আমার তুমি
সিজন ২ পর্ব ২২
#তানিশা সুলতানা
সায়ান তুলতুলকে নিয়ে ফিরে আসে তখন রাত নয়টা ছুঁই ছুঁই। গাড়ির শব্দ পেয়েই ছুটে যায় সালমা বেগম। তার পেছন পেছন মনি আর হামিদাও যায়। খুকি সুমুকে কল করে বলে ওরা চলে এসেছে।
সায়ান গাড়ি থেকে নামতেই শুরু হয়ে যায় মায়ের বকবকানি।
“আমি মরে গেলে শা*ন্তি পাবি তুই? এভাবে টেনশনে রাখতে তোর কলিজা কাঁপে না? মায়া হয় না মায়ের জন্য।
সায়ান মায়ের কথায় কান দেয় না। তুলতুল চুপচাপ বসে আছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। জীবনেও বোধহয় এতো কান্না করে নি।
মনি হামিদা খুকি আর সোনালীও চলে এসেছে ততখনে।
সায়ান ঘাড় বাঁকিয়ে গাড়ির ভেতরে তাকায়। তুলতুলকে বসে থাকতে দেখে মেজাজ বিগড়ে যায়।
” নামবি? না কি কোলে করে নামাতে হবে?
হতদম্ভ হয়ে যায় সবাই। তুলতুল মনে মনে কয়েকবার চিৎকার করে “ছি” শব্দটা উচ্চারণ করে লাফিয়ে নেমে পড়ে। একদম সায়ানের পাশে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সালমা বেগম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বভাবিক করে। “আসলেই ছেলেটা এই মেয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে”
নাহলে মা চাচিদের সামনে কেউ এমন কথা বলে?
“ভেতরে আয়। খেয়ে ঔষধ খেতে হবে।
ভেতরের দিকে পা বাড়িয়ে বলেন সালমা বেগম।
” তুলা আর খাবার দুটোই আমার রুমে পাঠিয়ে দাও। খেয়ে নেবো।
বলেই বড়বড় পা ফেলে ভেতরে ঢুকে যায় সায়ান। চমকায় তুলতুল। এই লোকটা চরম লেভেলের অসব্ভ্য।
সোনালী তুলতুলের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নেয়।
“মাথায় তোলো ছেলেকে। আব্বা আব্বা বলে গলা শুকাও। ফলটাও পাবে। শুনবে না তো আমার কথা।
খুকি বকতে বকতে ভেতরে ঢুকে যায়। হামিদা মুখ বাঁকিয়ে সোনার হাত ধরে।
” চল সায়ানের খাবার দিয়ে আসবি।
সোনার হাত ধরে টানতে টানতে চলে যায় হামিদা।
“তুলতুল এসো
বলে সালমা আর মনিও চলে যায়। তুলতুলের খুব খারাপ লাগছে। এই বাড়িতে সালমা বেগম ছাড়া যে আর কেউ ভালো চোখে তাকাচ্ছে না তুলতুলের দিকে তা ভালোই বুঝতে পারছে।
মনটা সায় দিচ্ছে না এখানে থাকতে। ” যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে তুলতুল থাকবে কিভাবে? ” যদিও একটা রাতই। তবুও।
“এতো বড়লোক বাড়ির আদরের ছেলে। তার সাথে তুলতুলের যায় না। নিজেকে গুটিয়ে নে তুলতুল। যা হয়েছে ভুলে যা। লোকটার থেকে দুরে দুরে থাক। তুইও ভালো থাকবি৷ লোকটাও ভালো থাকবে।
মনে মনে বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুলতুল।
বড় বড় পা ফেলে গেইটের বাইরে চলে যায়। হাতে একটা টাকাও নেই। কিভাবে যাবে বাড়িতে? এতো রাত। একা মেয়ে হেঁটেও তো যেতে পারবে না।
“বোনু তুই এখানে কেনো?
তন্ময় আর হাসিবও তখন বাড়িতে আসছিলো। তুলতুল তন্ময়কে দেখে নিজের কান্না গুলো লুকিয়ে রাখতে পারে না। ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে। দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তন্ময়ের বুকে।
” দাভাই আমি এখনই বাড়িতে যাবো। এখানে এক সেকেন্ডও থাকবো না।
কাঁদতে কাঁদতে বলে তুলতুল। তন্ময় চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। বুঝে যায় কিছু হয়েছে। হাসিব শুকনো ঢোক গিলে। সায়ানের জন্যই যে তুলতুল চলে যেতে চাইছে বোঝা হয়ে গেছে।
“এখনই বাড়ি যাবো বোনু। কান্না থামা।
তুলতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে বলে তন্ময়। তুলতুল শান্ত হয় না। বরং কান্নার শব্দ বাড়িয়ে দেয়।
তখন সুমু আর হিমুও চলে আসে৷ এভাবে তন্ময়ের বুকে তুলতুলকে কাঁদতে দেখে গলা শুকিয়ে যায় সুমুর। নিশ্চয় বড় কিছু হয়েছে।
” তুলতুল কি হয়েছে?
ওদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে সুমু। তন্ময় শক্ত চোখে তাকায় সুমুর দিকে। মাথা নিচু করে ফেলে সুমু।
“তুলতুলে ব্যাগ আর ফোনটা এনে দাও।
শক্ত গলায় বলে তন্ময়। সুমুর কান্না পায়। একটা দিন আসলো বাবার বাড়িতে থাকতে সেটাও হলো না।
টলমল চোখ নিয়ে বাড়িতে ঢুকে। হিমু হাসিবের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে ” কি হয়েছে?” হাসিবও চোখের ইশারায় বোঝায় “তুলতুল বলে দিছে”
ব্যাস হিমু আর হাসিবও কথা বলার সাহস পায় না।
সুমু কাঁদতে কাঁদতে নিজের লাগেজ আর তুলতুলের ব্যাগ নিয়ে বের হয়। খুকি বেগম সামনে পড়ে।
“বোনু কোথায় যাচ্ছিস? কি হয়েছে?
বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
” আমি আর কখনোই আসবো না তোমাদের এখানে।
বলেই দ্রুত চলে যায়। খুকি বেগম হায় হায় করে সবাইকে ডাকে। ততখনে সুমু চলে গেছে। তন্ময় সিএনজি দাঁড় করিয়ে তাতে তুলতুলকে নিয়ে বসে পড়েছিলো সুমু এসে তুলতুলের অন্য পাশে বসে।
“তুমি থেকে গেলেও পারতে।
তন্ময় শক্ত গলায় বলে।
” যে বাড়ি থেকে আমার ননদ কাঁদতে কাঁদতে বের হয়। সেই বাড়িতে আমি থাকতে পারতাম না।
সুমু নিজের চোখের পানি আড়াল করে বলে৷
মুহুর্তেই সিএনজি চলে যায়। বাড়ির সবাই বেরিয়ে এসেও ধরতে পারে না ওদের। সালমা বেগম হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। আহারে এতো কিছু রান্না করলো মেয়ে মেয়ের জামাইয়ের জন্য কিন্তু কিছুই খাওয়াতে পারলো না। মেয়েটার সাথে দুই মিনিট ভালো করে কথাও বলতে পারলো না।
কথাটা সায়ানের কানেও চলে যায়। সোনা খাবারের ট্রে সায়ানের সামনে রেখে বলে দেয় ওদের চলে যাওয়ার কথা। সায়ান শান্ত হয়ে শোনে সবটা। কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।
চুপচাপ মাথা তুলে খেতে শুরু করে। মাথা ব্যাথা বেরেই চলেছে। খাওয়া শেষ করে ঔষধ না খেলে চলবেই না।
সোনা চুপচাপ বসে থাকে সায়ানের সামনে।
সায়ানের খাওয়া দেখতে থাকে। খাওয়া শেষ হতেই হাতে প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। কেঁপে ওঠে সোনা। এক লাফে উঠে দাঁড়ায় বিছানা থেকে। ভয়ে বুক কাঁপছে। অথচ সায়ান শান্ত হয়ে পানি খাচ্ছে। ঔষধ ছিড়ে মুখে দিয়ে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে গ্লাসটাও ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। কাঁচের গ্লাস ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
সোনা এক দৌড়ে দরজার কাছে চলে যায়। এক টুকরো কাঁচ গায়ে লেগে গেলে।
ভাঙার শব্দ পেয়ে সবাই ছুটে আসে সায়ানের রুমের সামনে। সোনাকে কাঁপতে দেখে জড়িয়ে ধরে হামিদা বেগম। সালমান সুলাইমান আর আনোয়ারও চলে এসেছে জরুরি মিটিং শেষ করে। আব্দুল্লাহর পাশের রুমটা সায়ানের। তিনি সবেই বাইরের জামাকাপড় ছেড়ে বাড়িতে পড়ার লুঙ্গি আর সেন্ডো গেঞ্জি পড়েছে।
তিনিও ছুটে আসে।
কেউ ভেতরল ঢোকার সাহস পায় না। সায়ান একে একে রুমের সব জিনিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে দিচ্ছে। তান্ডব বয়িয়ে দিয়েছে গোটা রুমে।
“সায়ান কি করছিস? হয়েছে কি বল আমায়?
হিমু সায়ানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে। সায়ানের হাতে ছিলো পারফিউমের বোতল। সেটা ছুঁড়ে মারে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়। মুহুর্তে আয়না ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
সবাই আতঙ্কে ওঠে।
” দাদাভাই
হয়েছে কি আমাকে বলো?
আব্দুল্লাহ এগিয়ে এসে বলে।
সায়ান জবাব দেয় না। ফোন আর সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিয়ে বেলকনিতে চলে যায়।
“আব্বা যাস না। পড়ে যাবি। দরজা দিয়ে বের হ।
সালমা দৌড়ে আসতে আসতে বলে।কিন্তু কে শোনে কার কথা?
সায়ান বেলকনি দিয়ে লাফিয়ে নেমে যায় অনায়াসে।
কেঁদে ওঠে সালমা।
সালমান বাড়ির সবার দিকে তাকায়। বিনা কারণে রেগে যাওয়ার মতো ছেলে তো সায়ান না। নিশ্চয় কিছু ঘটেছে।
কেটে যায় আরও কিছু দিন। তুলতুলের দিন গুলো পাখির মতো উঁড়ে উড়ে যাচ্ছে। কোচিং ক্লাস বন্ধুদের সাথে আড্ডা এই নিয়ে দিন যায়। সায়ানের কথা মাথায় আসতেই আবার ঝেড়ে ফেলে। ভুলে যেতে চায়।
তুলতুলের নতুন একটা ছেলে বন্ধু হয়েছে। সিনিয়র বন্ধু তিয়াস। তিথির ভাই। তিথি হলো তুলতুলের বেস্টফ্রেন্ড।
তুলতুল নিজের সিম পাল্টে ফেলেছে। ফেসবুক আইডিও নতুন করে খুলেছে।
তন্ময় আর সুমুর সম্পর্কেরও উন্নতি হয়েছে।
তনু আর হিমু ফ্রেন্ড শিপ করেছে। তনু যে হিমুকে ভালো বাসতে শুরু করে দিয়েছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তিথি আর তিয়াসের সাথে গেছিলো তিয়াসের গানের স্কুলে। তিয়াস ভালো গান গাইতে পারে৷ আর একটা স্কুলও আছে। সেখানে সপ্তাহে তিনদিন করে গান শেখায়।
ক্লাস শেষে তিনজনই হাঁটছে। তুলতুল আর তিয়াস এক পাশে।
” ভাইয়া আপনি আমাকেও গান শেখাবেন? আমারও খুব ইচ্ছে গান শেখার। আহহা বড় সিঙ্গার হবো।
তুলতুল বলে
“তুমি চাইলেই শেখাবো।
তিয়াস একটু হেসে বলে। ছেলেটা কিউট আছে। সারাক্ষণ পিঠে গিটার ঝুলানো থাকে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি থাকবেই। হাসলে সুন্দরও লাগে। বা গালে টোল পড়ে।
” ঝালমুড়ি খাবো।
ঝালমুড়িওয়ালাকে দেখে তুলতুল চেঁচিয়ে বলে।
“কানের পোকা মে*রে দিবি।
তিথি চোখ মুখ কুঁচকে বলে। তুলতুল ভেংচি কেটে তিয়াসের হাত ধরে এক দৌড়ে ঝালমুড়ির দিকে যায়। তিয়াস তাকিয়ে থাকে তুলতুলের মুখের দিকে।
গান শেখা ঝালমুড়ি খাওয়া সব মিলিয়ে আজকে একটু বেশি দেরি হয়ে গেছে। পাঁচটা বেজে গেছে।
তুলতুল দৌড়ে বাসায় ঢোকে। সদর দরজা খোলাই ছিলো। প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। পেট ভরে ঝালমুড়ি খেয়ে দৌড়েছে। একটু পানিও খায় নি। তাই আরও বেশি ক্লান্ত লাগছে।
“আম্মু ও আম্মু একটু পানি দাও।
তুলতুল সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে বলে। কোনো সাড়াশব্দ আসে না।
তুলতুল চোখ বন্ধ করে থাকে। একটু জিরিয়ে নিজেই পানি ভরে খাবে। দিতে হবে না পানি।
পরপর অনুভব করে কেউ পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়েছে।
” এতোখন লাগে পানি দিতে? ম*রে গেলে দিবা না কি? ভালোটালো তো বাসো না।
বকতে বকতে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ফেলে।
“ছেলেটা কে ছিলো?
হঠাৎ চেনা কন্ঠের আওয়াজ শুনে চমকে ওঠে তুলতুল। হাত ফসকে গ্লাসটা পড়ে যায়।
চলবে……………