অরোনী, তোমার জন্য~১৫
লিখা- Sidratul Muntaz
দীপ্তির সারারাত ভালো ঘুম হয়নি। সকালেও দ্রুত ঘুম ভেঙে গেছে। ঘরের বাহিরে বের হতেও লজ্জা লাগছে এখন। কিছুক্ষণ আগে নিচে গিয়েছিল। তখন আড়াল থেকে শুনেছে ডাইনিংরুমে ননদিরা কিভাবে ব্রেকফাস্টে বসে তাকে নিয়ে হাসি-মশকরা করছে! তানজিমা বলছিল দীপ্তি নাকি প্রতিদিন সকাল-সকাল উঠে বাপের বাড়ির মেহমানদের জন্য নাস্তা বানাতো। কিন্তু আজ সে রুম থেকেই বের হচ্ছে না। তখন নিলিমা হাসতে হাসতে বলেছে, আর কখনোই দীপ্তির পরিবারের মানুষ এ বাড়িতে ঢোকার সাহস পাবে না।
সেজন্যই নাকি দীপ্তি দরজা আটকে শোক পালন করছে। এসব শুনে দীপ্তি আর ওদের সামনে যায়নি। নীরবে নিজের রুমে ফিরে এসেছে। ইশ, কি অপমান! নিজের চেয়ে বয়সে ছোট মেয়েগুলোর থেকে এমন অপমান সহ্য করা যায় না। দীপ্তির মন চাইছে লুকিয়ে থাকতে। সে কত চেষ্টা করেছিল রুবায়েতের দোষটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। কিন্তু লাভ হলো না।
রুবায়েত বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছিল। বাড়ির সবার সামনে এমনভাবে কথা বলেছে যে কারো আর বুঝতে বাকি নেই। গতকাল তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে এমনিতেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে কত জঘন্য অপরাধী। দীপ্তির আর কি করার? মান-সম্মান সব গেছে। এই বাড়িতে থাকার কোনো মানে হয় না। আজ রাহাত বাড়ি ফিরলে সে বড়সড় একটা ঝগড়া লাগাবেই। রাহাতও চালাকি করে আজ দ্রুত অফিসে চলে গেছে। দীপ্তির ফোন ধরছে না। দীপ্তি রাহাতের কাছেও খুব ছোট হয়ে গেল।
তানজিমা নিলিমার হাতটা ধরে হাঁটছে। তাদের গন্তব্য উর্মিদের ঘর। ছোটভাইয়ার এতোক্ষণে অফিসে চলে যাওয়ার কথা। উর্মিকে ছোটভাবীর কাছে পাঠাতে হবে। আগে তানজু,নিলি আর রুমা তিনজন সবসময় একসাথে থাকতো। রুবায়েতের ওই ঘটনার পর থেকে রুমার মন প্রচন্ড খারাপ। সে এখন দীপ্তির মতোই দরজা আটকে ঘরে বসে থাকছে। বেচারীর এবারও বিয়েটা ভেঙে গেল। মেয়েটার বিয়ের ভাগ্য এতো খারাপ! যার সাথেই বিয়ে ঠিক হয় তারই কোনো না কোনো সমস্যা বের হয়। উর্মিদের ঘরের কাছাকাছি এসেই পা থমকে গেল দু’জনের।
উর্মির মা-বাবা মানে ছোট চাচা আর ছোট চাচীর মধ্যে ঝামেলা লেগেছে। তারা একে-অপরের সাথে তর্কে ব্যস্ত। তাদের এই তর্কাতর্কির মূল বিষয় গতকালকের দূর্ঘটনা।
ছোট চাচা বলছেন,” তোমার সমস্যা কি?”
আশা জবাব দিলেন,” আমার সমস্যা তোমাকে নিয়ে। আগ বাড়িয়ে রুবায়েতকে অপমান করতে গেলে কেন? বাড়ির সবাই তো ছিল সেখানে। তোমার কথা বলার কি প্রয়োজন ছিল?”
” কথা বলেছি তো এখন কি হয়েছে? জাত চলে গেছে? এতোবড় একটা ঘটনা ঘটলো বাড়ির বউয়ের সাথে। আর আমি প্রতিবাদ করবো না?”
” তোমার প্রতিবাদের জন্যই তো আমার সাথে দীপ্তির সম্পর্কটা নষ্ট হবে এখন। আর বাড়ির বউ কাকে বলছো? অরোনীর মধ্যে কি বাড়ির বউয়ের কোনো বৈশিষ্ট্য আছে? না কোনো কাজ করে আর না বাড়ির বউয়ের মতো চলা-ফেরা করে। তাকে তো দেখলে মনে হয় এই বাড়ির মেয়ে বুঝি সে। সারাক্ষণ পটের বিবি সেজে দুইতলায় বসে থাকবে। চোখে কাজল, মুখে স্নো মেখে সাজগোজ করবে। আর মাথাভরা একগাদা চুল ছেড়ে রেখে নায়িকাদের মতো হাঁটবে। রুবায়েতের আর কি দোষ? যেকোনো ছেলে এমন অবস্থা দেখলে পাগল হবে। জীবনে কখনও মাথায় কাপড় দিতে দেখেছো ওকে? যা হয়েছে সব ওর দোষেই হয়েছে। এভাবে চলা-ফেরা করলে তো এমন হবেই।”
স্ত্রীর কথা শুনে ছোট চাচার মেজাজ গরম হয়ে গেল।
” কি আবোলতাবোল বলছো? মাথা ঠিকাছে? তুমি বলতে চাইছো এই দূর্ঘটনার জন্য অরোনীই দায়ী? রুবায়েতের দোষ নেই?”
” অবশ্যই তাই। ওই মেয়েই তো রূপ দেখিয়ে রুবায়েতের মতো সভ্য ছেলের মাথাটা খেয়েছে।”
” রুবায়েত সভ্য ছেলে!” ছোট চাচা বিষম খেলেন। রুবায়েত সভ্য হলে অসভ্য জিনিসটা কি? আশা একনাগাড়ে বলে যাচ্ছেন,” কত সুন্দর করে আমাকে ছোটচাচী বলে ডাকতো। দীপ্তি বলেছিল রুমার সাথে এই ছেলের বিয়ে হলে সে নাকি চাচী শাশুড়ীদের ডায়মন্ড নেকলেস উপহার দিতো। আহারে! কি সুন্দর চিন্তা!”
ছোটচাচা এতোক্ষণে বুঝতে পারলেন। ডায়মন্ড নেকলেসের জন্যই আফসোসে মরে যাচ্ছেন উর্মির মা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” চিন্তা করো না। আমি তোমাকে ডায়মন্ডের নেকলেস কিনে দিবো। তাও এসব বলা বন্ধ করো। শুনতে বিশ্রী লাগছে যে আমার স্ত্রী হয়ে তুমি একটা বদমাইশের পক্ষ নিয়ে কথা বলছো।”
আশা ধমক দিয়ে বললেন,” খবরদার মিথ্যা স্বপ্ন দেখাবে না। ডায়মন্ড নেকলেসের যেই দাম তোমার তিনমাসের বেতন একত্র করলেও তা উঠবে না। ইশ, বিয়েটা যে কেন ভাঙলো! রাফাতও যথেষ্ট বাড়াবাড়ি করেছে। ছেলেটার গায়ে হাত তোলার কি প্রয়োজন ছিল? বাড়িতে এতো মানুষ। তাও রাফাতকে কেউ কিছু বলল না কেন?”
ছোট চাচা হেসে বললেন,” ঠিকই তো আছে। ওর মেজাজ খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। দূর্ঘটনা ঘটেছে ওর বউয়ের সাথে। যদি তোমার সাথে এই দূর্ঘটনা ঘটতো তাহলে কি আমিও ছেড়ে দিতাম নাকি?”
আশা এই কথায় অপ্রস্তুত হয়ে মুখে হাত চেপে ধরলেন। কি অসম্ভব কথা! রুবায়েতকে তিনি নিজের ছেলের মতো দেখেন। আর রুবায়েত কি-না তার সাথে.. ছিছি!
” তোমার আক্কেল জ্ঞান কোনোদিন হবে না। কি বলতে কি বলো! আমার সাথে এসব কেন হবে? আমি কি অরোনীর মতো চুল ছেড়ে, চোখে কাজল লাগিয়ে ঘুরি নাকি?”
ছোট চাচা টিপ্পনী কেটে বললেন,
” একবার চেষ্টা করে দেখো। তোমাকে অরোনীর চেয়েও সুন্দর লাগবে। তখন আর রুমার বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। এমনিই মানুষ ডায়মন্ডের নেকলেস নিয়ে হাজির হবে।”
” নাউজুবিল্লাহ!”
তানজু আর নিলি এসব শুনে চাপা শব্দে হাসছিল। হঠাৎ উর্মি বের হয়েই ওদের দেখে ফেলল।
” এই তোমরা আমাদের ঘরে আড়ি পাতছো কেন?”
উর্মির কথায় ছোট চাচা আর চাচীর তর্ক থেমে গেল। তারাও মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি। নিলি আমতা-অমতা করে বলল,” আড়ি পাতবো কেন? তোকে নিতে এসেছি৷ মনে নেই কাল কি বলেছিলাম? ছোটভাবীর ঘরে যেতে হবে।”
উর্মি বলল,” আমি এখন ছোটভাবীর ঘরেই যাচ্ছি। চলো একসাথে যাই।”
তানজু আর নিলি সমস্বরে বলল,” চল।”
তিনজন খুব উৎসাহ নিয়ে দুইতলায় উঠেছে। দীপ্তির ঘরের দরজা আটকানো। তারা দক্ষিণ পাশে অরোনীর ঘরের সামনে এলো এবং যথারীতি অবাক হলো। কারণ ঘর তালা দেওয়া। আশ্চর্য! ছোটভাইয়া আর ভাবী কেউই কি বাসায় নেই?
রাফাত গতরাতেই ভেবেছিল অরোনীকে কিছুদিন বাপের বাড়ি নিয়ে রেখে আসবে। কিন্তু বাড়ির মানুষদের এই কথা জানালে কেউ না কেউ বাধা দিতোই। তাই রাফাত বুদ্ধি করে কাউকে কিছু না বলেই সকাল সকাল বের হয়ে গেছে অরোনীকে নিয়ে। মাত্র দুইঘণ্টার রাস্তা। ব্যাক্তিগত গাড়ি দিয়ে যেতে বেশি সময় লাগল না। অরোনীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই রাফাতকে অফিসে যেতে হবে। অরোনী মায়ের সামনেই রাফাতের শার্ট মুষ্টিতে ধরে রেখেছে। কিছুতেই রাফাতকে যেতে দিবে না সে। রাফাত ইতস্তত করে বলল,” দেখুন তো আন্টি, আমার কাজ আছে। অফিসে আজ যেতেই হবে। গত পরশুই ছুটি নিয়েছিলাম। কালকেও হাফ ডে নিয়েছি। এতো ঘন ঘন কি ছুটি নেওয়া যায়?”
শারমিন অরোনীকে ধমক দিয়ে বললেন,” সমস্যা কি তোর? একটা চড় মারবো। ছাড় ওকে।”
শারমিন জবরদস্তি অরোনীর হাত ছাড়িয়ে দিলেন। অরোনীর চেহারাটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। রাফাতের এতো মায়া লাগল! ইচ্ছে করল সব ছেড়ে-ছুড়ে সারাদিন অরোনীর সামনে বসে থাকতে। কিন্তু চাইলেই সব সম্ভব হয় না। কাজও করতে হবে। শারমিন বললেন,” তুমি নাস্তা করেছো বাবা?”
” জ্বী আন্টি। আমরা বের হয়ে দু’জনই রেস্টরন্টে নাস্তা করেছিলাম।”
” আচ্ছা, যদি সময় পাও তাহলে রাতে এসো।”
” আসবো আন্টি।”
তারপর রাফাত অরোনীর দিকে চেয়ে কোমল গলায় বলল,” বাই। চলে যাচ্ছি আমি।”
অরোনী তাকালোই না। অভিমানে তার চেহারা শক্ত। শারমিন রেগে বললেন,” এই মেয়ে একটা পাগল! মানুষ কি কাজ-কর্ম না করে সারাদিন তোকে নিয়ে বসে থাকবে? এতো সকালেও যে ছেলেটা এতোদূর এসেছে তোকে নিয়ে এটাই তো অনেক। এখন আবার উল্টো পথ ঘুরে অফিসে যাবে। কত কষ্ট! আর সে বসে আছে ঢং নিয়ে।”
অরোনী রাগ দেখিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে রুমে চলে গেল। শারমিন অবাক হয়ে বললেন,” মেয়েটার কি হয়েছে? কথা বলে না কেন?”
রাফাত নরম কণ্ঠে বলল,” ওর মনটা খুব খারাপ আন্টি। এজন্যই আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি। ওকে ধমক-টমক দিবেন না। একটু ভালো-মতো কথা বলবেন। ওর সাথে গল্প করবেন।”
শারমিন চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,” কি হয়েছে বলো তো বাবা? কেন মনখারাপ মেয়েটার?”
রাফাত মাথা নিচু করে বলল,” অনেক কাহিনী। এখন বলার সময় নেই। আপনি অরোনীর সাথে একটু কথা বলার চেষ্টা করেন। আপনি তো মা। হয়তো আমাদের কাছে ও যেটা বলতে পারছে না সেটা আপনার কাছে বলবে। আর না বললেও সমস্যা নেই। ওর মনটা যেন ভালো হয় তাই আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। এখানে নিপা ভাবী আছে, অথৈ আছে, ওদের সাথে মিলে-মিশে থাকলে অরোনীর ভালো লাগবে।”
শারমিনের দুশ্চিন্তা কমল না। তবুও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” ঠিকাছে বাবা। তুমি সাবধানে অফিসে যেও।”
” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
রাফাত চলে যেতেই শারমিন দরজা বন্ধ করে অরোনীর ঘরে গেলেন। না জানি কি হয়েছে মেয়েটার!
চলবে……..