টি,এস, সি, তে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ বাবু ভাই এসে হাজির, হাতে বিশাল এক মিষ্টির বাক্স।
– নে ধর, মিষ্টি খা।
-কিসের মিষ্টি বাবু ভাই? চাকরি হয়ে গেছে?
-আরে আগে মিষ্টি খা তো, তারপর বলছি।
আমরা চার পাঁচ জন ছিলাম। এক বাক্স মিষ্টি খেতে বড়জোর পৌনে পাঁচ মিনিট লাগলো।
বাবু ভাই একটু দূরে বসে সিগারেট টানছেন আর আমাদের মিষ্টি খাওয়া দেখছেন।
শেষ মিষ্টিটা মুখে রেখেই আবার বললাম, বলেন না বাবু ভাই। আমাদের তর সইছে না।
বাবু ভাই কায়দা করে সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললেন। সেটা অনুভূমিক ভাবে যেতে যেতে মাটিতে পড়ার আগে কেন জানি একটু উপর দিকে উঠে তারপর মাটিতে গোত্তা খেয়ে পড়লো। বাবু ভাই এসব কাজে ওস্তাদ। একবার কলাভবনের সামনের অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর্যের পায়ে দেশলাইয়ের কাঠি ঘষে চট করে আগুন ধরিয়ে ফেলেছিলেন। আমাদের ব্যাচের মিথিলা, যে কিনা সহজে অবাক হয় না, সেও ব্যাপারটা দেখে
সপ্রশংস দৃষ্টিতে বাবু ভাইয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন। বাবু ভাই নির্বিকার ভাবে সেই দেশলাইয়ের আগুন সামলে রেখে সিগারেট ধরিয়েছিলেন।
যাই হোক, বাবু ভাই এবার কাছে এসে বেশ আওয়াজ করেই বললেন, “আজকে নিয়ে পর পর দুইবার আমেরিকান এম্বেসী আমার ভিসা রিজেক্ট করলো। সিদ্ধান্ত নিয়েছি ঐ শালাদের দেশেই যাবো না । এটা তারই মিষ্টি। হা হা হা।”
বাবু ভাই আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে মাস্টারস শেষ করেছেন বছর তিন আগে। পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে করে প্রায়ই টি,এস, সি, তে আসেন, আড্ডা দেন। চাকরি বাকরি নিয়ে আলাপ করেন। তবে আমরা যারা উনার একটু কাছের, আমরা জানি তার আসার আরেকটা কারণও আছে।
বছর চার আগে আমাদের ভার্সিটিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টেই রুম্পা নামের একটি মেয়ে ভর্তি হলো। মেয়েটি উজ্জ্বল শ্যামলামত, পাতলা মুখ,পিঠের উপর একটা অবিন্যস্ত বেণী করে রাখা। চট করে নজরে পড়ে না, তবে একবার নজর পড়লে চোখ ফিরিয়ে নেয়াও যায় না।
রুম্পার উপর বাবু ভাইয়ের নজর পড়েছিল।
বলা চলে রুম্পাকে একটু দেখতে পেতেই বাবু ভাই আমাদের সাথে অসম বয়েসের বন্ধুতা তৈরী করেছিল। আমাদের মাধ্যমে রুম্পাকে বেশ কিছু উপহারও পাঠিয়েছিল। সেই উপহারগুলোও সেই রকম ! একখানা পেল্লায় সাইজের ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস (এটা বাবু ভাইয়ের এক মামা বিদেশ থেকে এনেছিলেন), তাঁর ছোটবেলায় জমানো ডাকটিকেটের এলবাম (ডাকটিকেট সহ), একটা বেড়াল-পুতুল যার গা’টা বেশ তুলতুলে। আবারো বিচিত্র রকমের উপহার। সেই সব উপহার পেয়ে রুম্পা যতটা বিরক্ত কিংবা বলা চলে রাগ করলো, আমরা সবাই মজা পেতে লাগলাম। উপহারগুলো দেয়ার ব্যাপারে অবশ্য বাবু ভাইয়ের কিছু লজিক ছিল। যেমন, হাতের নখ কাটতে গেলে মাঝে-মধ্যেই নখের একপাশের একটা টুকরো প্রায়শই চামড়ার ভিতরে ঢুকে যায়। ম্যাগ্নিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে ভালো ভাবে দেখলে ঠিক সেই সুক্ষ নখের কোনাটাকে টার্গেট করে তুলে নিয়ে আসা যায়। তা না হলে, আঙুলের চামড়া মায় গোস্ত পর্যন্ত কাটা পড়তে পারে। ডাক টিকেটের সংগ্রহ হচ্ছে তাঁর জীবনের সবচাইতে প্রিয় একটা জিনিস – যা তিনি রুম্পার জন্য স্যাক্রিফাইস করতে চান। অনেকটা ইব্রাহিম (আঃ) এর সাক্রিফাইসের মত। তিনি অনেক চিন্তা করে দেখেছেন, ডাকটিকেটের এই বইয়ের চেয়ে এর চেয়ে প্রিয় জিনিস তার আর কিছুই নেই। যাই হোক পুতুল বেড়ালটা নিয়ে ক্লাসে বেশ একটা কান্ড হয়েছিল। আমাদের আরেক বান্ধবী মিলিকে বাবু ভাই বেশ কাকুতি-মিনতি করে বলেছিলো, সে যেন এই উপহারটা রুম্পাকে পৌঁছে দেয়। বাবু ভাইয়ের অনুরোধ চট করে ফেলে দেয়াও যায় না। তাঁর চেহারার মধ্যে এক ধরণের “শিশুসুলভ সারল্য” ছিল। আমরা অনেকবার তাঁর অদ্ভুত সব অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে গিয়েও করতে পারি নি।
যাই হোক, রুম্পার অজ্ঞাতসারে মিলি বেড়ালটা রুম্পার হাতব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। ক্লাস চলার এক পর্যায়ে রুম্পা ব্যাগের ভিতর থেকে বই বা খাতা কিছু একটা বের করতে গিয়ে হঠাৎ কোমল-লোমশ স্পর্শ পেয়ে চিৎকার করে উঠে।
ব্যাপারটা জানাজানি হলে মিলি অবশ্য অনেকবার ‘স্যরি’ বলেছিলো। রুম্পা তাও রেগে ছিল। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর বাবু ভাই রুম্পার সামনে পড়ে যায়। করিডোরের এক পাশে দাঁড়িয়ে রুম্পা বেশ শক্ত ভাষায় বাবু ভাইকে কথা শুনিয়েছিল। বাবু ভাই দেখতে মন্দ নন। প্রায় ছ ফুট লম্বা, সিল্কি লম্বা চুল, মুখে ক’দিনের সেভ না করা দাড়ি।
বাবু ভাই স্বভাব সুলভ মুচকি মুচকি হাসছিলেন।
তাই দেখে রুম্পা আরও রেগে মেগে দুদ্দাড় হেঁটে চলে যায়। শাসিয়ে যায়, সে ডিপার্টমেন্টে নালিশ করবে।
রুম্পা ডিপার্টমেন্টে নালিশ করেছিল কিনা জানা যায় নি। তবে বেশ কিছুদিন বাবু ভাই আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে আসেন নি।
এর পর অনেকদিন পার হয়েছে। বাবু ভাই মাস্টার্স শেষ করে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলেও গেলেন। মাঝে মধ্যে টি, এস, সি’র আড্ডা ছাড়া তাকে এদিকটায় বড় একটা দেখা যেত না। আমাদের ফাইনাল ইয়ারের পর আমরাও ক্যাম্পাসের এইদিকে আসা বন্ধ করে দিলাম।
বছর পাঁচেক পরের কথা। আমি একটা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিতে তখন চাকরি করি। আমি বসি ঢাকার হেড অফিসে, কিন্তু আমাদের ফ্যাক্টরি নরসিংদীতে। সেখানেই একটা কাজে গিয়েছি। দুপুরের পর পর কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাস-স্টপের কাছে দাঁড়িয়ে আছি।
হঠাৎ হুস করে একটা জীপ্ গাড়ি এসে থামলো। জীপের জানালা দিয়ে খুব পরিচিত একটা নারী-মুখ আমার দিকে গম্ভীর-ভাবে তাকিয়ে আছে।
-উঠে পর।
আমি ভালো করে তাকাতেই দেখি রুম্পা। চশমা পরে থাকায় পুরোপুরি চিনতে পারি নি। ড্রাইভার অবশ্য এরই মধ্যে দরজা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়েছে।
এইখানে এইভাবে রুম্পাকে দেখবো স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি জানতাম রুম্পা বি’সি,এস, দিয়ে প্রশাসনে যোগ দিয়েছিলো। সে বরাবর সিরিয়াস ধরণের ভালো ছাত্রী। আমার মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন জট পাকিয়ে উঠছে। রুম্পা চোখের ইশারায় আমাকে বললো, এখন কথা নয়, বরং বাড়িতে গিয়ে কথা হবে।
জানা গেলো রুম্পা নরসিংদীর ম্যাজিস্ট্রেট। অফিস থেকে কোয়ার্টার দিয়েছে। এক পলকে বেশ সাজানো গোছানো বাড়ি বলে মনে হলো। রুম্পা প্রধান ফটক দিয়ে না ঢুকে মাঝামাঝি একটা দরজা দিয়ে আমাকে নিয়ে সরাসরি ডাইনিং রুমে বসালো। ভিতরে মধ্যবয়সি একজন কাজের মহিলা ছিল।
-এখানে বস। আগে চা খাও, তারপর লাঞ্চ করবে। কাজের মহিলাটাকে চা বানাতে আদেশ করে রুম্পা ভিতরে চলে গেলো। সম্ভবত ফ্রেশ হয়ে আসতে। আমি বসে চা খাচ্ছি। বাড়ির বাইরে থেকে কেমন অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে। কখনও পাখির ডাক মনে হচ্ছে, কখনও কিচ কিচ শব্দ। ওদের বাসার পেছনটায় জঙ্গল আছে নাকি? রুম্পাকে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে।
প্রায় ঘন্টা খানেক পরে সে ফিরে আসলো।
গাড়িতে সে শাড়ি পরে ছিল, এখন পড়েছে সালোয়ার কামিজ। একটু মুটিয়ে গেলেও, ওকে দেখে ভার্সিটি জীবনের রুম্পাকে মনে পরে গেলো।
খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ে করো নি?
– সে এক গাল হেসে, বললো কী মনে হয়?
-তার মানে করেছো। বরও কী তোমার মতো সরকারি অফিসার?
এর উত্তরে রুম্পা আর এক গাল হাসে। ভার্সিটি জীবনে ও এতটা হাসি-খুশি ছিল না।
খাওয়ার পর সে আমাকে নিয়ে ড্রইং রুমে ঢুকে। ড্রইংরুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো। দু’সেট সোফা, সোফার রঙের সাথে মিল রেখে কার্পেট, টবে ইনডোর প্ল্যান্ট। জানালার পর্দার নীলচে রং – ঘরের স্নিগ্ধতা বেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। ড্রইং রুমের আর এক পাশে ছোট্ট দেরাজের উপর চব্বিশ ইঞ্চি টিভি, তার পাশেই দেয়াল জুড়ে বেশ বড় একটা ছবি – রুম্পার সহাস্য মুখ আর তার কাঁধে হাত রেখে বাবু ভাই। তাঁর মুখে স্বর্গীয় হাসি।
আমাকে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রুম্পা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, “কি, হোঁচট খেলে?”
-খুব। কীভাবে কী হলো? আমি হরবর করে বলি।
একটু আসছি, বলে রুম্পা ভিতরে গিয়ে আবার দু’কাপ চা নিয়ে আসে। তরপর ওর জীবনের খুব ক্ষুদ্র অথচ মধুময় একটা উপাখ্যান আমাকে শোনায় :
“তোমাদের বাবু ভাই আমাকে এক সময় কীরকম জ্বালিয়েছে, সে তো সবই জানো। ওঁর অত্যাচারে একসময় মনে হতো ক্যাম্পাস ছেড়ে পালাই।
তোমরাতো দেখোনি মেয়েরা যে আমাকে নিয়ে আড়ালে কী হাসাহাসি করতো! বলতো, মানুষ প্রেমে পড়ে পাগল হয়, আর এই ছেলে পাগল হয়েই প্রেমে পড়েছে। চাইল্ডিশ, লুনাটিক আরও কত কী যে ওকে বলতো।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বাবু ভাইকে গাল দিলে তোমার অত কী? তুমি তো আর উনার প্রেমে পড়নি।
রুম্পা মৃদু হাসে। আগে লক্ষ্য করিনি হাসলে ওর ডান গালে একটা টোলের মত ঢেউ খেলে যায়।
হাসির ঢেউটা জিইয়ে রেখেই রুম্পা বলে, মাস্টার্স ফাইনালেই আমার বিয়ের কথা বার্তা চলতে থাকে। আমি তোমাদের জানাই নি। আমি অবশ্য তখন বি,সি,এস, প্রিলির জন্য তৈরী হচ্ছি। বাসায় বলেও দিয়েছিলাম চাকরি-বাকরির আগে বিয়ে করবো না। তোমাদের বাবু ভাই এই দেরির সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে।
-কী রকম?
রুম্পা আমার কথার উত্তর না দিয়ে বলে যায়, পাশ করার পর পর মাঝে মধ্যে উনার কথা যে মনে পরতো না তা নয়। তবে আমি উনার ব্যাপারটাকে সত্যিই অত সিরিয়াসলি নেই নি। প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে এক কান্ড।
আমি এবার আর কোনো প্রশ্ন করি না, ওকে বলতে দেই।
– মনে আছে সেবার বি.সি,এস, এ একদিনে দুটো সাবজেক্টের পরীক্ষা ছিল?
-না মনে নেই, আমি তো বি.সি,এস, দেই-ই নি। ওসব তোমাদের মতো ভালো ছাত্রীদের জন্য।
রুম্পা বলে চলে, সেইদিন সকালের পর্ব শেষ করে হল থেকে বের হয়েছি। অসম্ভব গরম পরেছে। আমি পাশের একটা বেকারি থেকে কিছু স্ন্যাক্স আর ঠান্ডা পানীয় কিনে একটু দূরে বসে খাচ্ছি। অনেক মেয়েদের অভিভাৱক খাবার নিয়ে এসেছে। আমার মা-ও আসতে চেয়েছিল, আমি বলেছি মাত্র একঘন্টার গ্যাপ, এইটুকুর জন্য এতো দূর থেকে আসা। আমি কিছু একটা খেয়ে নেবো। যাই হোক, কোকের বোতলে সবে একটা চুমুক দিয়েছি, গরমটা তেতে আসছে, আমি আরও একটু ছায়ার দিকে সরে গেছি – হঠাৎ দেখি তোমাদের বাবু ভাই রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা প্যাকেট, সারা শরীর ঘামে ভেজা।
আমাকে দেখে একটু বোকার মত হাসে। তারপর বললো, “আরে তোমার সীট এখানে পড়েছে নাকি?
আমি একটু গম্ভীর হয়েই বললাম, “আপনি এখানে?”
– আমার খালাতো বোনের এখানেই সীট পড়েছে বলে জানতাম। এখন খাবার নিয়ে এসে দেখি সে এখানে নেই। দেখো দেখি কী ঝামেলায় পড়লাম। মনে হচ্ছে রং ইনফরমেশন।
আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। বাবু ভাই বলে চলে, খাবারগুলো একটু ট্রাই করবে নাকি? আমার ক্যান্ডিডেটকে যখন পাওয়াই গেলো না?
– আমি খেয়ে ফেলেছি, বাবু ভাই।
-ওহ, তাহলে এটা একটু ট্রাই করো,বলে হঠাৎ কোত্থেকে একটা কাটা ডাব হাজির করলো। স্ট্র লাগানো। খুব গরম পড়েছে। প্লিজ এটাতে একটু চুমুক দাও।
আমি হাসতে হাসতে রুম্পাকে বললাম, “তো তুমি চুমুক দিলে ?”
রুম্পাও হাসতে হাসতে বললো, এই রকমের পাগল তুমি আর কোথাও দেখেছো?
আমি বললাম, তো তোমার বর এখন কোথায় ?
-সে তো অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে
-বল কী? কবে কখন? আমি বিস্মিত হই।
– সে তো আমেরিকার জন্য কতদিন চেষ্টা করেছে। হয়নি। সে সব তোমরা জানো। আমার কাছাকাছি যখন হলো হলো তখন থেকেই সে অস্ট্রেলিয়ার জন্য চেষ্টা করছিলো। এইতো এক বছর হলো সে ওখানে চলে গিয়েছে।
-হায় হায় বল কী! এখন একা একা তোমার খারাপ লাগে না? বলতে গেলে নতুন বিয়ে !
– খারাপ লাগার সময় কোথায়? সারাদিন অফিস করে এসে এদের দেখতে হয়। বলে রুম্পা ড্রইং রুমের পেছন দিকের আর একটা দরজা খুলে দেয়। সেখানে খাঁচার ভিতরে নানা রকমের পাখি, খরগোশ, গিনিপিগ। রুম্পাকে দেখে ওরা সবাই একসাথে যেন হুল্লোড় করে উঠে।
ডাইনিং রুম থেকে তখন যে শব্দগুলো শুনছিলাম, তার কারণ এখন বোঝা গেলো।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, এতো মিনি চিড়িয়াখানা !
-তাহলেই বোঝো। কী ঝঞ্ঝাট নিয়ে আছি। উনি আবার প্রতি সপ্তাহে ফোন করে এদের খবর নেন। ভিডিও কল করে এদেরকে দেখাতে হয়।
শুনেছি মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর কাছ থেকে কত গহনা-পত্র উপহার হিসেবে পায়। তোমাদের বাবু ভাই আমাকে দিয়েছে এই চিড়িয়াখানা।
অনেক্ষন থেকেই একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো। রুম্পা বোধ হয় টের পেয়ে যায়।
– বুঝলে, আমিও মাস্টার্সের জন্য অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাচ্ছি।
-বল কী? তো তখন এদের কী হবে? আমি খাঁচাগুলোর দিকে ইঙ্গিত করি।
সে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমাকে খুব শীঘ্রই চলে যেতে হবে। তা না হলে সে ওখানে যা শুরু করেছে!
আমি এবার ভয় পেয়ে যাই। ইতস্তত: করে বলি, কী শুরু করেছে? সাদা মেয়েদের সাথে প্রেম করছে নাকি?
রুম্পা এবার শব্দ করে হেসে উঠে। এই বাচ্চার সাথে প্রেম করবে কে? সে ওখানে যেটুকু টাকা জমায় তাই দিয়ে কী সব জিনিস যে কেনে।
একশো বছর আগের ভিউকার্ড, আবরিজিনদের কোন গ্রামে গিয়ে তাদের হাতে বানানো পুরোনো এক মালা । আমাকে নাকি মালাটাতে
খুব মানাবে।
-আগের অভ্যাস তাহলে বদলায় নাই।
– আর বোলো না, এতো দূর থেকেও বিরক্ত করে মারছে। আমি এখন শুধু দিন গুনছি।
“বিরক্ত করে মারছে” বলতে গিয়েও রুম্পার ঠোঁটের কোণের একটুখানি হাসির রেখা ওর ডান গালের টোলের মতই একটুখানি ঢেউ খেলে যায়।
আমি বিদায় নেয়ার জন্য বলি, “এবার আসি। তোমরা ভালো থেকো।”
রুম্পা ঘাড় নেড়ে সম্মতি দেয়। কিন্তু ওর দৃষ্টি তখনও খাঁচাগুলোর দিকে।
ফিরে আসতে আসতে মনে মনে বলি, বাবু ভাইয়ের এই শিশুতোষ ভালোবাসা রুম্পা কি সারাজীবন আগলে রাখবে?
হয়তো রাখবে। সত্যিকারের ভালোবাসা বহতা নদীর মতো নিশ্চয়ই তার পথ চিনে নেবে।
(ছোটগল্প: এনালগ যুগের প্রেম)