‘বউমা। নাতি নাতনির মুখ না দেখেই আমরা ওপারে চলে যাব, এটাই কী তোমরা চাইতেছো? পাঁচ বছর তো হইলো এবার একটা চিন্তা ভাবনা করো। আমাদেরও তো বয়স হয়েছে।’
শাশুড়ির কথায় একটুও মন খারাপ হয়নি। বরং সাফিনের উপর বেজায় রাগ হলো। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য যতবার বলেছি, ততবারই সাফিন বিভিন্ন অজুহাতে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছে। সবার ধারণা আমরা ইচ্ছে করেই বাচ্চা নিচ্ছি না। আসল কারণ কেউ জানে না।
‘সাফিন, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে?’
আমার বলার ভঙ্গিতেই সাফিন বুঝে নিয়েছে, আমি বেশ রেগে আছি৷
একগাল হেসে সাফিন আমার পাশে এসে বললো, ‘জ্বী, বেগম সাহেবা। আপনার মূল্যবান বক্তব্য শ্রবণ করার জন্য এই বৎস প্রস্তুত।’
‘শোনো, একদম ঢং করবে না। ডাক্তারের কাছে কবে যাচ্ছি আমরা?’
‘আগামী মাসে। এ মাসে হাতে একদমই সময় নেই গো।’
‘তোমার এই আগামী মাস কখনোই আসবে না, আমার ভালো করে জানা আছে।’
‘ডাক্তারের কাছে গিয়েই বা কী হবে?’
‘কী হবে এটা তুমিও জানো। অবান্তর প্রশ্ন করো না।’
সাফিন চুপ করে রইলো। আমি সাফিনের হাতের মধ্যে হাত গুঁজে দিয়ে বললাম, ‘আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার আমরা আসলেই কখনো বাবা-মা হতে পারব কী না! যদি না পারি সেটা সবাইকে জানিয়ে দিলে আর কেউ অযথা প্রশ্ন করে মন খারাপ করে দিবে না এবং কেউ প্রত্যাশায়ও থাকবে না।’
আমার হাতটা চেপে ধরে সাফিন প্রশ্ন করলো, ‘যদি সমস্যাটা আমার হয়, তবে কী তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে?’
‘পাঁচ বছরে এই আমাকে চিনলে সাফিন?’
সাফিন চুপ করে তাকিয়ে রইলো। আমি সাফিনের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে বললাম, ‘তুমি ছাড়া আমি, এমন কথা আমি কখনো কল্পনায়ও আনি না।’
‘তোমাকে খুব ভালোবাসি জুলিয়া।’
‘যদি সমস্যাটা আমার হয় তখনো কী বাসবে?’
‘আজীবন।’
‘সত্যি করে বলো তো, সমস্যাটা তোমার হতে পারে শুধু এই ভয়েই কী তুমি ডাক্তারের কাছে যেতে চাওনি?’
‘আমার কেন যেন মনে হয়, সমস্যাটা আমারই। আর আমি তোমাকে হারাতে চাই না।’
‘এসব ভাবার কোনোই দরকার নেই। চলো সামনের সপ্তাহেই ডাক্তারের কাছে যাই। বাবা-মা অস্থির হয়ে উঠেছেন। প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করেন।’
সাফিন রাজি হলে আমরা পরের সপ্তাহে ডাক্তারের কাছে গেলাম। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হলে জানা যায়, সমস্যাটা আসলে সাফিনের নয়, আমার। যদিও ডাক্তার পুরোপুরি হতাশ করেননি। বলেছেন, সম্ভাবণা রয়েছে তবে খুব কম। কিন্তু আমি ডাক্তারের এই কথাটাকে কেবল সান্ত্বনা হিসেবেই ভাবছি।
সাফিনকে নিয়ে ভয় হচ্ছে না। কিন্তু শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে। তাদের ছেলের সমস্যা নেই জানলে নিশ্চয়ই তারা আমার বিপরীতে কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন। বংশের ধারা বহল রাখলে নতুন সদস্য তো তারা চাইতেই পারেন, তাদেরই বা কী দোষ!
তবে কী সাফিনের ভালোবাসা ভাগ হয়ে যাবে! ভাবতেই চোখ জোড়া ছলছলিয়ে উঠলো। সাফিন আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে৷ এতদিন ওর চোখ জুড়ে শঙ্কা দেখেছি। আর এখন ওর জুড়ে স্বস্তি দেখছি। যেন কোনো কলঙ্কের দায় থেকে মুক্তি পেয়েছে সাফিন।
বাড়ি ফিরলাম। সাফিনকে বললাম, বাবা-মাকে বিষয়টা জানানো প্রয়োজন। সাফিন বললো, পরে জানানো যাবে। তাই আর এ নিয়ে এখন কিছু ভাবছি না৷
নিজের মধ্যে কেমন একটা অসম্পূর্ণতা অনুভব করছি। দিন যত যেতে লাগলো অস্থিরতা বাড়তে লাগলো। একসময় শ্বশুর শাশুড়িকে বিষয়টা জানালাম। তারা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। আমাকে তারাই পছন্দ করে বেশ আগ্রহ সহকারে এ বাড়িতে নিয়ে আসেন। আমার কষ্ট হয়, এমন সিদ্ধান্ত নিতেও তারা বেশ হিমসিম খাচ্ছেন।
শাশুড়ি মা বললেন, ‘চিন্তা করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই নিরাশ করবেন না৷ তাকে ডাকো।’
আমিও এই কথাই বিশ্বাস করি। সৃষ্টিকর্তা নিশ্চয়ই সুখবর দিবেন৷
দেখতে দেখতে আরও একটা বছর কেটে গেলো। কিন্তু সুখবরের দেখা মিলছে না। ইদানীং সাফিন বেশ দেরি করে বাড়ি ফেরে। সবসময় ব্যস্ত থাকে, সবকিছুতে যেন ওর তাড়াহুড়ো। সকালের নাস্তাটাও প্রায়ই না করে বের হয়। অথচ আগে আমার হাতের নাস্তা দিয়েই ওর দিন শুরু হতো।
‘জুলিয়া, অফিসের কাজের জন্য কয়েকদিন আমাকে ঢাকার বাহিরে থাকতে হবে।’
‘আমাকেও নিয়ে চলো না।’
‘অফিসের আরো সহকর্মীরা যাচ্ছে৷ তোমায় নিয়ে যেতে পারছি না। তুমি দয়া করে মন খারাপ করো না। তবে কথা দিচ্ছি, কাজ শেষ করে এসে তোমায় নিয়ে ঘুরতে যাব।’
‘তোমায় ছাড়া থাকতে খারাপ লাগবে সাফিন। অভ্যেস নেই তো।’
সাফিন আমায় ওর বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললো, ‘আমি যতদূরেই থাকি না কেন, আমার চিন্তা চেতনা জুড়ে সবসময় তুমিই আছো।’
সাফিন চলে গেলে বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করে। রাতে ঘুমও হয় না ঠিকঠাক। সাফিনকে কল করলেও তেমন কথা হয় না, কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় পার করছে।
টানা পাঁচ দিন পর বাড়ি ফেরে সাফিন। বেশ ফুরফুরে লাগছে ওকে। ওর চোখে মুখ জুড়ে আনন্দ আর খুশি লেগে আছে। সাফিন মুখে খুব বললেও আমার কেন যেন মনে হচ্ছে না, ও এতদিন আমার জন্য মন খারাপ করেছে। বরং কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে আমি ছাড়া ওর সময়টা আরও ভালো কেটেছে।
তারপর থেকে সাফিনকে সবসময় বেশ খুশি খুশি লাগতে শুরু করে। মানুষ প্রেমে পড়লে যেমন তার ভেতরকার খুশি তার চেহারায় ফুটে ওঠে, সাফিনের বেলাও ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। হয়তো অফিসে পদোন্নতি হতে চলছে খুব শীঘ্রই। আমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলেই হয়তো বিষয়টা লুকিয়ে রেখেছে। আমি উপরওয়ালার কাছে খুব প্রার্থনা করি, যেন সাফিনের মনোবাসনাটা পূর্ণ হয়।
সাফিনের প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফেরা, সারাদিন ফোনে ব্যস্ত থাকা, বাড়ি ফিরলেও ফোন নিয়ে পড়ে থাকা, কখনো কখনো বাড়িই না ফেরা, ওর এই ব্যস্ততাগুলো আমার থেকে ওকে ক্রমশ দূরে নিয়ে যাচ্ছে। আমায় নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা তো বেমালুম ভুলে বসে আছে। তবে কী সাফিন তার ভেতরের দুঃখ ভোলার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে! বাবা না হওয়ার দুঃখটা যে অনেক বড় একটা যন্ত্রণা।
কেটে যাচ্ছে সময় বিষন্নতায়। সাফিনকে কাছে পাই খুব কম সময়। দিন রাত খেটে চলছে অফিসের পেছনে। এত কষ্ট করে কী লাভ! কী হবে এত টাকা দিয়ে! আমাদের তো কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
‘বউমা, সাফিন বাড়ি ফিরেছে?’
‘না, মা। আজ মনে হয় ফিরবে না।’
‘কী যে হয়েছে ছেলেটার! নিজের দিকে খেয়াল নেয় না একটুও।’
চুপ করে রইলাম। সাফিনকে কল করলে দেখি নাম্বার বন্ধ। অন্ধকার গিলে খাচ্ছে আমায়। এখন যেন একা থাকতেই আমার অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে।
পরদিন সকালে সাফিন ফোনে জানায়, ‘অফিসের কাজে সাত দিনের জন্য চট্টগ্রাম যাচ্ছে। সঙ্গে সহকর্মী আরিফ সাহেব যাচ্ছেন।’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘ব্যাগ গুছিয়ে রাখবো। এসে নিয়ে যাবে?’
‘দরকার হবে না। ওখানে গিয়ে ব্যবস্থা করে নিব।’
শেষ কবে সাফিন ফোনে আমার সঙ্গে একটু সময় নিয়ে কথা বলেছে, আমি একদম ভুলে গিয়েছি। ব্যস্ততার অজুহাতে আমি আমাকে সামলে নিচ্ছি।
পাঁচ দিন পেরিয়ে গেলো, সাফিন আমাকে একবারের জন্যও মনে করেনি। আমি ফোন করলেও কথা বলার যেন তার সময়ই নেই।
বেশ কয়েকদিন যাবৎ শরীরটা একদম ভালো লাগছে না। ভাবলাম, সাফিন ফেরার আগে ডাক্তার দেখিয়ে আসি। শাশুড়ি মা’কে সঙ্গে নিয়ে বের হলাম।
ডাক্তার বললেন, পরদিন এসে টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে যেতে। ডাক্তারের ওখান থেকে বের হয়ে আমি আর শাশুড়ি মা কেনাকাটা করার উদ্দেশ্যে শপিংমলে এলাম। হঠাৎ সাফিনের সহকর্মী আরিফ সাহেবের সঙ্গে দেখা।
কুশল বিনিময় শেষে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কবে এলেন চট্টগ্রাম থেকে?’
আমার কথায় আরিফ সাহেব বিস্মিত হলেন।
‘চট্টগ্রাম তো যাইনি ভাবী।’
‘কেন আপনি আর আপনার সাফিন ভাই কয়েকদিন আগেইতো চট্টগ্রামে গেলেন অফিসের কাজে! সাফিন তো এখনো ফেরেনি।’
‘কী বলেন ভাবী! সাফিন ভাই তো সাত দিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন অফিস থেকে।’
আমার চোখ কপালে উঠলো। সাফিন আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে না। আরিফ সাহেবেরই হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।
‘সাফিনতো এর আগেও একবার অফিসের কাজে ঢাকার বাহিরে গিয়েছিলো।’
‘ভাবী আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। সাফিন ভাইকে কিংবা আমাকে এখনো অফিস ঢাকার বাহিরে কোথাও পাঠায়নি।’
মাথা ঘুরিয়ে এলো। সাফিন তাহলে মিথ্যা বলেছে আমার সঙ্গে। কিন্তু কেন! সন্দেহের কাটা বইছে মস্তিষ্ক জুড়ে। শরীরটা আরও খারাপ লাগছে। নিজেকে সামলে অপেক্ষা করতে লাগলাম সাফিনের ফেরার।
ডাক্তারের কাছ থেকে রিপোর্ট আনতে গিয়ে জানলাম, সত্যিই এবার আমি মা হতে চলছি। মুহুর্তেই যেন সব মন খারাপেরা দূরে সরে গেলো। খুশিতে চোখে জল জমে গেলো। আগামীকাল সাফিন বাড়ি ফিরবে। তখন ওকে এই খুশির খবরটা নিজেই জানাবো। তার আগে আর কাউকে জানাবো না বলে ঠিক করেছি। ও নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি হবে। আমাদের মধ্যেকার সব দূরত্ব ঘুচবে এবার, ভাবতে আনন্দ যেন বেড়ে দ্বিগুণ হচ্ছে।
পরদিন সাফিন বাড়ি ফেরে। সাফিনের চালচলন সবই আমার কাছে সন্দেহজনক লাগে। যেন এ এক অন্য সাফিন, আমার সাফিন নয়। বারবার মনে হয় সাফিন কিছু লুকাচ্ছে। এদিকে খবরটা জানানোর জন্য ভেতরে ভেতরে ছটফট করে চলছি কিন্তু সঠিক সময়টাই যেন পাচ্ছি না।
সাফিন ওয়াশরুমে গেলে আমি ওর ফোনটা হাতে নেই। এত বছরে আমি কখনোই ওর ফোন এভাবে সন্দেহ নিয়ে ধরিনি। আজ প্রথমবার সাফিনের ফোনে তল্লাশি চালাচ্ছি। মনে মনে প্রার্থনা করে চলছি, যেন আমার সব সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হয়।
মেসেজ বাক্সে চোখ রাখতেই কেঁপে উঠলাম। একটার পর একটা করে মেসেজগুলো পড়ে চলছি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। নিজের চোখেই বিশ্বাস হচ্ছে না।
সাফিন হয়তো ভেবেছে আমি কখনোই ওকে সন্দেহ করতে পারি না। তাই ফোনের একটা ফোনকল, মেসেজও ডিলিট করেনি। আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না, সাফিন অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। এতদিন আমাকে বোকা বানিয়ে সাফিন ওর সময়গুলো অন্য কারো সঙ্গে কাটিয়েছে।
সাফিন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আমার হাতে ওর ফোন দেখতেই আঁতকে ওঠে। আমার চোখ ভিজে জল গড়াচ্ছে। সাফিন অপরাধীর মত চুপ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
চোখের জল মুছে প্রশ্ন করলাম, ‘বিয়ে করেছো নাকি শুধুই সময় কাটিয়েছো?’
মাথা নিচু করে উত্তর দিলো সাফিন, ‘বিয়ে করেছি। তুমি অনুমতি দিলে এ বাড়িতে নিয়ে আসব।’
তীরের মত বিধলো কথাটা বুকের মধ্যে। এই সাফিনকে আমি দিনের পর দিন এতটা বিশ্বাস করে গিয়েছি।
‘আমি মা হতে পারব না বলেই কী এমনটা করেছো নাকি আরও কারণ আছে?’
‘জুলিয়া, আমাকে ভুল বুঝো না। সবারই তো বাবা হতে ইচ্ছে করে।’
‘সবার মা হতে বুঝি ইচ্ছে করে না সাফিন! অথচ তুমি আমাকে একসময় হারানোর ভয় পেতে। কিন্তু তুমি অপেক্ষা করতে পারলে না।’
‘অপেক্ষা করেই বা কী হত? লাভ হতো কোনো?’
চোখে টলমল করে উঠলো জলেরা। ভেতরে যন্ত্রণারা ছটফট করছে। ভাঙচুর হচ্ছে ভেতর জুড়ে।
‘তুমি তোমার স্ত্রী’কে এ বাড়িতে নিয়ে আসতে পারো।’
কথাটা বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে পানির ট্যাপটা ছেড়ে দিলাম। হাউমাউ করে কাঁদার শব্দ আর বাহিরে বের হচ্ছে না। এ কষ্ট কোনো সান্ত্বনাই আটকাতে পারবে না।
চোখ মুখ ধুয়ে বের হয়ে দেখি সাফিন বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছে। নিজের সবকিছু গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম।
শাশুড়ি আর শ্বশুর বারবার প্রশ্ন করে চলছেন, ‘কী হয়েছে বউমা? কেন এমন করছো? কোথায় যাচ্ছো?’
শান্ত গলায় বললাম, ‘বাড়িতে আপনার নতুন বউমা আসছে আর পুরাতন বিদায় নিচ্ছে।’
ডাক্তারের থেকে পাওয়া রিপোর্টের কাগজটা শ্বশুরের হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা আপনার ছেলেকে দিবেন। বলবেন, তার বিয়েতে এটা আমার প্রথম উপহার। আর দ্বিতীয় উপহারের কাগজটা খুব শীঘ্রই পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, যাতে স্বাধীনভাবে সংসারটা সে করতে পারে।’
শাশুড়ি আমাকে আটকানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলেন। আমার সামনের সময় কাটিয়ে দেওয়ার জন্য একজন সঙ্গী আমি পেয়ে গিয়েছি, আমার শত কষ্টের মাঝেও সে সুখের বার্তা হয়ে জীবনে এসেছে। তাকে ঘিরেই তো এখন আমার আগামী।
গল্প: আগামী।
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি ।
গল্প: আগামী (দ্বিতীয় পর্ব)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
আমাকে দেখতেই মা চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘তুই এই অসময়ে?’
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মা আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কী রে একা এলি যে? জামাইকে সাথে করে নিয়ে আসতে পারলি না?’
‘কেন বিয়ের পর কী জামাই ছাড়া মেয়েরা একা তার বাবা বাড়ি আসতে পারে না? নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?’ বেশ কড়া মেজাজে বললাম।
‘না, তা হবে কেন! এমনি বললাম। তা এবার কী কিছুদিন থাকবি নাকি খানিক পরই যাই যাই শুরু করবি?’
মায়ের নরম স্বর শুনে বললাম, ‘চিন্তা করো না৷ আমি আর ওবাড়ি ফিরব না। একেবারেই চলে এসেছি।’
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘ঠিক শুনেছো তুমি। আর হ্যাঁ, আমি তোমাদের আদরের জামাইকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তোর? কীসব বকছিস? কী হয়েছে? এমন কথা মুখে আনলি কেন হঠাৎ? ঝগড়া করে চলে এসেছিস?’
আমি ঠান্ডা মেজাজে উত্তর দিলাম, ‘এত প্রশ্নের জবাব এখন দিতে পারব না৷ খিদে পেয়েছে। খেতে দাও।’
মা আমার এমন অদ্ভুত আচারণে বেশ বিস্মিত হচ্ছেন তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আমি আপাতত সেটা নিয়ে ভাবছি না। আপাতত নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা জীবনটা ছাড়া আর কাউকে নিয়েই ভাবছি না।
ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটা লম্বা ঘুম দিলাম। ভেতরে ছটফট করা হাজারো যন্ত্রণাকে ঘুম পড়াতে নিজের একটা দীর্ঘ ঘুমের খুব প্রয়োজন অনুভব করলাম। ঘুম থেকে উঠে মায়ের ভেজা চোখ জোড়া দেখে বুঝতে অসুবিধা হলো না যে মায়ের কানে এতক্ষণে সব ঘটনা পৌঁছে গিয়েছে।
আমাকে ড্রয়িংরুমে আসতে দেখতেই মা বলে উঠলেন, ‘জামাইটা এমন একটা কাজ করতে পারলো!’
মায়ের কাতর গলা শুনে ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যেতে শুরু করলো। কষ্টগুলোকে থামিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘মানুষের উপর দেখে ভেতরের খবর বোঝা আসলেই খুব কঠিন জিনিস মা। কিছু কিছু মানুষ খুব চালাক হয়, সূক্ষ্ম অভিনয় দিয়ে তারা তাদের ভেতরের খবর ঢেকে রাখতে খুব পারদর্শী হয়। চমৎকার অভিনয় জানেন তারা।’
মায়ের গাল বেয়ে পানি নামছে৷ আমি টলমল চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘তোমাদের জামাই একজন চমৎকার অভিনেতা মা।’
মা চুপ করে রইলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই নাকি প্রেগন্যান্ট, এটা কী সত্যি?’
আমি মায়ের হাতের মধ্যে হাত গুঁজে দিয়ে মুচকি হেসে বললাম, ‘সত্যি মা। তুমি নানি হতে যাচ্ছো।’
মায়ের দুঃখ ভরা কান্নায় এবার খুশির ছিটে দেখতে পেলাম।
সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে চুপচাপ বসে আছি। এমন সময় ছোট বোন নায়লা এসে দাঁড়ায় পাশে।
‘বান্ধবীর বিয়ে কেমন খেয়েছিস?’
আমার প্রশ্নের উত্তরে নায়লা বললো, ‘ভালো। তবে তুই এসেছিস জানলে আরও আগেই চলে আসতাম।’
আমাকে চুপ থাকতে দেখে নায়লা প্রশ্ন করলো, ‘আপা, দুলাভাই কী সত্যিই আরেকটা বিয়ে করেছে?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, সাফিন বিয়ে করেছে।’
‘আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারলো না মানুষটা!’
আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, ‘অপেক্ষা না করে ভালোই করেছে বোধহয়। অপেক্ষা করলে ওর ভেতরের চিন্তাচেতনা সম্পর্কে কখনোই আমার জানা হতো না।’
‘দুলাভাই কী জানে যে তুই মা হতে চলছিস?’
‘এখন জানে কী না জানি না।’
‘তোর জানতে ইচ্ছে করে না, এই খবরটা জানার পরে তার রিয়াকশন কী?’
‘উহুম না। একদমই ইচ্ছে করে না ওর বিষয়ে কিচ্ছু জানতে।’
‘তুই আসার পর কল দিয়েছিলো?’
‘ফোন বন্ধ। দিলেও জানতে পারব না।’
রাতে মুঠোফোনটা চালু করতেই দেখি সাফিনের ফোনকল। বেশ কয়েকবার কেটে দেওয়ার পরে বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করলাম।
‘জুলিয়া আমি তোমাকে নিতে আসি?’
‘ভেবে পাচ্ছি না, কোন মুখ নিয়ে কথাটা বললে তুমি।’
খানিক চুপ থাকার পরে সাফিন বললো, ‘এই সংসার তো তোমারই জুলিয়া। বাবা-মা তোমাকে খুব ভালোবাসেন তুমি তো জানো।’
‘ও সংসার এখন আর আমার না। আর যার ভালোবাসার খুব প্রয়োজন ছিলো সে’ই যখন ভালোবাসেনি তখন অন্য কারো ভালোবাসার আর প্রয়োজন নেই।’
‘আমি যা করেছি ভুল করেছি। তুমি আমাকে একটাবার……’
সাফিনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘সন্তানের বাবা হবে শুনে এখন মনে হচ্ছে সব ভুল করেছো! অথচ খবরটা জানার আগেও ভাবতে সব ঠিক। সব যদি বাচ্চা হওয়া আর না হওয়ার উপরেই ধার্য হয়, তাহলে আমার প্রতি তোমার অনুভূতি আসলে কোথায়?’
সাফিন চুপ করে রইলো। আমি বললাম, ‘ডিভোর্স পেপার তোমার হাতে খুব শীঘ্রই পৌঁছে যাবে। তুমি নিশ্চিন্তে সংসার করতে পারো।’
‘আরেকবার কী ভেবে দেখবে জুলিয়া?’
‘তোমাকে আমার জীবনে আর প্রয়োজন নেই সাফিন৷ তোমার মতো মানুষেরা আমার জীবন থেকে সরে গেলেই বরং আমি ভালো থাকব। বিশ্বাস ভেঙ্গে দিয়েছো তুমি। সম্পর্কটা আর কখনো জোড়া লাগবে না সাফিন।’
সাফিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা সুইচড অফ করে দিলাম।
এই মুহুর্তে হাউমাউ করে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছি না৷ নায়লা পাশে এসে বসলো।
‘আপা, কষ্ট হচ্ছে তোর?’
কান্নাচাপা গলায় বললাম, ‘যে মানুষটা আমাকে কষ্ট দিয়েছে তার জন্য কষ্ট পাওয়া একদম উচিৎ হচ্ছে না। কিন্তু তবুও খুব কষ্ট হচ্ছে রে।’
মায়ের কাছ থেকে জানলাম সাফিনের বাবা-মা সব ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা চালাতে চাইছেন। মা’কে বললাম, তাদেরকে অযথা কষ্ট করতে বারন করে দিতে।
ভেতরে বড় হচ্ছে জীবন৷ পুত্র নাকি কন্যা জানতে ইচ্ছে করছে না। একটা সুস্থ জীবন আসুক, এটাই এখন একমাত্র প্রার্থনা৷
নায়লা এসে খবর দিলো, ‘জানিস আপা, দুলাভাই নাকি তার নতুন বউকে বাড়ি এনেছে।’
‘উকিল সাহেব বলেছেন, বাচ্চা জন্মের পরই ডিভোর্স কার্যকর হবে। তাই এই অপেক্ষা। তার মানে এই না যে আমি এখনো মন থেকে সাফিনকে স্বামী ভাবি। সুতরাং আর কখনো ওকে দুলাভাই বলবি না।’
নায়লা মাথা নেড়ে বললো, ‘মনে থাকবে আমার।’
‘তুই খবর জানলি কী করে?’
‘সাফিন ভাইয়ার কাজিন আমার ভার্সিটিতে পড়ে তো।’
‘ওহ, হ্যাঁ। মনে ছিলো না সে কথা।’
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু পেটটার দিকে তাকিয়ে বাচ্চার সঙ্গে কথা বলি আমি। মনের সব জমানো কথা আমি আমার অনাগত সন্তানের সঙ্গে বলাবলি করে মনটাকে হালকা রাখার চেষ্টা চালাই।
মায়ের মাধ্যমে সাফিনের বাবা-মা মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে আমার খোঁজ খবর রাখার চেষ্টা করেন। তাদের মাধ্যমেই খবর জানতে পারি, সাফিনের স্ত্রী গর্ভবতী। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। সাফিন এখনো স্বাক্ষর করে কাগজটা পাঠায়নি। তবে ডিভোর্সের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে সাফিন আমার সঙ্গে একবার যোগাযোগের চেষ্টাও করেনি, একবারের জন্য আমাকে দেখতে এবাড়িতেও আসেনি। আমি নিশ্চিত, অপরাধবোধের তাড়নায় নয়, সাফিন নতুন সংসার আর নতুন জীবনের কারণেই আমার মুখোমুখি হতে চায়নি। সে ডুবে আছে নতুন স্বপ্নে, নতুন ঘোরে। সেখানে আমার কোনো অস্তিত্ব নেই।
সাফিনের মনে আমার প্রতি বিন্দু পরিমাণে ভালোবাসাও আর অবশিষ্ট নেই যে সে কথা আমি জানি। তবে ডিভোর্স পেপারটা এখনো কেন ঝুলিয়ে রেখেছে, এটা জানি না। ওর স্বাক্ষর আর বাচ্চা জন্মানোর জন্যই আমার এখন অপেক্ষা। সামনের দিনগুলো আমি শান্তিতে আমার সন্তানের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে চাই। সেখানে সাফিন নামের ওই মানুষটার কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রচন্ড ব্যথা উঠলে বাবা মা আমায় হাসপাতালে নিয়ে এলেন। এখানেই জন্ম নেয় জমজ বাচ্চা। কী ফুটফুটে দেখতে দু’টো সন্তান। নায়লা ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘মেয়েটা দেখতে একদম তোর মতো হয়েছে আপা। আর ছেলেটা দেখতে সাফি…’
আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। বললাম, ‘কার মতো হয়েছে ওটা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। সুস্থ হয়েছে এটাই সবথেকে বড় খুশি।’
সন্তান হওয়ার খবর পৌঁছে যায় সাফিনের বাড়ি। ওবাড়ি থেকে সাফিনের বাবা-মা আসতে চাইলে বাবা বারন করে দিলেন। সাফিন একবারের জন্যও আর যোগাযোগ করেনি৷
হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে জানতে পারি সাফিনের তরফ থেকে স্বাক্ষর করা ডিভোর্স পেপারটা আমার বাসায় পৌঁছে গিয়েছে। হতে পারে এটা সাফিনের তরফ থেকে আমার বাচ্চাদের জন্য উপহার।
আমার দুই বাচ্চার মা হওয়া, আমাদের পুরোপুরি ডিভোর্স হয়ে যাওয়া নিয়ে সাফিনের কোনো অনুভূতি আমি জানতে পারিনি৷ জানার চেষ্টাও করিনি। হয়তো ডিভোর্সে খুশি হয়েছে আর সন্তান তো তার ঘরেও আসবে, তাই হয়তো এই সন্তানদের নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা আমি টের পাইনি৷
মা হতাশ গলায় বললেন, ‘জামাইটা এতটা নিষ্ঠুর, আগে কখনো চিন্তাও করিনি।’
‘সে আর তোমাদের জামাই নেই মা।’
মা ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমরা না হয় আত্মীয়ের তালিকা থেকে বাদ পড়েছি। কিন্তু সন্তান দু’টোর খবর নেওয়া তো তার উচিৎ ছিলো।’
মা’কে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘ওসব কথা বরং ভুলে যাও মা। আমার সন্তানদের পাশে আমি আছি৷ মা হয়েও আমি থাকব আর বাবা হয়েও।’
ভেতরে যতই কষ্ট থাকুক সন্তানদের মুখের দিকে তাকালে সব ভুলে যাই৷ সুন্দর দু’টো মুখ। এদের নিয়েই আমার বাকি জীবনটা সুন্দরভাবে কেটে যাবে আমার বিশ্বাস।
ওবাড়ির লোকেদের সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ হয় না৷ মাস খানেক পর নায়লা খবর জানায়, সাফিনের স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাচ্চাটা মারা গিয়েছে। ডাক্তার বলেছে সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি, কিন্তু তিনি আর কখনোই মা হতে পারবেন না।
আল্লাহ তায়ালার বিচার কী না সেসব যুক্তি তর্কে যাব না। তবে খবরটা শুনে খুশি হইনি মোটেও। সাফিনের প্রতি অনেক রাগ, ক্ষোভ, অভিযোগ ছিলো। তাই বলে অভিশাপ দেইনি তাকে কখনো। এমনটা সত্যিই প্রত্যাশা করিনি আমি।
বাচ্চারা বড় হয়ে উঠছে। আমিও অতীতকে চাপা দিয়ে দিন পার করে চলছি। জীবনে অনেক না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও, যা পেয়েছি তা দিয়ে সব শূন্যতা ভরাট করতে সক্ষম হয়েছি, এটাই সফলতা আমার।
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাসহ ছয় ঋতু নিয়ে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর। আমি এখন একটা স্কুলে বাচ্চাদের পড়াই। সবথেকে বড় পরিচয় আমি দুই সন্তানের মা। সারাদিনের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় যখন আমার বাচ্চারা আম্মু বলে ডাক দেয়।
স্কুল শেষ করে বের হতেই মনে পড়লো ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখেছি ঘন্টা খানেকের বেশি। কেউ কল করেছে কী না চেক করতেই দেখি নায়লা, মা আর নায়লার স্বামীর নাম্বার থেকে বেশ কয়েকটা ফোনকল জমা পড়েছে। ভেতরটা আঁতকে উঠে। নায়লাকে কল করলে একটা হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে বললো, জরুরী পৌঁছাতে। কার কী হয়েছে আমি কিচ্ছু জানি না৷ মনের মধ্যে অজানা ভয় কুঁড়ে খাচ্ছে। আমি তাড়াতাড়ি করে ছুটলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
ওখানটায় পৌঁছালে জানতে পারি, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে মা বাচ্চাদের নিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। মাথায় বাজ পড়লো। মায়ের অবস্থা ভালো কিন্তু বাচ্চাদের রক্তের প্রয়োজন। এবি নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের কাউকে এই মুহুর্তে খুঁজে বের করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মুহুর্তে বাচ্চাদের কাছেও যেতে বারন করে দিয়েছেন ডাক্তার। ভেতরটা ছটফট করছে। চারপাশ অন্ধকার মনে হচ্ছে। আমি কুল-কিনারাহীণ হয়ে আল্লাহ তায়ালাকে স্মরণ করে চলছি। নায়লা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।
খানিক বাদেই নায়লার স্বামী এসে জানায়, ‘আপা দুশ্চিন্তার কারণ নেই৷ এক ভদ্রলোককে পাওয়া গিয়েছে। তিনি রক্ত দিতে রাজি হয়েছিলেন।’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রক্ত কী দেওয়া হয়ে গিয়েছে?’
‘এতক্ষণে বোধহয় দেওয়া হয়ে গিয়েছে।’
‘আমি কী এখন বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে পারব?’
‘হ্যাঁ। আমার সঙ্গে চলেন।’
মায়ের পাশ থেকে উঠে গিয়ে আমি আর নায়লা বাচ্চাদের রুমের দিকে ছুটলাম।
রুমে পা দিতেই দেখি এক ভদ্রলোক বাচ্চাদের বিছানার পাশে বসে আছেন।
‘আপা ইনিই রক্ত দিয়েছেন।’ নায়লার স্বামী আমাকে কথাটা বলতেই ভদ্রলোক পেছন ঘুরে আমার মুখের দিকে তাকালেন।
আমি থ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। শরীরটা যেন অবশ হয়ে আসছে। নায়লা পাশ থেকে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে৷
আমাকে ইঙ্গিত করে নায়লার স্বামী ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে বললো, ‘তিনি হলেন বাচ্চাদের মা।’
সাফিন আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি কোনো কথা বলার পরিস্থিতিতে নেই। সাফিনকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ কী না বুঝে উঠতে পারছি না। তবে এই মুহুর্তে আমার আরও একবার মনে পড়লো, আমার বাচ্চাদের শরীরে তাদের বাবা সাফিনের রক্তও বইছে। আমি হাজার চাইলেও বাচ্চাদের থেকে তার বাবাকে দূরে রাখতে পারব কী না জানি না। আগামীতে বাচ্চারা তার বাবার ঠিক কতটা কাছে পৌঁছে যাবে তাও জানি না। শুধু জানি বাচ্চাদের পাশে তাদের বাবার ছায়া হয়ে কেবল আমিই থাকার চেষ্টা করব। সেখানে সাফিনকে কখনো মেনে নিতে পারব না৷ তবুও ভয় হয়। আগামী নিয়ে ভয়।
গল্প: আগামী (৩য় পর্ব)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
সাফিনের চোখে টলমল করছে জল। আমার দু’চোখে জেগে উঠেছে পুরাতন যত ক্ষোভ। সময় পেরিয়ে গিয়েছে অনেক। তাই বলে ভেতরে জমাট বাঁধা কষ্টগুলোর কথা ভুলে যাইনি, যেতে পারিনি।
মানুষ সুখের কথা যতটা না শক্ত করে মনে রাখে, তারথেকে হাজারগুণ বেশি শক্ত করে মনে রাখে দুঃখের কথা। দশদিন যে মানুষটা ভালোবেসেছিলো, তার কথা অতটা মনে থাকে না। কিন্তু একদিন যে মানুষটা কষ্ট দিয়েছিলো, সেই মানুষটার কথা কখনো মন থেকে সরে না।
তবুও ভেতরের অনুভূতিকে স্তব্ধ রেখে ভদ্রতা রক্ষাটা এই মুহুর্তে দরকারি মনে হলো।
একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের দৃষ্টিতে সাফিনের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমার সন্তানদেরকে রক্ত দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা কৃতজ্ঞ।’
আমার কথায় সাফিনের বিব্রতবোধটা টের পেলাম সহজেই। সাফিন নিচের দিকে তাকিয়ে জবাবে বললো, ‘মানুষ তো মানুষের পাশে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।’
এই কথার প্রেক্ষিতে অনেক কিছু বলতে মন চাইছে। মন চাইছে সাফিনকে আচ্ছামতো অপমান করে দিই কথার ভাঁজে। কিন্তু নিজেকে থামালাম। সাফিন আমার কাছে অপরিচিত মানুষের একজন। তার কোনো গুরুত্ব আমার জীবনে নেই। তাই অতীতের সব হিসেব নিকেশ স্থগিত করে বললাম –
‘আমার মনে হয়, আপনার এখন বিশ্রাম নেওয়া দরকার। আপনি চাইলে এখন বাসায় চলে গিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন।’
সাফিনের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আমি তাকে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্যই কথাটা বলেছি। তাই আর কথা বাড়ায় না। নায়লার স্বামী মুহিতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় সাফিন। আমি বাচ্চাদের পাশে গিয়ে বসি।
নায়লা প্রশ্ন করে মুহিতকে, ‘সাফিন ভাইয়াকে পেলে কোথায় তুমি?’
মুহিত অবাক স্বরে প্রশ্ন করে, ‘তাকে চিনতে তুমি?’
‘তিনিই তো বাচ্চাদের বা….’ আমি তাকিয়ে পড়ায় লাইনটা শেষ করতে পারলো না নায়লা।
নায়লার দিকে তাকিয়ে মুহিত ইশারা করলে নায়লা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই মুহিতের চোখেমুখে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে।
চাপা স্বরে বলে, ‘হায় আল্লাহ! আমি কী না শেষমেশ তাকেই খুঁজে পেলাম!’
‘কোথায় পেয়েছিলে?’
‘তার স্ত্রী’কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন। আমি তখন হন্য হয়ে রক্ত খুঁজছি। এখানকার কয়েকজন নার্সকে বলে রেখেছিলাম। একজন এসে জানালো, এক ভদ্রলোক’কে তিনি খুঁজে পেয়েছেন।’
‘নাটক, সিনেমা আর গল্পে এরম কাহিনী লেখা হয়৷ বাস্তবেও তাহলে এমনটা ঘটে!’
নায়লার কথায় মুহিত হেসে জবাব দেয়, ‘ঘটলো তো।’
ওদের কথার বিষয়বস্তু পাল্টে দিতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমরা কবে বাসায় যেতে পারব, ডাক্তার কিছু বলেছে?’
‘এখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। আমি জেনে আসছি।’ কথাটা বলে মুহিত চলে গেলো।
নায়লাকে বললাম, ‘মা’কে একবার দেখে আয়।’
বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা খুব একা হয়ে পড়েছেন। নায়লাও বিয়ের পর মুহিতের সঙ্গে আলাদা বাসা নিয়ে থাকে। মায়ের সঙ্গ বলতে আমি আর আমার দুই সন্তান।
বাচ্চাদের পাশে চুপচাপ বসে আছি। চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। অতীতের কথা ভেবে নয়, বাচ্চাদের কথা ভেবে। আজ যদি ভয়ংকর কিছু ঘটে যেত, আমি তাহলে বোধহয় বেঁচে থাকার সমস্ত আশা হারিয়েই ফেলতাম। বাচ্চারা ছাড়া আমি আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারি না।
বাচ্চারা সুস্থ হয়ে উঠছে। আগামীকাল বাসায় যেতে পারব বলে জানায় ডাক্তার। মা’কে নিয়ে নায়লা বাসায় চলে গিয়েছে গত পরশু। অফিস শেষে মুহিত এসে খোঁজখবর নিয়ে যায় রোজ। নায়লার জন্য এমন চমৎকার একটা ছেলে পেয়ে আমি আর মা ভীষণ খুশি। ওদের সম্পর্কটা আজীবন এমন সুন্দর থাকুক, মাঝপথে রঙ না বদলাক এটাই কামনা করি। আমি চাই না, আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি আর কারোর জীবনে ঘটুক।
সন্ধ্যায় আচমকা সাফিন এসে হাজির। দু’হাতে বাচ্চাদের জন্য একগাদা খাবার দাবার। ওর মুখটা দেখতেই ঠান্ডা মেজাজটা বিগড়ে যেতে শুরু করলো। বাচ্চাদের সামনে কড়া মেজাজকে দমন করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলতে হলো সাফিনের সঙ্গে।
বাচ্চারা প্রশ্ন করলো, ‘মা, উনি কে? কী হন আমাদের?’
সাফিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ইতস্ততবোধ না করেই চটজলদি বলে উঠলাম, ‘উনি তোমাদের একটা আঙ্কেল। তোমরা যখন অসুস্থ ছিলে, তিনি তখন তোমাদেরকে রক্ত দিয়েছিলেন।’
বাচ্চারা হাসিমুখে ধন্যবাদ জানালো সাফিনকে৷ আমার সঙ্গে আর সাফিনের কথা জমানোর সুযোগ হয়নি৷ বাচ্চাদের সঙ্গে খোশগল্প শুরু করতেই মুহিত চলে এলো। রুমের মধ্যে আমার দম বন্ধ লাগছিলো। মুহিত এলে স্বস্তি পেলাম। রুম ছেড়ে বের হয়ে বাহিরে দাঁড়ালাম। ভেতরে গল্প চলছে সাফিনের সঙ্গে সকলের। আমি একটু সামনের দিকে হেঁটে গেলাম।
হাসপাতালে নানান ধরণের মানুষের আগমন ঘটে। হরেক মানুষের হরেক সমস্যা, দুঃখ, যন্ত্রণা দেখে নিজের কষ্ট কখন যে শীতল হয়ে গিয়েছে টেরই পাইনি৷ আইসিইউ থেকে লাশ বের করে স্বজনেরা নিয়ে যাচ্ছেন আর হাউমাউ করে কেঁদে চলছেন। এমন দৃশ্য চোখে পানি এনে দিলো। চোখের পানি মুছে বাচ্চাদের রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখি সাফিন এদিকেই আসছে।
আমি দেখেও না দেখার অভিনয় করে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই সাফিন সামনে এসে বললো, ‘আমি কী একটু সময় নিতে পারি? আমাকে একটু সময় দেওয়ার জোর অনুরোধ রইলো।’
মন থেকে সম্মতি না পেলেও বললাম, ‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘এখানে তো অনেক লোকজন। আমরা কী একটু ওদিকটায় গিয়ে দাঁড়াতে পারি?’
সাফিনের ইশারা করা দিকটার দিকে তাকাতে দেখি ওদিকটায় লোকজন বেশ কম আছে।
আমি শান্ত গলায় বললাম, ‘চলুন।’
আমি সাফিন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি৷ পেছনে কেটে গেছে কতগুলো বছর। সাফিনের আচারণে বুঝতে কষ্ট হয়নি, আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস ওর নেই। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘জ্বী, এবার বলুন।’
‘কেমন আছো তুমি?’
সাফিনের এই নরম গলার প্রশ্ন শুনে অন্য কেউ হয়তো আবেগী হয়ে পড়তো। কিন্তু আমার বিন্দু পরিমাণেও আবেগ তৈরি হয়নি ভেতরে। বরং স্বরটা শক্ত হয়ে উঠলো।
‘আমার বাচ্চাদেরকে রক্ত দিয়েছিলেন আপনি। শুধু এই ভদ্রতার কারণেই আপনার সঙ্গে এখানটায় দাঁড়িয়ে আছি। জরুরী কিছু বলার থাকলে বলেন, আমাকে বাচ্চাদের কাছে যেতে হবে। ওরা আমায় হয়তো খুঁজছে।’
‘বাচ্চারা তোমায় অনেক ভালোবাসে।’
‘অবশ্যই। আমার বাচ্চারা আমাকেই তো ভালোবাসবে।’
‘আর বিয়ে করোনি?’
প্রশ্নটা শুনে সাফিনের দিকে তাকাতেই সাফিন চোখ সরিয়ে নিলো।
কড়া মেজাজে বললাম, ‘বুঝেছি, আপনার আসলে বলার মতো জরুরী কিছু নেই। আর এখানে আমি ব্যক্তিগত প্যাচাল পাড়ার জন্য আসিনি।’
কথাটা বলে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই সাফিন বললো, ‘জুলিয়া। আমি জানি তুমি আমায় ঘৃণা করো। অনেক রাগ জমে আছে আমার প্রতি।’
আমি পেছন ঘুরে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার কাছে এটাই কী স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না?’
খানিক চুপ থেকে সাফিন উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সঙ্গে। কষ্ট দিয়েছি তোমায়। যা করেছি সব ভুল করেছি। কিন্তু তাই বলে তোমায় যে আমি কখনোই ভালোবাসিনি, তা কিন্তু নয়।’
‘এক বালতি দুধের মধ্যে এক ফোটা বিষের যে প্রবাদটা ওটা বোধহয় আপনি ভুলে গিয়েছেন। আর এখন আপনার সঙ্গে পুরাতন স্মৃতি ঘাটার সময় এবং সম্পর্ক, কোনোটাই আমার নেই।’
‘কিন্তু তবুও কী তুমি অস্বীকার করতে পারবে যে তোমার বাচ্চাদের বাবা কিন্তু আমিই?’
কথাটা শোনা মাত্রই ভেতরে ক্রোধের আগুনের ফুলকি ছিটে উঠলো।
গলা ফাটিয়ে বললাম, ‘এই প্রশ্নটা করতে আপনার লজ্জা হওয়া উচিৎ ছিলো।’
আমার রাগত্ব স্বরে আশেপাশের কয়েকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে পড়লো। সাফিন চুপ করে রইলো। আমি চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বললাম, ‘আমার বাচ্চাদের দিকে নজর দিবেন না। ওরা আমার সন্তান। ওদের আর আমার মাঝে আপনার অস্তিত্বের কোনো প্রয়োজন নেই।’
সাফিন করুণ গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে আমার সন্তানেরা কী কখনোই আমার কথা আরকি তাদের বাবার কথা জানতে পারবে না?’
‘একটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন আপনি, সন্তানেরা কেবল আমার৷ ওদের বাবাও আমি, মাও আমি৷ কেবল জন্ম দিলেই যেমন মা হওয়া যায় না, তেমন এত সস্তায় বাবাও হওয়া যায় না। বাবা হতে গেলে বাবার দায়িত্ব পালন করতে হয়। আপনি কী কী দায়িত্ব পালন করেছিলেন সেই হিসেবে যাব না। সেটা আপনিও ভালো জানেন আর আমিও।’
সাফিন মাথা নিচু করে বললো, ‘আমি আমার সমস্ত ভুল শুধরে নিয়ে সব আগের মতো করে নিতে পারব না জানি৷ অন্তত একজন বাবা হিসেবে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ চাই তোমার কাছে। দয়া করে আমার বাচ্চাদের সাথে যোগাযোগের একটা রাস্তা খোলা রাখো তুমি।’
ধিক্কার ভরা স্বর নিয়ে বললাম, ‘আমি অত্যন্ত দুঃখিত, আমি আপনার জন্য কখনোই কিছু করতে পারব না, করতে চাইও না।’
সাফিনের চোখে ছলছল করছে জল।
কাতর গলায় বললো, ‘আমি আমার বাচ্চাদের মুখগুলো দেখেছি, ওদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি, ওদেরকে হাসতে দেখেছি। কী নিষ্পাপ দু’টো মুখ। আমি ওদেরকে ভালোবেসে ফেলেছি জুলিয়া।’
‘ভালোবাসাটা নিজের মধ্যেই চেপে রাখুন। ওসব কখনো আমাকে কিংবা আমার সন্তানদেরকে বলতে আসবেন না। আমাদের তিনজনের জীবনে আপনি কেউ না।’
কথাটা বলেই দ্রুত পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। পেছনে সাফিন দাঁড়িয়ে আছে। কতটা চোখের পানি ফেলেছে, জানি না৷ কখনো এসব জানতে চাইও না৷ আমি সাফিনকে ঘৃণা করি, ভীষণ ঘৃণা করি। এমন একটা মানুষ আমার বাচ্চাদের কাছে বাবা হয়ে উঠবে, এ আমি কখনো মেনে নিতে পারব না। আমি আমার সন্তানদের কাছে আর কখনো ওকে ঘেঁষতে দিব না। রক্ত দিয়েছে, এই জন্য যতটুকু ভদ্রতা প্রয়োজন ছিলো করার চেষ্টা করেছি। আর সম্ভব নয় কিছুই করা। আমি আমার সন্তানদেরকে আমার থেকে একটুও দূরে সরে যেতে দিব না।
‘মা, কোথায় ছিলে তুমি? জানো, ওই আঙ্কেলটা চলে গিয়েছে। আরও কিছুক্ষণ থাকতে বললাম, থাকলোই না।’
মেয়েটার কথা শুনে বললাম, ‘আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম মা।’
ওদের আঙ্কেল সম্পর্কে আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না।
মুহিত বললো, ‘আপা আমি তাহলে চলে যাচ্ছি। কাল সকালে এসে আপনাদেরকে নিয়ে যাব। আর প্রয়োজন হলে অবশ্যই কল করবেন।’
মুহিত চলে গেলো। বাচ্চাদের সঙ্গে আমি খেতে বসে গেলাম। ওদের মুখগুলো খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে, আগামীকাল বাসায় যাবে বলে।
হাসপাতালে মানুষ দায়ে পড়ে আসে, দিনের পর দিন থাকে, আশেপাশের মানুষের প্রতি মায়া জন্ম নিলেও হাসপাতাল কখনো কারো কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে না৷ কারণ সবাই বাড়ি ফিরতে চায়। হাসপাতাল ছুটি না দিলে, বাড়ি ফেরা যে সম্ভব নয়।
সকালে উঠে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম। মুহিত আমাদের নিতে চলে এসেছে। হাসপাতালের বাহিরে গাড়ি অপেক্ষা করছে৷ বাচ্চারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
ওদের আচারণ দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে তোমাদের?’
ছেলেটা উত্তর দিলো।
‘গতকালের ওই আঙ্কেলটা বলেছিলেন, আজ তিনি এখানে আসবেন৷ আমরা চলে গেলে তিনি আমাদের খুঁজে পাবেন কীভাবে?’
আমি মুহিতের দিকে তাকাতেই মুহিত বললো, ‘আসলে আপা গতকাল সাফিন ভাইয়া ওদেরকে বলে গিয়েছিলো, আজ তিনি আসবেন।’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘বুঝেছি।’
বাচ্চাদেরকে কাছে টেনে নিয়ে বললাম, ‘আঙ্কেল আসবেন না৷ তার হয়তো জরুরী কাজ পড়ে গিয়েছে। আমরা বরং এখন তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যাই। বাসায় নায়লা খালামনি আর নানি আপু মজার সব খাবার রান্না করে অপেক্ষা করছেন।’
বাচ্চারা মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা।’
বাসায় আসতেই খুশিতে লাফিয়ে উঠলো বাচ্চারা। স্কুল থেকে বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছি। এই সময়গুলো আমি কেবল বাচ্চাদেরকেই দিতে চাই।
রাতে বাচ্চাদের পাশে শুয়ে আছি এমন সময় মেয়েটা প্রশ্ন করলো, ‘মা তুমি জানো ওই আঙ্কেলটার নামও কিন্তু সাফিন?’
আমি খানিকটা অবাক হওয়ার ভঙ্গিমা করে বললাম, ‘তাই নাকি? তোমাকে কে বলেছে?’
‘আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তখন সে বললো, তার নাম সাফিন।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা।’
ছেলেটা বলে উঠলো, ‘বললাম, জানো আঙ্কেল আমার বাবার নামও সাফিন
এবার উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর সে কী বললো?’
‘সে কিছুই বলেনি। চুপ করে ছিলো।’
আমি চুপ করে রইলাম। ছেলেটা আবার বলে উঠলো, ‘মা, আমাদের বাবা দেখতে কেমন?’
আমি ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি কখনোই তাকে বলতে পারব না যে তার বাবা দেখতে তার মতোই। ঠিক যেমন তাদের সাফিন আঙ্কেল।
গল্প: আগামী (৪র্থ পর্ব)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
ছুটির দিনে বাচ্চাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে এসেছি নদীর ধারে। বিকেল হলে এখানে নানান মানুষের আনাগোনা শুরু হয়৷ যানজট আর কোলাহলপূর্ণ শহরে একটু বিশুদ্ধ শ্বাস নিতে মানুষ নদীর পাড়ে জমা হয়।
বাদামের খোসা ফেলে বাচ্চাদের হাতে বাদাম তুলে দিচ্ছি আর ওরা মজা করে খাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ চোখ পড়ে কিছুদূরে বসে থাকা সাফিনের দিকে। সাফিনের পাশে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন৷ এখান থেকে তার চেহারা অতটা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও, অনুমান করলাম যে তিনিই হয়তো সাফিনের বর্তমান স্ত্রী।
বাচ্চাদের নিয়ে এই মুহুর্তে স্থান পরিবর্তন করাটা খুব জরুরি মনে হলো। আমি ওদেরকে নিয়ে সাফিনের বিপরীত দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। যাতে আমাদের দূরত্ব বেড়ে গেলে সাফিনের মুখটা বাচ্চাদের চোখে না পড়ে।
‘মা, ওখানেই তো বসতে পারতাম!’
মেয়েটার কথার জবাবে বললাম, ‘ওখানের থেকে এইদিকটা বেশি ভালো মনে হলো।’
আমরা বসে আবার বাদাম খেতে শুরু করলাম। আশেপাশে অনেক বাচ্চারা রয়েছে। তারা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। সঙ্গে থাকা বাবা মায়েরা তাদের উপর কড়া নজর রাখছেন।
সাইকেল নিয়ে আসা ছোট্ট মেয়েটা তার বাবার সাহায্যে সাইকেল চালানো শিখছে। সেদিকে চোখ পড়তেই বাচ্চারা আবদারের সুরে বললো, ‘মা, আমাদেরকেও একটা সাইকেল কিনে দিবে?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘আরেকটু বড় হও। অবশ্যই কিনে দিবো।’.
‘ওই মেয়েটা তো আমাদের থেকে ছোট। তাহলে আমাদের কেন আরও বড় হতে হবে?’
মেয়েটার বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন শুনে বললাম, ‘তোমাদের মা আগে সাইকেল চালানোটা সম্পর্কে একটু শিখুক। তারপর তোমাদেরকে অবশ্যই কিনে দিবে। মা না শিখলে বাচ্চাদের কীভাবে শিখাবে বলো?’
ওরা চুপ করে রইলো। তারপর বললো, ‘আচ্ছা।’
‘এবার তাহলে চলো, বাসায় ফেরা যাক।’
বাচ্চারা সম্মতি দিলে উঠে পড়লাম। এমন সময় সাইকেল চালানো শিখতে আসা মেয়েটা সাইকেল নিয়ে পড়ে গেলে বাচ্চারা দৌড়ে গেলো ওকে সাহায্য করার জন্য। আমিও এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে।
মেয়েটার বাবা এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে চুমো খেলেন। তারপর আমার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘কী নাম তোমাদের?’
উত্তর দিলো ছেলেটা, ‘আমার নাম মিরাণ আর ওর নাম মেহরিমা।’
‘বাহ্! খুব সুন্দর নাম।’
‘ধন্যবাদ।’
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। আমি তার কোলে থাকা মেয়েটিকে প্রশ্ন করলাম, ‘মামুনি, বেশি ব্যথা পেয়েছো?’
মেয়েটা মাথা নেড়ে বললো, ‘অল্প একটু।’
‘তোমার নাম কী মামুনি?’
‘আমার নাম এশা।’
‘তোমার মতোই মিষ্টি তোমার নামটা।’
ভদ্রলোক মেহরিমা আর মিরাণের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাদের অনেক ধন্যবাদ।’
বাচ্চারা চুপ করে রইলো। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওরা কী টুইন?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হুম।’
‘খুব মিষ্টি দু’টো বাচ্চা আপনার।’
আমি হাসিমুখে বললাম, ‘ধন্যবাদ।’
আমরা কথা বলতে বলতে হেঁটে চলছি। কথায় কথায় জানতে পারলাম, ভদ্রলোক এ এলাকায় নতুন৷ তার স্ত্রী বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছেন। মিষ্টি দেখতে মেয়েটা মা হারা, শুনে খুব খারাপ লাগলো।
ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি বাচ্চাদের হাত ধরে হাঁটছি৷ হঠাৎ মিরাণ চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘মা, ওই যে সাফিন আঙ্কেল।’
থতমত হয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি সাফিন আর তার স্ত্রী এদিকেই আসছে। আমি চুপচাপ বাচ্চাদের হাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। ওরা সাফিনকে দেখে বেশ উৎসুক হয়ে আছে।
সাফিনের সামনাসামনি পৌঁছাতেই সাফিন থমকে দাঁড়ায়। বাচ্চাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় শেষে নিজের স্ত্রীকে পরিচয় করিয়ে দিলো। বাচ্চাদের সঙ্গে পরিচয় শেষে সাফিন তার স্ত্রীকে আমার সঙ্গে পরিচয় করাতে বললো, ‘আর উনি হলেন বাচ্চাদের মা, জুলিয়া।’
জুলিয়া নামটা শোনা মাত্রই সাফিনের স্ত্রী চমকে উঠলেন৷ তার চমকে যাওয়া মুখটা দেখে নিশ্চিত হলাম তিনি বিগত কয়েকদিনের ঘটনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না৷
চমকে যাওয়া মুখটাকে স্বাভাবিক করতেই তিনি বললেন, ‘জুলিয়া আপা, আমি লতা।’
জোর করা হাসিমুখ দেখিয়ে বললাম, ‘পরিচয় হয়ে ভালো লাগলো।’
বাচ্চারা সাফিনের সঙ্গে কথপোকথন চালিয়ে যাচ্ছে। আমি তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি৷ সাফিনের স্ত্রী লতা এসে আমার পাশে দাঁড়ায়।
বিস্ময় ভরা চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনিই তাহলে সেই জুলিয়া!’
আমি তার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে বললাম, ‘জ্বী। আমিই আপনার স্বামীর প্রাক্তন স্ত্রী।’
‘আপনার কথা অনেক শুনেছি, সাফিনদের বাড়িতে এসে।’
‘কেন এ বাড়িতে আসার আগে শুনেননি?’
‘জামতাম সাফিন বিবাহিত। তবে আপনার সম্পর্কে এতকিছু জানিনি৷’
‘আমার মনে হয়, আপনি জানার চেষ্টাও করেননি।’
আমার কথায় অপমানবোধ অনুভব করে লতা বললেন, ‘সাফিন বলেনি, তাই আর জানতেও চাইনি৷ প্রয়োজনীয় হলে নিশ্চয়ই বলতো।’
খানিক চুপ থাকার পরে বললাম, ‘তা ঠিক বলেছেন। তখন আমি সাফিনের কাছে অপ্রয়োজনীয়’ই ছিলাম।’
ভেতরে ভেতরে আমাকে লতা হিংসে করছে, সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ভেতরের খবর লুকাতে সবাই পারদর্শী হয় না। কেউ কেউ চাইলেও ভেতরের আমিকে লুকাতে পারে না৷
চোখেমুখে হিংসা নিয়ে লতা বললেন, ‘তখন আর এখনের মধ্যে কী কোনো পার্থক্য আছে?’
আমাকে ছোট করার জন্যই কথাটা লতা বলেছেন। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, ‘আমি তো ভেবেছিলাম, আমিই বোধহয় ব্যর্থ স্ত্রী ছিলাম তাই স্বামীর মনের খবর রাখতে সক্ষম হইনি। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে, আপনিও ব্যর্থ স্ত্রী।’
কথাটা গায়ে লাগলো লতার৷ প্রথম দেখাতেই আমাদের এমন কড়া আলাপ জমে উঠবে ভাবিনি কখনো। লতার চোখেমুখে জ্বলছে আগুন। সে আগুনে সাফিন পানি না ঢাললে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে দু’জনেই।
বাচ্চাদের নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলাম। সাফিনের প্রতি বাচ্চাদের এত আগ্রহ আমাকে মাঝেমধ্যে বিরক্ত করে৷ তাই বলে বাচ্চাদের প্রতি চড়াও হতে পারি না। আমি ওদেরকে ভালোবাসি। ওরা কষ্ট পাক, মন খারাপ করুক, আমাকে ভুল ভাবুক এ আমি চাই না৷ আবার এত ছোট বয়সে আমি ওদের মাথায় আমার বিষাক্ত অতীতের সকল স্মৃতি চাপিয়েও দিতে পারব না৷ ওরা বড় হলে একদিন ওরা সবটা জানতে পারবে। তখন নিশ্চয়ই ওরা আমাকে বুঝতে পারবে আরও ভালো করে।
সকালে স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। স্কুলের গেটের সামনে পৌঁছাতেই দেখি গতকালের ভদ্রলোক তার মিষ্টি দেখতে মেয়ে এশাকে সাথে নিয়ে স্কুলে প্রবেশ করছেন। রিকশা থেকে নেমে ‘এশা’ বলে ডাক দিতেই ভদ্রলোক আর তার আদুরে মেয়েটা পেছন ঘুরে তাকায়৷
‘আপনি এখানে?’
ভদ্রলোকের করা প্রশ্নের জবাবে বললাম, ‘আমারও তো একই প্রশ্ন, আপনারা এখানে?’
ভদ্রলোক হেসে উঠে বললেন, ‘মেয়েকে ভর্তি করাতে এসেছিলাম। আর আপনি?’
‘তাহলে আমি আপনার মেয়ের হবু শিক্ষিকা।’
‘আচ্ছা। আপনি তাহলে এখানকার শিক্ষিকা।’
‘জ্বী, হ্যাঁ।’
‘খুব উপকার হলো গতকালই পরিচয়টা হয়ে৷ দুশ্চিন্তায় ছিলাম মেয়েটা এখানে মানিয়ে নিতে পারবে কী না! যেহেতু আপনাকে ও চেনে, তো এখন মনে হচ্ছে খুব বেশি সমস্যা হবে না।’
হেসে বললাম, ‘দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। চলুন ভেতরে যাই।’
এশাকে ভর্তির বিষয়ে সহযোগিতা করার সময় জানতে পারি ভদ্রলোকের নাম এহসান। মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এহসান সাহেব চলে গেলেন। আজ এশার প্রথম ক্লাস এখানে। আমাকে পেয়ে এশা সাহস পাচ্ছে, এটা দেখে বেশ ভালো লাগছে।
ছুটি শেষে বের হয়ে দেখি এহসান সাহেব মেয়ের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। এশাকে আমার সঙ্গে বের হতে দেখে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি৷ এশা মামুনির থেকে বিদায় নিয়ে চললাম বাসার দিকে। এতক্ষণে হয়তো মায়ের সঙ্গে মিরাণ মেহরিমাও বাসায় চলে গিয়েছে।
রিকশা থেকে বাসার সামনে নামতেই দেখি সাফিন দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখামাত্র আমার শীতল মেজাজটা উত্তপ্ত হতে শুরু করলো।
কাছে গিয়ে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে কেন আপনি? কী করছেন এখানে?’
সাফিন নরম গলায় বললো, ‘তোমার সঙ্গে আমার কথা ছিলো জুলিয়া।’
‘আপনার এই যখন তখন কথা বলার প্রয়োজনীয়তাকে বন্ধ করুন। আপনার সঙ্গে কথা বলার মতো কোনো সম্পর্ক আমার নেই এই কথাটা কেন মাথায় থাকে না আপনার?’
‘আমার বাচ্চারা তোমার কাছে। সুতরাং কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে।’
চটে গিয়ে বললাম, ‘আমার বাচ্চা, এই কথাটা বলতে আপনার লজ্জা করা উচিৎ।’
‘জুলিয়া তুমি না চাইলেই কিন্তু আমাদের কোনো না কোনোভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে। আর বাচ্চারা আমাকে যথেষ্ট পছন্দ করে। তুমি কী আজীবন ওদের কাছ থেকে আমাকে দূরে রাখতে পারবে?’
‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাব।’
‘তবুও ওরা একদিন অবশ্যই ওদের বাবার সম্পর্কে জানতে পারবে।’
বিদ্রুপের স্বরে বললাম, ‘সেদিন অবশ্যই ওরা ওদের বাবাকে ভীষণ ঘৃণা করবে।’
সাফিন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি কোনো কথা না বলে বাসার ভেতরে চলে গেলাম।
এশার কাছে আমি দিনে দিনে প্রিয় শিক্ষিকা হয়ে উঠতে শুরু করি। এহসান সাহেবের সঙ্গে এখন থেকে রোজ দেখা হয়। শিক্ষার্থীর অভিভাবক হিসেবে তিনি আমার ফোন নাম্বারটা সংগ্রহ করলেন। মেয়ের বিষয়ে জরুরি প্রয়োজনে তিনি কল করেন।
স্কুল শেষে বের হতে আজ একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে৷ ব্যাগটা হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বের হয়ে দেখি এশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা আসেনি এখনো?’
মন খারাপ করে বললো, ‘না।’
আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, ‘মন খারাপ করো না। এখনই চলে আসবে বাবা।’
এরমধ্যে তাকিয়ে দেখি গাড়ি নিয়ে হাজির এহসান সাহেব৷
‘আমি দুঃখিত। আজ অফিস থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ বোধহয় আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো!’
‘না, আজ আমিও দেরি করেই বের হয়েছি।’
আশেপাশে একটা রিকশারও ছবি চোখে পড়ছে না। বাসায় আজ নায়লার আসার কথা। বোনটার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হবে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার ইচ্ছে থাকলেও উপায় হিসেবে রিকশার দেখা মিলছে না৷
এহসান সাহেব পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বললেন, ‘আপনি কিছু মনে না করলে আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারি। যেহেতু রাস্তায় কোনো রিকশা দেখছি না৷ একা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন!’
এশাও বায়না ধরলো তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। উঠে পড়লাম গাড়িতে। এশা আর এহসান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাসার সামনে পৌঁছে গেলাম। গাড়ি থেকে নেমে দেখি নায়লাও মুহিতের গাড়ি থেকে নামছে। ভদ্রতা সরূপ এশাকে নিয়ে এহসান সাহেবকে বাসায় আসার দাওয়াত দিলে, পরে আসবেন বলে তিনি জানান।
নায়লাকে নামিয়ে দিয়ে মুহিত চলে গেলো। আমি আর নায়লা কথা বলতে বলতে বাসার দিকে হেঁটে চলছি।
‘ভদ্রলোকটা কে রে আপা?’
‘ছাত্রীর বাবা। তাছাড়া পূর্বপরিচিত ছিলো। রিকশা পাচ্ছিলাম না বলে সহযোগিতা করলো।’
‘দেখতে তো সুদর্শন। মানুষটা কীরকম?’
‘একজন বাবা হিসেবে তিনি চমৎকার একজন মানুষ। বাকিটা জানি না।’
‘কী করেন তিনি?’
‘সরকারি কর্মকর্তা। এই শহরে নতুন।’
নায়লা হেসে বললো, ‘আমি বেসরকারি কর্মকর্তাকে বিয়ে করে ভালোই করেছি আপা। কোনো বদলির দুশ্চিন্তা নেই। যখন মন চায় তোদের সঙ্গে দেখা করতে চলে আসতে পারি।’
আমি হাসলাম।
বাসায় ঢুকতেই ফোনকল বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি এহসান সাহেবের কল।
গল্প: আগামী (৫ম পর্ব)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
‘আপনার ছাতাটা গাড়িতে রেখে গিয়েছেন৷’
আমি হেসে বললাম, ‘সমস্যা নেই। আগামীকাল ওটা এশার কাছে পাঠিয়ে দিবেন।’
এহসান সাহেব কলটা কেটে দিলেন।
আগামীকাল বাবা দিবস। বাবার উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে, সেই চিঠি নিয়ে যেতে বলেছেন, বাচ্চাদের স্কুলের শিক্ষক।
বাচ্চারা মন খারাপ করে আমার কাছে এসে বললো, ‘মা, আমাদের বাবা তো আমাদের সঙ্গে থাকে না। আমরা তাকে নিয়ে কিভাবে চিঠি লিখব তাহলে?’
বাচ্চাদের মন খরাপ করতে দেখে বললাম, ‘তোমাদের বাবা তোমাদের সঙ্গে থাকলে কী কী করতেন, তোমরা কী করতে, বাবাকে কী কী বলার আছে তোমরা বরং সেটাই লিখে ফেলো।’
বাচ্চারা আমার পরামর্শে খুশি হয়ে লিখতে বসে যায়। আমি চুপচাপ বারান্দায় বসে আছি। নায়লা মায়ের সঙ্গে পাশের ঘরে গল্প করে চলছে।
রাতে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়লে আমি ওদের খাতাটা বের করে দেখি ওরা বাবা সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছে৷ বাবার কাছে ওদের চাওয়া পাওয়া, বাবার প্রতি ওদের ভালোবাসার অনুভূতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে লেখায়।
নায়লা এসে পাশে দাঁড়ায়। মিরাণের খাতাটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে।
প্রিয় বাবা,
তুমি তো আমাদের সঙ্গে থাকো না। তুমি কেন আমাদের সঙ্গে থাকো না? থাকলে কত ভালো হতো! পাশের বাড়ির তুর্যের মতো তোমাকে রোজ চকলেট কিনে দিতে বলতাম না, আমাদের ক্লাসের জিসান আর রোহানের মতো আমি তোমার ফোনটাতে গেম খেলে নষ্ট করে ফেলতাম না, তুমি নিষেধ করলে সেই কাজ আর কখনো করতাম না৷ সবার বাবা সবার সঙ্গে থাকে। তুমি কেন আমাদের সঙ্গে থাকো না বাবা? রোহান বলে, তোদের বাবা তোদেরকে ভালোবাসে না তাই তোদের সঙ্গেও থাকে না। তাহলে ওর কথা কী ঠিক বাবা?
খাতাটা রেখে নায়লা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘দেখেছিস আপা, বাবাকে বাচ্চারা কতটা মিস করে। ওদের আসলেই বাবার প্রয়োজন।’
‘আমিই ওদের বাবা।’
‘ওটা মুখে বলা যায় আপা। কিন্তু বাবার সব দায়িত্ব মা হয়ে পালন করা যায় না।’
রেগে বললাম, ‘তো এখন কী তাহলে বাচ্চাদেরকে ওদের ওই দায়িত্বহীন বাবার কাছে পাঠিয়ে দিব?’
‘অবশ্যই না আপা। আমি চাই তুই আবার একবার নতুন করে ভাবতে শুরু কর।’
‘এত বছর যখন কাউকে প্রয়োজন পড়েনি, আগামীতেও পড়বে না।’
নায়লা চুপ করে চলে গেলো। আমি বাচ্চাদের পাশে শুয়ে পড়লাম। আমি আমার বাচ্চাদের জন্য আসলেই কী যথেষ্ট না? প্রশ্নটা ঘুরতে থাকে মস্তিষ্কের ভেতর। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমে তলিয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।
স্কুলে গেলে এশা দৌঁড়ে এসে ছাতাটা হাতে দিলো। মেয়েটার চোখমুখ জুড়ে মায়ার ছড়াছড়ি। ওর মুখের দিকে তাকালে, তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। যখন মেয়েটা খিলখিল করে হেসে ওঠে আমি তখন চুপ করে তাকিয়ে দেখি।
স্কুল থেকে বের হয়ে দেখি এহসান সাহেব আর এশা দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে একগাল হেসে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, ‘আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম।’
‘কেন?’
‘আজ এশার জন্মদিন। এশা চাচ্ছিলো আপনি মিরাণ আর মেহরিমাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়ি আসুন৷ আপনারা এলে আমরা খুব বেশি খুশি হতাম।’
আমি এশার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, ‘আজ এই মিষ্টি মেয়েটার জন্মদিন। আমাকে তো একবারও বললো না মেয়েটা।’
এশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমি বললাম, ‘শুভ জন্মদিন মামুনি।’
‘তুমি কিন্তু আসবে মিরাণ ভাইয়া আর মেহরিমা আপুকে নিয়ে। না এলে আমি খুব কষ্ট পাবো।’
মেয়েটার গাল ফুলিয়ে বলা কথা শুনে হেসে উঠলাম।
‘তুমি কষ্ট পাও সেই কাজ কী আমি করতে পারি! অবশ্যই যাব।’
‘সন্ধ্যায় দেখা হচ্ছে তাহলে।’ এহসান সাহেব কথাটা বলে চলে গেলেন।
আমি জন্মদিনে কী উপহার দেওয়া যায় সেটাই ভেবে চলছি।
এশা একবার আমায় বলেছিলো ওর লাল রঙ খুব পছন্দ। শপিংমল থেকে এশার জন্য লাল টুকটুকে একটা ফ্রক কিনলাম। সেই সাথে মিরাণ মেহরিমার জন্যও নতুন পোশাক কিনে নিলাম। এশার পোশাক দেখে ওদের মন খারাপ হোক এটা আমি চাইব না।
সন্ধ্যায় হাজির হলাম এহসান সাহেবের বাসায়। আমরা ছাড়াও এখানে বেশ অতিথি রয়েছেন৷ আমাদেরকে দেখতেই এশা ছুটে এলো। মেয়েটা আমাকে খুব পছন্দ করে, এই কারণেই বোধহয় মেয়েটার প্রতি আমার রোজ আরও বেশি মায়া জন্ম নেয়।
এহসান সাহেবের বাড়িটা ঘুরে দেখলাম। স্ত্রীকে তিনি এখনো খুব ভালোবাসেন বোঝা যাচ্ছে। দেয়ালে তাদের দু’জনের ছবি ঝুলছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি। পাশে এসে দাঁড়ায় এহসান সাহেব।
‘এই ছবিটা আমাদের বিয়ের প্রথম বছরে তোলা। মনে হয় এই তো সেদিন। কিন্তু কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। তারপরেও মানুষটা একইরকম ভাবে বিস্তার করছে আমার ভেতর।’
স্ত্রীর প্রতি এহসান সাহেবের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করলেও একটা দীর্ঘশ্বাস জাগিয়ে দিয়েছে ভেতরে। আমাকেও যদি এতটা ভালোবাসতো সাফিন! তাহলে আজ আমাদের সন্তানেরাও তাদের বাবার সঙ্গে থাকতে পারতো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকিয়ে দেখি এশা আমার দেওয়া লাল টুকটুকে জামাটা পড়ে মিরাণ আর মেহরিমার সঙ্গে ছুটে বেড়াচ্ছে। মেয়েটাকে পরীর মতো লাগছে দেখতে।
অনুষ্ঠান শেষ হলে এহসান সাহেব আমাদেরকে বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে বাচ্চারা তাকে ভীষণ পছন্দ করতে শুরু করেছে। এহসান সাহেব আর এশাকে আমাদের বাসায় আসার জোরালো নিমন্ত্রণ দিয়ে এসেছে বাচ্চারা। আমিও সুর মেলালাল ওদের সঙ্গে। উপেক্ষা করতে পারলেন না আর তিনি। আগামী শুক্রবার আসবেন বলে নিশ্চিত করলেন এহসান সাহেব।
রাতে মুঠোফোনে অচেনা নাম্বার থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো, ‘আমি সাফিন বলছি।’
ক্লান্ত শরীরটা এবার বিরক্তিতে ছেয়ে গেলো।
‘কেন ফোন দিয়েছেন?’
‘বাচ্চাদের খবর জানতে।’
‘ওরা ভালো আছে।’
‘আমি কী আগামীকাল ওদের সঙ্গে একবার দেখা করতে পারি?’
‘অবশ্যই না।’
ফোনটা কেটে দিয়ে চুপ করে শুয়ে পড়লাম। এই মানুষটা দিনে দিনে আরও বেশি অসহ্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে।
দুপুরে খাওয়ার টেবিলে মা সাফিনকে নিয়ে কথা তুললেন। বাচ্চারা নায়লার বাসায়। এই সুযোগটাই মা কাজে লাগাতে চাচ্ছেন বুঝতে কষ্ট হলো না।
‘হঠাৎ সাফিনের কথাই বা কেন তুললে?’
‘গতকাল বিকেলে হাঁটতে বের হয়েছিলাম তখন ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো।’
‘তো?’
‘আমি ওকে বলেছি আমার নাতি নাতনির প্রতি ওর উতলে ওঠা দরদের পরিমাণটা কমাতে। আরও বলেছি ……..’
কথাটা শেষ না করে মা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘আরও কী বলেছো?’
মা আমতা আমতা করে বললেন, ‘বলেছি আমি তোর জন্য পাত্র ঠিক করেছি, তোকে আমরা বিয়ে দিব।’
হাতে থাকা ভাতের লোকমাটা প্লেটে রেখে বললাম, ‘এসব কেন বলতে গেলে মা?’
‘যাতে ও তোর আশা ছেড়ে দেয়।’
‘সাফিন আমার আশা এমনিতেও করে না মা৷ কারণ ও ভালো করে জানে আমাকে আর ও কোনোদিন ফিরে পাবে না। কিন্তু তুমি এসব বলতে গেলে কেন!’
‘বলব না তো কী করব! আমি তো তোকে বিয়ে দিতেই চাই। শুধু তুই রাজি হোস না। কম পাত্র দেখেছি বল! এভাবে জীবন পার করা যায়? বাচ্চাদেরও তো বাবার সঙ্গের প্রয়োজন হয়। ওদের জন্য হলেও তোর বিয়ে করা উচিৎ।’
খাবার প্লেটটা সরিয়ে রেখে আমি উঠে পড়লাম। ইদানীং সবাই আমার বিয়ে নিয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ছে। এসবের কারণ ওই সাফিন। ওর এই হঠাৎ আগমন সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে।
বাসায় আজ রান্নার আয়োজন অনেক৷ সন্ধ্যায় এহসান সাহেব আর এশা আসবে। মা তো খুব উৎসুক হয়ে আছে এহসান সাহেবকে দেখার জন্য।
মায়ের এত আগ্রহ দেখে মনে সন্দেহ তৈরি হলে মা’কে সাবধান করতে বললাম, ‘খবরদার মা, এমন কোনো কথা বলো না যাতে আমি ছোট হয়ে যাই। উনি তার স্ত্রীকে এখনো খুব ভালোবাসেন কথাটা মাথায় রেখো কিন্তু।’
মা আমার কথাটা অতটা গুরুত্বের সঙ্গে ভেবেছে বলে মনে হলো না। নায়লা রান্নাঘরে খাবারগুলো চেক করছে৷ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলে দেখি মুহিত চলে এসেছে।
আমরা সবাই একসঙ্গে খেতে বসেছি। এহসানকে পেয়ে বাচ্চারা খুব খুশি। মা বারবার এহসান সাহেবকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নানান প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করে চলছেন। খেতে খেতে মুহিত আর নায়লার সঙ্গে এহসান সাহেবের আলাপটাও বেশ জমে উঠেছে৷
‘ছেলেটা খুব ভালো।’
মায়ের হাসিমুখের নিচে লুকিয়ে থাকা আসল উদ্দেশ্যের কথা টের পেয়ে বললাম, ‘বিয়ের আগে সাফিনকেও কিন্তু তোমার খুব ভালো ছেলে বলেই মনে হয়েছিলো।’
মায়ের হাসিমুখটা নিমিষেই চুপসে গেলো। মুখ গোমড়া করে রাগান্বিত গলায় বললেন, ‘সব সময় কী আর মানুষ চিনতে ভুল হয় নাকি।’
মায়ের কথায় সুর মেলাতে লেগে পড়লো নায়লা। এহসান সাহেবকে নিয়ে এবার কথা উঠতে থাকলো একের পর এক। আমি চাইলেও সে আলাপ বন্ধ করতে সক্ষম হলাম না।
ব্যালকনিতে বসে আছি৷ নায়লা এসে বসলো পাশে৷
ক্ষোভ নিয়ে বললো, ‘আপা ওই সাফিন নামের মানুষটা এত অন্যায় করার পরেও কেন কোনো শাস্তি পাচ্ছেন না বুঝি না৷ সেদিন রাস্তায় দেখা হয়েছিলো। দেখে তো মনে হলো ভালোই আছে।’
আমি বললাম, ‘মুখে হাসি দেখলেই সে ভালো আছে, এমনটা ভাবা ঠিক না। আর কেউ না জানুক আমি জানি সাফিন ভেতরে ভেতরে কতটা যন্ত্রণায় ভুগছে। সন্তানদেরকে ও খুব ভালোবাসে কিন্তু সন্তানদেরকে সে কথা বলতে না পারার, নিজেকে প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা ওকে ভেতরে ভেতরে কুড়ে কুড়ে খায়।’
‘সে যদি বাচ্চাদেরকে সবটা বলে দেয় তখন?’
নায়লার আতঙ্কিত স্বরে করা প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘সে সাহস নেই সাফিনের। থাকলে এতদিন চুপ করে থাকতো না৷ ওর অপরাধবোধ ওকে তাড়া করে বেড়ায় ভেতরে। নিজেকে মেলে ধরবে কোন সাহসে!’
নায়লা চুপ করে রইলো। প্রসঙ্গ বদলে আমি অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে কথা তুললাম।
বাচ্চাদের নিয়ে অনেক দিন বাদে আবার ঘুরতে বের হয়েছি। নদীর পাড়ে গিয়ে বসতেই সাফিনের সঙ্গে দেখা। আমি বুঝি না এই মানুষটার সঙ্গে আচমকা এভাবে দেখা হয়ে যায় কী করে! যাকে সবসময় দূরে রাখতে চাই সে কেন বারবার সামনে চলে আসে এভাবে!
সাফিনের সঙ্গে আলাপ শেষে বাচ্চারা খেলতে শুরু করলো। সাফিন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, ‘তুমি না চাইলেও আমাদের দেখা ঠিক হয়ে যায় জুলিয়া।’
আমি হেসে উঠলাম।
তারপর বিদ্রুপের স্বরে বললাম, ‘এই দেখা হয়ে যাওয়াটাই তো আপনার জন্য শাস্তি সাফিন। আপনার চোখের সামনে আপনারই বাচ্চারা আপনাকে আঙ্কেল বলে ডাক পাড়ে, আপনি আপনার বাচ্চাদেরকে কাছে পেয়েও বাবার আদরটা দিতে পারেন না, ওদের কাছে নিজেকে বাবা হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। এর থেকে বড় শাস্তি আর কী হয়?’
সাফিন চুপ করে রইলো। আমি আবার বলতে শুরু করলাম, ‘যত দেখা হয় তত আপনার মায়া বাড়ে আর ততই আপনি ভেতরে ভেতরে ছটফট করতে থাকেন অনুতাপে। বাচ্চাদের সঙ্গে কোনোদিন দেখা না হলে তো আপনি এই মানসিক অশান্তিটা পেতেন না সাফিন।’
সাফিন অপরাধীর মতো বললো, ‘আমি কেবল ভুলগুলো শুধতে নিতে চাই৷’
‘আপনি সব হারিয়ে এখন সব ফিরে পাওয়ার বৃথা স্বপ্ন দেখছেন। আপনি এখন চাইলেও সব ঠিক করে নিতে পারবেন না কারণ সেই উপায় আপনি রাখেননি।’
সাফিন চুপ করে রইলো। বাচ্চাদের নিয়ে আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। বাচ্চারা এই নদীর পাড়টাকে খুব পছন্দ করে৷
চারদিকে বাতাস বইছে। মনের মধ্যের সব ক্ষোভ চাপা দিতে চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে চোখ মেলে পাশে তাকাতেই দেখি এহসান সাহেব।
গল্প: আগামী (শেষ পর্ব)
লেখা: মাহফুজা রহমান অমি।
‘দেখা হয়ে গেলো আপনাদের সঙ্গে এখানেও।’
এহসান সাহেবের কথা শুনে হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ। তাই তো দেখছি।’
‘এশা কিন্তু বাসায় আপনার কথা খুব বলে। সারাদিন আমাকে নিয়ে ওর যতটা না কথা থাকে তারথেকে বেশি কথা থাকে আপনাকে নিয়ে।’
হেসে উঠলাম।
‘তাহলে তো বলতে হবে শিক্ষক হিসেবে আমি সফল।’
‘তা তো অবশ্যই।’
‘এখানে রোজ আসা হয় নাকি?’
‘রোজ সময় করতে পারি না। প্রায়ই আসা হয় আরকি।’
এশার সাইকেলটা নিয়ে মিরাণ চালানোর চেষ্টা করতেই ধপ করে পড়ে গেলো। এহসান সাহেব দৌঁড়ে গিয়ে ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে শুরু করলেন। আমি চুপ করে এই দৃশ্যটা দেখতে লাগলাম। এহসান সাহেবের জায়গায় আজ ওদের বাবা হলেও এই একই কাজ করতো। এখন আমিও দিনে দিনে একটু একটু করে বাচ্চাদের পাশে ওদের বাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করি। মাঝেমধ্যে যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখন মনে হয় একজন কেউ থাকলে বোধহয় ভালোই হত।
‘সাইকেল চালাতে শিখতে চাও?’
এহসান সাহেবের কথায় মিরাণ আর মেহরিমা মাথা নেড়ে বললো, ‘হুম।’
‘আচ্ছা আমি এখন থেকে তোমাদের তিনজনকেই একসঙ্গে সাইকেল চালানো শিখাবো৷’
বাচ্চারা খুশি হয়ে বললো, ‘সত্যি?’
‘সত্যি।’
‘কিন্তু মা তো আমাদের সাইকেল কিনে দেয়নি।’
আমি কিছু বলার আগেই এহসান সাহেব বললেন, ‘তাতে সমস্যা নেই৷ একটা সাইকেল তো আছেই। আগে এটা থেকে চালানো শিখে ফেলো এরপর মা অবশ্যই সাইকেল কিনে দিবেন।’
তারপর এহসান সাহেবের পরামর্শ অনুযায়ী প্রায়ই নদীর পাড়ে বাচ্চাদের নিয়ে আসতে শুরু করলাম। বাচ্চারা এহসান সাহেবের কাছে সাইকেল চালানো শিখতে শুরু করেছে।
দিন যাচ্ছে দিনের মতো। এহসান সাহেবের সঙ্গে বাচ্চাদের ঘনিষ্ঠতাও দিনকে দিন বেড়ে চলছে। ওরা যেন এহসান সাহেবের সঙ্গ পেলে বাবার অপূর্ণতা ভুলে যায়। এহসান সাহেবও খুব সুন্দরভাবে বাচ্চাদের সামলে নিতে পারেন। আমাকে এই বন্ধনটা ইদানীং খুব ভাবিয়ে তুলছে।
এহসান সাহেবের সঙ্গ আমারও দিনে দিনে প্রিয় হয়ে উঠেছে। মেহরিমা, মিরাণ আর এশাকে নিয়ে আমার আর এহসান সাহেবের কাটানো মুহুর্তগুলো প্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে ভেতরে।
বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ এহসান সাহেব। এশাকে রোজ স্কুলে নিয়ে আসা আর নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা আমিই নিলাম। মা মাঝেমধ্যে এটা ওটা রান্না করে এহসান সাহেবের জন্য আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। মায়ের এমন আতিথেয়তায় ভীষণ খুশি তিনি। এই শহরে তার আপন বলতে আমাদের পরিবার। এই কথাটা এবার তিনি প্রতিমুহূর্তে আমাকে মনে করিয়ে দিতে লাগলেন।
‘আপনি অনেক করেছেন আমার জন্য। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা এভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয় যদিও। তারপরেও অনেক ধন্যবাদ।’
আমি হেসে বললাম, ‘আপনি আমাদের পরিচিত। এতদিন ধরে আমাদের পরিবারের সঙ্গে আপনার চেনা জানা। এতটুকু তো করতেই পারি।’
এহসান সাহেব চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, ‘সবথেকে বড় কথা এতদিনে আপনি আমার একজন ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছেন৷’
বন্ধু শব্দটা শুনে এহসান সাহেব খুশি হয়ে বললেন, ‘যাক এতদিন বাদে আমাদের এই সম্পর্কের একটা নাম দাঁড়ালো তবে।’
হেসে উঠলাম আমি৷
সাফিনের করা হুটহাট ফোনকলগুলো আমাকে বারবার বিষাক্ত অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তার দ্বিতীয় স্ত্রী লতাও আমাকে বেশ কল করতে শুরু করেন। তার ধারণা আমিই তার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে চলছি আগের সব ফিরে পেতে।
‘আমাকে বারবার কল না দিয়ে আপনি বরং আপনার স্বামীকে বোঝান যে সে যা চাচ্ছে তা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কখনো সম্ভব নয়। তাকে বলেন যে আমার বাচ্চার বাবা হিসেবে তাকে কখনো আমি বাচ্চাদের সামনে নিয়ে আসব না।’
লতা ওপাশ থেকে বললেন, ‘আপনি আশকারা দেন বলেই সে আপনার কাছে ছুটে যায়।’
‘আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে লতা। আপনি আমাকে এখনো চিনতে পারেননি। চিনলে এ কথা বলতে পারতেন না। আমি কোনো সস্তা রমণী নই যে কোনো বিবাহিত পুরুষ এসে বললেই গলে পড়ব।’
বেশ অপমানিত হয়ে ফোনটা কেটে দিলেন লতা। কেনাকাটার উদ্দেশ্যে আমি বেড়িয়ে পড়লাম।
শপিংমলে আবার দেখা সাফিনের সঙ্গে।
‘জুলিয়া আমাকে তুমি ঘৃণা করা কবে বন্ধ করবে? পুরাতন সব ভালোবাসার কথাই তুমি এভাবে ভুলে গেলে?’
‘দুধের মধ্যে বিষ ঢেলেছিলেন আপনি। ছোট্ট ময়লা ফেলেননি যে ওটা আঙ্গুল দিয়ে তুলে ফেলে দুধটা খেয়ে ফেলব।’
‘আমাকে প্রয়োজনে আদালতের কাট গোড়ায় দাঁড় করাও। তবুও বাচ্চাদের থেকে এভাবে দূরে সরিয়ে দিও না।’
‘আপনি আপনার বিবেকের কাট গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন। আপনাকে আর আদালতের কাট গোড়ায় দাঁড় করাতে হবে না৷ বিবেকের থেকে বড় আদালত আর কিচ্ছু হতে পারে না।’
‘আমাকে এভাবে আর ফিরিয়ে দিও না।’
‘লতার বাচ্চাটা বেঁচে থাকলে আপনি আর জুলিয়ার কাছে আসতেন না৷ তাই না? আপনার শাস্তি আপনাকে আজীবন ভোগ করে যেতে হবে।’
সাফিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। যন্ত্রণায় ছটফট করা সাফিনের চুপসে যাওয়া মুখটা দেখতে আমার ভালোই লাগছে।
এহসান এসেছে বাসায়৷ পাশের রুমে বাচ্চারা টিভিতে শব্দ বাড়িয়ে কার্টুন দেখছে। মা এহসানের সঙ্গে তার আত্মীয় স্বজনদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছেন। নায়লা বাচ্চাদেরকে নাস্তা দিয়ে এহসানের জন্য কফির মগ নিয়ে এলো।
মা চলে গেলে আমি এহসান আর নায়লা বসে রইলাম।
নায়লা এহসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি এহসান ভাই?’
কফির মগে চুমুক দিয়ে এহসান সাহেব বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো নায়লা।’
‘আপনি কী আমার আপাকে বিয়ে করবেন?’
নায়লার এমন হঠাৎ প্রশ্নে আমি থ হয়ে গেলাম। এহসান সাহেব কফির মগে চুমুক দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। আমি নায়লার দিকে ধমকের চোখে তাকিয়ে রইলাম।
নায়লা এ সবকিছু উপেক্ষা করে বললো, ‘আপা তোর পাশে আসলেই একজনকে খুব দরকার। যে তোকে আর বাচ্চাদেরকে ভালোবাসা দিয়ে আপনের মতো আগলে রাখবে, সব দায়িত্ব পালন করবে। বাচ্চারাও যাকে ভালোবাসতে পারবে৷ আর এহসান ভাইকে তো বাচ্চারা খুব পছন্দ করে, তোদের দু’জনের সঙ্গেও বন্ধুত্ব আছে। তাহলে সমস্যা কী?’
‘তুই থামবি নায়লা।’ ধমকের স্বরে বললাম আমি।
এহসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে দুঃখিত গলায় বললাম, ‘আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না।’
নায়লা এসব কথা পাত্তা না দিয়ে বললো, ‘ভুল কিছু বলিনি তো আমি। এশারও তো একজন মায়ের প্রয়োজন। মেয়েটা তোকে কতটা ভালোবাসে। আর এহসান ভাইয়ের পাশেও একজন দরকার। এভাবে একা একা হতাশা নিয়ে জীবন পার করার কোনো মানে হয়! যেখানে চাইলেই সুখে থাকার অপশন রয়েছে।’
আমরা চুপ করে রইলাম। নায়লা কথা থামাচ্ছে না। বলেই যাচ্ছে। আজ যেন ও পরিকল্পনা করেই এখানে বসেছে এসব বলবে বলে।
‘বাচ্চারা তাদের বাবা মায়ের অপূর্ণতা অনুভব করে এটা স্বীকার না করে পারবি তোরা আপা? ওদের জন্য এবং তোদের নিজেদের জন্য আমার মনে হয় তোরা এই বিষয়টা নিয়ে এবার ভাবতে পারিস৷’
এহসান সাহেব কোনো কথা না বলে চুপচাপ এশাকে নিয়ে চলে গেলেন। আমিও চুপ হয়ে বসে রইলাম। এই মুহুর্তে নায়লার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। হঠাৎই সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। যেন সব স্তব্ধ হয়ে আছে।
বাচ্চারা এহসান আর এশাকে খুব মিস করছে। অনেকদিন এহসান সাহেবের সঙ্গে কথা বা দেখা হয় না৷ এশাও আর বাড়িতে আসে না। সেদিনের পর আমি কিংবা এহসান কেউ আর যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। এশাকে প্রতিদিন ড্রাইভার এসে স্কুলে দিয়ে যায় আবার নিয়ে যায়। অনেকবার ভেবেছি মেয়েটাকে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করব, কিন্তু কোথাও গিয়ে যেন আটকে যাই। জিজ্ঞেস করা আর হয়ে ওঠে না।
লতা এবার নতুন সুর ধরেছেন। সাফিন তাকে পটিয়ে ফেলে নরম করতে সক্ষম হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে।
তার কথা, ‘বাচ্চারা তো আপনার একার নয়, সাফিন আর আপনার দু’জনের। আর বাচ্চাও তো একটা নয়, দুইটা। তাহলে একজনকে আপনি রাখেন আর বাকি জনকে আমাদেরকে দিয়ে দিন। সেক্ষেত্রে আপনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আপনি মিরাণ মেহরিমা যাকে পছন্দ রাখতে পারেন। আপনার বাছাই শেষে যে থাকবে তাকে আমরা নিয়ে আসব।’
আমি চটে গেলে তিনি বললেন, ‘চিন্তা করবেন না, বাচ্চাকে আমরা আপনার থেকে কোনো অংশে কমে বড় করব না। বরং আরও ভালোভাবে মানুষ করব।’
মহিলার কথা শুনে গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো৷
‘নিজের বাচ্চা হারানোর শোকে আপনি বাচ্চা আর মা এই দুইটা জিনিসের মর্মার্থ ভুলে গিয়েছেন। আপনার মাথা আসলেই খারাপ হয়ে গিয়েছে। তা না হলে এমন একটা প্রস্তাব আপনি আমাকে দেওয়ার সাহস করতেন না।’
‘আপনি চাইলেই কী বাচ্চা জোর করে রাখতে পারবেন?’
‘আমিও দেখতে চাই আপনারা কীভাবে আমার থেকে আমার বাচ্চাদের আলাদা করেন।’
লতার কথায় দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে বাসার সবাই। বাচ্চারা এখনো তাদের বাবার বিষয়ে কিছুই জানে না। আমি আমার একটা বাচ্চাকেও দূরে রাখতে পারব না৷ আমি ওদেরকে নিজের চাইতে বেশি ভালোবাসি।
বাচ্চাদেরকে এখন চোখের আড়াল করতেই ভয় হয়। ওদেরকে সারাদিন চোখে চোখে রাখতে পারলেই যেন স্বস্তি পাই। দুইজনের কাউকে আমি কম ভালোবাসি না। দু’জনকেই সমান ভালোবাসি। কেউ কারো থেকে কম নয় আমার কাছে।
মা বারবার বলছেন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে। আমার হাতটা শক্ত করে কেউ ধরে রাখলে দুশ্চিন্তা থেকে কিছুটা মুক্তি মিলবে বলে নায়লার ধারনা। বেশ কয়েকটা বিয়ের প্রস্তাবও মা আর নায়লা মিলে জোগাড় করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। এহসানকে খুব মনে পড়ছে৷ তিনি আমার সব বিষয়ে জানতেন৷ আমাকে সবসময় নানান পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতেন। তার বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ আমার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটাতে সক্ষম হতো। কিন্তু আজ সে পাশে নেই। তাকে ফিরিয়ে আনাও সম্ভব নয়। নিজের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করতে আমি পারব না।
তবুও এশার কাছে তার বাবার কথা জানতে চাইলাম। এশা বললো তার বাবা নাকি অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকে। আমি আর কিছু বললাম না৷ নায়লার সেদিনের কথায় তিনি নিশ্চয়ই খুব রাগ করেছেন। নায়লাটা যে ওভাবে বলে বসবে, এটা জানলে আমি সেদিন এহসান সাহেবকে দাওয়াতই করতাম না।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই বাচ্চারা তাদের আঁকা কতগুলো ছবি আর লেখা চিঠি হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপর চিৎকার করে বললো, ‘মা দিবসের শুভেচ্ছা তোমাকে।’
এখন বুঝতে পারলাম যে আজ মা দিবস। গতকাল স্কুলে যাইনি তাই আজকের দিবস সম্পর্কেও জানা হয়নি৷ বাচ্চাদেরকে কাছে ডেকে গালে চুমো খেলাম। ওরা আমাকে এতটা ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছে যে সব কঠিন পথ পাড়ি দিতেও সাহস পাই।
তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। স্কুলে পৌঁছাতেই দেখি এশা সেই লাল টুকটুক জামাটা গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতেই খিলখিল করে হেসে উঠে ছুটে এলো।
ওর হাসি আমার মুখেও হাসি এনে দিলো। মেয়েটা আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলো।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী আছে ভেতরে?’
‘খুলে দেখ।’
‘এখনই খুলব?’
মেয়েটা বললো, ‘হ্যাঁ।’
আমি খামটার ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করলাম। এশা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর সামনে বসেই চিরকুটটা পড়তে শুরু করি।
‘শুভ মা দিবস। তোমাকে মা দিবসের শুভেচ্ছা। তুমি কী আমার মা হবে?’
পড়েই থমকে গেলাম। এইটুকুন মেয়েটার মাথায় এসব কথা ঢুকিয়েছে কে বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এহসান সাহেব জানলে নিশ্চয়ই খুব অখুশি হবেন, এশার উপরে রেগেও যেতে পারেন।
তাড়াতাড়ি করে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার বাবা দেখেনি তো এটা তুমি লিখেছো?’
মেয়েটা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর হাতটা ধরে বললাম, ‘এই চিরকুটের কথা একদম বাবাকে বলো না। বাবা কিন্তু খুব রাগ করবে তবে।’
এশা খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
হাসি থামিয়ে ও বললো, ‘বাবা রাগ করবে কেন? বাবা’ই তো বলেছে এই চিঠিটা লিখে তোমাকে দিতে।’
এই মেয়েটা বলে কী! অবাক হয়ে হা হয়ে রইলাম আমি। এহসান সাহেব এটা দিতে বলবে! বিশ্বাসই হচ্ছে না।
আচমকা তাকিয়ে দেখি এহসান সাহেব এদিকেই আসছেন। মনে হচ্ছে আমার শরীরটা যেন শীতল হয়ে আসছে।
সময় যাচ্ছে আনন্দে আনন্দে। এশা, মিরাণ আর মেহরিমাকে নিয়ে আমি এবং এহসান এসেছি নদীর পাড়ে ঘুরতে। বাচ্চারা সাইকেল চালাতে শিখে গিয়েছে। তিনজনের এখন তিনটে সাইকেল।
আমরা হেঁটে চলছি ফুরফুরে শীতল বাতাস গায়ে মেখে। লতা এবং সাফিনের সঙ্গে দেখা হতেই বাচ্চারা দৌঁড়ে গেলো। আমি আর এহসান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
এহসানকে দেখিয়ে বাচ্চারা সাফিনকে বললো, ‘সাফিন আঙ্কেল ওই যে আমাদের বাবা।’
সাফিনের আনন্দিত মুখটাতে নিমিষেই অন্ধকার নেমে এলো।
বাচ্চারা আবার খেলতে শুরু করলো৷ আমি এগিয়ে গেলাম সাফিন আর লতার দিকে।
সাফিন আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।
‘আপনার বাচ্চারা আপনারই চোখের সামনে আপনাকে আঙ্কেল আর অন্য একটা মানুষকে বাবা বলে ডাকার দৃশ্যটা হজম করতে বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে! তাই না সাফিন?’
সাফিন চুপ করে রইলো৷ আমি চুপ হলাম না।
‘নিজের বাচ্চাদের মুখ থেকে কখনো বাবা ডাক শুনতে পারবেন না আপনি৷ যে অন্যায় করেছিলেন আমাদের সঙ্গে, এটাই তার উপযুক্ত শাস্তি। এই যন্ত্রণায় আজীবন আপনি ছটফট করবেন।’
লতা আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘অন্যের সন্তানকে জোর করে ছিনিয়ে এনে কখনো মা হওয়া যায় না৷ মা আলাদা একটা শব্দ। মা হওয়া এত সহজ না।’
লতা চুপ করে রইলেন।
পেছন থেকে এশা ডাক দেয়, ‘মা। আমি আইসক্রিম খাব। দেখ, বাবা কিনে দিচ্ছে না।’
আমি হাসিমুখে বাচ্চাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। এশাকে বললাম, ‘তোমার ঠান্ডা লেগেছে মামুনি। আইসক্রিম খাওয়া একদম ঠিক হবে না।’
মেয়েটার গোমড়া মুখটা দেখে হেসে বললাম, ‘বাসায় গিয়ে আমি তোমাদেরকে একটা দারুণ চকলেট কেকে বানিয়ে দিব। ঠিক আছে?’
এবার বেশ খুশি হয়ে উঠলো বাচ্চারা।
এহসান আমার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে৷ বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে।
আমি এহসানের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘একা লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তুমি পাশে সাহস আর শক্তি নিয়ে দাঁড়ালে। আমার জীবনটা আবার সুন্দর হয়ে উঠলো।’
এহসান আবেগময় চেহারায় তাকিয়ে বললো, ‘তুমি আমার অগাছালো জীবনটা গুছিয়ে দিয়েছো, আমার বাচ্চার মা হয়ে উঠেছো, তোমার ওই নিষ্পাপ বাচ্চা দু’টোর বাবা হওয়ার সুযোগ দিয়েছো। আমার জীবনের অপূর্ণতাগুলোকে তাড়িয়ে রঙহীন জীবনটাকে তুমি রঙিন করে তুলেছো জুলিয়া।’
‘বাকি জীবনটা আমরা একসঙ্গে বেশ সুখে কাটিয়ে দিব তাই না এহসান?’
‘অবশ্যই। আমি পেয়ে আর কিছু হারাতে চাই না। আমাকে এক বাচ্চা থেকে তিন বাচ্চার বাবা বানিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ তোমায়।’
হাসিমুখে বললাম, ‘আমাদের এখন তিনটে বাচ্চা। ওরা আমাদের সন্তান।’
এহসান হেসে বললো, ‘তিন বাচ্চার মা, আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
‘কতটা?’
‘বাসায় গিয়ে মেপে বলবো।’
হেসে উঠলাম আমি। হেসে উঠলো এহসানও।