#শারমিন আঁচল নিপা
আমি আর দেরি করলাম না।৷ দ্রূত পায়ে রওনা দিলাম থানার দিকে। বুকটা ভীষণ কাঁপছে। মেঘেরা আকাশে খেলা করছে। কালো মেঘ যেন জানান দিচ্ছে ভয়ানক কিছু হচ্ছে। এ ভয়ের হাত থেকে রেহাই পাব তো? গ্রামের এলোপাতারি রাস্তার মতো আমার মনটাও উতাল পাতাল করে এলোমেলো হচ্ছে। আনহারির কিছু হলে নিজেকে হয়তো ক্ষমা করতে পারব না। মনে হাজার টা সংশয় নিয়ে এগুচ্ছি। এর মধ্যেই একটা গাড়ি আমার দিকে জোর গতিতে আসছে। আমি এখান থেকে কোনদিকে মোড় নিব বুঝতে না পেরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে হিতাহিতজ্ঞান যেন আমার চলে গেছে। আমি আর নড়তেও পারছি না। গাড়ির গতিবিধি আমাকে যেন নড়াতে পারছে না।
কারো কোমল হাতের সম্পর্শ অনুভব করলাম। কোমল হাতগুলো আমাকে যেন শক্ত করে ধরে টেনে নিল। আমি মাটিতে ছিটকে পড়লাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলাম। তারপর চোখ খুলে একটু উঠে দাঁড়ালাম। একটা জোরালো কণ্ঠ ধেয়ে আসলো
“কী করছো এসব? মরে গেলে কী সব সমাধান হয়ে যাবে? সময় খারাপ যাচ্ছে মানে ভালো সময় ফিরে আসবে। আনহারিকে খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত নিজেকে টিকিয়ে রাখো। এভাবে হারিয়ে গেলে কী হবে?”
আমি চোখ তুলে তাকালাম। সাদা থ্রি- পিস পরা একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রকৃতি যেন সকল সৌন্দর্য তার শরীরে ঢেলে দিয়েছে। পরীর মতো সুন্দরী একটা মেয়ে। মনে হচ্ছে জান্নাত থেকে হুর নেমে এসেছে। সম্ভবত সে এ গ্রামের ডাক্তার। আমি তাকে হাসপাতালেই দেখেছিলাম বেশ কয়েকবার এপ্রোন পরা অবস্থায়। তবে তখন তাকে বেশ ভালোভাবে খেয়াল করে না দেখায় তার সৌন্দর্য আমার চোখে লাগেনি। সে আমাকে আবারও বলে উঠল
“ইন্তু নিজেকে সামলাও।”
ইন্তু নামটা শুনতেই আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমার পুরো নাম ফিয়না তাসমিয়া ইনতিয়া। ফিয়না আমার ভালো নাম। কাগজে কলমে ফিয়নায় আমাকে ডাকা হয়৷ তবে ইন্তু নামটা আমার বড়ো আপা, বাবা আর মা বেশি ব্যবহার করত। স্কুল কলেজ বাইরের মানুষ আমাকে ফিয়না হিসেবেই চিনত। আপা ফিয়না, ইন্তু, মাঝে মাঝে ফিন্তু, ইন্তু বলেই ডাকত বেশি। মা ও একই রকম ডাকত। কিন্তু যখন বাহিরের মানুষের সাথে কথা বলত তখন ফিয়না বলেই সম্বোধন করত। সেদিন আনজুমানকে আমি ফিয়না নাম বলাতেও চেনে নি। কারণ ফিয়না নামটা তারা খুব বেশি শুনে নি। আর তাদের বাসায়ও যাতায়াত আহামরি হত না। এক, দুবার ফিয়না নাম শুনলেও বেশিরভাগ ফিন্তু বা ইন্তু শুনেছে। তাই বারো বছর আগের সে ফিয়না নামটা তাদের মাথা থেকে চলে গেছে। তাদের মাথায় এটাও জাগে নি অনন্যা ফিরে এসেছে, কিন্তু ওর পরিবার কোথায় বা ওর বোন কোথায়? তারা এটা ধরে নিয়েছে আমার পরিবার গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে আর অনন্যা কোনো না কোনোভাবে বেঁচে ফিরে এসেছে। তাই তারা আনহারিকে দমাতে সকল বুদ্ধি খরচ করছিল তবে পরিবার পর্যন্ত যাওয়া উচিত সেটা বুঝে নি। সব মিলে তাদের ধারণার বাইরে ছিল অনন্যার বোনও অনন্যার সাথে এসেছে। আর বারো বছরে আমার অনেক পরিবর্তন হওয়ায় তারা আমাকেও চিনতে পারে নি।
এবার আমি সামনে থাকা মেয়েটাকে কোমল গলায় বললাম
“আপনি আমার এ নাম কীভাবে জানলেন? আমাকে তো এ নামে আমার একান্ত পরিচিত ছাড়া কেউ চিনে না। আর আনহারিকে আপনি চেনেন কীভাবে? আনহারিও আমাকে এ পর্যন্ত ফিন্তু বা ইন্তু বলে সম্বোধন করে নি। তার সবকিছু অনন্যার মতো হলেও এ জায়গাটাতেই একটু ভিন্নতা ছিল। এস সব ঝামেলার মাঝে এ পয়েন্টটা আমার মাথা থেকে চলেই গিয়েছিল। আপনার সম্বোধনে মাথায় আসলো বিষয়টি। সে সাথে অনেকগুলো প্রশ্নের সমাচার ঘটছে। কে আপনি?”
অপর পাশ থেকে উত্তর আসলো
“আমি মহিমা। তোমার এ নাম আমি অনন্যার মুখে শুনেছি। আমাকে দেখতে ভীষণ ছোটো লাগলেও আমার বয়স আনজুমানের সমান। আনজুমান আমার সৎ বোন। আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন আমার মা। আমার মা জানতই না আমার বাবা বিবাহিত ছিলেন। শহরে থাকত তখন বাবা। সে সময় টায় বিয়ে করে আমার মাকে। আমার মা বাবার গার্মেন্টস এই চাকুরি করত। অসম্ভব সুন্দরীর অধিকারী হওয়ায় বাবার চোখে পড়ে। আর বিয়ে করে। মা তখন জানত না বাবা বিবাহিত। আমি জন্ম নিই। সব ভালোই চলছিল। আলাদা একটা সংসার ছিল মায়ের। আমার দু বছর বয়সে মা জানতে পারে বাবা বিবাহিত। এ নিয়ে বাবার সাথে বেশ কয়েকবার কলহ হয়৷ মায়ের এ দুনিয়ায় কেউ ছিল না। তাই বাবাকে ছাড়ার কথা চিন্তাও করতে পারে নি। সবকিছু মুখ বুজেই সংসার করছিল।
সত্য কখনও চাপা থাকে না। সেটা কোনো না কোনদিন প্রকাশ পায়৷ তেমনি দীপকের মা ও জানতে পারে বাবার দ্বিতীয় বিয়ের কথা। আর সে সময়টায় বাবা সিদ্ধান্ত নেয় মাকে ছেড়ে দিবে। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। সবে বুঝতে শিখেছি। বাবার সাথে এগুলো নিয়ে মায়ের প্রতিদিন ঝগড়া। এসব করতে করতে বাবা গত হয়ে গেলেন। খবর আসলো বাবা আর নেই। মা যেন সব হারিয়ে ফেলল। বাবারেই একটা ফ্ল্যাটে আমরা থাকতাম। বাবার তো ফ্ল্যাটের অভাব ছিল না। কিন্তু আমাদের সেখান থেকেও তুলে দেওয়া হলো। দীপকের মায়ের কথায়। মা থানায় থানায় দৌঁড়েছে এক বিন্দু থাকার জায়গার জন্য। কিন্তু আইন জিম্মি ছিল তাদের হাতে।
মা বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে দীপকদের ঢাকার বাসায় যায়। দীপকের মাকে অনুরোধ করে অন্তত আমার কথা বিবেচনা করে হলেও যেন একটু থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দেয়। এমনিতে তো আমি মেয়ে হিসেবে সম্পদের ভাগ পাই। সে সূত্র ধরেই যেন আমাদের একটু থাকার জায়গা দেওয়া হয়। সেদিন দীপকের মা আমার মাকে মারতে মারতে মেরেই ফেলেছিল। আমি আমার মাশের লা/শটা সেখানে রেখেই ভয়ে পালিয়ে এসেছিলাম। আমি এখনও জানি না আমার মায়ের লাশটা তারা কী করেছিল। আমাকে পুরোপুরি এতিম করে দিল।
তবে কথায় আছে না রাখে আল্লাহ মারে কে? ঠিক তেমনি আমার জীবনে ফেরেশতা হয়ে আসলো লিয়াকত জোহার ভাই আরাফাত জোহা। লাবনী জোহার কোনো আপন ভাই নেই। লিয়াকত জোহা আর আরাফাত জোহা লাবনী জোহার চাচাত ভাই। তবে লিয়াকত জোহাকে লাবনী জোহার মা নিজের সন্তানের মতো আদর করতেন। আরাফাত জোহাও নিঃসন্তান ছিলেন। ঘটনাক্রমে আমি পালিয়ে বাংলা সিনেমার মতো আরাফাত জোহার গাড়ির নীচেই পড়ি। এরপর তারা আমাকে বাঁচিয়ে তুলে। আমার মুখ থেকে সবকিছু শুনার পর তারা আমাকে তাদের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। কথায় আছে না যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছে। ঠিক তেমনি আল্লাহ আমার কাছে আমার বাবাকে পাঠিয়েছিলেন। যার ছায়াতলে আমি বড়ো হই। আর মমতাময়ী মাকে পাঠিয়েছিলেন যার ভালোবাসায় আমি সিক্ত হই।
মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বড়ো হয়ে মায়ের খু/নের প্রতিশোধ নিব। আমি এ পরিবার নিয়ে ঘাটব। তবে এর আগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পড়াশোনা মন দিয়ে করি। এরপর ডাক্তার হই। বি সি এস দেওয়ার পর, সেটাও হয়ে যায়। সব মিলিয়ে নিজের জীবনটা বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলাম। বিয়েও হয় একজন চরিত্রবান পুরুষের সাথে। আল্লাহ তার সকল নেয়ামত আমাকে ঢেলে দিয়েছিলেন। তবে মায়ের খু/নীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা মনে হলেই আমার বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হত। সেজন্য আমি অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে জানতে পারি দীপকরা গ্রামে এসে থাকবে। অদিতি আর জুই এর সাথে ডিভোর্সের পর কিছু আইনী জটিলতা আর সম্মানের ভয়ে তারা গ্রামে চলে আসে। আমিও সে সুযোগ নিয়ে পোস্টিং এ গ্রামে নেই।
এ গ্রামে পোস্টিং নেওয়ার ঠিক পাঁচদিন পরেই আমার নিকট অনন্যার লাশ আসে। আমি জানতে পারি অনন্যা দীপকের তৃতীয় বউ। অনন্যাকে আমি চিনতাম না। তবে হুট করে আনহারির মতো অনন্যাকে দেখে চমকে উঠি। আনহারি ঠিক আছে কিনা জানার জন্য তাকে কল দিই। জানতে পারি সে ঠিক আছে। অনন্যাকে সবাই ভেবেছিল মারা গেছে তবে অলৌকিকভাবে সে বেঁচে ছিল। আমি যখন বুঝতে পারি সে বেঁচে আছে তখন আমার মাথায় এটাই কাজ করতেছিল তাকে বাঁচাতে হবে। অনন্যার স্বামী দীপক আর এ পরিবার সম্পর্কে তো আমি আগেই জানতাম। সেখান থেকে বুঝতে পেরেছিলাম অনন্যার বেঁচে যাওয়ার কথা বললে তারা আবার অনন্যাকে মারতে দ্বিধা করবে না। আমি সেজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম অনন্যাকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলব৷ সে সময় থানায় একটা বেওয়ারিশ লাশ ছিল। মেয়েটার গঠনও অনন্যার মতো ছিল। আমি সে লাশটাকে ময়না তদন্তে পাঠিয়ে দেই। আর তারা সেটা জানতই না। আর ময়না তদন্তের রিপোর্টটা তাদের মতো করেই বানাবে আমি জানতাম। টাকা আর ক্ষমতার দাপটের বলে।
আমি বেশ কষ্টে অনন্যাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় পাঠাই। সেখানে আনহারিকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। আনহারি অনন্যার ব্যাপারটা জানত। সে বিভোর নামে একজনের কাছ থেকে অনন্যার কথা শুনেছিল। সে নিজে অনন্যাকে চিকিৎসা করানোর জন্য নিয়ে যায়। তাকে চিকিৎসা করানো হয় সবার অজান্তেই। আনহারি লাবনী জোহা আর ওয়াজেদ চৌধুরির একমাত্র সন্তান হওয়ায় টাকার সাগরে বড়ো হয়েছে। আর যখন যা ইচ্ছা হত সে করতে পারত।
আনহারিই অনন্যাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। আর দুভার্গ্যবশতঃ অনন্যা কোমায় চলে যায়। অনেকদিন কোমায় থাকার পর ঠিক হয়৷ তবে তার বাকশক্তি এবং শরীর অসাড়েই থেকে যায়। আনহারি তখন দেশের বাইরে থেকে সবটা মেইনটেইন করত৷ আমিও করতাম। সেখানে একজন নার্সকে রেখে আলাদা বাসায় অনন্যার চিকিৎসা এবং থেরাপি চলছিল। মেয়েটা শারিরীক অনেক কষ্ট ভুগ করেছে।
আর এদিকে আমি সেই বেওয়ারিশ লাশটাকে অনন্যা বানিয়ে দিয়ে দেই। মুখে এমনিতেও কিছু কাটা ছেড়া করতে বলি যাতে মুখ অবয়ব স্পষ্ট না হয়। সে লাশটায় কৌশলে অনন্যা সাজিয়ে দিয়েছিলাম তোমার পরিবারকে।
আমি তার মধ্যে বলে উঠি
“তাহলে বাবা যে বলল সে লাশটা পুতার সময় কাফনের কাপড় সরিয়ে মুখটা দেখেছিল আর সেটা অনন্যায় ছিল।”
মহিমা হালকা গলায় বলল
“মুখটা স্পষ্ট ছিল না। আর তোমার বাবা তখন সাব কনসিয়াস মাইন্ডে ছিল। মানে অনন্যার ঘোরে। মানুষের কনসিয়াস মাইন্ডকে যখন সাব কনসিয়াস মাইন্ড দখল করে নেয় তখন মানুষ যা চিন্তা করে সেটাই দেখতে থাকে। তোমার বাবার বেলাতেও তাই হয়েছে। আর অনন্যার লাশ ভেবে অনেকে তাকে গোসল ও করায়নি। এজন্য সেটা অনন্যা ছিল না এটা কেউ ধরতে পারেনি। আর হাসপাতালে বেওয়ারিশ লাশ এসেছিল এটা কেবল আমি এবং আরেকজন জানতাম। আর জানত একজন পুলিশ অফিসার। সে এখন লন্ডন চলে গিয়েছে। সেই সবটা হ্যান্ডেল করেছে।
আমরা সবাই অনন্যার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষা করছিলাম। আর এদিকে এ পরিবারকে ধ্বংসের পায়তারা খুঁজছিলাম। অনন্যার শারিরীক অবস্থাটা আমাদের বেশ ভাবাচ্ছিল। একবার ভালোর দিকে যাচ্ছিল একবার খারাপ দিকে। কতটা সহ্য করেছে এটা কেবল আমরা যারা তাকে নিজ চক্ষে দেখেছি তারা জানি।
ঘটনার সাত বছর পর অনন্যার মুখের বাক আসে। সেদিন সে প্রথম ফিন্তু নামটায় উচ্চারণ করেছিল। এরপর দীর্ঘ দু বছর তার থেরাপি, বিভিন্ন ট্রিটমেন্টের পর সে একটু সুস্থ হয়। আস্তে আস্তে সে স্বাভাবিক হয়। হাঁটতে শুরু করে। তবে সবকিছু গুলিয়ে ফেলত। ব্রেনে বেশ আঘাত পেয়েছিল তাই।
তিন বছর আগে তাকে একটা ভালো পরিবেশ এবং সময় দেওয়া দরকার ছিল। তাই বুদ্ধি করে আনহারির জায়গায় অনন্যাকে পাঠানো হয়। আর লাবনী জোহাকে বলা হয় আনহারি একটা রোগে ভুগছে। সে হঠাৎ করে সব ভুলে যেতে শুরু করেছে। তাই তার কোর্সটা কমপ্লিট না করেই চলে আসতে হচ্ছে।
লাবনী জোহা মেয়ের চিন্তায় ভেঙে পড়তে লাগল। তাড়াহুড়ো করে আনহারিকে নিজের কাছে আনার চেষ্টা করল। আর সে সময়টা আনহারি নিজের নম্বর ঠিকানা সব বদলে ফেলে। দেশে যাওয়ার নাম করে দেশে না গিয়ে সেখানেই থেকে যায় আর অনন্যাকে লাবনী জোহার কাছে পাঠায়।
যেহেতু বলা হয়েছিল আনহারি মানসিক সমস্যায় ভুগছে সেহেতু লাবনী জোহা ধরতে পারেনি এটা আনহারি না। আর লাবনী জোহা জানত না আনহারির জমজ বোন আছে। সব মিলে অনন্যা আনহারি হয়ে থেকে গেল লাবনী জোহার কাছে। অনন্যা অনেক কিছুই এলোমেলো করে ফেলত। আনহারি হওয়া তো অনন্যার পক্ষে সম্ভব ছিল না। একটা মানুষকে পুরোপুরি কপি খুব সহজে করা সম্ভব না। কিন্তু এতে কেউ তাকে সন্দেহ করে নি একটা বিষয়ের জন্য আর সেটি হলো আনহারির হুট করে ভুলে যাওয়া রোগের কথা প্রচার হওয়ায়।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আনহারি ভেবে অনন্যার আবারও মৃত্যু হয় ওয়াজেদ চৌধুরির কাছে। সে সময়টা লাবনী জোহা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। তাই তাকে চিকিৎসা করানোর জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়। এদিকে অনন্যার দাফন কার্য শেষ করে ওয়াজেদ চৌধুরি। অপরদিকে আনহারি তার মায়ের কাছে গিয়ে বুঝায় সে বেঁচে আছে। আর তার বাবাকে সে একটা সারপ্রাইজ দিতে চায়। যেহেতু তার বাবা জানে সে মারা গেছে তাই সে তার বাবার কাছে দুটো বছর পর গিয়ে একটা বড়ো সারপ্রাইজ দিতে চায়। আর সিঙ্গাপুরে তাকে চিকিৎসার জন্য লাবনী জোহায় এনেছিল পরে সে অসুস্থ হওয়ায় বিষয়টি ভুলে গেছে।
লাবনী জোহার মনে এটাই গেঁথে দেওয়া হয়। আর লাবনী জোহা এখনও মানসিক ভাবে সুস্থ না হওয়ায় তার মনে গেঁথে দেওয়া কথাটায় রয়ে গেছে। সে জানে না তার মেয়ের জায়গায় অন্য কেউ স্থান দখল করে শূন্য করে চলে গেছে। আনহারি জানত খু’নটা তার বাবায় করেছে। কারণ অনন্যার সাথে আনহারির যোগাযোগ ছিল৷ তার বাবার অদ্ভুত অদ্ভুত গতিবিধি সে আনহারিকে শেয়ার করত। সে সাথে মালিহার বিষয়টি ও শেয়ার করত। আনহারি ভেবেছিল খুব শিঘ্রই এসে এর বিহিত করবে। কিন্তু এর মধ্যেই সবটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এরপর আনহারি টানা দুই বছর ওয়াজেদ চৌধুরি এবং দীপকের পরিবারের শাস্তির পরিকল্পনা করে। সে রেশ ধরেই দু বছর পর এসে পরপর প্রতিশোধ নিতে থাকে। একের পর এক ছক কষে এগুতে থাকে। তবে শত্রু পক্ষের গতিবিধি সবসময় বুঝা যায় না। আনহারির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সেজন্য সে এখন নিঁখোজ। জানি না মেয়েটার সাথে কী হয়েছে?
অনেক প্রশ্নের অবসান ঘটেছে। তাহলে সে হোটেলটার মালিক অনন্যাকেই দেখেছিল। যে কি’না সে সময়টায় আনহারির বাসায় ছিল৷ আর তখন অনন্যার পক্ষে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে নিজের নামটা হয়তো অভ্যাসবশত অনন্যায় বলে ফেলেছিল।
এদিকে দ্রূত থানায় যেতে হবে। আনহারির খোঁজ যে করে হোক আনতেই হবে৷ এর মধ্যেই মোবাইল বেজে উঠল। কলটা ধরতেই লাবনী জোহা কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল
“অফিসার মাহিদ আমাকে দ্রূত থানায় যেতে বলেছে৷ আমি তো যেতে পারছি না৷ দেশের অবস্থা যে ভালো না৷ চারদিকে মৃত্যুর হাহাকার লেগে গেছে। ন্যায্য অধিকার চায়তে গিয়ে ছাত্ররা মাটিতে র/ক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে যাচ্ছে। শত শত মায়ের বুক খালি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বের হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বুকের ধন হারিয়ে যাওয়ার অস্থিরতা যে আমাকেও ঝেঁকে ধরেছে। ফিয়না আনহারি ঠিক আছে তো?”
লাবনী জোহার কথা শুনে আমার গলাটা কেঁপে উঠল। অফিসার মাহিদ লাবনী জোহাকে যেহেতু আসতে বলেছে তার মানে আনহারির নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে। আমি কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম
“আন্টি একটু সময় দিন সবটা জেনে বলছি।”
ফোনটা দ্রূত কাটলাম। শরীর দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতি একদম অনুকূলে মনে হচ্ছে না৷ শরীরটা ভীষণ কাঁপছে। বল পাচ্ছি না একদম। মহিমা আমার হাতটা ধরে বলল
“চলো আগে থানায় যাওয়া যাক।”
আমি হাতটা চেপে ধরে তার সাথে রওনা দিলাম। গাড়িতে করে থানায় যেতে মিনেট ছয়ের মতো সময় লেগেছে। তবে এ ক্ষুদ্র সময়টা ও আমার কাছে অনেক বৃহৎ মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ৬ ঘন্টা পার করে ফেলেছি।
থানায় চৌকাঠ পার হয়ে আনহারির কাপড় চোপর দেখে আমার বুকটা মুচড়ে উঠল।
কপি করা নিষেধ