফেলবো।’
‘ তোর ফুপি সেই ভোর থেকে ফোন দিয়ে চলেছে। আজ আমাদের এই বাসায় দাওয়াত। তোর বাবা আর আমি এখানে এসে নাস্তা সেরে ফেলেছি। তোকে ডাকলাম, তুই উঠলি না। এখানে আসতেই হবে তাই রান্না করিনি। তুইও এখানে চলে আয়।’
শুভ্র ভাই এবার আরও রেগে গেলেন। ফোনের ওপাশে প্রচন্ড এক শব্দ হলো। আমি চমকালাম। শুভ্র ভাই গর্জে উঠে বললেন,
‘ তোমার ননদ তোমায় দাওয়াত দিয়েছে তুমি প্রাণ ভরে খাও। আমার মেজাজ খারাপ করাবে না। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, তুমি বাসায় আসছো কি আসছো না? আমি অবশ্যই অন্যের বাসায় নাস্তা করতে আসছি না। তোমার ছেলে অভুক্ত সে নিয়ে তোমার কোনো দুশ্চিন্তাই দেখতে পাচ্ছি না। সিরিয়াসলি আম্মু? তোমার তো ছেলের প্রতি কোনো মায়া মোহাব্বতই নাই। পারলে আমি এক্ষুণি জাপানে ফিরে যেতাম। এইবার দেশ ছাড়ার পর খবরদার ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করবে না। কান্নাকাটি করলে আমি বাংলাদেশে বোম মারবো।’
এমন উত্তপ্ত মুহূর্তেও আচমকা হাসি পেয়ে গেলো আমার। আমি ফিক করে হেসে দিতেই শুভ্র ভাইয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। ধমক দিয়ে বললেন,
‘ তোমার পাশে কে আম্মু? রোদ? এই ফাজিলকে এক্ষুনি কঠিন একটা থাপ্পড় দিবে। আমি এখানে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি আর তোমরা দু’জন ফোন লাউডে দিয়ে হাসি মজা করছো?’
মামানি বিপন্ন কণ্ঠে বললেন,
‘ আমি এক্ষুনি তোর জন্য খাবার পাঠাচ্ছি। তুই এতো রাগ করছিস কেন? তোর ফুপি কী অন্য মানুষ?’
শুভ্র ভাই শীতল কণ্ঠে বললেন,
‘ খাবার পাঠানোর প্রয়োজন নেই। আমি খাবো না। শুধু আজকে কেন? কাল ফ্লাইট ধরার আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি কিছুই খাবো না। বাংলাদেশ থেকে আমি যাবো অভুক্ত অবস্থায়। আমার ব্যাগে কোনো রকম খাবার দেওয়ার চেষ্টা তুমি করবে না। দিলে সব আমি ডাস্টবিনে ফেলে দিবো।’
মামানি আঁতকে উঠে বললেন,
‘ এটা কেমন কথা? তুই কী এখনও বাচ্চা আছিস? বাচ্চাদের মতো আচরণ করছিস কেন? আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাসায় আসছি। এসেই রান্না বসাবো।’
শুভ্র ভাই শান্ত কণ্ঠে বললেন,
‘ না, তুমি বাসায় আসবে না। তুমি বাসায় এলে আমি এই মুহূর্তে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবো। তুমি জানো, আমি তাই করবো।’
মামানি হতভম্ব হয়ে বসে রইলেন৷ ছেলের রাগ সম্পর্কে জানেন বলেই দুশ্চিন্তায় কালো হয়ে গেলো তার মুখ। আমি নিজের আতঙ্ক চাপা দিয়ে মামানিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম,
‘ তুমি এতো দুশ্চিন্তা করো না তো মামানি। শুভ্র ভাই রাগের মাথায় কী না কী বলেছেন তাই নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা করতে হবে? আমি এক্ষুনি আম্মুকে বলে ভাইয়ার হাতে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
মামানি আহত চোখে আমার দিকে চাইলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,
‘ তুই নিজেও জানিস, শুভ্র যা বলেছে তাই করবে। ওর কথার নড়চড় হবে না। আমার এখানে আসায় উচিত হয়নি। ছেলেটা আমার কাল চলে যাবে অথচ আমি এখানে এসে বসে আছি। ঘুমন্ত ছেলেকে রেখে কী করে এলাম আমি? ছেলেটা কাল থেকে উপোষ। আমার এতো অস্থির লাগছে!’
আমাকে অবাক করে দিয়ে মামানির দু’চোখ টলমল করে উঠলো। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মামানিকে বসালাম। মামানির মাথা নিজের বুকে টেনে নিতেই বুঝলাম, মামানির সারা শরীর দুশ্চিন্তায় কাঁপছে। আমি বিস্মিত হয়ে দেখলাম, স্বীয় পুত্রের জন্য কী পরিমাণ ভালোবাসা বুকে জমিয়ে রেখেছেন একজন নারী। আমি মামানিকে জড়িয়ে ধরে হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মামানি রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,
‘ এখন আমি কী করবো? বাসায় গেলে রাগারাগির চূড়ান্ত করবে শুভ্র। ডিরেক্ট বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে। আল্লাহ এতো রাগ দিয়েছে আমার ছেলেটার মধ্যে; একটু বুঝ দিক। রেগে গেলে ও এতো নিষ্ঠুর হয়ে যায়!’
আমি দিশেহারা বোধ করলাম। মামানির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না। আমি আছি না? আমি নিজে যাবো তোমাদের বাসায়। খাবে না মানে? উনার চৌদ্দ গোষ্ঠীসহ খাবে। তুমি প্লিজ শান্ত হও।’
মামানি শান্ত হলেন। আনমনা হয়ে বললেন,
‘ হু, তুই গেলে বোধহয় রাগ একটু কম করবে। তুই কিন্তু আজ আবার ওর সাথে ঝগড়া করিস না মা। আমার ছেলেটা আসছে থেকে এক বেলাও ঠিক মতো খেতে পারেনি। একটুও হাসেনি। এটা নিয়ে মন খারাপ, ওটা নিয়ে রাগ লেগেই আছে। কাল তো চলেই যাবে। এমন মন খারাপ নিয়ে গেলে ছটফট করবে না? রাতে তো ঘুম হবে না ওর। আমি কেমন মা? আমি থাকতেও আমার ছেলেটার এতো মন খারাপ হচ্ছে; আমি আটকাতে পারছি না।’
আমি একদৃষ্টিতে মামানির দিকে চেয়ে রইলাম। এই প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম, শুভ্র ভাইকে কী ভয়ঙ্করভাবেই না ভালোবাসেন মামানি! আম্মুও ভাইয়াকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন কিন্তু মামানির মতো এতো আকুল হয়ে কোনো মাকে ভালোবাসতে দেখিনি আমি। শুভ্র ভাইয়ের দেহ-মনে সূক্ষ্ম আঘাতও তিনি সহ্য করতে পারেন না। শুভ্র ভাই খুব ভালো করে জানেন, তার কিছু হলে তার মাকে এক মিনিটও বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তারপরও যাবতীয় রাগ দেখান মামানির সাথেই। যার ভালোবাসা যত বেশি আমরা বোধহয় তাকেই সবথেকে বেশি কষ্ট দিতে ভালোবাসি। আমার মন আনমনা হয়ে ভাবে, এই পৃথিবীতে কে আমাকে এই পৃথিবীর থেকেও বেশি ভালোবাসে? আমিও কী তাকে এভাবেই কষ্ট রাখি?
গুড়িগুড়ি বৃষ্টি ঝমঝম রূপ নিয়েছে আমি বাড়ির সীমানা পেরুতেই। আম্মু সাথে ছাতা নিতে বলেছিলেন, নিইনি বলে আফসোস হচ্ছে। এই মাঘের শীতে এমন ঝমঝমে বৃষ্টির আদৌ কী কোনো প্রয়োজন আছে? কিছুটা দৌঁড়ে, কিছুটা হেঁটে, গায়ের চাদর ভিজিয়ে, অর্ধসিক্ত অবস্থায় চার তলায় উঠে হাঁপ ধরে গেলো আমার। ঠাণ্ডায় শরীর কাঁপছে। মামুর বাসায় গিয়েই এক কাপ আগুন গরম চা না খেলে এই শীত কাটবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি কলিংবেল বাজিয়ে অপেক্ষা করলাম। শুভ্র ভাই দরজা খুললেন অনেকটা সময় নিয়ে। এলোমেলো চুল, শুকনো মুখটা আমাকে দেখেই শক্ত হয়ে গেলো। আমি উনার শক্ত মুখের পরোয়া না করে ভেতরে ঢুকলাম। গায়ের অর্ধ ভেজা চাদরটা তৎক্ষনাৎ খোলে শুভ্র ভাইয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওড়নায় হাত মুখ মুছতে লাগলাম। খুব অভিযোগ নিয়ে বললাম,
‘ বাইরে কী বৃষ্টি জানেন? আমি বের হওয়ার পরই কেন এতো বৃষ্টি নামতে হলো? আমার ভাগ্য এতো খারাপ! নয়তো মাঘ মাসের এই শীতের দিনে বৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ আছে? এখন তো বৃষ্টির দিন নয়।’
কথা বলতে বলতেই বসার ঘরের পাশের ওয়াশরুম থেকে পা ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলাম আমি। শুভ্র ভাই তখনও ভেজা চাদর হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে বিভ্রান্তি। আমি রান্না ঘরের সরঞ্জাম দেখতে দেখতে শুধালাম,
‘ কী খাবেন বলুন তো? আজি ঝরো ঝরো বাদলও দিনে… খিচুড়ি চলবে? খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর ডিম ভুনা। মাছ ভাজা যেতো। কিন্তু বরফ গলতে সময় লাগবে।অতো সময় হাতে নেই। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি। আমিও এখনও নাস্তা করিনি, জানেন?’
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। ভেজা চাদর হাতে চুপচাপ নিজের ঘরে ফিরে গেলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দুইদিন আগে আমার ভীষণ জ্বর ছিলো। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরটা আবার আড়মোড়া ভাঙছে। যেকোনো সময় হুহু করে বাড়তে শুরু করবে। জ্বর বেড়ে যাওয়ার আগেই রান্না শেষ করতে হবে। আমি রান্না ঘরের জানালা খোলে দিলাম। বৃষ্টির ছাঁট আসছে, আসুক। আজকের রান্না হবে বৃষ্টিবিলাস করতে করতে। মনে বাজবে বৃষ্টির গান,
‘শ্রাবণের মেঘগুলি জড়ো হলো আকাশে,
অঝোরে নামবে বুঝি শ্রাবণে ঝরায়ে
আজ কেন মন, উদাসী হয়ে
দূর অজানায়, চায় হারাতে –
আমার রান্না শেষ হতে ঘন্টাখানেক লেগে গেলো। আমি টেবিলে খাবার গুছিয়ে শুভ্র ভাইয়ের ঘরে উঁকি দিলাম। শুভ্র ভাই দরজার দিকে পিঠ করে অলস ভঙ্গিতে বসে আছেন। টেবিলে অনেকগুলো কাগজ, মার্কার, পেন্সিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুভ্র ভাইয়ের কোলের উপর বোধহয় ল্যাপটপ। তিনি ল্যাপটপ কোলে নিয়ে উদাসমুখে বৃষ্টি দেখছেন। আমি পায়ে পায়ে হেঁটে শুভ্র ভাইয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়লো। বাবা প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরেই বারান্দায় গা এলিয়ে বসেন। ঘর-সংসারের নানান কথা চিন্তা করেন। আমি পাশে দাঁড়ালে নরম কণ্ঠে বলেন,
‘ কাঁধ ম্যাসেজ করে দাও তো, মা। চুলে হাত বুলিয়ে দাও। যদি একটু ঘুম আসে?’
এই কাজে বাবা কখনোই আপুকে ডাকেন না। বড়ো মেয়ের সাথে বাবার সংকোচবোধটা প্রবল। আমি বাবার কাঁধে হাতের আলতো চাপ দিতে দিতে শুধাই,
‘ বাবা, তুমি কেমন আছো?’
আমি শুভ্র ভাইয়ের প্রশস্ত কাঁধে হাত রাখলাম। শক্ত কাঁধে হাতের আলতো চাপ পড়তেই প্রতিবাদহীন চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন শুভ্র ভাই। বাইরে দারুণ বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির জলে ভেসে যাচ্ছে বারান্দায় লাগানো ফুলগাছ। তিরতির করে কাঁপছে সবুজ পাতা, রঙিন ফুল। হিম দেওয়া বাতাসে উড়ে যাচ্ছে দরজার সফেদ পর্দা। ঠান্ডার দাঁত ভাঙা কামড়ে শিরশির করে উঠছে গায়ের চামড়া। তবুও অদ্ভুত এক ভালো লাগায় মন ভরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর কোথাও যেন খুব আনন্দের ব্যাপার ঘটছে। সেই আনন্দ জ্যোতির কিছুটা এসে লাগছে আমার মনে। দূরে কোথাও পছন্দের গান বাজলে যেমন কথা হারিয়ে কেবল সুরগুলো ভেসে আসে কানে ঠিক সেরকম এক আনন্দ। ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়; গভীরভাবে আস্বাদন করা যায় না। আমি অদ্ভুত এক মমতায় শুভ্র ভাইয়ের মাথায় হাত রাখলাম। এলোমেলো চুলের গোড়ায় নরম আঙুল পড়তেই পেছন দিকে ঘাড় ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। কিছুক্ষণ চুল ধরে টানাটানি করে শুভ্র ভাইয়ের কপালে চিবুক ঠেকিয়ে ফিসফিস করে শুধালাম,
‘আপনি কেমন আছেন , শুভ্র ভাই?’
প্রশ্নের সাথে সাথে ঠোঁট ছুঁয়ে গেলো তার শীতল কপাল। শুভ্র ভাই চোখ মেলে চাইলেন।চোখেদুটোতে তার মুগ্ধতা ও বিস্ময়ের অপরূপ মিশ্রণ। সেই মিশেল দৃষ্টি নিয়ে তিনি নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন আমার চোখে, উত্তর দিলেন না৷ আমি মিষ্টি করে হাসলাম। চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে দুই কাঁধে শক্ত চাপর দিয়ে শুধালাম,
‘ চুল আঁচড়াননি কেন? কাকের বাসার মতো লাগছে। আচ্ছা, আপনি চুলে কী শ্যাম্পু লাগান?’
শেষ প্রশ্নটা করে সরে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। নিজের বিনুনি খুলতে খুলতে মুখ ভার করে বললাম,
‘ এতো করে টানলাম তবু একটা চুলও উঠলো না আপনার। অথচ আমার চুলে টান পড়লেই ফরফর করে উঠতে থাকে।’
আমি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ালাম। শুভ্র ভাই চেয়ারের হাতলে কনুই রেখে হাতের মুঠোয় চিবুক ঠেকিয়ে নীরবে নিষ্পলক আমার চুল আঁচড়ানো দেখলেন। আমি বিনুনি গাঁথতে গাঁথতে চোখ না তুলেই শুধালাম,
‘ পাশের বাসার চারতলার ছেলেটা কোন ক্লাসে পড়ে শুভ্র ভাই? অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার চুল বাঁধা দেখছে। ওদের বারান্দায় লাল রঙের ফুলগুলোর নাম কী? চাইলে দিবে?’
শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে এবার প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো। তড়িৎ গতিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে অপর পাশের ছেলেটিকে দেখলেন। তারপর সশব্দে বন্ধ করে দিলেন দরজা। আমি চোখ বোজে সেই শব্দ হজম করলাম। শুভ্র ভাই বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘ এই এক বিনুনি গাঁথতে গাঁথতেই তো দশ বছর লাগিয়ে দিচ্ছিস। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে চুল তোর একাই আছে আর কারো চুল নেই। আমরা সব টাকলু। আর কী ছাইপাঁশ বিনুনি গাঁথছিস? এর থেকে ভালো বিনুনি তো আমিই গাঁথতে পারি। সর, দেখি। আমি বিনুনি গাঁথবো।’
আমি অবাক হয়ে শুধালাম,
‘ আপনার চুলে বিনুনি হবে?’
শুভ্র ভাই উত্তর দিলেন না। আমার দিলে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এক টানে আমার চুলের গোছা টেনে নিলেন নিজের হাতে। আমি ব্যথায় চুল চেপে ধরে আর্তনাদ করে উঠলাম। শুভ্র ভাই গ্রাহ্যই করলেন না। সম্পূর্ণ বিনুনি খুলে আবার নতুন করে চিরুনি চালালেন। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে বিনুনি গাঁথতে বসলেন। আমি ভেবেছিলাম, শুভ্র ভাই বোধহয় টেনেটুনে অর্ধেক চুলই ছিঁড়ে ফেলবে আমার। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে শুভ্র ভাই খুব ধৈর্য দেখালেন। সময় নিয়ে খুব ধীরে ধীরে বিনুনি গাঁথলেন। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বারান্দা থেকে এক মুঠো সাদা লিলিফুল তুলে আনলেন। সেগুলো গুঁজে দিলেন বিনুনির ভাঁজে ভাঁজে। ফুলে অলঙ্কৃত বিনুনিখানা আমার কাঁধে ছড়িয়ে দিয়ে আমার বাহু চেপে আয়নার সামনে দাঁড় করালেন। আমার মাথার উপর চিবুক ঠেকিয়ে পেছনে দাঁড়ালেন তিনি। আয়নার মধ্যে দিয়ে নির্নিমেষ চোখে দেখলেন। নরম চুলে আলগোছে ছুঁয়ে গেলো তার উষ্ণ ঠোঁট। বিমুগ্ধ কণ্ঠে বললেন,
‘ শুভ্রফুলে শুভ্রবধূ, কী সুন্দর!’
আমি নাকি বিনুনি, কার সৌন্দর্যের প্রশংসা করলেন বুঝা গেলো না। বুঝার অবশ্য প্রয়োজনও নেই। আমি খুশি হয়ে বিনুনিখানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে আমার মাথায় শক্ত এক চাপট মেরে বললেন,
‘ ক্ষুধা লেগেছে, খেতে আয়।’
উনার চাপটে আমার বিনুনি থেকে দুটো ফুল খুলে পড়ে গেলো। কত বড়ো বেয়াদব, চিন্তা করা যায়? আমি মুখ ভার করে ফুলগুলো তুলে আবারও বিনুনিতে লাগানোর চেষ্টা করলাম। তখনই চোখে পড়লো বিছানার একপাশের ছোট্ট টেবিলটা উল্টে পড়ে আছে মেঝেতে। একটা কাচের জার আর গ্লাসও গড়াগড়ি খাচ্ছে তার সাথে। এটাতেই নিশ্চয় লাথি কষিয়েছিলেন ফোনে কথা বলার সময়? আমি বিরক্তবোধ করলাম। কথায় কথায় জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা যার স্বভাব তার সাথে গোটা জীবন একই ছাদের নিচে কাটানো সম্ভব? অতিরিক্ত রাগে যে একদিন বউ মেরে ফেলবে না তার কোনো নিশ্চয়তা আছে? আচ্ছা, মারুক।আমার মন আচমকা নরম হলো। এতো সুন্দর বিনুনি করে দেওয়ার জন্য তাকে একটা বউ মেরে ফেলার অনুমতি দেওয়া হলো। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে টেবিলটা তুললাম। গ্লাসটা অক্ষত থাকলেও পানির জারটা ভেঙে চুরমার। ভাঙা কাচ উঠাতে গিয়ে চোখে পড়লো পানিতে ভিজে জবজবে এক ওয়ালেট। নিশ্চয় শুভ্র ভাইয়ের? অথচ উনি খেয়াল পর্যন্ত করেননি। ভেতরের জিনিস ঠিকঠাক আছে কি-না দেখার জন্য দ্রুত ওয়ালেট খুললাম আমি। টাকাপয়সা তেমন একটা নেই। সব কার্ড-ফার্ডে ভর্তি আর সাথে একটা মেয়ের ছবি। ছবিতে মেয়েটা হাসছে। মেয়েটা কেন হাসছে সে তথ্য না জানলেও মেয়েটাকে আমি চিনি।
‘ রোদ তুই আসবি? নাকি আমি সব খাবার ডাস্টবিনে ফেলে দিবো?’
শুভ্র ভাইয়ের চেঁচামেচিতে উঠে দাঁড়ালাম। তড়িৎ পায়ে খাবার ঘরে এসে উপস্থিত হলাম। শুভ্র ভাই খুব গুছিয়ে খাবার পরিবেশন করেছেন। আমি একটা চেয়ার টেনে বসে ওয়ালেটটা টেবিলের উপর রাখলাম। উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,
‘ আপনার প্রিয়তমার ছবি তো ভিজে গিয়েছে শুভ্র ভাই। মনে হচ্ছে, দুই একদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে।’
শুভ্র ভাই ভ্রু বাঁকিয়ে চাইলেন। ব্যাপারটা ধরতে পেরেই তড়িৎ গতিতে ওয়ালেটটা তুলে নিলেন হাতে। আমার বক্তব্যের সত্যতা বিচার করে আগুন চোখে চেয়ে বললেন,
‘ এই কাজটা তুই ইচ্ছে করে করেছিস।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ আমি কেন করবো? আপনার প্রিয়তমার ছবি নষ্ট করে আমার কী কী লাভ হতে পারে তার একটা উদাহরণ দিন।’
শুভ্র ভাইয়ের আগুন দৃষ্টিতে এবার হতাশা নেমে এলো। আমাকে বিষদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে বললেন,
‘ আই হ্যাভ আনাদার কপি।’
আমি নির্বিকারমুখে কাঁধ ঝাঁকালাম। একটা শসার টুকরো তুলে নিয়ে বললাম,
‘ থাকলে ভালো। আমাকেও এক কপি দেন। টানিয়ে রাখবো ঘরে। আপনার প্রিয়তমা বলে কথা।’
শুভ্র ভাই আবার কটমট করে তাকালেন। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, ছবি নয় আমি তার যক্ষের ধন চেয়ে বসেছি। আমি পাপী, পাপিষ্ঠ! আমি ঠোঁট উল্টালাম। না দিলে নাই। অতো ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকানোর কী আছে? আমি এই মেয়েকে রোজ দেখি; একটা ছবির জন্য পাপিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই।
মাঘের দেশে বর্ষা হাসে — ধরনের পরিস্থিতি চারিদিকে। এতো অশ্রু জড়ানোর পরও মুখ কালো করে আছে আকাশ। প্রগাঢ় অভিমান ; সহজে ভাঙবে বলে মনে হচ্ছে না। ঠান্ডায় গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। আমি গায়ে কম্ফোর্টার জড়িয়ে চেয়ারের উপর পা তুলে পদ্মাসনের মতো বসে আছি। শুভ্র ভাই একমনে খাচ্ছেন। আমি গালে হাত দিয়ে তার খাওয়া দেখছি। সুদর্শন মানুষের সবকিছুই সুন্দর হয়। হাঁটা-চলা, খাওয়া, হাসি, ঘুম সবকিছুতেই ছড়িয়ে থাকে সৌন্দর্যের দ্যুতি। তারপরও আমার ধারণা, শুভ্র ভাইয়ের মাঝে অন্যকিছু আছে। যে কারণে যারা তাকে ভালোবাসে, ভালোবাসে পাগলের মতো। মামানি, আম্মু, আমার পুরো কাজিনমহল, তাসনীম আপু, সুস্মিতা আপু, রাফিয়া এমনকি রাফিয়ার সেই পুচকু খালাতো বোন নিধি পর্যন্ত। শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্য এরকম হওয়ার কথা না। আমি শুভ্র ভাইয়ের দিকে চেয়ে শুধালাম,
‘ আপনার কেমন মেয়ে পছন্দ শুভ্র ভাই?’
শুভ্র ভাই নির্বিকার কণ্ঠে বললেন,
‘ আই অ্যাম ম্যারিড।’
‘ তারপরও। কী রকম মেয়ে দেখে মাথা-টাথা খারাপ হয়ে যায় আপনার? ইন শর্ট, একদম ক্রাশড হয়ে যান?’
‘ কেন? তুই কী মেয়েদের দালালি শুরু করেছিস নাকি? যার যার পছন্দ অনুযায়ী ডেলিভারির ব্যবস্থা?’
‘ সবার জন্য না। তবে আপনি স্পেশাল কেস।’
শুভ্র ভাই ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
‘ কী রকম?’
‘ তার আগে প্রশ্নের উত্তর দিন।’
শুভ্র ভাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন,
‘ আমাকে কী গাধা মনে হয় তোর? আমি বলি আর তুই আমার সংসারে একটা গ্যাঞ্জাম বাঁধিয়ে দে? তোরা পুরো গোষ্ঠীই তো গ্যাঞ্জাইম্যা।’
আমি কাতর কণ্ঠে বললাম,
‘ কোনোরকম গ্যাঞ্জাম বাঁধাবো না। আই সয়ার। এটা আমার বিজনেস। বিজনেস আর পার্সোনাল লাইফ আলাদা রাখাই হলো প্রফেশনালিজম। আমি যথেষ্ট প্রফেশনাল। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।’
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
‘ তুই কী সত্যি সত্যি মেয়েদের দালালি শুরু করেছিস নাকি? কী দারুণ অধঃপতন রে? চরিত্র খারাপ থাকলে সুবিধা নেওয়া যেতো৷ আফসোসে মরে যাচ্ছি।’
আমি নির্বিকার কণ্ঠে বললাম,
‘ মেয়েদের দালালি করছি না। আপনি আমার ব্যবসার একমাত্র ক্যাপিটাল। দালালিটা আপনাকে নিয়ে হচ্ছে।’
শুভ্র ভাই হতভম্ব, হতচকিত, হতাশ হয়ে বললেন,
‘ কী!’
আমি গম্ভীর কণ্ঠে বললাম,
‘ হু। আকর্ষণীয় মামাতো ভাই থাকার বেশ কিছু ঝামেলা আছে। সুন্দরী মেয়েরা খুব অত্যাচার করে। সুযোগ পেলেই কী করে আপনাকে সিডিউস করা যাবে তার উপর টিপস্ জানতে চায়। ভাবলাম, অত্যাচারকে টাকায় কনভার্ট করে ফেললে কেমন হয়? টাকা পেলে সকল অত্যাচারই লাগবে মধু। এরপর থেকে কেউ টিপস্ চাইলে তাকে প্যাকেজ অফার করা হবে। একেক প্যাকেজের একেক রকম দাম।’
শুভ্র ভাই বিষম খেলেন। বামহাতে থামস্ আপ দেখিয়ে বললেন,
‘ দূর্দান্ত! আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ। এই না হলে বংশের ধারা? একেবারে বাপের গুণ!’
আমি ঠোঁটভর্তি মেকি হাসি নিয়ে বললাম,
‘ থেংকিউ, থেংকিউ, থেংকিউ! এবার ঝটপট উপায়গুলো বলে ফেলুন। আমি নোট করে নিচ্ছি৷’
শুভ্র ভাই হাসলেন,
‘ কীসের উপায় বলবো?’
‘ এইযে, আপনাকে কীভাবে সিডিউস করা যেতে পারে তার মৌখিক বিবরণ।’
শুভ্র ভাইয়ের হাসি বিস্তৃত হলো। ঠোঁট টিপে হাসি চাপার চেষ্টা করে বললেন,
‘ এর আগে কেউ আমাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেনি; করলেও ধরতে পারিনি। তাই মৌখিক বিবরণ দিতে পারছি না। তবে তুই চেষ্টা করে দেখতে পারিস। আমি মাইন্ড করবো না। তোর ব্যবসার কথা চিন্তা করে এতোটুকু সেক্রিফাইজ আমি করতেই পারি।’
কত বড়ো খারাপ মানুষ! আমি চোখ-মুখ গম্ভীর করে বললাম,
‘ একদম ফালতু কথা বলবেন না। এই মুহর্তে আমি একজন উদ্যোক্তা। আমার প্রশ্নের ঠিকঠিক উত্তর দিন। আমি ঠিক ভেবে ভেবে পয়েন্ট বের করে ফেলবো।’
শুভ্র ভাই অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
‘ ফালতু কথা কোথায় বললাম? আমি তো তোর ব্যবসার বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছি। বিশ্বাস কর, আগ্রহে আগ্রহে আমার ভেতরটা ফেঁটে যাচ্ছে। ব্যবসার থেকেও বেশি আগ্রহ আমার উদ্যোক্তার প্রতি। উদ্যোক্তা সাহেবার উচিত এই পুরো ব্যাপারটা প্রেকটিক্যালি হ্যান্ডেল করা। এই বৃষ্টি শ্রাবণ দিনে, আমি বলি হতে রাজি।’
শেষ লাইনটা সুর করে গাইলেন শুভ্র ভাই। তারপর আবার চোখও টিপলেন। কত বড়ো ফাজিল! আমি বিষম খেলাম। চোখ-মুখ শক্ত করে বললাম,
‘ আপনি অত্যন্ত ফাজিল!’
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে চোখে জল চলে এলো। আমি অতিষ্ঠ কণ্ঠে বললাম,
‘ এতো হাসির কী আছে? হাসি থামান নয়তো খাওয়া বন্ধ।’
শুভ্র ভাই হাসি থামালেন না। বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজ ছাপিয়ে বেজে উঠলো তার মেঘমন্দ্র কণ্ঠ। তাকে প্রাণখোলে হাসতে দেখে আমার মন ভালো হয়ে গেলো। আমি তার দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলাম। বুক বেয়ে বেরিয়ে এলো একটিই প্রার্থনা,
‘ এই সুন্দর মানুষটির ঠোঁটের হাসি অম্লান হোক। অম্লান হোক। তার এক টুকরো হাসির জন্য আমার সকল সুখ বাজি। পৃথিবী জানুক, আমি তাকে আকাশের ভালোবাসি।’
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/