আসামের সিনেমা দেখেন এমন প্রশ্ন করলে শতকরা ৯৯ জন ভ্রু কুচকে তাকাবেন।অনেকে বলবেন আসামের লোকজন আবার সিনেমা বানায় নাকি।বোম্বে সিনেমা দেখলাম,কলকাতার ভোজপুরি ও দেখলাম।আসামিরা যে সিনেমা বানায় এই কথা তো শুনিনি।
এরকম যাদের ধারণা তাদের জন্য আজকের আলচনা সাড়া ফেলানো আসামি মুভি Aamis এর গল্প।মুভিটির পরিচালক ভাস্কর হাজারিকা।দর্শক,সমালোচক থেকে শুরু করে এওয়ার্ড ফাংশন অ মাতিয়েছিল এই সিনেমা।সাদামাটা প্রেমের গল্পের এই সিনেমা যে শেষে গিয়ে দর্শককে এভাবে ৪২০ ভোল্টের শক দিয়ে চমকে দিবে তা শুরুতে কেউই আন্দাজ করতে পারেনি।
চলুন তাহলে ঢুকে পড়া যাক সহজ সরল নিটোল প্রেমের গল্পের অন্য রকম পরিবেশনে।
আসামের শহরতলীর নির্মলীয়া ও সুমনের প্রেমের গল্প।নির্মলীয়া পেশায় ডাক্তার।সে বিবাহিত তার একটা ছেলেও আছে।ঘটনা চক্রে তার পরিচয় হয় সুমনের সাথে।সুমন পি.এইচ.ডি করছে নর্থ ইস্টের মানুষের খাদ্যভাস নিয়ে।সে নিজেও রান্নায় পারদর্শী ।
সুমন নির্মলীয়ার পরিচয় কিছুটা অদ্ভত। সিনেমা শুরুতে আমরা দেখি সুমন তার বন্ধুদের সাথে খাসির মাংস দিয়ে পিকনিক করছে।আর এই মাংস খেয়েই ঘটল বিপদটি।সুমনের নিরামিষ ভোজী বন্ধু মাত্রাতিরিক্ত আমিষ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। বন্ধুকে সুস্থ করতে ডাক্তার নির্মলীয়ার বাসায় ছুটে যায় সুমন।ছুটির দিন হওয়াই প্রথমে নির্মলীয়া রাজী না হলেও পরে রাজী হয়।হাটতে হাটতে তাদের দুজনের অনেক গল্প হয়।দুজনের কথোপকথোনে সুমন বিভিন্ন ধরনের মাংসের স্বাদ ও তাদের মাংসাশী ক্লাবের কথা বলে,যা নির্মলীয়ার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হয়।
রোগি দেখা শেষে নির্মলীয়াকে বাসায় পৌছে দিতে যায় সুমন।সুমন যখন নির্মলীকে তার ফিস দিতে চায় তখন সে অপারগতা প্রকাশ করে।পরে অনেক জোরা জুরির পর সে রাজি হয়;কিন্তু ফিস নয় তাদের মাংসাশী ক্লাবের রান্না করা মাংস।সেদিনের মতো মাংস খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নেয় সুমন।
হঠ্যাত একদিন মাংসের বাটি হাতে নির্মলীর চেম্বারে এসে উপস্থিত সুমন।চেম্বারে বসে মাংস খাওয়ার পর ফোন নাম্বার বিনিময় করে তারা।ক্রমশ বাড়তে থাকে তাদের সম্পর্কের গভীরতা।সুমন প্রায়ই নতুন নতুন মাংসের রেসিপি তৈরি করে নিয়ে আসে নির্মলীর জন্য।কখনো খাসির মাংস,কখনো শুকর আবার কখনো বুনো খরগোশ।মাংস নিয়ে অদ্ভত ও বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতা সে শেয়ার করে নির্মলীর সাথে।মুগ্ধ হয়ে সে সব শুনে নির্মলী।এভাবে তাদের মধ্য তৈরি হয় এক সংজ্ঞাহীন ভালোলাগার সম্পর্ক।
আপাত দৃষ্টিতে তাদের এ সম্পর্ক নেহাত বন্ধুত্বের হলেও তাদের চাহনি,হাসি, অভিমান এসবের মধ্য চেপে রাখা অস্বীকার করতে চাওয়া সত্যটা উকি দিয়ে যায় বারবার।তবুও নির্মলী সে সত্যকে স্বীকার করতে পারে না।
সমাজ নিদৃষ্ট বৈধ অবৈধের জ্ঞান এমন ভাবে অস্থি মজ্জায় ঢুকে গেছে যে তাদের থেকে আলাদা হয়ে নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা জানাবার সৎ সাহস তার নেই।সুমন যে নির্মলীকে ভালবাসে তা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারবে যে কেউ।তবে,নির্মলীর কেন সুমনের প্রতি এত টান তা খুব একটা বুঝা যায়না।দুই খাদ্য প্রেমির সম্পর্কটা এভাবেই এগিয়ে যায়।প্রতিনিয়ত চেম্বারে বা রেস্টরেন্টে দেখা করা।মাংস রান্না করে একে অপরের জন্য নিয়ে আসা এসব চলতে থাকে। নির্মলী্র স্বামী যখন ছুটিতে আসে তখন সুমনের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়,স্বামিকে তাদের বন্ধুত্বের কথা বললেও আসলে কি তার ভাল বন্ধু?নাকি তাদের সম্পর্ক গড়িয়ে যাচ্ছে পরকীয়া প্রেমের দিকে।
আপনার মনে এমন নানা প্রশ্নের জন্ম দিবে
এই দুই খাদ্য প্রেমির গল্প।যে গল্পের ঘোরে আপনি ডুবে যেতে বাধ্য।
কিন্তু এমন এক টুইস্ট আপনার জন্য অপেক্ষা করছে যে,এটা দেখার পর আপনি এমন ধাক্কা খাবেন যে বলে উঠতে বাধ্য হবেন এটা কি দেক্ষলাম।বলা হয়ে থাকে সম্পর্কের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে যৌনাতা,নারী দেহের ভিতরে প্রবেশের উনম্মত্ত আকাঙ্খা থেকেই নাকি পুরুষ মনে প্রেমের সৃষ্টি হয়।সুমন ও কি সেটাই চায়?সেও কি চায় নির্মলীর শরীরের ভিতরে প্রবেশ করতে?
হ্যাঁ,সে চায় তবে সে চাওয়াটা একটু অন্য রকম।সে চায় নির্মলীর শরীরের অংশ হয়ে টিকে থাকতে।সুমনের এই চাওয়া নির্মলীকে প্রবল ভাবে ছুঁয়ে অনুভব করার। সিনেমার এই পর্যায়ে আমরা সবচেয়ে বড় টুইস্ট দেখি,সুমন প্রতিবারের মতো একদিন একটি স্পেশাল খাবার বানিয়ে নির্মলীকে পাঠায়।রাতে সুমনের বানানো ওই খাবার খেয়ে নির্মলীর মনে হয় সে যেন সুমনের সাথে মিলনের শারীরিক সুখ অনুভব করছে।তক্ষনি সে সুমন কে ফোন করে খাবারের সুস্বাদ সম্পর্কে জানায় এবং জানতে চায় খাবারে কি কি মেনু ছিল।জবাবে সুমন বলে দেখা হলে সামানা সামনি বিস্তারিত জানাবে,এই বলে সুমন কথা শেষ করে।
এরপরে একটা রেস্টরেণ্টে সুমনের সাথে নির্মলীর দেখা হয় এবং সুমন বলে সে তার শরীরের এক টুকরো মাংস কেটে সেই খাবারটি বানিয়েছিল।এটা শুনে নির্মলী এতো হতোবাক হয় যে রেগে সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়।রাস্তায় তিনি বমি করার চেষ্টা করেন,কিন্তু তিনি বমি করতে পারেন না,কারণ তিনি সজ্ঞানে না হলেও অজ্ঞানে বাঅচেতন অবস্থায় সুমনের শরীরের অংশ সুখ হিসাবে গ্রহণ করেছে,যা তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেন না।বিশ্বাস হয় একটা অসমীয় সিনিমায় এসব ঘটে চলেছে।
হ্যাঁ প্রিয় শ্রোতা বন্ধুরা,
এরপর ঘটতে চলেছে আরো ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। নির্মলী্র ভিতর দিন দিন বাড়তে থাকে মাংস খাওয়ার বাসনা।আর এদিকে নিজের শরীরের ছোট ছোট অংশ কেটে নিয়মিত নির্মলীকে খাওয়াতে থাকে সুমন।এতে তার শারীরিক কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু অপর দিকে সে ভালোবাসার মানুষকে সুখি দেখে মানষিক প্রশান্তি ও লাভ করছে প্রতিনিয়ত।
নিজের শরীর থেকে আর কতোটা মাংস কাটা যায় বলুন।
কিন্তু অচিরেই দেখা গেল যে সুমনের শরীরের মাংস খেয়ে নির্মলীর পাগল পাগল অবস্থা।সে আরো খেতে চায়,মানুষের মাংস ছাড়া তার আর চলেই না।মাঝে মাঝে সুমন তার শরীরের বিভিন্ন টুকরো টুকরো মাংস রান্না করে খাওয়ালেও এতে তার আর চলছে না,তার প্রতিনিয়ত মাংস চাই।
এদিকে নির্মলীও তার শরীর থেকে মাংস কেটে সুমনের জন্য রান্না করে নিয়ে আসে।দুজনের এই আদান প্রদান প্রথা চলতে থাকে।নিজেদের শরীরে আর কতো টুকুই বা মাংস থাকে?সেটা দিয়ে তো আর রোজ রোজ এই চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়।তাহলে উপায়?অন্য মানুষের মাংসের ব্যবস্থা করতে হবে।
নির্মলী ততো দিনে প্রচুর বুভুক্ষু হয়ে উঠেছে,একদিন ও তার মানুষের মাংস ছাড়া চলেনা।মাংস না পেলে সে হিংস্র হয়ে ওঠে।হাসপাতালে পরে থাকা বে-ওয়ারিশ লাশ কেটে হলেও তাকে মাংস খেতেই হবে।শুরু হয় নির্মলী ও সুমনের এক অভাবনীও যাত্রা।শহরের সব নামী দামী রেস্টরেণ্ট খুজেও কোথাও মেলেনা মানুষের রান্না করা মাংস।
অবশেষে নির্মলী,সুমন কে নিয়ে যায় তার ক্লিনিকের মর্গে;বলে এই বে-ওয়ারিশ লাশ মাত্র ক্লিনিকে এসেছে তার চাইলে এর শরীর থেকে মাংস কেটে নিতে পারে। নির্মলীর এই কথা শুনে সুমন যেন আকাশ থেকে পড়ে।সে আফসোস করে বলে যে নির্মলীকে সে চিনত এ নির্মলী সে না।
নির্মলী তাকে অনুরোধ করে বলে একবারে যদি সুমন তাকে বেশ খানিকটা মাংস এনে দেয় তবে সে এটা শেষ বারের মতো খেয়ে তৃপ্তি মেটাবে।সুমন তার অপরাধ বুঝতে পারে,তার ছোট্ট চাওয়া যে এমন ভয়ঙ্কর রুপ নিবে তা সে কল্পনা ও করেনি। সে তো শুধু চেয়েছিল নির্মলীর শরীরের অংশ হয়ে টিকে থাকতে।
প্রেমিকার শরীরের চাহিদা পূরণ করতে সুমন নামে রাস্তায়,খুজতে থাকে উপায়।শেষমেষ আর কোন পথ না পেয়ে এক রিক্সা চালক কে খুন করে তার শরীর থেকে মাংস কেটে নেওয়ার চেষ্টা করে সে।এই মাংস কেটে সে নির্মলীকে শেষ বারের মতো খাওয়াবে।কিন্তু বিধি বাম,মাংস কেটে নেবার সময় সে ধরা পড়ে পুলিশের হাতে পুলিশের রিমাণ্ডে সে শিকার করে সব সত্য ঘটোনা,কেন সে হত্যা করেছে এই লোকটাকে,কেনই বা তার শরীর থেকে মাংস কেটে নেওয়ার চেস্টা করছিল,এই মাংস দিয়ে সে কি করবে সব বলে দেয় পুলিশকে।
সুমনের কাছ থেকে এই ঘটনা শুনে পুলিশ ছুটে যায় নির্মলীর বাড়িতেও,গ্রেফতার করে তাকেও।এই লোমোহর্ষক ঘটনা শোনার পর গোটা দেশে হৈচৈ পড়ে যায়, এক মহিলা ডাক্তার ও এক পি.এইচ.ডি স্টডেণ্ট রিক্সা চালক কে হত্যা করেছে তার শরীরের মাংস কেটে খাওয়ার লোভে।গণমাধ্যমে শোরগোল ওঠে,পুলিশ কাস্টেরিতে তাদেরকে রাখা হয় আলাদা কাস্টেরিতে।আদালতে নিয়ে যাবার সময় মুখ ঢেকে তাদের নিয়ে আসা হয় গণমাধ্যম এর সামনে,থানার সামনে তাদের ফটোসেশন হয়।নির্মলী প্রথমবারের মতো স্পর্শ করে সুমনের হাত,এতো দিনের প্রেমে যে স্পর্শ হয়নি হয় প্রথম ও শেষ বারের মতো।
সুমন ও নির্মলী হাত ধরে পাশাপাশি দাড়িয়ে থাকে যখন তাদের সামনে গোটা বিশ্বের গণমাধ্যম,সমাজ,রাষ্ট্র হাজির।এভাবেই ইতি টানে আমিষ শিরনামে মুক্তি পাওয়া অসমীয় সিনেমাটির।
ভালবাসার মানুষের জন্য যে কোন কিছু করা যায়,এরকম গাতানুগতিক সিনেমার বাহিরে গিয়ে নতুন কিছু করে দেখিয়েছে এই পরিচালক।সিনামাটিকে দেখার পর দর্শক কয়েক দিন মাথা থেকে এই গল্পটিকে মাথা থেকে বের করতে পারবেননা।
বার বার বলবেন এটা কি হলো,এটা কিভাবে সম্ভব,কিভাবে আপনি ভালোবাসার মানুষের শরীরে মিশে যেতে পারেন।পরিচালক যেভাবে দেখিয়েছেন তাতে যে কেউই ইলেকটিক শক খাওয়ার মতো অবাক হবে।এরকম শক খাওয়ার পরে আপনি পরিচালকের সাহসীকতাকে বাহবা দিতে পারেন আবার গালি ও দিতে পারেন।তবে আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যারা আর্ট ফিল্ম পছন্দ করেন এবং গতানুগতিক ধাঁচের বাহিরে গিয়ে নতুন কিছু খোজেন তাদের আমিষ নামের এই সিনেমা ভালো লাগবেই।
কেমন লাগলো আমাদের আজকের সিনেমার গল্প আবশ্যই জানাবেন।আমদের গল্প যদি আপনাদের ভাললাগে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন এবং বেশি বেশি বন্ধু দের সাথে শেয়ার করে আমাদের উৎসাহ দিবেন যেন আমরা আপনাদের জন্য নতুন নতুন গল্প নিয়ে আসতে পারি।