#শারমিন আঁচল নিপা
ফিয়না খেয়াল করল সেই কালো বিড়ালটা যেটা সে আগেও দেখত। কিন্তু শেষ ঘটনার পর আর দেখেনি। মানে অনন্যার হাসবেন্ড দীপকের মৃত্যুর ঘটনার পর এ কালো বিড়ালের কথা সে ভুলে গিয়েছিল। এর আগে প্রায়ই দেখত সে। কিন্তু দীপকের মৃত্যুর পর আর দেখেনি৷ এত বছর পর আজকে আবার দেখল। বিড়ালটা এক কোণ থেকে এসে মিলিয়ে গেল। ফিয়নার শরীর কেমন করে যেন কাঁপছে। বিশেষ করে হাত গুলো থরথর করে কাঁপছে তার। যুক্তির চোখে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় হলো। সে ফিয়নার হাতের তালুটা নিজের দুহাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে বলল
“এনিথিং রং? কী হয়েছে তোমার?”
ফিয়না কথায় বলতে পারছিল না। চুপ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে কোনোরকম সামলে নিল সে। হাতটা ছুটিয়ে একটা কাশি দিয়ে উত্তর দিল
“আমি ঠিক আছি।”
এর মধ্যেই অদিতি ডেকে উঠল তাকে। অদিতি এ প্রোগ্রামের হোস্ট। পুরো প্রোগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব তার। কারণ ফিয়নার পরিবারে দায়িত্ব পালনের মতো তেমন কেউ ছিল না। সবাই বিদেশ থাকে। আর আপন মা তো জেলে। ঘৃণায় কখনও দেখা করতেও যায় না। যার কাছে আছে সে ও প্যারালাইজড। তাই বাইরের কাউকে দায়িত্ব দিতে বাধ্য হয়েছে সে। অদিতির ডাক শুনে ফিয়না যুক্তিকে বলল
“অনন্যার বিষয়টা নিয়ে আমরা পরে কথা বলব। অনেক কিছুই জানার বাকি। তাই তোমাকে এক কথায় বুঝানো সম্ভব না। আমি আস্তে ধীরে তোমাকে বলব। অনুষ্ঠানটা শেষ হোক।”
যুক্তি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল
“আচ্ছা ঠিক আছে। সমস্যা নেই। তুমি স্টেজে যাও। আর শুভকামনা তোমার জন্য। রুদিতাকে দেখো তোমার আগে স্টেজে গিয়ে বসে আছে। “
ফিয়না একটু হেসে স্টেজের দিকে এগুলো। এদিকে যুক্তি রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় এতক্ষণ ছিল অনন্যার অতীত নিয়ে কথা। এখন ঝেঁকেছে অনন্যার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন। অনন্যা বলেছে তার মা অন্যত্র বিয়ে করেছে এরপর খু’ন হয়েছে। বাবাও মারা গেছে। এক বোন বিদেশ থাকে যোগাযোগ নেই। তবে আনহারির কথা অনুযায়ী অনন্যা নিঁখোজ কয়েক বছর হবে। তাহলে অনন্যার পরিচয় কী?সে যে অতীত বলেছিল এটা কী তাহলে মিথ্যা? আর অনন্যা যদি এদের বোন হয় তাহলে অনন্যা কেন এখানে আসছে না? অনন্যার মনে রাখার শক্তি আছে সেটা সে কথা বলেই বুঝতে পেরেছে। এমন না যে সে তাদের ভুলে গেছে। যদি ভুলে না যায়, তাহলে তাদের কাছে কেন আসছে না? অনন্যা নামটা ঘিরেই যেন একটা রহস্য তাকে তলিয়ে নিচ্ছে।
একটা হাতের স্পর্শ কাঁধে পেল যুক্তি। পাশ ফিরে তাকিয়ে লক্ষ্য করল আনহারির হাত। আনহারির দিকে তাকাতেই আনহারি বলে উঠল
“অনন্যার কথায় ভাবছেন তাই তো?”
যুক্তি হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বলল
“অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অনন্যার বলা অতীতের বর্ণণা আপনাদের পরিবারের সাথে মিশছে না। অনন্যার ভাষ্যমতে তার একটায় বোন ছিল। আপনারা তো দেখছি তিন বোন। ওর বাবা, মা মারা গেছে এটা বলেছিল। এখন তো দেখছি মা বেঁচে আছে।”
যুক্তির কথা শুনে আনহারি আরেকটু রহস্য বাড়াতে বলল
“আমাদের বাবা বেঁচে আছে। তবে আমাদের দুজনের পালিত বাবা আলাদা। তারা মারা গেছে। আর আমাদের জন্মদাত্রী মা জেলে। আর ফিয়না আমাদের সৎ বোন। লাবন্য জোহা আমার পালিত মা। সব মিলিয়ে আপনাকে পুরো কাহিনি না বললে বুঝবেন না। আপনি স্থির হয়ে অনুষ্ঠানটা উপভোগ করুন। ফিয়নার বিয়ের পর সব খুলে বলব।”
কথাগুলো শুনে যুক্তির মাথা আরও নড়ে গেল। কৌতুহল যেন তাকে গ্রাস করে নিল। কী বলছে কী হচ্ছে কিছুই সে মেলাতে পারছে না। আবারও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। এবারও আনহারির ডাকে তার ঘোর কাটে। আনহারি তাকে বলল
“চলুন স্টেজের দিকে যাওয়া যাক।”
যুক্তি এগুচ্ছে ধীর গতিতে। আর আনহারি এগুচ্ছে একটু দ্রূত গতিতে। যুক্তি একটু সামনে গিয়ে থেমে যায়। আর আনহারি স্টেজে উঠে।
এদিকে ফিয়নার ভেতরটাও অনন্যার কথা শুনে অস্থির হয়ে আছে। তবুও নিজেকে সামলে অনুষ্ঠান উপভোগ করছে সে।
চারদিকে জোরালো আওয়াজে গান বাজছে। একটা মুখরিত পরিবেশ। ফিয়নার বন্ধু মহল কেউ ছিল না। তাই এখানে যারা উপস্থিত, যারা নাচছে তারা সবাই ভাড়া করা। সত্যি বলতে আপন যারা আছে তারা কেউ বেঁচে নেই, কেউ হারিয়ে গেছে আবার কেউ কেউ দেশের বাইরে।
গানের আওয়াজ টা হুট করেই থেমে গেল ফিয়নার এক চিৎকারে। ফিয়নার আচমকা এমন চিৎকারে সবাই যেন কেঁপে উঠল। ফিয়নাকে বেশ অস্থির দেখাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট বেড়েছে তার। আনহারি ফিয়নাকে শক্ত হাতে ধরে বলল
“তুমি কি এখনও অনন্যার কথা চিন্তা করছো? কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? তুমি কি ঠিক আছো?”
ফিয়না কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
“অনন্যাকে তো হারিয়ে ফেলেছি। নসিবে থাকলে ফিরে পাব। আপন সবাই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমার ভালোবাসার মানুষটাও হারিয়ে গেল। দুটো বছর একসাথে থেকে একে অপরকে এত কাছে থেকে চিনলাম। আর এখন বিয়ের দিন সে পালিয়ে গেল। ওর বড়ো বোন কল দিল। সে নাকি আমাকে বিয়ে করতে পারবে না। তাই একটা চিঠি লেখে দেশের বাইরে চলে গেছে। আচ্ছা আপা আমার জীবনেই কেন এমন হবে বলো তো? আমি কী খুব খারাপ যে এত শাস্তি পাব?”
যুক্তি যতবারেরই স্বাভাবিক হতে চেয়েছিল ততবারেই এমন অবাক করা ঘটনা তাকে অস্বাভাবিক করে তুলছে। এত অদ্ভুত ঘটনা প্যারালাল আকারে হতে সে কখনও দেখেনি। দুই বছর সম্পর্কের পর ঠিক করা বিয়ে কী করে এভাবে ভেঙে যায়। ছেলে যদি না চাইত আগেই বিয়ে ভাঙতে পারত। আর ছেলে দেশের বাইরে গেলে নিশ্চয় আগেই ভিসা প্রসেসিং করেছিল। তাহলে হলুদের দিন এমন কান্ড ঘটানোর কী দরকার ছিল! একজন মানুষ এত ইমম্যাচুরের মতো কাজ করবে না। এখানেও কিছু না কিছু রহস্য তো লুকিয়েই আছে। এখন তো তার পুরো বিষয়টা অদ্ভুত রহস্যময় লাগছে। মনে হচ্ছে কোনো রহস্যের ফাঁদে সে পড়ে গেছে। চায়লেই সব সমাধান করতে পারছে না।
এদিকে ফিয়নাকে আনহারি বুঝ দিতে লাগল। ফিয়না বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। উৎসব মুখরিত পরিবেশটা হঠাৎ করেই মরা বাড়ির মতো নীরব হয়ে গেল। ইভেন্টের লোকেরা আনহারির এক ইশারাতেই সব খুলে নিয়ে যেতে লাগল। গানের মাদল থেমে গেল। সবাই সবকিছু গুছিয়ে টাকার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আনহারি ফিয়নাকে রুমে নিয়ে গেল। সেখানে শুইয়ে দিয়ে সবাইকে টাকা দিয়ে বিদায় করল। রুদিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তার ছোট্ট মন এতটুকু বুঝতেছে যা হচ্ছে স্বাভাবিক কিছু না। তাই গুটিসুটি হয়ে সব দেখছে। সবাই চলে গেলেও যুক্তি রয়ে গেল ফিয়নাকে একটু স্বাত্ত্বণা দেওয়ার জন্য।
ফিয়না বিছানায় শুয়ে এক নজরে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে কাঁদছে। আনহারি তাকে ধরতে গেলে। যুক্তি আনহারিকে বাঁধা দিয়ে বলল
“এখন তাকে কিছু বলে উত্তেজিত করার দরকার নেই। স্বাভাবিক স্বাত্ত্বণাও তার কাছে এখন বিষের মতো লাগবে। তাকে এক মনে নীরব হয়ে থাকতে দিন। লাইটটা অফ করে ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিন। আর আমরা চলুন ঘরের ঐ কোণাটায় বসি। একা রেখে যাওয়াও ঠিক হবে না। কারণ এসব রোগীরা সুইসাইডাল প্রবণ হয়ে যায় হুট করে৷”
আনহারি যুক্তির কথায় কান দিল। কারণ যুক্তি একজন সায়কেট্রিক্স। সে যা বলেছে বুঝে শুনেই বলেছে। তাই তারা ঘরের এক কোণে বসল। যুক্তি তখন আনহারিকে বলল
“আমাকে কি অনন্যার ব্যাপারে বলা যাবে?”
আনহারি হালকা গলায় বলল
“হুম বলা যাবে।”
কথাটা বলে একটা নিঃশ্বাস নিল তারপর ঘটে যাওয়া ঘটনা বলতে লাগল। এবং অনন্যা নিঁখোজ কীভাবে হয়েছিল এবং নিঁখোজ হওয়ার পরের রহস্যও বলে উঠল। যা কাহিনির নতুন একটা মোড় আনল।
কপি করা নিষেধ।