দীর্ঘ সময় বিদেশ কাটিয়ে দেশে ফিরে মায়ের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হলাম মেয়ে দেখতে যেতে। আমার অসুস্থ মায়ের একটাই কথা মরার আগে তার আমার বৌ দেখে যেতে চান।
বেশ আয়োজন করেছে মেয়ের বাড়িতে। বাড়িটাও বেশ পরিপাটি বোঝাই যাচ্ছে বাড়ীর মানুষগুলো খুব সৌখিন। যথাসময়ে মেয়েকে নিয়ে আসা হলো, আম্মু সহ ফ্যামিলির সবারই খুব পছন্দ হলো মুমুকে, আসলে বাহ্যিক দিক বিবেচনা করলে মুমু পাত্রী হিসেবে প্রথম সারিরই বলা যায়।
কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাসটা মুখের কাছে নিতেই খেয়াল করলাম খুব মিষ্টি, ফর্সা টুকটুকে একটা পরী ছয় বা সাত বছরের মতোই হবে হয়তো, আমাকে বলছে, আংকেল আমি তোমার থেকে কোক খাবো। এতো মায়াভরা চেহারা যে কেউ এমন বাচ্চা দেখলে কোলে নিবেই, আমিও ওকে কোলে নিয়ে কোল্ডড্রিঙ্কসটা খাইয়ে দিচ্ছিলাম, জানতে পারলাম ও মুমুর বড়ভাইয়ের মেয়ে যিনি কিনা সাতবছর আগে ক্যান্সারে মারা গেছেন।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমি বরাবরই বাচ্চাদের খুব পছন্দ করি কোলে নিয়ে আদর করি কিন্তু এই বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিচ্ছিল, কেমন একটা টান অনুভব করছিলাম ওর মায়াবী চেহারা গঠনে। মনে হচ্ছিল আমার জীবনের হারিয়ে যাওয়া মানুষটির প্রতিচ্ছবি ওই মায়াবী মুখটিতে। মনে মনে হয়তো আমি বাচ্চাটির মাকে খুজছিলাম।
সবাই গল্প গুজব করছে এমন সময় ডোরবেল বেজে উঠলে বাচ্চাটি লাফ দিয়ে আম্মু এসেছে, আম্মু এসেছে বলে দরজা খুলতে চলে গেল। হুম ওর আম্মুকে নিয়েই ভেতরে এলো। মনে হয় বাজার করতে গিয়েছিল মহিলাটি। বাচ্চারা নিজের মায়ের উপস্থিতি সবার আগেই হয়তো বুঝতে পারে।
হঠাৎ আমার চোখদুটো কোনও একটা মুখে আটকে গেল, কাকে দেখছি আমি! একটু নড়ে চড়ে বসলাম, হুম আমিতো ঠিকই আছি ঠিকটাই দেখছি কিন্তু এমনটা দেখার জন্য আমি কখনও প্রস্তুত ছিলামনা, কাকে দেখছি আমি! হ্যাঁ, শায়লাই তো। কি হাল হয়েছে শায়লার!
শুনেছিলাম আটবছর আগে ওর বিয়ে হয় কোনও এক ধনী পরিবারে। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন, ছয়টা মাস অপেক্ষা করতে বলেছিলাম ওকে কিন্তু সেটুকু সময়ও আমাকে দিতে পারেনি। কিন্তু তাই বলে আজ এই শায়লাকে আমি কোনওদিন দেখতে চাইনি। এতো সুন্দর একটা মেয়ের কি অবস্থা হয়েছে। চোখের নীচে কালি, শরীরটাও অনেকটা ভেঙে গেছে মাত্র আটবছর ব্যবধানে আর ওর এই অবস্থা আমাকে দেখতে হলো!
ওবাড়ি থেকে আসার পর থেকে একটা সপ্তাহের প্রতিটা রাত নির্ঘুম কেটেছে। আটবছরের ব্যবধানে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিলাম কিন্তু ভাগ্য আমাকে কেন নিস্তার দিচ্ছেনা জানিনা। ওদিকে মা বারবার জানতে চাইছে বিয়ের তারিখ পাকা করবে কিনা। সিদ্ধান্ত নিলাম মুমুর সাথে কথা বলবো আর তারপরই বাড়ীতে সিদ্ধান্ত জানাবো।
বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা, মুমু খুব গোছালো আর টাইম সেন্স খুব ভাল এটা বুঝতে বাকি রইলনা আমার। মেরুন রঙের ড্রেসে হালকা মেকআপে অপরূপ লাগছে মেয়েটাকে তার চেয়েও বড় কথা মেয়েটাকে কেমন নিষ্পাপ দেখতে লাগে।
কিছুক্ষন গল্প করার পর মুমুকে আমার জীবনের পাস্ট নিয়ে বললাম, এতে জানিনা মুমুর কেমন লাগছে কিন্তু আমার নিজেকে হালকা লাগছে। তবে পুরো ঘটনা মুমুকে তেমন ধাক্কা না দিলেও আমার পাস্ট যে ওর ভাবী শায়লা এটা শুনে ও হয়তো খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
তিন বছরের সম্পর্ক ছিল আমার আর শায়লার। শায়লা অতিমাত্রার সুন্দরী এক মেয়ে ছিল তবে খুব ব্রিলিয়ান্ট হবার পরও ইন্টারের পর লেখাপড়া করতে পারেনি। সৎ মায়ের সংসারে যা হবার তাই। অফিসিয়াল কাজে ছয়মাসের জন্য আমি অস্ট্রেলিয়া যাই আর কথা হয় আমি এসেই শায়লাকে বিয়ে করবো কিন্তু তিনমাস যেতেই হঠাৎ শুনি শায়লার বিয়ে হয়ে গেছে খুব ধনী এক পরিবারে।
শায়লার বিয়ের পর কোনওদিন যোগাযোগ করিনি এমনকি জানতেও চাইনি কেন আমার সাথে এতবড় বিশ্বাসঘতকতা করলো। কিন্তু আজ মুমুর মুখে সবটা শুনে নিজেকে যেন আর সামলে রাখতে পারলামনা। মনে হচ্ছে কেন সেদিন চাকরীর মায়া আর শায়লার উপর রাগটা দমিয়ে শায়লার কাছে ছুটে এলামনা যখন শায়লার বান্ধবী রীতা আমাকে মেসেজ করে জানিয়েছিল শায়লার তিনদিন পর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এমনকি রাগে একটিবার জানতেও চাইনি কেন শায়লা আমাকে রেখে অন্যকোথাও বিয়ে করছে অবশ্য আমি নিজেও হয়তো ভেবেছি খুব বড়োলোক ফ্যামিলি পেয়ে শায়লাও রাজী হয়ে গেছে।
বরাবরই শায়লার স্বাধীনতার অভাব ছিল এমনকি ও মোবাইল ইউজ করতে পারতনা। আমার দেয়া মোবাইলও ওর সৎমা বহু আগেই কেড়ে নিয়েছিল। সেদিন রাগ করে না থেকে একটিবার যদি চিন্তা করতাম শায়লা কেন বিয়েতে রাজী হয়েছে আমাকে কিছু না জানিয়ে, একটিবার ওর টোটাল সিচুয়েশন বোঝার চেষ্টা করতাম তবে এতো বড় দুর্ঘটনা ওর জীবনে ঘটতোনা আর আমাকেও আটটি বছর ধরে বিদেশে একা একা যন্ত্রণার আগুনে পুড়ে মরতে হতোনা। আমার একটি ভুলের মাশুল দিয়েছি আমি, শায়লা দুজনই। কিন্তু এই ভুল থেকে কি করে ফিরে আসবো!
মুমুর ভাইয়া ক্যান্সারের রোগী ছিল তবু ওদের ফ্যামিলি চেয়েছিল ছেলেকে বিয়ে করাবে আর শায়লার সৎ মা সবটা জেনেও জোর করে শায়লাকে রাজী হতে বাধ্য করে কারণ ছেলেপক্ষ শায়লাকে খুব পছন্দ করেছে আর বিনিময়ে অনেক টাকা দিতে প্রতিশ্রুতি দেয় তারা আর শায়লারও কোনও উপায় ছিলনা কারণ ও বিয়েতে রাজী নয় বলে তিনদিন ওর প্যারালাইজ্ড বাবাকে না খাইয়ে রাখা হয় দরজা তালাবন্দি করে আর বলা হয় শায়লা এই বিয়েটা না করলে ওর বাবাকে ওভাবেই না খাইয়ে মেরে ফেলা হবে তাই ওর বাবার হাজারও বারণ স্বত্বেও ও রাজী হয় বিয়ে করতে।
বিয়ের এক বছরের মাথায় ওর বর মারা যায় আর রেখে যায় এক বাচ্চা কিন্তু ওর শ্বশুরবাড়ী ওকে বাচ্চা দিতে রাজী না হলে অনেক রিকুয়েস্ট করে ওই বাড়িতে নিজ সন্তানের সাথে থাকার পার্মিশন পায় বিনিময়ে ও বাড়ীর ঝী এর জায়গাটা পায়। একমাত্র মুমু আর শায়লার শ্বশুর ছাড়া কেউ সামান্য শান্তিটুকুও ওকে দেয়না। বাড়ীর বাজারঘাট থেকে শুরু করে রান্না সহ যাবতীয় কাজ শায়লার।
মুমু ঘটনা বলে যাচ্ছে কিন্তু আমি যেন আর শুনতে পারছিলামনা, একটু সময় নীরব কাটিয়ে মুমুকে বললাম আমি আমার ভুল থেকে ফিরে আসতে চাই আর তাই আমি মুমুকে নয় শায়লাকে বিয়ে করবো আর ও আমাকে এই কাজে সহযোগীতা করবে কিনা। আমার প্রপোজাল শুনে মুমু যেন একটুও অবাক হলোনা বরং ওর অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে ও এই প্রপোজালটার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। মুমু কিছুক্ষন চুপ থেকে আমাকে আস্বস্থ করলো ও সম্পূর্ণ সহযোগীতা করবে।
বাড়িতে মাকে সবটা খুলে বললে মা সহ কেউ রাজী হচ্ছিলনা কিন্তু আমার জেদের কাছে অবশেষে বাধ্য হয় শায়লাকে বাড়ীর বৌ করে আনার সিদ্ধান্ত নিতে। মুমুর বাড়িতে তখন চরম তান্ডব চলে শায়লার উপর, তারা কিছুতেই শায়লাকে বিয়ে করতে দেবেনা আর যদি শায়লা বিয়ে করে তবে ওর সন্তানকে কোনওদিন দেখতেও পাবেনা আর শায়লা নিজেও রাজী হয়না আমাকে বিয়ে করতে। তখন পুরো ব্যাপারটা সামাল দেয় মুমু একা।
তবে সেদিন বিয়ে একটা নয় দুটো বিয়ে হয়েছিল একই মঞ্চে। আমাদের ফ্যামিলি বা আমি নিজেও চাইছিলামনা মুমুর মতো মেয়েকেও নিজেদের বাড়ীর বৌ করা থেকে দূরে থাকতে। শায়লা, আমার বিয়ে আর মুমুর সাথে আমার ছোটভাইয়ের বিয়ে দিয়ে সেদিনই আমরা শায়লা আর মুমুকে আমাদের বাড়ীর বৌ করে নিয়ে আসি আর নিয়ে আসি আমাদের সন্তান, আমাদের কন্যা আনমোলকে।
আমাদের বিয়ের আজ একবছর হলো। যদিও কেউ মন থেকে প্রথমে শায়লাকে মেনে নেয়নি কিন্তু ওর ভালোবাসা আর যত্নে এখন সবাই শায়লা বলতেই পাগল আর হবেনাইবা কেন, পুরো সংসারটাকে ভালোবাসার ছোঁয়ায় আগলে রেখেছে আর পরিপূর্ণ সুস্থ করে তুলেছে আমার অসুস্থ মাকে।
ভুল থেকে ফেরা
রানু মোস্তফা।
#kobitor_গল্পের_ওয়েবসাইট