#শারমিন আঁচল নিপা
ননাস এসেই বলে উঠল
“সাবধান করতে এসেছি। এরপর এমন শুনলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে। ফাতেমার সাথে খারাপ ব্যবহার কেন করেছো? ফাতেমা এ বাড়ির সব কাজ করে। তাকে তুমি যা’তা বলেছো। ওর গায়ে হাত তুলার সাহস কে দিছে তোমারে? কী চাও তুমি? তোমার বেয়াদবি কী কমবে না? তোমাকে শেষ বার সাবধান করছি নিজেকে সামলাও।”
আপুর কথায় এবার একটু হেসে বললাম
“আমি তো ফাতেমার গায়ে হাত তুলেছি। আপনি সবকিছু জানলে খু’ন করে ফেলতেন। একটু চোখ কান খুলা রাখুন। নিজের স্বামীর সাথে অন্য মেয়ে দেখলে কেমন লাগে বুঝবেন। আর যদি জানতে পারেন একই সাথে ভাই আর স্বামীর দুজনেরেই চক্কর চলছে তখন আপনার মুখটা দেখতে কেমন হবে আমি তাই ভাবছি। আপনারা অনেক অপমান করেছেন, কষ্ট দিয়েছেন সহ্য করে নিয়েছি। আপনিও তো একটা মেয়ে। মেয়ে হয়ে কী আপনি মেয়ের যন্ত্রণা বুঝেন না? আপনার কী কষ্ট হয় না আমাকে এসব বলতে?”
আপুর মুখটা চুপসে গেল। বেশ কৌতুহল আর অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করল
“ফাতেমার সাথে কার কী চক্কর চলছে? সোজাসাপটা বলো।”
আমি হেসেই জবাব দিলাম
“দুদিন হলো না বাড়িতে এসেছি আমার চোখে পড়ে গেল আপনার পড়ল না? পড়বেই বা কী করে। অন্যের বাড়ির মেয়েকে কীভাবে অপমান করা যায় তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। দুলাভাইয়ের দিকে নজর রাখেন কিছুদিন। এরপর নিজেই টের পাবেন ফাতেমাকে কেন মেরেছি। এ বাড়িতে এসে কেবল নোংরামির সাক্ষী হচ্ছি। আল্লাহ কোন পাপের ফল হিসেবে এখানে পাঠিয়েছেন আল্লাহ ভালো জানেন।”
কথাগুলো বলেই সামনে থেকে সরে গেলাম। আপু আর পাল্টা জবাব দিল না। হয়তো তার টনক নড়েছে।।যন্ত্রণা আমাকে ঘায়েল করছে ভীষণ। এ জীবনটায় একটু শান্তি চেয়েছিল আর সেটা যেন আমাকে শেষ করে দিচ্ছে, কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
সবকিছুই মিলে আমার সংসার চলছে। পড়াশোনার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। হাতে পায়ে ধরেও আর পারিনি। পরিবারের সাপোর্ট থাকলে হয়তো পারতাম, তবে সেটা না থাকায় আর হয়নি। সবমিলিয়ে আমার জীবনটা কেটে যাচ্ছে কোনোরকম। মা বারবার খবর পাঠায় বাসায় চাল নেই, ডাল নেই আমি যেন কিছু পাঠাই। আমারও পাঠাতে ইচ্ছা করে তবে পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে সেটা আর পারি না। বড়ো ঘরে মেয়ে হয়তো মা এজন্যই বিয়ে দিয়েছিল যাতে করে তাদের অভাবটা ঘুচে যায়। তবে বাস্তবতা এদকম আলাদা।
দীপকের সাথে আমার বৈবাহিক সম্পর্ক এত ভালো না। এ একমাসে ভালো করে উঠতেও পারিনি। চেষ্টা করেছি তবে তার দিক থেকে কোনো চেষ্টা ছিল না। তাই কোনোরকম সংসার চলছে।
ব্যবসার কাজে দীপক গেছে ঢাকার বাইরে। আমি সকালে ঘুমাচ্ছিলাম। এই তো সকাল ৬ টা বাজবে। বাইরে থেকে চিৎকারের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙলো। ভাবলাম কি’না কি হলো। তাই দ্রূত বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে গিয়ে অবলোকন করলাম আপু ফাতেমাকে ধরে বেদরম পেটাচ্ছে। সকাল সকাল এত শান্তিময় দৃশ্য যেন আমাকে আরও বেশি প্রশান্ত করে তুলল। পাশেই মাথা নীচু করে দুলাভাই দাঁড়িয়ে আছে।
হাতেনাতে ধরেছে আপু আজকে। মেয়েদের নজর ভয়ংকর একবার পড়লে সত্য হাতেনাতে ধরা পড়বেই। আমার শ্বাশুড়ি এবার সুর পাল্টে ফেলল। নিজের মেয়ের জামাইকে বলে উঠল
“এত নীচে নামতে পারলে তুমি? তোমাকে আমি কত ভরসা করতাম। সেদিন তাহলে অনন্যা ঠিকেই বলেছিল। তোমার চরিত্রে সমস্যা আছে। এখনই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।
ফাতেমা তোরে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসছিলাম। বউরে দিয়া কাম করাইছি তোরে দিয়া করাই নাই। তারপরও তুই এমন করলি। মা/ গির বাচ্চা বের হ আমার চোখের সামনে থেকে।”
ফাতেমা, আপুর হাতে আরও কয়েকটা উত্তম মধ্যম খেল। তারপর আপু চুলের মুঠি ধরে বের করল। আমার কী যে শান্তি লাগতেছে বুঝাতে পারব না। এ দিনটার অপেক্ষায় আমি ছিলাম। দুলাভাই মায়ের পা ধরে ফেলল। তারপর আপুর পা ধরে বসে রইল। যতই হোক নিজের স্বামী। মেয়েরা এ জায়গায় হেরে যায়। শত কষ্ট দেওয়ার পরও মেয়েরা এখানেই গলে যায়। স্বামী নামক এক শব্দের কাছে মেয়েরা পরাজিত হয়ে যায়। সকল অভিমান যেন এ সম্পর্কটা শেষ করে দেয়। আপাও গলে গেল। আর দুলাভাইকে কতগুলো কথা শুনিয়ে মাফ করে দিল।
চারদিকে হঠাৎ আসা ঝড়টা হঠাৎ করেই থেমে গেল। সবাই সবার রুমে চলে গেল। আমিও চলে আসলাম আমার রুমে। এক বিন্দু শান্তি যেন আমাকে ঘিরে ধরল। বাইরে বষ্টি পড়ছে। এ বৃষ্টিটা যেন আমার প্রশান্তির কারণ আজকে।
তবে প্রশান্তির সময় আর বেশিক্ষণ থাকে না। ভেতরের যন্ত্রণা যে কী ভয়াবহ কেবল সেটা আমিই জানি। আমার সাথে সেদিন এমনটা না হলেও পারত।
এরপর থেমে গেলাম। পরের পৃষ্ঠা গুলো ছেড়া। বুঝাই যাচ্ছে কেউ ইচ্ছা করে ছিড়ে রেখেছে। বাকি পৃষ্ঠাগুলো পড়ার জন্য আমার অস্থিরতা বেড়েই যাচ্ছে। আমি তন্ন তন্ন করে লিখা খুঁজতে লাগলাম। তবে পেলাম না। এরপর আপার সাথে কী হলো আমার জানার অনেক ইচ্ছা জাগল। কিন্তু কোনোভাবেই সেটা আর পূরণ হলো না। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি জানতে চাই আপার জীবনের প্রতিটা অংশ। আপার হয়ে আমি প্রতিশোধ নিতে চাই। কিন্তু পৃষ্ঠা গুলো কোথায় গেল। কোথায় গেল সে শব্দগুলো যেগুলো আপা লিখেছে।
আমি অঝোরে কাঁদছি। কান্না যেন আমার থামছেই না। বাইরে তাকিয়ে দেখলাম সকাল হয়ে গেছে। আমি কাঁদতে কাঁদতেই রাস্তায় বের হলাম। হাঁটতে লাগলাম অজানা গন্তব্যে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি হেরে গেলাম। আপুর সাথে তারপর কী হয়েছিল। এসব ভেবেই সামনে তাকিয়ে চমকে গেলাম। স্বয়ং আপু আমার সামনে দাঁড়িয়ে। একদম হুবুহু আপু। আপুকে আমি জাম গাছে ঝুলতে দেখেছি তাহলে এটা কে? আমার বুক ধরফর করছে। স্বপ্ন দেখছি না তো? পরক্ষণেই বুঝতে পারলাম এটা আমার ভ্রম না সত্যি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন
“আচ্ছা আনহারি ভবনটা কোথায় বলতে পারেন?”
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম তার কথায়। আনহারি ভবন এ এলাকার সবচেয়ে বড়ো ভবন। অনেক বড়ো বিজন্যাসম্যানের বাড়ি এটা। আমি ঢুক গিলে কেবল সামনের দিকে ইশারা করলাম। তিনি হালকা হেসে ধন্যবাদ দিয়ে গাড়িতে ঢুকে গেলেন। গাড়িটা আমার সামনে দিয়েই আনহারি ভবনের দিকে এগুচ্ছে। আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। গাড়ির পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলাম। তবে নাগাল পেলাম না। আনহারি ভবনের নিরপত্তা অনেক কঠোর চায়লেও সেখানে প্রবেশ আমি করতে পারব না।
আমি নিজেকে সামলে বাসায় আসলাম। মাকে আল্লাহর কসম কেটে বলতে বললাম বড়ো আপার সাথে আপার কোনো জমজ হয়েছে কি’না। মা অস্বীকার করল। মাকে বারবার জিজ্ঞেস করার পরও মা না করল। মাকে আমি আপাকে দেখার কথা বললাম। মা আমাকে বলে উঠল
“ফিয়না অনন্যা আমার মেয়ে। যত রাগ আর কষ্ট দেখাই না কেন দিনশেষে সে আমার মেয়ে। আমার মেয়ের জমজ হলে আমি জানতাম না? গ্রামের কেউ জানত না? আমাদের তো ডাক্তারের যুগ ছিল না এখনের মতো। কয়টা বাচ্চা হবে সেটা বুঝাও যেত না। দায়রা নিজের ঘরে এসে বাচ্চা প্রসব করাইয়া যেত। এমন হলে আমি বুঝতাম না? অনন্যা আমার প্রথম সন্তান ছিল। আবেগ তো ছিলই আমার৷ ওকে তো আমি কম ভালোবাসিনি। প্রথম সন্তান কী কেউ দিয়ে দেয়? ফিয়না মায়ের কষ্ট বুঝে না মানুষ। আমাকে তুই পাষাণ বলিস, নির্দয় বলিস। মনে করিস অনন্যার জন্য আমার পুড়ে না। কিন্তু বুঝিস না কতটা পুড়ে। আমার যন্ত্রণা তোর বুঝায় ক্ষমতা নাই। বিয়ের পর আমি চাইতাম অন্যন্যা আমাদের সাহায্য করুক। কী করব বল অভাবের সংসার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। একটু ভালো তো থাকতে চাইবই। অনন্যাকে বিয়ে দিয়েছিলাম ভেবেছিলাম সুখে থাকবে। তবে নিজের মেয়েকো তো চিনতাম। ঠোঁটকাটা স্বভাবের। স্বামীর বাড়ি এসব চলে না। তাই শাসন করতাম যাতে মানিয়ে নেয়। আমি তো এখন পাষাণ হবই। আর এখন তুই বলছিস আমার অনন্যার সাথে আমার আরও মেয়ে হয়ছে কিনা? আমি তাকে দত্তক দিছি কিনা৷ আরে এত বড়ো ভবনে যাচ্ছে মেয়েটা বললি। এত বড়ো ভবনের কারও সাথে আমাদের মতো ফকিরের কী সম্পর্ক থাকবে। আর এত বড়ো ঘরে মেয়ে দিলে তো টাকা নিয়ে দিতাম। আমাদের সংসারের এ হাল হত না। সামনে থেকে সর তুই। সারাদিন এ ঘুরেই থাকিস। তাই এমনটা দেখেছিস।
মায়ের কথা বুঝতে পারলাম, মা মিথ্যা বলছে না। অনন্যার কোনো জমজ নেই। এদিকে অনন্যা মৃত্যুবরণ করেছে। তাহলে কে এই? এগুলো আমাকে ভীষণ প্যারা দিচ্ছে।
এর মধ্যেই দরজার খটখট আওয়াজ পেলাম। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে চমকে উঠলাম। কী ভাবছেন ঐ মেয়েটা এসেছে? না ঐ মেয়েটা আসেনি৷ তবে…
কপি করা নিষেধ
চলবে?
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার