– ইফতি সাহেব আপনার বিয়ের বয়স কত দিন হইসে?
– ৬ বছর।
– বাপরে বাপ। আপনেরে দেখে তো লাগে না আপনার বিয়ের এত বছর হয়ে গিয়েছে।
– হাহাহাহা তাই নাকি?
– হুম।
– তো কি দেখে বুঝা যায় যে বিয়ের অনেক বয়স হয়েছে?
– ডিপ্রেস চেহারা। যেটা আপনাকে করতে দেখি না ।
– -হাহাহাহাহা তাই বলে কি আমার ডিপ্রেশন নাই?
– কি যেনো? জানিনা।
– শুনেন ডিপ্রেশন সবারই আছে তবে এইটা বলতে পারেন যে সাংসারিক কোন ডিপ্রেশনে আমি ভুগি না।
– বলেন কি?
– এপিক ব্যাপার স্যাপার।
– মিজান ভাই একটা গল্প বলি?
– বলেন।
আমার বিয়ের ১৯ দিন আগে আমি প্রথম চাকরি পাই। মাত্র ১৯ দিন আগে। প্রেম করেছিলাম আপনাদের ভাবীর সাথে। এক সাথেই পড়াশোনা করতাম। আমার হয়ত বিয়ের জন্য সঠিক সময় হয় নাই তখন কিন্তু তনু মানে আপনাদের ভাবীর তখন বিয়ের জন্য পারফেক্ট সময় ছিলো। তাই চাকরিটা পেয়েই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম। আব্বা আম্মাও বেশ সাপোর্ট দিলো। তবে আমার বেতন একটা সংসার টানার জন্য যথেষ্ট ছিলো না। একদমই না। তাই আমি একটু দুশ্চিন্তায় ছিলাম বিয়ের ব্যাপারে ।
যাই হোক নতুন অফিসে কেউ সিগারেট খেতেও আমাকে ডাক দিতো না। নতুন হিসেবে অফিসে আমাকে তেমন কেউ পাত্তাই দিত না। আমিই সেধে সেধে গিয়ে কথা বলতাম।অফিস শেষে মোটামুটি সবাইকে দেখতাম নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। গল্প করে। কিন্তু একজন সিনিয়ির স্যারকে (রফিক) কখনো দাড়াতে দেখতাম না। অফিস ছুটির পর দেখতাম সে ডানে বামে না দেখে সোজা বাসার দিকে হাঁটা দিতো।
একদিন খেয়াল করলাম আমাদের এক সিনিয়র ভাই তাকে সিগারেট খেতে ডাকছে। ঐ স্যার আসলেন না। একতা ভদ্রতা মূলক হাসি দিয়ে দুঃখিত বলে চলে গেলেন। উনি চলে যাওয়ার সাথে সাথে বাকিরা বলে উঠলে “ এমন বৌ পাগলা বেডা জীবনেও দেখি নাই” কথাটা আমার কাছে কিছুটা আপত্তিকরই মনে হলো। নতুন তাই শুধু শুনলাম কোনো কথা বললাম না।
তার দুদিন পর অফিসের সবাই শুক্রবারে প্লান করলো ঘুরতে যাবে । রফিক স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হলো আর সে সেদিনও বলল
“না রে ভাই সম্ভব না। আপনাদের ভাবীর জন্মদিন গেলো মঙ্গলবার । অফিসের কারনে সেদিন দেরী করে বাসায় ফিরেছি। কাল একটু ঘুরতে যাবো।”
সেদিন আমার কাছে বেশ ইন্তারেস্টিং লাগলো। আমার পাশের টেবিলে বসা লোকটা বলল
– উনারে যে কে ডাকতে যায়। জানে যে উনি যাবে না হুদাই মুখের শব্দ অপচয় করে।
সেদিন একটু সাহস করে কথা বললাম আমি।
– স্যার খুব পরিবারের প্রতি দুর্বল। তাই না?
– আরে ধুর মিয়া কিসের দুর্বল? আমাদের কি বৌ সংসার নাই নাকি? তার মত এমন বৌ পাগল না আমরা।
একটা চা বিড়ি খায় না। কেমন যেনো নিরামিষ টাইপ।
– অনেকেই তো খায় না।
– আরে মিয়া আগে খাইতো। বিয়ার পর থেকে খায় না। আগে আমাদের সাথে এদিক সেদিক ঘুরতেও যাইতো বিয়ের পর থেকে কিছুই করে না। বেটি মাইনসের মতন ঢং করে। গা টা জ্বলে এগুলা দেখলে।
আমি আর কিছু বললাম না। তার কয়দিনপর আমার বিয়ের কার্ড নিয়ে রফিক স্যারের কাছে গেলাম। স্যার খুব অমায়িক মানুষ। আমাকে দেখে এত সিনিয়র মানুষ উঠে হাত মিলিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন। আমাকে তার ডেস্কে বসিয়ে বললেন
– নতুন জীবন শুরু করছেন। নিজেও ভালো থাকেন,তাকেও ভালো রাখেন।
– জ্বী স্যার। স্যার আমি আপনাকে পরিবারবর্গ দাওয়াত করেছি। আমি জানি আপনি ম্যাডামকে ছাড়া কোথাও যান না। তাই ……………
– হাহাহাহা না বিষয়টা এমন না। তাকে ছাড়াও চলাফেরা করি কিন্তু সেটা খুব কম। এই অফিসে আমাকে অনেকে বৌ পাগলা বলে। সেটা আমি জানি কিন্তু খারাপ লাগে না। কখনো উত্তরও দেই না।
– জ্বী স্যার।
– শুনো ইফতি। সবাই যখন প্রতিদিন ১০০ টাকার সিগারেট খায় আমি তখন ঐ ১০০ টাকা দিয়ে প্রতিদিন তোমাদের ম্যাডামের জন্য টুকিটাকি কিছু কিনে বাসায় ফিরি। মেয়ে মানুষ এসব খুব পছন্দ করে। মাঝে মাঝে ১০০ টাকাও খরচ হয় না। ১০ টাকার ফুল নিলেই খুশি। আমি চাইলেই রাত করে বাসায় ফিরতে পারি। সবার সাথে আড্ডা দিতে পারি। কিন্তু যেদিন থেকে ভাবছি কেউ আমার জন্য সকাল থেকে অপেক্ষায় আছে। শুধু ঘরের কাজ করার জন্য বিয়ে করি নাই। তারও ইচ্ছা করে আমার সাথে সারাদিনের অত শত গল্প করতে। সে শুধু আমার সাথে রাতে ঘুমানোর কোন প্রোডাক্ট না , সেদিন থেকে আমি তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে গিয়েছি। তাকে সময় দিয়েছি। আমি চাইলেই বাইরে একা ঘুরতে যেতে পারি। সে আমাকে মানা করবে না এমনকি আমাকে সে ই মাঝে মাঝে ঘুরতে যেতে বলে তাকে রেখে। আমিই আসি না। আচ্ছা ইফতি বলেন তো তার কি আমার সাথে ঘুরতে ইচ্ছা হতে পারে না? সব শখ কি শুধুই পুরুষ মানুষের?
এই মেয়েগুলারও ইচ্ছা করে …বুঝছেন? আমাকে বৌ পাগল বললে আমি একদমই রাগ হই না। তাছাড়া যেই মানুষ আমার সাথে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত থাকবে তার জন্য পাগল হওয়া আমি যৌক্তিক মনে করি । বন্ধু কলিগ কেউই মরার সময় মুখে পানি দিবে না। যে দিবে সে হলো স্ত্রী। যে আমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে সে হলো আমার স্ত্রী। তাই তাকে ভালো রাখাটা আমার কাছে মূখ্যম। আমি তাকে ভালো রাখতে পারি বলে সে সারাদিন আমার ঘরকে ভালো রাখে। আমার বাবা মা কে ভালো রাখেন। পারিবারিক দিক দিয়ে আমি সুখী।
কয়েক মিনিটের জন্য আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। লোকটার দিকে ভালো মত তাকালে বুঝা যায় সে আসলেও ভালো আছেন। আর এই ভাল রাখাটা খুব সহজ প্রক্রিয়া। আমি স্যার কে ধন্যবাদ বলে বের হয়ে আসার সময় স্যার বললেন
– ইফতি আমি আশা করি একদিন আপনার সুখে থাকার গল্পও কেউ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনবে , শিখবে আর সে নিজেও ভালো থাকার চেষ্টা করবে।
আমি সেদিন স্যারের কথা শুনে রুম থেকে বের হয়ে কেঁদে ফেললাম। অনেক শক্তি পেলাম। অল্প বেতন পেয়েও সাংসারিক জীবনে সুখে থাকার উপায় শিখলাম। বিয়ের ভয়টা কেটে গেলো।
আসলেও ভাই সারাদিন অফিস করে যদি স্ত্রীর গোমড়া মুখ দেখেন তাহলে তো ফাস্ট্রেশনে ভুগবেনই। একটা পুরুষ মানুষ কে শারীরিক আর মানসিক ভাবে সুস্থ রাখতে তার স্ত্রী ই যথেষ্ঠ। যে সুস্থ রাখবে তাকে আগে ভালো রাখা উচিৎ …
আমি নিজেও ৬ বছর ধরে এভাবেই চলে আসছি। ভালো ও আছি। দিনশেষে যখন তনুর মুখের হাসি দেখি এমনেই ক্লান্তি হারিয়ে যায়। আমি ভালো আছি। আমরা ভালো আছি। বেতন অল্প হলেও শান্তির কোন কমতি শুরু থেকেই ছিলো না। এখনো নাই।
ইফতির কথা শেষ হওয়ার পর মিজান সাহেব বললেন “ আমার জন্য দোয়া কইরেন যাতে আমিও কোনদিন এমন করে কাউকে ভালো থাকার গল্পটা বলতে পারি” …।। মিজান সাহেব ইমোশনাল হয়ে গেলেন।
ইফতি হেসে রফিক স্যারের কথা মনে করলেন। অনেকদিন হলো স্যারের কোন খোঁজ নেওয়া হয় না। আজই একটা ফোন করবে ইফতি। অফিস ছুটি এখন বাসায় যাওয়ার পালা। বিয়ের পর থেকে সে ও সিগারেটটা ছেড়েই দিলো। সে ও এখন তনুর জন্য ফেরার সময় কিছু না কিছু নিয়ে যায়। আজ সে নিবে “জিলাপী” …… সেটা দেখে নিশ্চয়ইই তনু দৌড়ে এসে বলবে “ তুমি কেমনে জানো আমার আজকে জিলাপী খেতে ইচ্ছা করছে ?” ……
সত্য ঘটনা অবলম্বনে লোকটা বৌ পাগল
#লেখনীতে_জাকিয়া_হোসেইন_তৃষা
[ সমাজে রফিক সাহেবের মত মানুষের খুব অভাব। তাই ইফতির মত মানুষগুলো বিয়ের পর নিজেকে পরাধীন ভাবতে শুরু করে আর তনু এর মত মেয়ে গুলো বিয়ের পর থেকে আজীবন শুধু দায়িত্ব ই পালন করে যায়। সংসার ঝামেলা লাগে দুজনেরই কাছে।
সবাই ভালো থাকুক। ]