লেখক:হৃদয় আহমেদ
পর্ব ২
তুখোড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বড়মা আমার দিকে। সাথে আব্বু। দূরে দাড়িয়ে সিয়াম ভাইয়া। তাদের দৃষ্টি অস্হির। চোখগুলো খুতিয়ে দেখছে আমায়। আগুন্তকঃ এর চিঠিটা শক্তিহীন হাতে খিচে নিলাম। শরীর নেতিয়ে গেছে। জোর পাচ্ছি না।চারপাশের এত মানুষ আমার ভয় বাড়িতে দ্বিগুন করে তুলছে। দূরে একপলক তাকালাম। না! আমার অদ্ভুত কান্ডের প্রভাব সিয়াম ভাইয়ার উপর পড়েনি। উনি নিজ মনে কিছু ভাবছেন। লেহেঙ্গার কুচিতে আড়াল করলাম চিঠিটা। মামীর কন্ঠে সন্দেহ,
‘ কে ছিলো মেয়েটা সিয়া? ‘
কেঁপে উঠে তাকালাম মামির দিকে। কড়া দৃষ্টি মামির। আমায় গিলে নেওয়ার সবটা শক্তি যেন সে দৃষ্টিতে আছে। খ্যাচ করে উঠলো বুকটা। চিঠিতে কি লেখা আছে এটা না জেনে আমি কিছুতেই এ চিঠি আতছাড়া করবো না। কাউ চাইলেও না! আমায় আর সিয়াম ভাইয়াকে বিদায় দেওয়ার জন্য বাড়ির বাইরে আনা হয়। সেখানেই আবিষ্কার এ চিঠির। বোরকা-নিকাব পরহিত কোন মহিলা চিঠি হাতে গুজে জোর পায়ে হেটে যায়। প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। কে এনি? আমায় কেনই বা হাতে চিঠি দিলো? আর মেয়েটি যে কাজে পটু নয়, তার দেওয়ার ভঙ্গিতেই বোঝা গেল। না হলে সবাই জানতো নাকি?
‘ তুই চিনিস? ‘
জোরপূর্বক হাসলাম আমি। তাচ্ছিল্য হেঁসে বললাম,
‘ আরে তোমরাও না? শুধু ধাক্কা লেগেছে। তেমন কিছুই না। ‘
প্রতিটা মানুষের মুখের সন্দেহ মুহুর্তে উবে গেলো আমার কথায়। কিন্তু আব্বুর কালো বড়বড় চক্ষদ্বয়ের দৃষ্টিতে সন্দেহ অনড়,অনল রইলো। ইকবাল হোসেন অরফে আমার বাবা। আজ আবারো হারলাম বাবার কাছে। উনি কি বুঝে গেলেন আমি মিথ্যে বললাম? সবাইকে মিথ্যে বোঝাতে পারলেও তাকে বোধহয় পারিনি। বিয়ে করবে না বলে কেঁদে চোখ ফোলানো মেয়েটা হঠাৎ হেঁসে কথা বলছে, সন্দেহ না হওয়ার কারন তো নেই!
‘ অনেক রাত হলো, সিয়াম..আয় এবার ফিরতে হবে তো? ‘ বললেন মামী। চিঠিটা হাত মুষ্টিমেয় বলের মতো করে খিচে নিলাম আমি। আব্বু শান্ত দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে এলেন। চোখ ছলছল করছে আব্বুর। একটু অপরাধবোধ সে চোখে। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
‘ সবটা বলবো! সবটা! সময় কখন কাকে কোন পথে আনবে বাধ্য করে কেউ জানে না সিয়া। আমি….’
কন্ঠ আঁটকে এলো। চোখে অথই পানি! চিকচিক করছে। না পারে জড়িয়ে নিলাম আব্বুকে। এইতো সেদিনই মানুষটা বলছিলো, তোকে অনেক পড়তে হবে! অনেক! একদিন তুই অনেক বড় হবি। তোকে কালো বলা লোকগুলো হিংসেয় জ্বলবে। আর আজ? মুহুর্তে সবটা ধসে পড়লো? আব্বুর চোখ বাঁধ মানলো না। তার দুফোঁটা গরম চোখের পানি ঠিকিই ঘারে পড়েছে বুঝতে পারলাম। হু হু করে কেঁদে উঠলাম। আব্বু শিতল স্পর্শে হাত রাখলেন মাথায়। শিতল কন্ঠে বললেন,
‘ ভালো থাকবি! বিশেষ করে সিয়াম,তার কথার অবাধ্য হয়েছিস এটা যেন কক্ষণো না শুনি সিয়া, মনে থাকবে? ‘
একদিনে একটা মানুষ কিভাবে নিজের রং পাল্টাতে পারে? কিভাবে এতটা কঠোর হতে পারে? এ পরিবর্তনের কারন কি? আমি গলা ছেড়ে কেঁদে উঠলাম। অভিমানে ছিটকে দূরে সরে গেলাম। এরপর ছুটে গিয়ে বসে পড়লাম গাড়িতে। বুকে হাত গুজে ঠোঁট ঠোঁট চেপে কেঁদে উঠলাম আমি। নিঃশব্দ আর্তনাত! বুক ছাড়খাড় করা কষ্ট! হৃৎপিণ্ডে কেউ যেন মরিচ লাগিয়ে দিয়েছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব! আব্বু হয়তো অপরাধবোধ অনুভব করছে! আর জলভর্তি আখিতে দেখছে আমায়! ভাবছে, সিয়া তাকে ভুল বুঝছে। তাকে ঘৃনা করছে। হয়তো ওনার কলিজা পুড়ছে দাউদাউ করে। কিন্তু বিশ্বাস করো বাবা, সিয়া পারছে না তোমায় ভুল বুঝতে। পারছে না! এই সিদ্ধান্তে পেছনে রহস্য অগণিত! ভয়ানক সেই রহস্য! কিন্তু কি?
_____
আকাশে থলের মতো চাঁদ। আলো কতটা স্নিগ্ধ, সুন্দর! পাতা নড়ে বাতাস বইছে হালকা। হাইওয়ের বড় সড়কে ছুটছে আমাদের গাড়িটা! আমি বাইরে তাকিয়ে। আশপাশে রাতের আধারে যতদূর চোখ যায় ততদূর জমি। ধান কাটা হয়েছে সবে। রাস্তার ধারের কলা, মোটা শালগাছ গুলোও যেন ছুটছে আমাদের সাথে। কি মনোরম দৃশ্য! কিন্তু এসবের কিছুই মন ছুতে পারছে না আমার। চুপ করে চোখের পানি ফেলছি। বাবা বলতো, তুই আমার সাত রাজার ধন। তোর চেহারার থেকে হাজার হাজার গুন তোর ভবিষ্যত উজ্জল! হঠাৎ কাঁদার মাঝেই ফিক করে হাসলাম আমি। শব্দ হলো একটু। এরপর দৃষ্টি বাইরে নিক্ষেপ করলাম। কান্না থামছে না! বাবার সাথে করা খারাপ আচরনটুকু পুড়িয়ে ঝাঁঝড়া করে দিচ্ছে আমায়।
কারো স্পর্শ পেতেই বাম হাতে পানি মুছে নিলাম আমি। না দেখেই বুঝলাম ওটা সিয়াম ভাইয়া। এ গাড়িতে উনি আর আমি ছাড়া কেউ নেই। তাকালাম না। বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম।
‘ সিয়া? ‘
কন্ঠ করুন শোনালো। ক্ষিন স্বরে বললাম, ‘ হুম ‘
‘ তোর কষ্ট হচ্ছে খুব তাইনা? ‘
এবার কন্ঠ খাদে ওনার। জোড়ে নিশ্বাস নিলাম। স্হির করলাম কড়া গলায় না বলবো। আমার বলার আগেই অদ্ভুত ভঙ্গিতে উনি বলে উঠলেন,
‘ তুই তোর আব্বুকে ভুল বুঝছিস? বুঝিস না! এতে ওনার দোষ নেই। ‘
ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, ‘ একবারও কি বলেছি আমি এ কথা? ‘
‘ না! মনে হলো। তাই! ‘
আর কথা হলো না। হাত সড়িয়ে নিলাম। এখন অপেক্ষা পরশুদিনের। সবটা সেদিনই জানা যাবে।
সা সা করে চলা গাড়িটা থেমে গেলো হঠাৎ। হকচকিয়ে উঠলাম। বাইরে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও বুঝতেই পারিনি কখন চলে এসেছি। যেন ঘোর কাটলো কেবল। সিয়াম ভাইয়া নেমে গেলেন গাড়ি থেকে। পরপর দুটো গাড়ি ঠিক পিছনে এসে দাড়ালো। সকলে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। চুপচাপ বসে আছি। কেউ দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো। একটু অবাক চোখে তাকালাম। শেরোয়ানির হাতা গুটাতে গুটাতে বাড়ানো হাতটা সিয়াম ভাইয়ার । মুখ ফিরিয়ে বললাম,
‘ একাই পারবো। ‘
কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন আমার দিকে সিয়াম ভাইয়া। এরপর সরে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমে তার ছায়াটাও আর দেখলাম না। মামীর সাথে অনেক অজানা মানুষ, যাদের আমি চিনি না। কোথথেকে সিনথি ছুটে এলো। কোমর জড়িয়ে আহ্লাদী স্বরে বলে ওঠে,
‘ সিয়া আপু তুমি আমার ভাবি? আমি না জাস্ট ভাবতেই পারছি না। ‘
বলেই আবার ছেড়ে দিলো। সিনথি মামাতো বোন আমার। বারো-তেরো বয়স হয়তো। মামী আমায় ঘরে নিয়ে এলেন। বাড়িতে প্রচুর আত্মীয়। এরা রিসোর্ডে যায়নি সম্ভবত। গলা ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়।
‘ এখানটায় বস,একটু খেয়ে নে। সকাল থেকে তো খাওয়া হয়নি বোধহয়? ‘
খিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। কিন্তু মন খেতে চাইছে না। আমি হেসেই বললাম,
‘ খিদে নেই। ‘
মামী মায়াভরা চোখে তাকালো। কত কষ্ট, বেদনা সে চোখে। অগ্রাহ্য করলাম। বিরক্ত লাগছে সবকিছু। সবটা!
অনেক জোর করলো খেতে। খাইনি। ইচ্ছেই জাগেনি খেতে। সিনথি, অনু তনু আপু আমায় বসিয়ে দিলো বাসর ঘরে৷ কাল ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট বেরোবে। আমিকি আর পড়তে পারবো? প্রশ্নটা মাথাচাড়া দিয়ে বসলো। তবুও নীরব বসে রইলাম। গা ঘামছে আমার। এক মোন ভারি এই লেহেঙ্গা আর নিতে পারছি না। সিনথি, অনু, তনু সবাই হাসিঠাট্টা করছে। লজ্জা লজ্জা কথা বলছে! তার প্রভাব আমার উপর পড়ছে না। ঘরটা অসুন্দর বলার উপায় নেই! অসম্ভব সুন্দর এককথায়। কোনদিনও আসিনি এ ঘরে। সাথে সেটেল্ড বেলকনি। ছোট ছোট টবে ফুল গাছ লাগানো। আরেকটু সময় পর বেড়িয়ে গেলো ওরা।
সময় কাটছে! রাত এগারোটা ছুঁইছুই। কখন ঘুমিয়েছি জানা নেই। বেলকনি দিয়ে আসা ঠান্ডা বাতাসে শরীর হেলিয়ে দেই, তখনি বোধহয় চোখ লেগে এসেছে।
কেউ গায়ে চাদর টেনে দিলো। মুহুর্তে সিরদাড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত ছুটে যায়। চমকে উঠে বসে পড়লাম। সামনে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে বসে থাকা সিয়াম ভাইয়াকে দেখে আৎকে উঠে বললাম,
‘ ছোঁবেন না আমায়। আমি নিচে ঘুমাচ্ছি। ‘
উনি উশখুশ করছেন। কিছু বলতে চাইছে বোধহয়। আমি তড়িৎ গতিতে বিছানা থেকে নেমে এলাম। উনি আটকানো গলায় বললেন,
‘ তুই..তুই ভুল ভাবছিস। মাঝরাতে একটু শিত পড়ে। তাই চাদরটাই জড়িয়ে দিচ্ছিলাম। ‘
হাপরের মতো বুক ওঠানামা করছিলো আমার। হঠাৎ থেমে গেলো। উনি আঙুল দিয়ে পাশের টেবিলটায় দেখালেন। ওখানে সালোয়ার কামিজ। আমি দ্রুত সেগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।
_____
আকাশের চাঁদ কাচির মতো হয়েছে। ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাঝেমাঝে দমকা হাওয়ায় চুলগুলো নড়ে উঠছে। উনি পাশে গভির ঘুমে তলিয়ে। একটু পরপর জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছেন। মাঝে কোলবালিস। আর ঘুম এলো না চোখে। অস্বস্তিতে নিজেই বিরক্ত হচ্ছি। উপায় না পেয়ে বেলকনিতে আসলাম। তারাগুলো আকাশে জ্বলছে। মায়ের কথা মনে পড়ছে খুব। কেন রেখে গেলে মা? তোমার সিয়ার সাথে অন্যায় হয়েছে! দেখো, আজ আমার বাসর,অথচ আমি একলা! ভীষণ একলা।
চোখ ছলছল করে উঠলো। চাঁপা কান্না করে উঠলাম। দেখতে দেখতে আলো ফুটলো। পূর্ব দিগন্ত থেকে আলোর উৎস ভাসে। চোখ যতদূর যায় শুধু বিল্ডিং! বেলকনির টবগুলো ছাড়া গাছপালার লেশমাত্র চোখে পড়লো না।
‘ উঠে পড়েছিস? ‘
পিছনে ফিরলাম। আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় বসে সিয়াম ভাইয়া। তার কুঁকড়ে যাওয়া বড়বড় চুলগুলে এলোমেলো। মুখ ফর্সা,গোল। চাপদাড়িও রয়েছে। দেহ সুঠাম,সুন্দর! সাদা-কালো জ্যাকেট পড়ে যেন দুনিয়ার সবথেকে সুদর্ষন যুবকটিই দাড়িয়ে আমার সামনে।
‘ একরাতে প্রেমে পড়ে গেছিস? ‘
টনক নড়লো আমার। যেসব কথা ভাবছিলাম,ভাবতেই ধিক্কার জানালাম নিজেকে। এসব কি ভাবছি আমি? কেন ভাবছি। চোখ ফিরিয়ে নিতেই উনি শব্দ করে হেসে উঠলেন। আয়নায় সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললেন,
‘ আজ আর্জেন্ট’লি অফিস যেতে হবে। তোর যা যা প্রোয়োজন বলতে পারিস, আসার পথে নিয়ে আসবো। ‘
কথা বলতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হলো না। ‘ মামীকে বলে দেব ‘ বলে গটগট করে বেড়িয়ে এলাম ঘর থেকে। চিঠির কথা বেমালুম ভুলে বসলাম। সে গাড়িতেই হয়তো পড়ে আছে কাল থেকে। আর ওটাতেই অফিসে যাবেন সিয়াম ভাইয়া।
#চলবে….
আমার সংসার গল্পের লিংক (all part) kobitor.com
বলেছিলাম দ্রুত দেব কিন্তু আজ ভ্যাকসিন নেওয়ায় এর বেশি লিখতে পারলাম না। সকলে এই পর্বে রেসপন্স করবেন। কাল বড় পার্ট দিবো।