#শারমিন আঁচল নিপা
ফাতেমার ব্যাপারে জটলা মুখ খুলেছে। দ্বিতীয় জিজ্ঞাসাবাদে সে বর্ণণা করেছে কীভাবে সে ফাতেমাকে খুন করেছে এবং সে সাথে এক জটিল রহস্যের আভাস দিয়েছে। তার ভাষ্যমতে
“ফাতেমা মেয়েটা তেমন ভালো ছিল না। আমার শ্বশুড়বাড়িতে কাজ করত। আমি এবং আমার শ্যালক দুজনের সাথেই তার সম্পর্ক ছিল। একটা মেয়ে নিজে থেকে সব দিলে কোনো পুরুষ উপেক্ষা করতে পারবে বলুন? তাই আমিও পারিনি। ফাতেমা আমার নিকট ভোগের পণ্যই ছিল। একদিন আনজুমান সব জেনে যাওয়ায় তাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর ফাতেমার সাথে আমার বেশ অনেকদিন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ফাতেমায় চেয়েছিল আমি আবার যোগাযোগ করি। আমি তাকে উপেক্ষা করতে পারিনি। এরপর আমাদের সম্পর্ক আবার শুরু হয়। সম্পর্কের একটা পর্যায়ে ফাতেমা বাচ্চা সম্ভাবা হয়। আমি সেটা জানতাম না। আমাকে ইচ্ছা করেই জানানো হয়নি। পাঁচমাস পর জানতে পারি। এরপর চাইলেও বাচ্চা নষ্ট করার উপায় ছিল না। ফলবরূপ বাচ্চাটা জন্ম দেয় সে। একটা ফুটফুটে ছেলে হয় ফাতেমার । আমার একটা মেয়ে আছে। এ ছেলেটা হওয়ায় আমার ভীষণ মায়া জন্মায় যখন আমি তার মুখ দেখি। নিজের সন্তান বলে কথা। মায়া তো হবেই। আমি ফাতেমাকে বলেছিলাম বাচ্চার দায়িত্ব আমি নিব তবে বিয়ে করতে পারব না। ফাতেমা তাতে রাজি হয়।
এভাবে কেটে যায় চারটা বছর। কিন্তু নাছোর বান্দা ফাতেমা তা মেনে নিতে পারছিল না বেশিদিন। দিনের পর দিন তার চাওয়া বাড়তে থাকে। সে বারবার বিয়ে করো, বিয়ে করো বলে মাথা খেতে লাগল। ওকে বিয়ে করলে আমি সব কিছু হারাতাম। আরামের জীবনটা আমার নষ্ট হয়ে যেত। তাই বারবার বুঝালাম তাকে। বুঝলো না। এক পর্যায়ে সে আমার শ্বশুড় বাড়িতে উঠে পড়ল। আমি সেদিন কোনোরকম আশ্বাস দিয়ে তাকে বিদায় করি।
এরপর বুঝতে পারলাম বিষয়টি খারাপ দিকে মোড় নিবে। আর সে আমার পথের কাটা। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম পথের কাটাকেই সরিয়ে দিব। তাই তাকে বুঝ দিলাম বিয়ে করলে ছেলের আড়ালে করতে হবে। নাহয় ছেলের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে। আর ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করতে বোর্ডিং এ দেওয়ায় বেস্ট। সে আমার কথায় পটে গেল। আমি বিয়ে করব এটাতেই সে ভীষণ খুশি ছিল।
আমি পরিকল্পনা অনুযায়ী ছেলেকে বোর্ডিং এ দিয়ে আসি। আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি ফাতেমাকে খুন করতাম পরদিন। কিন্তু আমি নিজেও জানি না কী হয়েছিল সেদিন। ছেলেকে বোর্ডিং এ দিয়ে রুমে আসার পর লক্ষ্য করলাম ফাতেমা মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। উল্লেখ্য যে আমরা একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। তার মুখটা এব্রোথেব্রো হয়ে গেছে। কেউ হয়তো শক্ত বলিষ্ঠ ধারালো জিনিস দিয়ে আঘাত করেছে। গলায় দাগ দেখে বুঝতে পারলাম গলায় কিছু একটা পেঁচিয়ে তাকে খুন করেছে।
আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। মাথায় শুধু ঘুরছিল কে খুন করলো? কেন করলো? পুলিশকে খবর দেওয়ার সাহসও হলো না। কারণ আমার দিকে আঙ্গুল উঠত। এটা নিশ্চিত খুনটা আমি করিনি। ঐ সময়টায় আমি সেখানে ছিলামেই না। ছেলের বোর্ডিং স্কুলে ছিলাম। নিজেকে বাঁচাতে এবার আমি কোনোরকম লাশটা সুটক্যাসে ঢুকালাম। এত বড়ো একটা মানুষ ছোটো সুটক্যাসে আটকাচ্ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে হাড়গুলো ভেঙ্গে সুটক্যাসে ভরি। তারপর এটা নিয়ে রাতের আধাঁরে দূরের একটা নদীতে ফেলে দিই। বাড়িওয়ালাকে বাসার ভাড়া দিয়ে জিনিসপত্র সব দিয়ে দেই। এবং বলি আমরা নিজেদের বাসায় উঠব ঐখানে সকল জিনিসপত্র নতুন কিনব। আর কাপড়চোপড় যা ছিল তা নিয়ে পুড়িয়ে ফেলি জঙ্গলে।
এরপর জানতে পারি পুলিশ তার লাশ পেয়েছে। সেদিন আমার বুক ভীষণ ধুকধুক করছিল। তবে আমি জানতাম ফাতেমার কোনো পরিচিত এখানে নেই। যে পুলিশ স্টেশনে পেয়েছে সেটাও কয়েক থানা পর। তাই একটু চিন্তামুক্ত রাখলাম নিজেকে। এদিকে পুলিশ ফাতেমার লাশকে বেওয়ারিশ ঘোষণা করে দাফন করে দিল।
বিশ্বাস করুন ফাতেমাকে খুন করার পরিকল্পনা ছিল আমার তবে আমি খুন করিনি। কে করেছে আমি জানি না। এখনও সেটার সমীকরণ আমি মেলাতে পারছি না। মাঝে মাঝে মনে হয় হয়তো কোনো আত্মা আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমাদের এভাবে কপোকাঁত করছে।
আনহারির মুখে এ বর্ণণা শুনে আমার মনেও প্রশ্ন জাগল ফাতেমাকে কে খুন করেছে? তাহলে কী এমন কোনো তৃতীয় ব্যাক্তি আমাদের মাঝে আছে যে আমাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে কিন্তু আমরা তাকে ধরতেও পারছি না।
এদিকে রাত হয়ে গেল। বাবার লা/শটা কালকে আমাদের হস্তান্তর করা হবে। মাকে বেশ বিষন্ন লাগছে। কিন্তু আমার কেন জানি না একদম খারাপ লাগছে না। মনে হচ্ছে যা হয়েছে হয়তো ভালো হয়েছে। সামনে যা হবে হয়তো ভালোর জন্যই হবে।
এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ ভরে ঘুম চলে আসলো। সকালে ঘুম ভাঙলো পুলিশের ডাকে। পুলিশ এসেই মাকে এরেস্ট করলো। কেন এমন করলো কিছুই প্রথমে বুঝতে পারি নি। হঠাৎ করেই মাকে ধরে নিয়ে থানায় নিয়ে গেল।
এদিকে আমিও পিছু পিছু গেলাম সঠিক তথ্য উদঘাটনের জন্য। আর সে তথ্য উদঘাটন করতে গিয়ে আমার ভেতরে থাকা সকল বিশ্বাস ধুলোয় মিশিয়ে গেল। সত্যি বলতে চোখে যা দেখা যায় তার আড়ালেও অনেক কিছু থেকে যায়। যা আমরা চাইলেও হুট করে দেখতে পারি না। আমার মা তার স্বামীকে আর আমার বাবাকে খুন করেছে। খুনের বর্ণণা আর কারণ যখন বলল সেটা শুনে আমার কেবল যন্ত্রণা বাড়তেই লাগল। মাকে পুলিশ অফিসার আমার সামনেই জিজ্ঞাসাবাদ করে। মাকে প্রথমেই একটা চেয়ারে বসানো হয়। চেয়ারটির এপাশে মা ওপাশে পুলিশ। মাঝখানে একটি টেবিল। টেবিলে একটি গ্লাস রাখা তবুও সেটা অর্ধপূর্ণ। মাকে বসিয়ে তিনি সাধারণ গলায় জিজ্ঞেস করলেন
“আপনার স্বামীকে কেন খুন করেছেন? আর কীভাবে খুন করেছেন?”
মা প্রথমবার সব অস্বীকার করে। কিন্তু পুলিশ অফিসার যখন মাকে কঠোর গলায় আবার জিজ্ঞেস করে মা গড় গড় করে সব বলতে থাকে। মা একটু ভীতু স্বভাবের ছিল সবসময়। এখনও তার প্রতিফলন ঘটল। কোনোরকম গায়ে হাত তুলার আগেই মা সব বলে দিল। মায়ের বয়ান,
“রাত বারোটায় সবসময়ের মতো কাজ শেষ করে আমার স্বামী বাসায় আসে। আমি তাকে রোজকার রুটিনে খাবার দিই। লক্ষ্য করলাম তিনি একটু মনমরা হয়ে বসে আছেন। আমি বিষয়টি খেয়াল করে তার কাঁধে হাত দিতেই তিনি রেগে গেলেন। আমাকে তার মোটেও সহ্য হচ্ছিল না। আমার সাথে এমন কেন করছে এটার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে আমার জীবনের এক গোপন সত্য উদঘাটন করে।”
কথাটা বলেই মা একটু থেমে গেল। পুলিশ অফিসার মাকে আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
“কী গোপন সত্য?”
মা আস্তে গলায় বলল,
“আমিই আমার বড়ো মেয়ের খুনে জড়িত ছিলাম। আমার বড়ো মেয়েকে বেশ আশা নিয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম বড়ো ঘরে। ভেবেছিলাম আমাদের অভাব গুচবে। দিনশেষে সেই মেয়েই আমাদের বোজা হয়ে ঘরে ফিরে এলো। এ ভার সহ্য করা অনেক কষ্টদায়ক ছিল। একদিন লক্ষ্য করলাম আমার মেয়ে অনন্যা বের হয়ে কোথায় যাচ্ছে। রাত তখন ৪ টা। আমিও তার পিছু নিলাম।
পিছু নিতে নিতে চলে গেলাম অনন্যার শ্বশুর বাড়ির জাম গাছ তলায়। সেখানে অনন্যা কারও সাথে কথা বলছিল। তবে কার সাথে বুঝতে পারছিলাম না। এক সময় তাদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক চলে। আর একটা পর্যায়ে মনে হলো কেউ অনন্যার মুখ চেপে ধরেছে। তবে আমার বুঝায় ভুল ছিল তারা অনন্যার মুখ নয় গলা চেপে ধরেছিল শক্ত দঁড়ি দিয়ে৷ অনন্যার কেনো আওয়াজ না পেয়ে সামনে এগুতেই খেয়াল করি অনন্যা মাটিতে লুটিয়ে আছে। আমি একটা চিৎকার দিতে নিলে অনন্যার ননদের জামাই আমার মুখ চেপে ধরে৷ আমাকে দুটো অপশন দেয়া হয়, এক সবটা লুকিয়ে গিয়ে পাঁচ লাখ টাকা নিতে নাহয় প্রাণ বিসর্জন দিতে অনন্যার মতো।
আমি ভীষণ ভীতু প্রকৃতির হওয়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এদিকে অভাবের সংসার ছিল, টাকাটার দরকার ছিল৷ লোভ আমাকে ঝেঁকে বসে। ভাবলাম মেয়ে তো আর ফেরত পাব না। যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। তাই পাঁচ লাখ টাকার প্রস্তাবটা গ্রহণ করে চলে আসি।
সেদিন আমি আমার মেয়ের খুন হয়েছে জেনেও প্রতিবাদ করিনি। বরং চেপে গিয়েছি।
এটা বারো বছর পর জানতে পেরে আমার স্বামী আমার সাথে বেশ অস্বাভাবিক আচরণ করে এবং পরদিন পুলিশে গিয়ে সবটা বলে দিয়ে জেল খাটানোর হুমকি দেয়। আমি সেটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিনি। কারণ পাঁচলাখ টাকা খেয়ে যদি জেলে যেতে পারতাম তাহলেও মানতে পারতাম। যেখানে আমি পাঁচ লাখের পাঁচ আনাও পাইনি। শুধু মাত্র তাদের মিথ্যা আশ্বাসে নিজের সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়েছি। সেজন্য জেল খাটতে হবে শুনে আমার মনটা হঠাৎ হিংস্র হয়ে উঠে। সে সাথে সারাজীবন জেলে পঁচে মরতে হবে এটা ভাবতেও পারছিলাম না। জীবনে অনেক অভাবের কষ্ট সহ্য করেছি। নতুন করে কোনো কষ্ট সহ্য করতে চাচ্ছিলাম না।
আমি তার মাথার পেছনে রুটি বেলার বেলোন দিয়ে জোরে আঘাত করি। সাথে সাথে সে মাটিতে লুটিয়ে যায়। এবং নিস্তেজ হয়ে যায়। পরে খুব কষ্ট করে তাকে সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দেই।
মায়ের কথা শুনে পুলিশ অফিসার আমির চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ । এ কেইসটা পুলিশ অফিসার আমিরের তত্ত্বাবধানে হচ্ছে। তিনি বলে উঠলেন,
“আপনার স্বামীর মৃত্যু আপনার আঘাতের জন্যই হয়েছে। কী পেলেন জীবনে বলুন। না পেলেন স্বামীকে না পেলেন সন্তানকে। আপনি কী ভেবেছিলেন খুন করে পার পেয়ে যাবেন? পুলিশ কিছুই টের পাবে না? বুঝতে পারবে না? সবটা গোপনেই থাকবে! সত্য কখনও চাপা থাকে না। বারো বছর আগের সত্যও বের হয়ে চলে এসেছে। এবার বুঝুন সত্যের কতটা পাওয়ার। নিজের স্বামীকে খুন করাটা বেশ স্বাভাবিক কেইস। তবে নিজের সন্তানকে খুন করার কেইসটা বেশ মর্মান্তিক। আচ্ছা আপনার বুক কাঁপে নি নিজের সন্তানের খু’নিরা যখন ঘুরে বেড়িয়েছে আর আপনার সন্তান কবরে গিয়েছে।”
সে প্রশ্নের উত্তরে মা যা বলল তা শুনে আমার যন্ত্রণা আরও বাড়তে লাগল। এগুলো শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
সবার আগে গল্প পেতে নীল লেখায় চাপ দিয়ে লাইক ফলো দিন শারমিন আঁচল নিপা । Sharmin Achol Nipa
কপি করা নিষেধ
শারমিন আক্তার
শারমিন নিপা